Published : 02 Jun 2020, 03:18 PM
পৃথিবীটা এমনই, বিশ্বাস করো! এই নিষ্ঠুর সমাজে সবাই সফলদের নিয়ে উচ্ছাস প্রকাশ করবে, বিফলতার দুই পয়সাও মুল্য এখানে নেই। এই অকৃতকার্যতা হয়ত তোমাদের ক্ষণিকের জন্য রাহুর মতো গ্রাস করে ফেলবে। হতাশ হও, কিন্তু হাল ছেড় না। জেনে রেখ তোমরা খুব সৌভাগ্যবান। কারণ, এই পৃথিবীর নিষ্ঠুরতা তোমরা ১৬-১৭ বয়সেই দেখে ফেলেছ, আজ যারা সফল তারাও হয়ত জীবনে চলার পথে অন্য কোনোখানে অন্য কোনো ভাবে চরম নিষ্ঠুরতার সম্মুখীন হবে। তোমরা এই ক্ষণিকের ব্যর্থতাকে তাই এখনই সুযোগ হিসেবে লুফে নাও। এখন তোমার চারপাশের মানুষ হয়ত তোমার কাছ থেকে দৃষ্টি অন্য দিকে ফিরিয় নেবে। আর এটাই তোমার জন্য মোক্ষম সুযোগ! কিছুদিন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আরও কিছুদিন ধরে গভীরভাবে নিঃশ্বাস নাও। তারপর চিন্তা করতে শুরু কর একাডেমিক পড়াশুনা বাদে তোমার অন্যান্য শক্তিগুলো কী কী। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, প্রতিটা মানুষ অনেক সম্ভাবনা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। বিভিন্ন বাস্তবতার যাতাকলে পড়ে সে সম্ভাবনা অনেক সময় হয়ত অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়। আর এটাই জীবনের সৌন্দর্য। ব্যর্থতা আছে বলেই সফলতার এত কদর! তবে বিশ্বাস করো, সফলতার কোনো শেষ নেই। তাই সফলতার পেছনে না দৌড়ে মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকাটা উপভোগ করতে শেখো। মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকাটাই অত্যন্ত চমৎকার একটা বিষয়। এখন না হলেও জীবদ্দশার কোনো এক পর্যায়ে গিয়ে তা খুব ভালোভাবে বুঝতে পারবে। তাছাড়া সফলতার সংজ্ঞাটাই বা কী? আজ আমরা যাদেরকে প্রতিনিয়ত স্বরণ করি বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের জন্য, তাদের ক'জনের একডেমিক রেজাল্টা ভালো ছিল, এটা নিয়ে ছোটখাটো একটা অধ্যয়ন করে দেখতে পারো। বিজ্ঞান ছাড়া শিল্প-সাহিত্য, ক্রীড়া-কলাসহ হালের রাজনীতিবিদ-সাংবাদিক-ব্যবসায়ী প্রভৃতি ক্ষেত্রে সফল ব্যক্তিদের কেতাবি ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাবে তাদের অধিকাংশেরই একাডেমিক রেজাল্ট সাধারণ মানের ছিল। তাই বলে কি তাদের প্রতিভা কেউ আটকে রাখতে পেরেছে? না পারেনি, প্রতিভা ঠিকই প্রস্ফুটিত হয়েছে। তাই বলি, তোমার ভিতরের প্রোথিতযশা সত্তাকে বের করে আনার এখনই উপযুক্ত সময়। তুমি যদি একজন ভালো চিত্রশিল্পী হও তুমি সেখানেই তোমার সময় ও মেধা ব্যয় করো, যদি খেলাধুলা বা সঙ্গীতে ভালো হও তুমি তাই কর, ব্যবসায়ী মানসিকতার হলে একজন উদ্ভাবনী উদ্যোক্তা হও। দেখবে সফলতা একদিন ঠিকই তোমার কাছে এসে ধরা দেবে। যদি সফল না-ও হতে পারো, তাতেও খুব একটা আফসোস থাকবে না। কারণ, তোমার যোগ্যতার সর্বোচ্চ চেষ্টাটাই তুমি করেছ। সফল হতে না পারার অর্থ ওটা তোমার নিয়ন্ত্রনের বাইরে। তাই এটা নিয়ে আর আক্ষেপ না করে তখন তোমার উচিত হবে সফলতার চূড়ান্ত রূপ, অর্থাৎ সুখের পিছনে দৌড়ানো। কারণ, দিনশেষে যে আমরা ওটাই খুঁজি! একটা গল্প বলে শেষ করব।
"ব্যবসায়ী দিলদার সাহেব মস্ত বড় ধনী। তার এত টাকা যে, তার কথায় বিভিন্ন ব্যাংকের এমডি-ডিএমডিরা ওঠাবসা করে। বছরের বারো মাসই ওনার জীবনে বসন্ত থাকে। পৃথিবীর যে দেশে যখন বসন্ত আসে, দিলদার সাহেব পরিবারসহ বিলাসবহুল ব্যক্তিগত জেটে করে সে দেশ ভ্রমণ করে থাকেন। আর বিদেশ ভ্রমণের সময় সংশ্লিষ্ট দেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাস নিজ উদ্যোগী হয়ে ভিসাসহ যাবতীয় অনুমোদনের দাপ্তরিক কাজসমূহ করে থাকেন। দিলদার সাহেব বিমানবন্দরে নিজ জেটে চড়ার সময় বন্দরের বড়কর্তাগণ সাহেবকে বিশেষ আতিথেয়তা দিয়ে ধন্যি হয়।
তো দেশে থাকা অবস্থায় কোনো এক বসন্তে দিলদার সাহেব আগ্রহ একাদেমিককরলেন যে, উনি কয়েকদিনের জন্য কুয়াকাটায় অবকাশ যাপন করবেন। যে কথা সেই কাজ। সাহেবের কথা কন্ঠনালী থেকে নিঃসৃত হতেই বিভিন্ন পাইক-পেয়াদা, সংশ্লিষ্ট ডিসি-এসপিরা কুয়াকাটার সবচেয়ে বড় বাংলোটা ব্যবস্থা করে দিলেন। যথারীতি তিনি কুয়াকাটায় গিয়ে সাগর কন্যার রুপে মোহাবিষ্ট হয়ে পড়লেন। অবকাশকালীন সময়ে একদিন তিনি পাখি শিকার করার মনস্থির করলেন। সাহেবের ভৃত্যরা এদিক-সেদিক ঘুরাঘুরি করে বাংলো হতে কিয়দাংশ দূরে ধান ক্ষেত পার হয়ে লোকালয় বেষ্টিত জঙ্গলে সাহেবের পাখি শিকারের স্থান ঠিক করলেন। পরদিন তৃতীয় প্রহরে সাহেব একটা দোনলা বন্দুক নিয়ে পাখি শিকারে বের হলেন। যাত্রা পথে তিনি দেখলেন একজন পরিশ্রান্ত কৃষক মাথার নিচে একটা গামছা বিছিয়ে পরম তৃপ্তি নিয়ে ঘুমাচ্ছেন। তার পায়ের গোঁড়ালির উপর পর্যন্ত কাদামাটি লেগে আছে। দিলদার সাহেবের কেন জানি লোকটার প্রতি একটু মায়া হলো! তিনি কৃষককে ঘুম থেকে ডেকে তুললেন।
– তোমার নাম কি?
– "গনি মিঞা", কৃষক উত্তর দিলেন।
– এভাবে এখানে ঘুমাচ্ছো কেন? অসুখ করবে তো।
– গনি মিঞা হতভম্ব দৃষ্টিতে দিলদার সাহেবের পানে চেয়ে রইলেন…
– "বলি এভাবে ঘুমাচ্ছো কেনো, বাপু?", দিলদার সাহেব আবারো জিজ্ঞাসা করলেন।
– এই পাশের ভূঁইতে কাজ কত্তেচিলাম। দুপুরে খা'র পর শরীলডা ছ্যা'রে দিয়েলো। তাই এই গাছের তলে এট্টু জিরিয়ে নিচ্চিলাম।
– বাসায় গিয়ে ঘুমাতে পারো না?
– সন্দ্যের মদ্যি ভূঁইতে আরেকটু কাজ কত্তি অবেনে যে! বাড়ী যাতি-আসতি দশ টাহা-দশ টাহা, এই কুঁড়ি টাহা ভ্যান ভাড়া। আমরা গরীব মানুষ স্যার। তাই…।
– দিলদার সাহেবের খুব মায়া হলো। তিনি দরদী কন্ঠে বললেন, "চাকরি দিলে ঢাকায় আসবে?"
– না স্যার, শুনিচি ডাকায় মানষির নাকি অনেক কষ্ট।
– "তা অনেক কষ্ট, কিন্তু মাস শেষে অনেক টাকা বেতন পাবে। অভাব-অনটন থাকবে না", দিলদার সাহেব বললেন।
– "কষ্টই যদি অবে, এত বেতন দিয়ে কি করব?" গনি মিঞার খেদোক্তি।
– "এই ধর মাস শেষে বেতন পেলে পরিবার নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যেতে পারবে, কোলাহল ছেড়ে কোনো নির্জন স্থানে গিয়ে রিলাক্স করতে পারবে", দিলদার সাহেব বললেন।
– "তা এতক্কন আমি এহানে কি কত্তেচিলাম?", বিরক্ত নিয়ে গনি মিঞা দিলদার সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন।
দিলদার সাহেব আর কথা না বাড়িয়ে শিকারের উদ্দেশ্যের রওনা হলেন!"
সুপ্রিয় ভাইবোন, আমরা সফলতার পিছনে দৌড়াতে গিয়ে নিজের সুখগুলোকে যেন হারিয়ে না ফেলি, সেদিকেও আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। জীবনের তাৎপর্যকে একাডেমিক ফলাফলের মধ্যে যেন আমরা ব্রাকেট বন্দী করে না ফেলি। তোমাদের জন্য নিরন্তর শুভকামনা রইল।