Published : 26 Jun 2020, 05:03 PM
বেঁচে থাকলে আজ তিনি সাতাশি বছরে পা দিতেন। মাত্র পাঁচদিন আগে তার দেহাবসান ঘটেছে। কিন্তু যে কাজ, সংগ্রামের যে আদর্শ তিনি আমাদের জন্য রেখে গেছেন, তা আরও হাজার বছর আমাদের পথ দেখাবে। সংকটে সংগ্রামে আমাদের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে তার জীবন।
কামাল লোহানী। ভাষা সংগ্রামী, মুক্তিযোদ্ধা, নৃত্যশিল্পী, সাংবাদিক এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল প্রতিটি আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা সৈনিক। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি জনগণের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করেছেন। নেতৃত্ব দিয়েছেন ছায়ানট, ক্রান্তি ও উদীচীর মতো অনেক সাংস্কৃতিক সংগঠনকে। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংবাদ বিভাগের দায়িত্ব পালন করেছেন। পেশাগত জীবনে লড়াই করেছেন সাংবাদিকদের অধিকার আদায়ের জন্য।
দুই
বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের অধিকারী কামাল লোহানী জন্মগ্রহণ করেন অবিভক্ত ভারতবর্ষে ১৯৩৪ সালের ২৬ জুন। খুব ছোটবেলায় মা-কে হারিয়ে কলকাতায় ফুপুর কাছেই তিনি বেড়ে উঠেছেন। তার কৈশোর কেটেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকাময় দুর্যোগের মধ্যে। বড় হতে হতেই দেখেছেন মন্বন্তর, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আর দেশভাগ। দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালে তিনি পাবনা চলে আসেন। নবগঠিত পাকিস্তানে তখন স্বপ্নভঙ্গের আগুন জ্বলছে। বাঙালির ভাষার অধিকারকে ভূলুণ্ঠিত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী। ভাষার দাবিতে তৎকালীন পূর্ব বাংলা জ্বলছে।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছিল সারাদেশে। কামাল লোহানী তখন মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। ভাষার দাবির মিছিলে পাবনায় আন্দোলন করছেন তিনি। ভাষা শহীদদের রক্তের আগুনে দীক্ষা নিচ্ছেন রাজনীতির। বায়ান্নর সেই সংঘাতময় দিনগুলোতেই কামাল লোহানীর রাজনৈতিক জীবনের শুরু। মাধ্যমিক পরীক্ষার পর পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তি হন। মাতৃভাষা আন্দোলনের চেতনায় সহযোদ্ধাদের সঙ্গে গড়ে তোলেন 'পাইওনিয়ার্স ফ্রন্ট'। এই জোটের পক্ষ থেকেই ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করেন। ১৯৫৩ সালে পাবনার তৎকালীন 'জিন্নাহ পার্কে' (বর্তমান স্টেডিয়াম) মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের জনসভার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নামেন তিনি। শিক্ষার্থী হত্যাকারী নুরুল আমিনের জনসভায় বাধা দিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করলে পাবনার রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের সঙ্গে তিনিও কারাবরণ করেন। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে সকল প্রগতিশীল শক্তির সঙ্গে তিনিও যুক্তফ্রন্টের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেন। একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদদের স্মরণে পাবনা টাউন হল মাঠে আয়োজন করেন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। পরদিনই তিনি গ্রেফতার হন।
১৯৫৫ সালের জুলাই মাসে তিনি মুক্তিলাভ করেন রাজশাহী জেল থেকে। ঢাকায় আসেন এবং যোগ দেন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টিতে। এর মাধ্যমেই তিনি জাতীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। একই বছর তিনি দৈনিক মিল্লাত পত্রিকায় সহ-সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। পরবর্তীতে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি পার্টির নির্দেশেই সেখানে যোগ দেন ।
১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইস্কান্দার মির্জা সমগ্র পাকিস্তানে সামরিক আইন জারি করলে কামাল লোহানী ও তার সহযোদ্ধারা আত্মগোপনে চলে যেতে বাধ্য হন। কিছুদিন পর সরকারের ধরপাকড় আর অত্যাচারের প্রকোপ কমলে তিনি নৃত্যগুরু জি. এ. মান্নানের একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন এবং সংবাদপত্রে প্রকাশ করেন। এর মাধ্যমেই তার জীবনের নৃত্য অধ্যায়ের সূত্রপাত। এ সময় বুলবুল ললিতকলা একাডেমীতে জি. এ. মান্নান নক্সী কাঁথার মাঠ প্রযোজনা করেন। এই প্রযোজনায় অংশ নেন কামাল লোহানী। ১৯৫৯ সালে এই নৃত্যনাট্য নিয়ে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশ সফর করেন। এর মধ্যেই তার কর্মস্থলের বদল হয়। তিনি তৎকালীন বনেদি পত্রিকা দৈনিক আজাদ-এ যোগ দেন। ১৯৬১ সালে তিনি পাকিস্তান সাংস্কৃতিক দলের সদস্য হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে যান এবং বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র সফর করেন।
সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্র আন্দোলন গর্জে উঠেছিল। সংগ্রামী কামাল লোহানীর নামেও তখন হুলিয়া জারি করে সরকার। ১৯৬২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে তিনি গ্রেফতার হন। ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের ২৬ নম্বর সেলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, আবুল মনসুর আহমেদ, হায়দার আকবর খান রনো, অধ্যাপক রফিকুল ইসলামসহ আরও অনেকের সঙ্গে তিনিও বন্দী ছিলেন। তিন মাস পর মুক্তি লাভ করে তিনি দৈনিক সংবাদ পত্রিকার সিনিয়র সাব-এডিটর হিসেবে যোগ দেন। এরপর ১৯৬৭ সালে যোগ দেন পূর্বদেশ পত্রিকায়।
১৯৬১ সালে তমসাচ্ছন্ন পাকিস্তান আমলে প্রতিবাদী রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উদযাপন করে বাংলার মানুষ। সেই প্রতিবাদের ধারাতেই প্রতিষ্ঠিত হয় সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট। ১৯৬২-১৯৬৬ সাল পর্যন্ত কামাল লোহানী ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৭ সালে মার্কসবাদী আদর্শে গড়ে তোলেন 'ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী'। ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বর্বর জেনোসাইড শুরু করে বাংলার মানুষের ওপর। নির্বিচারে মানুষ হত্যার এমন বিভৎস নজির পৃথিবীর ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এপ্রিলের শেষে কামাল লোহানী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। দায়িত্ব নেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংবাদ বিভাগের। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তার কণ্ঠেই বাংলাদেশের মানুষ শুনেছিলেন বিজয়-বার্তা।
দেশ স্বাধীন হবার পর বীর মুক্তিযোদ্ধা কামাল লোহানী আত্মনিয়োগ করেন রাষ্ট্র পুনর্গঠনের কাজে। ঢাকা বেতারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি। বিধ্বস্ত বেতার পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেন পুরোদমে। স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের প্রতিটি রাজনৈতিক আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক সংগ্রামে তিনি নিরলস কাজ করেছেন। যেমন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে, তেমনি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রেও তিনি আমাদের প্রজন্মকে তৈরি করেছেন। তার নেতৃত্ব ও দিক-নির্দেশনায় আমরা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কর্মী হিসেবে গড়ে উঠেছি, কাজ করছি।
তিন
২০১২-২০১৬ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতি হিসেবে আমাদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার চিন্তা, কর্ম এবং দিক-নির্দেশনা আমাদের যেমন ঋদ্ধ করেছে, তেমনি সাংগঠনিক নানা বিষয়ও তিনি আমাদের হাতে ধরে শিখিয়েছেন। উদীচীর সভাপতি হিসেবে তিনি যখন দায়িত্ব পালন করছিলেন, তখনও দেখেছি, যতই অসুস্থ থাকুন না কেন কোনো সভায় তিনি অনুপস্থিত থাকতেন না। সভাপতি হিসেবে কেবল উপস্থিত হওয়াই নয়, প্রতিটি সভার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি থাকতেন এবং নানা বিষয়ে আলোচনা করতেন। কখনো কখনো এমন হতো সভা দীর্ঘ হয়ে গেলে তিনি নানা ধরনের বুদ্ধিদীপ্ত হাস্যরসাত্মক আলোচনা করতেন। সাংবাদিক হিসেবে তার অভিজ্ঞতা থেকে তীব্র রাজনৈতিক স্যাটায়ার করতে পারতেন। উদীচীর কর্মী হিসেবে এ ছিল আমাদের বাড়তি পাওনা। উনার বক্তৃতা যারা শুনেছেন, সকলেই জানেন, যেমন ছিল তার প্রতিবাদের ভাষা তেমনি তিনি বিষয়ের গভীরে শ্রোতাদের নিয়ে যেতে পারতেন। কখনোই তিনি বসে বক্তৃতা করতেন না, এমনকি সাংগঠনিক সভাতেও না।
যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি গড়ে উঠেছিল শাহাবাগ আন্দোলন। সে সময় তার নেতৃত্বেই আমরা উদীচীর কর্মীরা নিজেদের সর্বশক্তি নিয়ে শাহাবাগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করি। সারাদেশে এই আন্দোলন ছড়িয়ে দেবার ক্ষেত্রে দেশজুড়ে উদীচীর ভাইবোনরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। সে সময় কেবল সভাপতি হিসেবেই নয়, একজন অভিভাবক হিসেবেও তিনি আমাদের নেতৃত্ব দিয়েছেন, পরামর্শ দিয়েছেন।
চার
যুদ্ধাপরাধী ও উগ্র সাম্প্রদায়িক অপশক্তি যখন দেশজুড়ে শাহাবাগ আন্দোলনের সহযোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ শুরু করে; যখন একের পর এক লেখক, ব্লগার ও প্রকাশক হত্যা করে মুক্তচিন্তার পথকে রুদ্ধ করে দেবার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়; তখনও তিনি আমাদের পাশে শক্তভাবে এসে দাঁড়িয়েছেন। বিতর্কিত সাতান্ন ধারা বা পরবর্তীতে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট ইত্যাদি কালাকানুনের বিরুদ্ধে শ্রদ্ধেয় কামাল লোহানী আমৃত্যু সোচ্চার ছিলেন। তিনি যেমন স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন কর্মী তেমনি তিনি নতুন প্রজন্মের সঙ্গেও আদর্শের ধারায় সামিল থেকেছেন। মহামানবের জীবন এমনই হয়, প্রতিটি প্রজন্মের কাছে তারা পৌঁছে দিতে পারেন মানবমুক্তির শাশ্বত বার্তা।
জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি অন্যায় আর অবিচারের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, দমন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে তার আদর্শিক অবস্থান নিয়ে তিনি তরুণদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
গত মাসেই আমরা হারালাম অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্যারকে। মাত্র কদিন আগে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন আমাদের পরম অভিভাবক কামাল লোহানী। মানুষ চলে যাবেন, এর চেয়ে অবধারিত সত্য তো আর নেই কিন্তু যে কর্ম আর আদর্শের শিক্ষা তারা রেখে গেছেন আমাদের জন্য, আমরা যেন তা ধারণ করতে পারি। অসাম্প্রদায়িক, বিজ্ঞানমনষ্ক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ নির্মাণে ভবিষ্যত প্রজন্মকে সঠিক পথের দিশা দিতে এই মহাজীবনের আদর্শ যেন ঠিকটাক তুলে ধরতে পারি।
আমাদের সকল সংকটে সংগ্রামে অর্জনে তাদের জীবনবোধ হোক আমাদের গুরুত্বপূর্ণ পাঠশালা।