Published : 02 Jun 2020, 01:33 PM
কয়েক দিন ধরেই একটি ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল। আমেরিকার মিনেসোটার মিনিয়াপোলিসে শুট করা হয়েছে ভিডিওটি। সেখানে দেখা যাচ্ছে, এক ব্যক্তির উপরে চড়াও হয়েছে একাধিক পুলিশ। হ্যান্ডকাফ পরা অবস্থায় সেই ব্যক্তি রাস্তায় শুয়ে এবং পুলিশ পাঁচ মিনিটেরও বেশি সময় ধরে হাঁটু গেড়ে বসে তার ঘাড়ে চাপ দিয়ে রয়েছে। ওই ব্যক্তি রুদ্ধশ্বাস অবস্থায় কোনও মতে বলছেন, ''আমি শ্বাস নিতে পারছি না (আই কান্ট ব্রিদ)!'' তার পরেও তাকে ছাড়া হয়নি। পরে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে ওই ব্যক্তিকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়।
৪৬ বছর বয়স্ক ওই হতভাগ্য ব্যক্তিটির নাম জর্জ ফ্লয়েড। মিনিয়াপোলিস শহরের একটি রেস্তোরাঁয় নিরাপত্তা কর্মী হিসাবে কাজ করতেন। ২৫ মে সন্ধ্যায় সন্দেহভাজন একটি প্রতারণার ব্যাপারে কল পেয়ে পুলিশ তাকে ধরে। একজন প্রত্যক্ষদর্শীর তোলা ১০ মিনিটের ভিডিও ফুটেজে দেখা যায় জর্জ ফ্লয়েড নিঃশ্বাস না নিতে পেরে কাতরাচ্ছেন এবং বারবার একজন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসারকে বলছেন, "আমি শ্বাস নিতে পারছি না"। কিন্তু বর্ণবিদ্বেষী আমেরিকান সেই পুলিশ অফিসারের মনে এতটুকু করুণার আলোড়ন সৃষ্টি হয়নি!
গোটা আমেরিকা জুড়েই রব উঠেছে: 'আমি শ্বাস নিতে পারছি না!' হ্যাঁ সেখানে যে ঘটনা ঘটেছে তাতে শ্বাস নেয়া সত্যিই যেন অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এমনিতেই করোনাভাইরাস সংক্রমণে বিধ্বস্ত আমেরিকা। তারই মধ্যে পুলিশি নির্যাতনে কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর ঘটনার প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠেছে পুরো দেশ। শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ পরিণত হয়েছে উন্মত্ত প্রতিবাদে। আই কান্ট ব্রিদ— মৃত জর্জ ফ্লয়েডের এই কথাগুলোই হয়ে উঠেছে প্রতিবাদীদের স্লোগান। আমেরিকা জুড়ে প্রতিবাদ ছড়িয়েছে অন্তত ৭৫টি শহরে। ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা, পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট ও বোতল বৃষ্টি, পুলিশের গাড়িতে আগুন, দোকানপাটে আগুন ও লুটপাট— ১২টির বেশি বড় শহরসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে। নানা শহরে নামানো হয়েছে ন্যাশনাল গার্ড বাহিনীকে। বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট ব্যবহার করেছে পুলিশ। রবার বুলেটে আহত হয়েছেন এইচবিও চ্যানেলের সিরিজ 'ইনসিকিওর'–এর অভিনেতা কেনড্রিক স্যাম্পসন। পুলিশের লাঠিও লেগেছে তার গায়ে। ফ্লয়েডের ঘটনায় সোশ্যাল মিডিয়ায় ন্যায়বিচারের দাবি জানিয়েছেন অভিনেত্রী লেডি গাগা, রিহানা, ডয়নে জনসন, সেলিনা গোমেজসহ অন্যরা।
পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে পথে নেমেছেন আফ্রিকান আমেরিকানরা। কারফিউ উপক্ষো করে গত পাঁচ দিন ধরে চলা প্রতিবাদ ও হিংসা ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে। বিক্ষোভকারীদের উসকানি দেয় ট্রাম্পের মন্তব্য। ২৯ মে তিনি টুইট করেন, 'লুঠ শুরু হলে গুলি শুরু হবে।' ৩০ মে হোয়াইট হাউসের সামনে জমায়েত হওয়া বিক্ষোভকারীদের ওপর 'হিংস্র কুকুর' ও 'ভয়ঙ্কর অস্ত্র' প্রয়োগের হুমকিও দেন। এতেই পরিস্থিতি আরও তপ্ত হয়ে ওঠে। প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, 'মহামারী ও অর্থনীতির সঙ্কটে আমরা ব্যতিব্যস্ত। তবে মনে রাখতে হবে, লক্ষ লক্ষ আমেরিকানকে স্রেফ বর্ণের ভিত্তিতে বিচার করা হয়। এটা ট্র্যাজিক ও বেদনাদায়ক। স্বাস্থ্য পরিষেবা, অপরাধীর বিচার, রাস্তায় জগিং করা কিংবা পার্কে বসে থাকা— সর্বত্রই এই বিভাজন দেখা যাচ্ছে। ২০২০ সালের আমেরিকায় এসব 'স্বাভাবিক' হতে পারে না।' ফ্লয়েডের মৃত্যুর ঘটনার কড়া নিন্দা করেছেন ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী জো বাইডেন। তবে একই সঙ্গে হিংসার সমালোচনাও করেছেন তিনি।
বিক্ষোভের জেরে নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটন, ফ্লোরিডা, আটলান্টা, ডেনভার, লস এঞ্জেলেস, মিনিয়াপোলিস, সান ফ্রান্সিসকো, সিয়াটেলসহ ১২টির বেশি শহরে জারি করা হয়েছে কারফিউ। প্রায় সব কটি শহরের বহু বাড়িতে স্প্রে দিয়ে লেখা হয়েছে 'আই কান্ট ব্রিদ'। বিভিন্ন শহর থেকে প্রায় দুই হাজার বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
এর আগে ২০১৪ সালের ১৭ জুলাই এরিক গার্নার নামে এক যুবককে নিউইয়র্কে হত্যা করা হয় একই কায়দায়। খুচরা সিগারেট অবৈধভাবে বিক্রি করছেন এই সন্দেহে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই ঘটনার ফুটেজেও দেখা যায় গার্নার বারবার কান্নাজড়ানো গলায় আকুতি করছেন, "আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না" আর একজন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ, ড্যানিয়েল পান্টালিওকে দেখা যায় তার হাত দিয়ে গার্নারের গলা টিপে ধরে আছেন এমনভাবে যাতে তিনি দম নিতে না পারেন!
এ ধরনের ঘটনা আমেরিকায় প্রায়ই ঘটছে। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ-আন্দোলন-সংগ্রামও কম হচ্ছে না। কিন্তু তারপরও পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হচ্ছে বলে মনে হয় না। আমেরিকার ওয়াশিংটন পোস্ট সংবাদপত্রের সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে আমেরিকায় পুলিশের গুলিতে মারা গেছে ১০১৪ জন, যাদের বেশিরভাগই কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান। ম্যাপিং পুলিশ ভায়োলেন্স নামে একটি বেসরকারি সংস্থার চালানো জরিপে বলা হয়েছে যে আমেরিকায় পুলিশের গুলিতে শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় তিনগুণ বেশি মারা যায় কৃষ্ণাঙ্গরা।
দেশটিতে পুলিশি নির্মমতার প্রতিক্রিয়ার ফলশ্রুতিতে গড়ে উঠেছে #BlackLivesMatter (কৃষ্ণাঙ্গদের জীবনও মূল্যবান) নামের আন্দোলন। গায়ক বিয়োন্সে, বাস্কেটবল খেলোয়াড় লেব্রন জেমসের মত তারকারা এই আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছেন। তারপর পরও বিভেদকামী ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর মদদে বর্ণবাদ কিছুদিন পরপরই মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে।
সাদা আমেরিকা ও কালো আমেরিকার এই পারস্পরিক বিশ্বাস-হানি আকস্মিক নয়। সেটা দীর্ঘদিন ধরেই সে দেশের সমাজে ও রাজনীতিতে প্রকটভাবে বিরাজমান। জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর ঘটনা মার্কিন সমাজকে এক বিরাট সংকটের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। গোটা দেশজুড়ে সম্প্রতি যে সামাজিক মেরুকরণের চিহ্ন, অভিবাসী সমাজের সঙ্গে কৃষ্ণাঙ্গ সমাজকেও তা কতটা বিপন্ন করছে, এই ঘটনায় স্পষ্ট। ট্রাম্পের বিভেদমূলক রাজনীতি এই মেরুকরণের মধ্যে একটি নিবিড় যোগ আছে। আমাদের দেশের সাম্প্রদায়িকতার মতো বর্ণবাদের এই অসুখটি মার্কিন সমাজের গভীরে প্রেথিত। দীর্ঘকালীন অনাচার ও অত্যাচারের পর বর্ণবিদ্বেষ খাতায়-কলমে ঘুচলেও কৃষ্ণাঙ্গ সমাজ জানে, প্রাত্যহিক দিনযাপনে তা অনেকাংশে অব্যাহত। এমনকি রাষ্ট্রীয় পুলিশসহ বিভিন্ন উচ্চপদেও কৃষ্ণাঙ্গরা অবহেলিত। আর, যে সমাজে দীর্ঘকাল ধরে 'ভিকটিম কমপ্লেক্স'যুক্ত অর্থাৎ অত্যাচারিত-মনোভাব নিয়ে বাঁচতে শিখেছে, তার পক্ষে হিংসাত্মক ও নিষ্করুণ হয়ে উঠবার পথটি যথেষ্ট সহজ। সেই পথ তাদের পরিহার করাতে হলে সমাজ ও রাজনীতিকে আরও সংবেদনশীলতা দেখাতে হবে। সেই সংবেদন ঠিক কী ও কোন প্রকারের হওয়া উচিত, কীভাবে কায়েম হতে পারে, সেটাই এখন প্রশ্ন। তবে পথ খুঁজে পেতেই হবে। তা না হলে ''আমি শ্বাস নিতে পারছি না''-এই আর্তিতে সামাজিক স্থিতি বিনষ্ট হতে বাধ্য।
''আমি শ্বাস নিতে পারছি না'' এটা অবশ্য কেবল আমেরিকার সমস্যা নয়, কমবেশি সবখানেই এটা ছড়িয়ে পড়ছে। ''আমি শ্বাস নিতে পারছি না। শ্বাস নিতে পারছি না।'' মৃত্যুর আগে এটাই সম্ভবত শেষ কথা ছিল সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগির। তাকে হত্যা করার পর তুরস্কের গোয়েন্দাদের মারফত যে অডিও টেপ শোনা গিয়েছিল, সেখানে আমরা একটা চাপা কণ্ঠস্বরে এই আর্তিই শুনতে পেয়েছিলাম!
বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যে সব করোনাভাইরাস রোগী মারা যাচ্ছেন, তাদের বেশিরভাগই শ্বাসকষ্টের সমস্যায় মারা যাচ্ছেন। মৃত্যুর আগে অস্ফূট কণ্ঠে তারা অনেকেই বলছেন, ''আমি শ্বাস নিতে পারছি না। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।''
গোটা পৃথিবীরই এখন গভীর অসুখ চলছে। কখনও অদৃশ্য ভাইরাস আমাদের শ্বাসরোধ করছে। কখনও বলদর্পী শাসকের ভাড়াটে জল্লাদ আমাদের শ্বাসরোধ করছে। কখনও রাষ্ট্রযন্ত্রের বেতনভুক শান্ত্রীরা আমাদের শ্বাসরোধ করছে। এর থেকে আমরা রেহাই পাচ্ছি না।
চিকিৎসাশাস্ত্রে 'প্যানিক ডিসর্ডার' বলে একটি মানসিক রোগের কথা বলা আছে। এই রোগে আক্রান্ত হলে রোগীর হঠাৎ করেই মনে হবে, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, দম বন্ধ হয়ে আসছে, এই বুঝি হার্ট বিটই বন্ধ হয়ে এলো।
আমরা বর্তমানে সবাই প্রায় 'প্যানিক ডিসর্ডারে' ভুগছি। যখন দেশে করোনাভাইসের সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি তখন আমাদের সব কিছু খুলে দেওয়া হলো। স্বাস্থ্যবিধি, সামাজিক দূরত্ব সব কিছুকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে মানুষ এখন কর্মক্ষেত্রে ছুটছে। এদিকে করোনাভাইরাস টেস্ট করার সুযোগ এখনও খুবই কম। হাজার হাজার মানুষ করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছেন, কিন্তু সিরিয়াল পাচ্ছেন না। আক্রান্তরা হাসাপাতালে সিট পাচ্ছেন না। আইসিইউ-এ বেড খালি নেই। ভেন্টিলেটর নেই। অক্সিজেন সিলিন্ডার নেই। মোটের উপর এখন করোনাভাইরাস চিকিৎসা পুরোপুরিই 'আল্লাহ-ভরসা' হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদিকে প্রতিদিনই চেনা-জানা মানুষ করোনাভাইরাসে মৃত্যুবরণ করছেন। সবার মধ্যে ভয়, আতঙ্ক। কোথাও কোনো পরিকল্পনা নেই, বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার কোনো উদ্যোগ নেই, ভরসা নেই, সান্ত্বনা নেই। এদিকে উপার্জনের সুযোগও কমে যাচ্ছে। হাত-পাতা মানুষের সংখ্যা বাড়ছে।
এ অবস্থায় দেশের অনেক মানুষেরই শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে!
কিন্তু হায়, কোথাও কোনো ভেন্টিলেটরের সন্ধান কেউ দিতে পারছেন না!