Published : 30 Apr 2020, 08:52 PM
মেক্সিকোতে 'ইনভেস্টিং ইন হেলথ ফর ইকোনোমিক ডেভেলপমেন্টস' শিরোনামের একটি গবেষণায় একাধিক উত্তর উল্লেখ করে সাধারণ মানুষের কাছে প্রশ্ন করা হয়েছিল, 'well-being' (সুখ, সমৃদ্ধি, মঙ্গল, কল্যাণ) বলতে আপনার কাছে সবচেয়ে উপযুক্ত কোনটি? ২৩ শতাংশ বলেছে খাদ্যের নিশ্চয়তা, ১৬ শতাংশ বলেছে সুস্বাস্থ্য। আরেকটি প্রশ্ন ছিল, পরবর্তী ১০ বছরে অর্জনের ক্ষেত্রে আপনি কোন দুইটি জিনিস সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিবেন? ২৭ শতাংশ উত্তর দিয়েছে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়া, এবং ১৬ দশমিক ১ শতাংশ বলেছে একটি ভাল চাকরি পাওয়া।
স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানবাধিকারসমূহের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধিকার। স্বাস্থ্যসেবার সাথে জীবন ও জীবিকার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। সঠিক স্বাস্থ্যসেবার নিশ্চয়তা না থাকলে ব্যক্তি কর্মের অধিকার, শিক্ষার অধিকার এমনকি জীবনের অধিকার থেকেও বঞ্চিত হন। অপরাপর অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার উপভোগের ক্ষেত্রে একজন দরিদ্র ব্যক্তির মূল সম্পদ হলো স্বাস্থ্য। স্বাস্থ্যসেবার সাথে অর্থনৈতিক উন্নয়ন অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ রবার্ট ফ্রোজেল ইংল্যান্ডের ওপর দীর্ঘ গবেষণায় দেখিয়েছেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে জনগণের স্বাস্থ্যের বাস্তব সম্পর্ক রয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশগুলোর ১০০ বছরেরও বেশি সময়ের ইতিহাস গবেষণা করে বিশ্বব্যাংকও নিশ্চিত করেছে যে, সুস্বাস্থ্য অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জনসাধারণ সঠিক স্বাস্থ্যসেবা পেলে কম অসুস্থ হয় ও কাজে অনুপস্থিতির পরিমাণ কমে যায়। ফলে উৎপাদন ক্ষতি হ্রাস পায়। অন্যদিকে, দীর্ঘ অসুস্থতার অনুপস্থিতি, ব্যক্তির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি করে। অসুস্থ না থাকলে একজন ব্যক্তি তার জমানো অর্থ সন্তানের পড়াশোনা, অধিকতর পুষ্টি কিংবা অন্যান্য উন্নয়নমূলক খাতে ব্যয় করতে পারে। গবেষণা বলছে, গড় আয়ু ৫০ থেকে ৭০ বছরে অর্থাৎ ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পেলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৪ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। আরেকটি গবেষণা বলছে অপুষ্টি বা এ জনিত অসুস্থতার কারণে বিশ্বব্যাপী প্রবৃদ্ধি ০.২৩ থেকে ৪.৭ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেতে পারে।
স্বাস্থ্যের সাথে মানুষের জীবন-জীবিকা ও উন্নয়নের গভীর সম্পর্ক অনুধাবন করে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের সংবিধানে প্রত্যক্ষভাবে দুইটি ও পরোক্ষভাবে একাধিক অনুচ্ছেদ সংযোজন করেন। সংবিধানে প্রত্যক্ষ যে দু'টি অনুচ্ছেদ রয়েছে তার একটি ১৫ অনুচ্ছেদে অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসা সহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থাকে রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। অন্যদিকে ১৮ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'জনগণের পুষ্টির স্তর-উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতিসাধনকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবেন এবং বিশেষত আরোগ্যের প্রয়োজন কিংবা আইনের দ্বারা নির্দিষ্ট অন্যবিধ প্রয়োজন ব্যতীত মদ্য ও অন্যান্য মাদক পানীয় এবং স্বাস্থ্যহানিকর ভেষজের ব্যবহার নিষিদ্ধকরণের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন৷'
স্বাস্থ্যখাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্বেও ১৯৯৫ এর আগে এর অন্দরমহলের বিষয়ে আমার কোন অভিজ্ঞতা ছিল না। ১৯৯৫ এ কেরালার ত্রিবান্দ্রামে আয়োজিত সেমিনারে যোগদান শেষে কলকাতায় যাত্রাবিরতি করি। দেশে ফেরার ঠিক আগের দিন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লাম। মারাত্মক অসুস্থ। হাসপাতালে ভর্তি হতে হল। বেশ কয়েকদিন হাসপাতালে থাকার পর পুরোপুরি সুস্থ না হয়েই দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নেই। দেশে আসার পর শরীর-মনে নানা জটিলতা দেখা দিল। চিকিৎসা শুরু করলাম, কিন্তু সুস্থ হচ্ছিলাম না। ঢাকায় পিজি হাসপাতালের (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) একজন ডাক্তার যিনি আমাদের পরিবারের সাথে ঘণিষ্ঠ, তার দ্বারস্থ হলাম। ডাক্তারের চিকিৎসায় ও আচরণে মুগ্ধ হলাম। চিকিৎসা সূত্রে ডাক্তার মামার সাথে সখ্য গড়ে ওঠলো। সেই সূত্রে স্বাস্থ্যখাতের অন্দরমহলের নানা অব্যবস্থাপনার সাথে প্রথম পাঠ হল আমার।
অনেক আগের ঘটনা, তারপরও বেশ মনে পড়ছে। তিনি বলেছিলেন, রোগীদের খাবারের জন্য ট্রাকবোঝাই করে দিয়ে গেল পাঙ্গাশ মাছ, কিন্তু চালানে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ লিখে দিল খাসির মাংস। হাসপাতালে ট্রাকবোঝাই করে সরবরাহ করা হল নিম্নমানের সিনথেটিক ব্যান্ডেজ, চালানে লিখে দেয়া হল কটন ব্যান্ডেজ। ট্রাক ভর্তি দুর্নীতির কথা শুনে মনটা খারাপ হলো। এবার শুনুন চিকিৎসা ক্ষেত্রের আরও ভয়ংকর কথা। পোস্ট গ্র্যাজুয়েট তথা এফসিপিএস, এমডি ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের ফলাফল শিট ছিঁড়ে ফেলে সেই সময়ের সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠন নিজেদের পছন্দের প্রার্থীদের তালিকা প্রস্তুত করতো। এমনও হয়েছে নিজেদের রাজনৈতিক দলের কাউকে কাউকে ভর্তি করা হয়েছে যে ভর্তি পরীক্ষায়ই অংশ নেয়নি কিংবা সার্জারিতে এমডির জন্য অপশন দিয়েছে, কিন্তু তাকে গাইনিতে প্লেসমেন্ট দেয়া হল। এসব যখন ঘটেছে তখন বিএনপি সরকার দুর্দান্ত প্রতাপে ক্ষমতায়। এরপর দীর্ঘ সময় কেটে গেছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, বেসামরিক ও সামরিক সমর্থনপুষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশ শাসন করেছে। ২০০৯ থেকে পরপর তিন মেয়াদে আওয়মী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আছে। কিন্তু স্বাস্থ্যখাতে স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়নি। দুর্নীতি ও অনিয়মে আকণ্ঠ ডুবেছে স্বাস্থ্যখাত। স্বাস্থ্যখাতকে ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে মাফিয়া সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের একজন ডন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মেডিকেল এডুকেশন শাখার সাবেক হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. আবজাল হোসেন, যিনি স্বাস্থ্যখাতের টাকা লোপাট করে দেশে-বিদেশে শত শত কোটির টাকার মালিক হয়েছেন।
২০১৮ সালের ৭ মে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্য জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশন কর্তৃক প্রস্তুত এক জরিপে বলা হয় যে, জিডিপির হিসাবে জনস্বাস্থ্যে বাংলাদেশের বরাদ্দ দক্ষিণ, দক্ষিণ-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ জিডিপি-র এক শতাংশেরও কম ব্যয় করছে স্বাস্থ্য খাতে। স্বাস্থ্যখাতে জিডিপির ১০.৮ শতাংশ মালদ্বীপ, আফগানিস্তান ২.৯, ভুটান ২.৬, নেপাল ২.৩, শ্রীলংকা ২, ভারত ১.৪, পাকিস্তান ০.৯ শতাংশ ও বাংলাদেশ ০.৮ শতাংশ ব্যয় করেছে ২০১৮-২১০৯ অর্থ বছরে। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী, একটি দেশে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ জিডিপির ন্যূনতম ৫ শতাংশ এবং মোট বাজেটের ১৫ শতাংশ হওয়া প্রয়োজন।
স্বাস্থ্যখাতে আমাদের সীমিত বরাদ্দের চেয়েও বড় সমস্যা এর বড় অংশই লুটপাট হয়ে যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ- ফরিদপুর মেডিকেলে ১০ হাজার টাকার ডিজিটাল ব্লাড প্রেসার মেশিন কেনা হয়েছে ১০ লাখ ২৫ হাজার টাকায়। আর একটি গাছ লাগাতে খরচ হয়েছে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা। বৃক্ষরোপন প্রকল্পে ১১ কোটি খরচে কলেজ সংলগ্ন এলাকায় লাগানো হয় ২০০টি গাছ। আইসিইউর রোগীকে আড়াল করে রাখার কয়েক হাজার টাকার এক সেট পর্দার দাম পড়েছে ৩৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। রংপুর মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ ২০ হাজার টাকা থেকে এক লাখ টাকা মূল্যের প্রতিটি ডেন্টাল চেয়ার কিনেছে সাড়ে ৫৬ লাখ টাকায়। মোট পাঁচটি ডেন্টাল-চেয়ার কিনতে খরচ দুই কোটি ৮২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। আর দিনাজপুর মেডিক্যাল কলেজের জন্য প্রতিটি ডেন্টাল চেয়ার কেনা হয়েছে ১৮ লাখ টাকায়। কোনও কোনও কেনা-কাটায় দেখা যায় 'কাজীর গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই'। মানে যন্ত্রপাতি সরবরাহ ছাড়াই শত শত কোটি টাকার বিল তুলে নেয়া হয়েছে যোগসাজশে। দূর্নীতির ভয়ংকর থাবায় স্বাস্থ্যখাতে অবকাঠামো গড়ে উঠেনি। সরবরাহ নেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জামাদির। অস্ট্রেলিয়ার সেন্ট্রাল কুইন্স ইউনিভার্সিটি অনিতা মেধাকর ও বাংলাদেশের মুহাম্মদ মাহবুব আলী 'চিকিৎসা সেবা নিতে বাংলাদেশের মানুষের অধিক হারে ভারত যাওয়া'র ওপর একটি মাঠ পর্যায়ের গবেষণা করেছেন। তাদের গবেষণা প্রবন্ধের শিরোনাম হলো- Key Reasons for Medical Travel from Bangladesh to India। রোগীদের বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে চিকিৎসা সেবা নেওয়ার পেছনে দায়ী কতিপয় 'পুশ ও পুল' ফ্যাক্টর চিহ্নিত করেছেন এই দুই গবেষক। যেসব পুশ-ফ্যাক্টরের কারণে রোগীরা বাংলাদেশ ছেড়ে যায়, তার মধ্যে অন্যতম হলো- ক্রমাবনতিশীল স্বাস্থ্যসেবা, উচ্চমূল্য, দুর্নীতি ইত্যাদি।
অন্যদিকে যেসব পুল-ফ্যাক্টর রোগীকে ভারতে চিকিৎসা নিতে আকৃষ্ট করে তা হলো- অভিজ্ঞ ও ভালো মানের ডাক্তার, মানবিক ও মানসম্মত নার্সিং, কম খরচ, সহজলভ্যতা ও চিকিৎসায় সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও সরঞ্জাম ব্যবহার। গবেষণায় অংশগ্রহণকারী উত্তরদাতারা বাংলাদেশের নিম্নমানের স্বাস্থ্যসেবার জন্য যোগ্য ও দক্ষ ডাক্তার ও নার্সের অভাব, ডাক্তার-নার্স-এর পেশাদারিত্বের অভাব, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, সেকেলে চিকিৎসা সরঞ্জাম ও মেডিক্যাল টেকনোলজি, দুর্নীতি, স্বাস্থ্য সেক্টরে জবাবদিহিতা ও দায়িত্বশীলতার অভাব, হাসপাতালের নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ইত্যাদিকে দায়ী করেছেন।
স্বাস্থ্যখাতের বিরাজমান অব্যবস্থাপনা ও দুর্দশার জন্য দুর্নীতির পাশাপাশি অদক্ষতা ও অযোগ্যতাও বহুলাংশে দায়ী। করোনাক্রান্তিতে 'নিঃসঙ্গ শেরপা' মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সময়মতো শক্তভাবে হস্তক্ষেপ না করলে স্বাস্থ্যখাতের অদক্ষতায় প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস 'সরকারীঘাতি'-তে রুপ নিতে পারত। বর্ণচোরা বাংলাদেশবিরোধী কিছু ষড়যন্ত্রী ঘাপটি মেরে বসে আছে। ন্যূনতম সুযোগকে ব্যবহার করেও সরকারকে ক্ষমতাচ্যূত তথা বাংলাদেশকে কক্ষচ্যূত করতে দ্বিধা করবে না তারা।
করোনাকালে স্বাস্থ্যখাতের অদক্ষতার একটি চিত্র তুলে ধরতে চাই। শুরু থেকেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলে আসছে টেস্ট, টেস্ট, টেস্ট। আমরা দেখলাম শুরুতে দেশের নানা প্রান্ত থেকে নমুনা সংগ্রহ করে কয়েক শ' কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে কেবল ঢাকার আইইডিসিআর-এ করোনাভাইরাস পরীক্ষা করতে। অথচ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থিত অনেক সরকারি বিশ্বদ্যিালয়ে মাইক্রোবায়োলজি, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও বায়োকেমিস্ট্রিসহ বেশ কিছু বিভাগের করোনাভাইরাস শনাক্তকরণের জন্য আরটি-পিসিআর যন্ত্রসহ প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষিত জনবল রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, চট্টগ্রাম বিভাগে ১১টি জেলার মধ্যে একমাত্র কক্সবাজারে করোনাভাইরাস পরীক্ষার ব্যবস্থা আছে। বাকি জেলার মানুষের করোনাভাইরাস পরীক্ষা করতে হচ্ছে চট্টগ্রামের ফৌজদারহাটে অবস্থিত বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজে (বিআইটিআইডি)। এই একটি প্রতিষ্ঠান করোনাবাইরাসে আক্রান্ত রোগীর নমুনা পরীক্ষা করতে হিমশিম খাচ্ছে। দুই দিন আগে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয় (সিভাসু)-কে ও কয়েকদিন আগে চট্টগ্রাম বিশ্বদ্যিালয়ের একটি যন্ত্র ও ছয়জনের একটি টিমকে বিআইটিআইডিতে যুক্ত করা হয়েছে। অথচ চট্টগ্রামে সরকারি প্রতিষ্ঠান- বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) চট্টগ্রাম শাখা, চট্টগ্রাম মেরিন ফিশারিজ অ্যাকাডেমিতে করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য উপযুক্ত বেশ কয়েকটি আরটি-পিসিআর মেশিন পড়ে আছে। রয়েছে অব্যবহৃত জনবলও। করোনাভাইরাস শনাক্ত করার প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এবং কিট উদ্ভাবনের সক্ষমতা রয়েছে মর্মে গত ২৯ মার্চ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু একমাস পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় থেকে আনুষ্ঠানিক কোনও সাড়া পায়নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সহযোগিতার প্রস্তাব জানিয়ে চিঠি দিয়েছে গ্র্যাজুয়েট বায়োকেমিস্ট অ্যাসোসিয়েশন (জিবিএ)। কিন্তু স্বাস্থ্য বিভাগ নিরুত্তর। অথচ তিন দিন ধরে আইইডিসিআর এর কাছে ঘুরেও করোনাভাইরাস টেস্ট করাতে পারেননি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ক উপদেষ্টা প্রয়াত খন্দকার মিল্লাতুল ইসলাম। মৃত্যুর পরও এই কর্মকর্তার নমুনা নিতে আসেনি আইইডিসিআর। সর্বশেষ দাফনের ঠিক আগ মুহূর্তে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য পাঠায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। পরে তার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি ধরা পড়ে। খবরে দেখেছি করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য উপচেপড়া ভিড়। কিন্তু স্বাস্থ্য বিভাগ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও প্রশিক্ষিত জনবলসমৃদ্ধ প্রস্তাবকে উপেক্ষা করছে। সততা, সদিচ্ছা ও দক্ষতা থাকলে কী হয় তা বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় চট্টগ্রামে ১৫ দিনে ৬০ শয্যার 'করোনা ফিল্ড হসপিটাল' তৈরি করে দেখিয়ে দিয়েছেন ডা. বিদ্যুৎ বড়ুয়া।
আমি জানি স্বাস্থ্য বিভাগ অব্যবস্থপনা, অদক্ষতা, করোনাযোদ্ধাদের জন্য ক্রয়কৃত পিপিই ও মাস্ক নিয়ে ওঠা বিতর্ক কোনওটাই স্বীকার করবেন না। কিন্তু তাদের ওপর যে জনআস্থা শূন্যের কোঠায় তা অস্বীকার করবেন কিভাবে? আর স্বাস্থ্যসেবার মত খাত থেকে আস্থা ওঠে গেলে তা দেশের জন্য কী বিপজ্জনক হয় তার জন্য দুটো পরিসংখ্যান উল্লেখ করছি। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক রোগী চিকিৎসা নিতে বিদেশে যায়। এ কারণে বছরে ৪০০-৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার দেশের বাইরে চলে যায়, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ৩৮ হাজার কোটি টাকারও বেশি এবং জিডিপির প্রায় সাড়ে ৩ শতাংশ। বিদেশে চিকিৎসা ব্যয়ের সিংহভাগই যায় ভারতে। ভারতের বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বিদেশিদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে দেশটি যে ৮৮ কোটি ৯৩ লাখ ডলার আয় করেছে, তার মধ্যে বাংলাদেশি রোগীর কাছ থেকেই আয় করেছে ৩৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার অর্থাৎ প্রায় ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের এক হিসাব মতে, বিদেশে চিকিৎসা করাতে বাংলাদেশিরা বছরে ২.০৪ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেন যা বাংলাদেশের মোট জিডিপির ১ দশমিক ৯৪ শতাংশ।
গত বছর সেপ্টেম্বরে ব্যাঙ্গালুরুর দেবী শেঠীর হাসপাতাল খ্যাত Narayana Institute of Cardiac Sciences গিয়েছিলাম। পাশে রয়েছে Mazumdar Shaw Medical Center ও Narayana Nethralaya। হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিন লাখ লাখ ডলার খরচ করে হাজার হাজার বাঙালিকে চিকিৎসা নিতে দেখেছি। শুধু হাসপাতাল নয়, উপচেপড়া ভিড় দেখেছি ওষুধের দোকানগুলোতে। লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশিরা ৬মাস বা এক বছরের ওষুধ কিনছেন ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ ভারতীয় রুপি খরচ করে। প্রশ্ন করেছিলাম এত ওষুধ কেন কিনছেন? উত্তর মিলেছে, ভারতীয় ওষুধের মান ভাল। কেউ পাল্টা প্রশ্ন করেছে হাসপাতালে, ডাক্তারের চেম্বারের সামনে ওষুধ কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভ দেখেছেন? তাদের ধারণা বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানি ডাক্তারদের পিছনে অবৈধ অর্থ খরচ করে ওষুধের মান বজায় রাখতে পারছে না। বড়ই শংকার কথা। কর্নাটকের ভাষা কন্নড়। হাসপাতালে বা তার আশ-পাশের রাস্তায়, হোটেলে বাংলা ছাড়া কন্নড়, হিন্দি, ইংরেজি শুনবেন না। খাবার হোটেল গুলোতে বাংলায় লেখা আছে এখানে ভাত-মাছ-সবজি পাওয়া যায়। হোটেল মালিক, রাঁধুনি ও পরিবশেনকারীরা দিব্যি বাংলায় কথা বলছে। অনেক ডাক্তারও কম-বেশি বাংলা শিখে ফেলেছেন। ব্যাঙ্গালুরুর বাইরেও চিকিৎসা নিতে কলকাতা, চেন্নাই, ভেলোর, দিল্লী, মুম্বাই সহ অনেক জায়গায় যাচ্ছেন বাঙালিরা।
বিদেশনির্ভরতার কারণে যে ব্যয় বাড়ছে, তা রাশ টেনে ধরতে না পারলে এবং পুরো স্বাস্থ্য খাতকে শৃঙ্খলায় আনতে না পারলে ভবিষ্যতে দেশের চিকিৎসা সেবা কাঠামো বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। একদিন হয়তো করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেমে যাবে। কিন্তু আমাদের স্বাস্থ্যখাত কি সত্যিই ভাইরাস মুক্ত হতে পারবে!