Published : 19 Jul 2020, 12:22 PM
ব্রিটিশ সমাজ ব্যবস্থার প্রথাগত সংলাপকে চ্যালেঞ্জ জানাতে ষাটের দশকে 'অ্যাংরি ইয়াংম্যান' শিরোনামে এক শ্রেণির তরুণ-তরুণীদের উন্মেষ ঘটে। দার্শনিক, চিত্রপরিচালক, তাত্ত্বিকসহ বেশ কিছু পেশার মানুষ একাট্টা হয়ে ঐ সমাজের বুর্জোয়া এবং ঊর্ধ্বতন শ্রেণির চিরাচরিত মনোভাবের বিপরীতে নতুন নতুন চিন্তা উপস্থাপন করেন। ফলাফল তারা ঐ সময়টাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর সাথে সাথে নির্মাণ করতে পেরেছিলেন ভবিষ্যৎ মুক্তবুদ্ধির পথ।
বাংলাদেশ প্রতীক্ষায় আছে এমন কিছু 'অ্যাংরি ইয়াংম্যান' এর। যারা নিজেদের প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থা এবং চাকুরি সর্বস্ব উদ্যোক্তাহীন আচরণ থেকে সরিয়ে নির্মাণ করবেন বর্তমানের আলোকে ভবিষ্যৎ মুক্তবুদ্ধির পথ। কারণ দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এখন এমন এক টানেলগামী যে তাতে শুধু সার্টিফিকেটসর্বস্ব জেনারেশন তৈরি হচ্ছে। 'অ্যাংরি ইয়াংম্যান'গণের আগমনে এটা স্পষ্ট হবার সুযোগ ছিল যে এইসব সার্টিফিকেট-বিশ্ববিদ্যালয় নয় বরং এখানে প্রয়োজন পারিবারিক এবং কর্মমুখী-কারিগরি শিক্ষা।
বিগত কয়েক বছরে জমতে থাকা উচ্চ শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রায় ৩৪%-ই মাস্টার্স পাস করা যুবক-যুবতী। কাজেই এই বিপুল সংখ্যক জনবল শুধু সরকারি-বেসরকারি চাকুরির প্রতি সীমাবদ্ধ না রেখে পড়াশুনার সিলেবাসটাই যদি কর্মমুখী করা যায় অর্থাৎ পড়াশুনা করতে করতেই বা শেষ করে নিজেরাই একক কিংবা সমবায় ভিত্তিতে ছোট ছোট ইন্ডাস্ট্রি বা কারখানার উদ্যোক্তা হওয়া। তবে এক্ষেত্রে রাষ্ট্র কর্তৃক ক্ষুদ্র লোন প্রক্রিয়া আরও সহজ করা জরুরি।
যদিও এ বিষয়ে আরেকটি বাস্তবতা সামনে আসবে তা হল এখানাকার মার্কেট ছোট। তবে একে ভিন্নভাবেও ভাববারও সুযোগ আছে। যেমন এই ছোট ছোট উদ্যোক্তাদের উৎপাদনমুখী করা গেলে একদিকে যেমন সাপ্লাই প্রতিযোগিতায় পণ্যের দাম ক্রেতাদের হাতের নাগালে আসবে, অন্যদিকে উদ্যোক্তা তৈরির মাধ্যমে বেকারত্বের চাকরিমুখী লাইন কমে আসবে। পাশাপাশি বিদেশি পণ্য আমদানির হিড়িকও কমে আসবে।
তবে এই বেকারত্বের আরেকটা বিশেষ দিকও আছে। এখানে স্বল্প শিক্ষিতদের চেয়ে উচ্চ শিক্ষিতের হারই বেশি। কারণ স্বল্প শিক্ষিত অংশ পড়াশুনার একটা ছোট গণ্ডি শেষ করেই নিজেদের কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত করেন। অন্যদিকে উচ্চ শিক্ষিতের অংশ নিজেদের কর্মসংস্থান মানেই 'সরকারি, বেসরকারি এবং আধা সরকারি কিছু জায়গায় শুধুই চাকুরি মনে করেন। কিন্তু এসবের বাইরেও যে ছোট ছোট উদ্যোক্তা হওয়া যায় সেটা ভাবনায় আনেন না। কিন্তু এই এরাই যদি এসব উদ্যোক্তা বিপ্লবে অংশ নেন তবে বেকারত্বের পাশাপাশি সামাজিক আচরণবোধও বদলে যেত।
আর এই না হওয়া বদল সংকটের দায় রাষ্ট্র, সমাজ এবং পরিবারকে নিতে হবে। দেখা যায় হালের বিসিএস, ব্যাংকসহ বিভিন্ন সরকারি ও কিছু বেসরকারি চাকুরিতে এত এত প্রণোদনা এবং মুনাফার হাতছানি যে তরুণ-তরুণীরাও শুধু ঐ অংশটুকুতেই থাকতে চান। অথচ দেশের ফিল্ম মেকিং, অ্যানিমেশন মেকিং, খেলার জগত (ক্রিকেট, ফুটবল, ভলিবল, দাবা, গলফ, ব্যাডমিন্টন, সুইমিং ইত্যাদি), আইডিয়া মেকিং এসবেও যে পৃথিবীব্যাপী নেতৃত্ব দেয়া, প্রতিনিধিত্ব করা যায়, সাথে কর্মসংস্থানের বাজারও অর্জন করা যায় সেটা বহুলাংশের কাছেই অজানা।
অন্যদিকে বৈশ্বিক বাস্তবতায় 'ওয়ার্ল্ড ইকোনমি'র অন্যতম প্রতিনিধি জাপান আগামী কয়েক বছরের ব্যবধানে কর্মক্ষম মানুষ হারিয়ে ফেলবে। কারণ তাদের অধিকাংশ কর্মক্ষমই মানুষই প্রবীণ হবার পথে। কাজেই ওদের মার্কেটকে টার্গেট করে জনশক্তিকে প্রশিক্ষিত করে তুললে আগামীতে বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে জনশক্তি রপ্তানি করতে পারবে বাংলাদেশ। এইসব অর্থনৈতিক ব্যপ্তি চিন্তার পাশাপাশি পারিবারিক শিক্ষার প্রতিও বিশেষ জোর আরোপ জরুরি। যেখানে আচরণগত এবং সহনশীলতার শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ চর্চা করা হবে।
কারণ এই রাষ্ট্রের এখন আঞ্চলিকতা এবং সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে পথচলা জরুরি। শিক্ষক রাজনীতির নামে বিভাগগুলোতে যে পারিবারিক ঝাণ্ডা জেগেছে সেটাকে বন্ধ জরুরি। পদের লোভে দায়িত্ব ভুলে অন্ধত্ব ছেড়ে বিশ্ব দেখা জরুরি। এসবই কেবল পারে অর্থনৈতিক শক্তি কিংবা কর্মসংস্থানের পাশাপাশি বিশ্ব নেতৃত্বে বাংলাদেশকে নিয়ে আসতে নইলে এদেশের চলচ্চিত্রের বাজার যেমন চোখের সামনে লুট হয়ে যাচ্ছে তেমনি সকল ক্ষেত্র লুট হয়ে যাবে আর আমরা চলে যাব জাদুঘরে। তবে এসবে প্রতিরোধ কিংবা জয়ে আজও পথ খোলা আছে।
কখনও কখনও কোথা থেকে শুরু করা যায় সেই পথ পাওয়া মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। সেক্ষেত্রে এই বৈশ্বিক করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মোতাবেক বিশ্ব বদলের অংশ হিসেবে এদেশও এরকম 'অ্যাংরি ইয়াংম্যান'দের প্রত্যাশা করে। যারা সময় এবং প্রথাকে চ্যালেঞ্জ করে ধ্বংস্তূপের মাঝেও জীবনের জয়গান গাইতে পারেন এবং নিজেদের ফরমায়েশ নির্ভর নয় বরং উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করাতে পারেন। আর এমন প্রেম জাগ্রত করাতে পারলেই এই সমাজ হবে সহনশীলতার এবং এই প্রজন্ম হবে বিশ্বমানের।