Published : 10 Nov 2020, 02:05 AM
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন বিশ্বগণমাধ্যমের মনোযোগ টেনে নেওয়ায় সাম্প্রতিক একটি ঘটনা অনেকটা আড়ালেই পড়ে গেছে, যার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নামও জড়িয়ে আছে। বলতে গেলে ঘটনাটির নেতৃত্বই দিচ্ছে দেশটি।
কথা হচ্ছে অক্টোবরে টোকিওতে হয়ে যাওয়া চারজাতি নিরাপত্তা সংলাপ, যে উদ্যোগে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গী হয়েছে জাপান, ভারত ও অস্ট্রেলিয়া। বর্তমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি আর ভূ-রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে চার দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের এই সংলাপের গুরুত্ব যথেষ্ট।
গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়ে চার দেশ একমত হলেও বৈঠকের পর কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেওয়া হয়নি। তবে চারপ্রান্তের বন্ধুপ্রতীম দেশগুলোর এ সংলাপ যে বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিক ছিল, তা বলাই বাহুল্য।
২০০৭ জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের দেওয়া চারজাতি নিরাপত্তা সংলাপ (কোয়াড্রিলেটারাল সিকিউরিটি ডায়ালগ বা কিউএসডি) ধারণাটি দীর্ঘ এক যুগের বেশি সময়েও কাঠামোবদ্ধ রূপ না পেলেও সম্প্রতি এ তৎপরতা নতুন গতি পেয়েছে। এর কারণ হচ্ছে আগ্রাসী চীন। মূলত চীনকে ঠেকাতেই ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ভারসাম্যপূর্ণ একটা পরিস্থিতি তৈরি করার লক্ষ্যেই টোকিও সংলাপ।
যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল আর 'চারজাতি সংলাপ'কে শক্তিশালীকরণ- দুটো বিষয় সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। মূলত চীনা আধিপত্যের বিপরীতে ভারসাম্যপূর্ণ 'মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক' ধারণাকেই প্রতিনিধিত্ব করছে এটি।
টোকিও সংলাপের পর মার্কিন উপ-পরাষ্ট্রমন্ত্রী স্টিফেন বিগানের বাংলাদেশ সফরেও ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা শোনা গেলেও পরে আর বিষয়টি এগোয়নি।
ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান অনুমিতই। কারণ বাংলাদেশ এখনও সবার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নীতিতে অটুট। তাছাড়া চার দেশই বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী, এখানে রয়েছে তাদের মোটা বিনিয়োগও। আর প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে তো সম্পর্ক বহুদিনের পুরনো, পরীক্ষিত। অন্যদিকে চীনেরও রয়েছে বাংলাদেশে মোটা বিনিয়োগ। সবকটি দেশের সঙ্গে বাণিজ্যক সম্পর্কও বেশ ভালো।
তবে গত কয়েক বছর ধরেই এ অঞ্চলে চীনের আগ্রাসী উত্থান, কৌশলগত অবস্থান এবং দক্ষিণ চীন সাগরে দেশটির আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা খর্ব করার চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র। তারই অংশ হিসেবে ২০১৮ সালে চীনের সঙ্গে সম্পর্কে অস্থিরতা শুরু হলে যুক্তরাষ্ট্র বন্ধুপ্রতীম জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের সঙ্গে মিলে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ধরে রাখার চেষ্টায় মনোযোগী হয়।
নিরাপত্তা ইস্যুতে জোটবদ্ধ হওয়ার মূল উদ্দশ্য যে 'চীন ঠেকাও', সেটি আরও স্পষ্ট হয় কিছুদিন আগে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও-র একটি সাক্ষাৎকারে।
জাপানের নিক্কেইকে দেওয়া ওই সাক্ষাৎকারে পম্পেও বলেছেন, জাপান, ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে সহযোগিতাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র এ সম্পর্কের ধারা নিয়ে যেতে চায় অন্যান্য প্রতিবেশী দেশগুলোতেও।
এই তৎপরতার তিনটি উদ্দেশ্যের কথাও বলেছেন পম্পেও। সেগুলো হল- ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে একটি বহুপক্ষীয় নিরাপত্তা কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা, এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে অভিন্ন মূল্যবোধ এবং কৌশলগত বিষয়ে ঐক্যকে শক্তিশালী করা এবং চীনের বিরুদ্ধে 'যুক্ত ফ্রন্ট' গড়ে তোলা।
ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে জাপান এবং অস্ট্রেলিয়া সবসময়ই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক মিত্র। চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে জাপান ওপরে-ওপরে বাস্তববাদী ভূমিকায় থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক বেশ উষ্ণ, বিশেষ করে সামরিক ও প্রতিরক্ষা খাতে।
অন্যদিকে ভারত এতদিন আঞ্চলিক কোনো নিরাপত্তা জোটের ব্যাপারে আগ্রহ না দেখালও সম্প্রতি চীনের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধসহ বিভিন্ন বিষয় যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের দিকে এগোতে শুরু করেছে বলা যায়।
গত সেপ্টেম্বরে ইয়োশিহিদে সুগা জাপানের নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই পম্পেও নতুন সরকারকে পূর্বসূরী আবের আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক নীতি এগিয়ে নিতে উৎসাহ দেওয়ার পাশাপাশি দুই দেশের সামরিক সহযোগিতা আরও শক্তিশালী করার কথা বলেন।
চীনের উত্থান ঠেকাতে টোকিও বৈঠকে চার দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা একটি মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক ধারণাকে এগিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি সমুদ্র নিরাপত্তায় নিজেদের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানো এবং উন্নতঅবকাঠামো গড়ে তোলার সিদ্ধান্তও নিয়েছেন।
সব মিলিয়ে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের আধিপত্য খর্ব করতে অদূর ভবিষ্যতে যে চারজাতি নিরাপত্তা সংলাপ আরও বেশি সক্রিয় হবে সে আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
দেশগুলো নিজেদের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও জোরদারও করতে পারে। এখানেও স্বস্তিতে নেই।
চীন থেকে বিদেশি নামিদামি প্রতিষ্ঠানের পাততাড়ি গোটানোর তালিকা দিন দিন বড় হচ্ছে; বিপাকে চীনা শাসকদল।
গতবছর গুয়ানডংয়ে স্যামসাং মোবাইল ফোনের কারখানা বন্ধ হওয়ার পর সেখানকার ৬০ শতাংশ ছোট ছোট কারখানা, রেস্তোরাঁও বন্ধ হয়ে গেছে। ওই স্যামসাংয়ের কারখানা বন্ধের ঢেউ লেগেছে পাশের হুইঝুর সহযোগী অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও।
গত অগাস্টে হুইঝু মিউনিসিপ্যাল ব্যুরো অব কমার্সের এক গোপন প্রতিবেদন বলছে, কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে অর্থনীতিতর যে নিম্নগতি চলছে, তা দ্বিগুণ করে তুলেছে স্যামসাংয়ের মতো কোরিয়ান কোম্পানিগুলোর বিদায়ে।
জাপানের সনি, রিকো, স্পোর্টিস ব্র্যান্ড অ্যাসিস, শার্প করপোরেশনসহ আরও অনেক কোম্পানি চীন থেকে মুখ ফিরিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর দিকে ঝুঁকছে।
গতবছর চীনা পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপের পর থেকেই দেশটি থেকে বিদেশি কোম্পানিগুলোর বিদায়ের তোড়জোড় শুরু হয়।
সম্প্রতি নির্বাচনী প্রচারে ডনাল্ড ট্রাম্প শুল্কারোপ অব্যাহত রেখে ট্রাম্প চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার কথা বললেও এরই মধ্যে ভোটে জিতে হোয়াইট হাউসে যাওয়ার অপেক্ষায় থাকা জো বাইডেন মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়নের আভাস দিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, চীনের উপর একতরফা শুল্কারোপ না করলেও আন্তর্জাতিক জোটের মাধ্যমে চীনকে এমনভাবে 'জবাবদিহিতায়' বাধ্য করবেন, যেন চীন তা 'এড়িয়ে যেতে না পারে'।
তবে সার্বিকভাবে চীনের বিষয়ে বাইডেন প্রশাসনের নীতিতে খুব একটা পরিবর্তন হবে না বলে ধরে নেওয়া যায়। কারণ বাইডেন নিজেও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের একজন কট্ট সমালোচক।।
যুক্তরাষ্ট্রের নয়া প্রেসিডেন্ট চারজাতি নিরাপত্তা সংলাপের মাধ্যমে চীনের রাশ কতটা টেনে রাখতে পারবেন, সেটাই এখন দেখার বিষয়।