সঠিক ব্যবস্থাপনা না থাকায় ব্যাপক পানি থাকার পরও সংকট দিন দিন বাড়ছে। পানি ব্যবহারে কোনো নীতি নেই, পানি সম্পদ আইন থাকলেও সম্পদের মর্যাদা নেই।
Published : 22 Mar 2024, 02:06 PM
পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত হলেই নিরাপদ পানির প্রসঙ্গ আসে। কিন্তু হাজার হাজার বছর ধরে পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত হলেও নিরাপদ পানির নিশ্চয়তা আসেনি। যখন আমরা নিরাপদ পানির জন্য ব্যাকুল তখন সর্বত্রই পানির সংকট দেখা দিয়েছে। সম্পদের অপচয় এবং লুণ্ঠনের মানসিকতা এই সঙ্কটের কারণ। তৈরি হয়েছে পানির জন্য হাহাকার। এখনই নিরাপদ পানির বিষয়ে সোচ্চার হওয়া দরকার। এজন্য চাই সত্যিকার পানি ব্যবস্থাপনা। পানি ব্যবস্থাপনা না থাকায় ব্যাপক পানি থাকার পরও সংকট দিন দিন বাড়ছে। পানি ব্যবহারে কোনো নীতি নেই, পানি সম্পদ আইন থাকলেও সম্পদের মর্যাদা নেই। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৯৮ শতাংশ মানুষের আওতার মধ্যে পানির প্রাপ্যতা রয়েছে। কিন্তু পানি ব্যবহারের যে ধরন তাতে কোনো পরিকল্পনা নেই। তাই এত নদ-নদীর দেশেও ভূগর্ভস্থ পানির উপরই আমরা নির্ভরশীল। নদীর সংখ্যা নিয়ে অবশ্য বিতর্ক আছে। সৈয়দ শামসুল হক তার ‘আমার পরিচয়’ কবিতায় লিখেছেন, ‘তেরশত নদী শুধায় আমাকে, কোথা থেকে তুমি এলে?’ নদী রক্ষা কমিশন বলছে, দেশে নদ-নদীর সংখ্যা ১ হাজার ৮টি। এই সংখ্যাটি নদী নিয়ে কর্মরত সংগঠনগুলো মানতে নারাজ।
নদীর সংখ্যা নিরূপণ নয়, নদীর পানি ব্যবহার নিয়ে এই আলোচনা। পান, ব্যবহার এবং সেচের জন্য ভূ-উপরিস্থ পানি যেমন নিরাপদ নয়, তেমনি ভূগর্ভস্থ পানিও পুরোপুরি নিরাপদ নয়। অফুরন্ত পানি রয়েছে মনে করে অধিকাংশ সময় নির্বোধের মতো পানি ব্যবহার করা হচ্ছে। যাতে পানির অপচয় হচ্ছে।
কৃষকের সেচে, শিল্পের ব্যবহারে কোথাও পানি ব্যবহারে আধুনিকতা ও যান্ত্রিক পূর্ণতা নেই। বিশুদ্ধ পানির অভাবে রয়েছে হাজার হাজার মানুষ। পানিবাহিত রোগের পাশাপাশি অজ্ঞতার কারণে পানির অপচয় হচ্ছে। এজন্য খাবার পানির সংকটও ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। যা তৈরি হয়েছে বিশুদ্ধ পানির সংকট ও পানি অব্যবস্থাপনার কারণে।
অন্যদিকে বিশুদ্ধ ও নিরাপদ পানির চাহিদা মেটাতে পাতালে প্রবেশ করেছি আমরা। অথচ আমাদের ভূপৃষ্ঠে যে পরিমাণ পানি রয়েছে তাতে পাতালে প্রবেশের কোনো কারণ ছিল না। পাতালে তোলপাড় করার কথা ছিল না। কিন্তু এখন পাতালেও পানি মিলছে না। তবু আমরা গভীরে প্রবেশের চেষ্টা করছি। এতে বিপন্ন হয়ে উঠছে পরিবেশ।
সঠিক ব্যবস্থাপনায় ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহার করা গেলে পরিবেশকে বিপন্নতার হাত থেকে কিছুটা রক্ষা করা যেত। যখন প্রযুক্তি দুর্বল ছিল তখন যেমন এ ব্যাপারে চিন্তাভাবনা ফলপ্রসূ হয়নি, আজও সেটা নিয়ে খুব বেশি গরজ নেই কারও।
ঢাকা শহরে ব্যবহার হওয়া আশি শতাংশ পানিই ভূগর্ভস্থ। এই পানির ২৫% অপচয় হয়। অথচ ঢাকা শহরের চার পাশে নদী। তবু আমরা মাটির নিচের পানির সর্বনাশ করে আসছি। এর প্রধান কারণ আমাদের নদীদূষণ। কেন এই নদীদূষণ ও দখল— সেটা জানতে খুব বেশি চিন্তাভাবনার প্রয়োজন হয় না। আমরা তা শুনে আসছি। যে কারণে পরিবেশের নামে সকলে মাটির নিচের পানির জন্য হাহুতাশ করলেও কোনো লাভ হয় না। এভাবে বাংলাদেশের পরিবেশগত বিষয়গুলো আসলে অনেকটা সচেতনভাবেই অবহেলার শিকার। পরিণতি জেনে-বুঝে চোখ বুজে থাকার মতো।
একটা ছোট ভূখণ্ডে ১৭/১৮ কোটি মানুষের পলিথিন ব্যবহারের কথাই ধরুন। অথচ যে পরিবেশবন্ধু পাট আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের এক সময়ের প্রধানতম উপায় ছিল, তার অতীত-বর্তমান সর্বনাশ করেছি। পাটের দিকে নজর না দিয়ে নতুন জায়গায় হাত দিয়েছি, নতুন ইস্যু সৃষ্টি করেছি নতুন মতলবে। এ রকম মতলব আমরা বুঝি পাটের দুরবস্থা দেখে। একইভাবে বাংলাদেশের নদ-নদী, পানির অপচয়, বিভিন্ন অঞ্চলে পানি সংকট এগুলো থেকে নজর সরিয়ে ভিন্ন দিকে নজর দিতেই বেশি মনোযোগ দেখা যায়।
অথচ পানিও ভাটি অঞ্চলের মানুষের সম্পদ, দেশের সম্পদ, খনিজ সম্পদ। কিন্তু মাটির উপর-নিচের পানিসম্পদের যে ছারখার অবস্থা তৈরি হলেও সেদিকে কারও নজর নেই। ভুরি ভুরি গবেষণা, পর্যবেক্ষণ-পরিবীক্ষণ, বিশেষজ্ঞ সুপারিশ, পরামর্শ— কোনো কিছুই কানে তোলার গরজ নেই যেন। কেউ কারও তোয়াক্কা করে না, না কোনো আইন কানুন বা নীতিনিয়ম নেই। বলতে গেলে আমাদের ভূগর্ভ এখন পানিশূন্য হতে চলেছে।
কোথাও পানি সংকট দেখা দিলেই সমাধান হচ্ছে গভীর নলকূপ। একসময় শুধুই নলকূপ দিয়ে চলত। এখন তা আর চলে না। এখন তো অনেক জায়গায় গভীর নলকূপেও পানি ওঠে না। তথ্যমতে, দেশে ব্যবহৃত সর্বমোট পানির ৮০ শতাংশই ভূগর্ভস্থ, রাজধানী ঢাকায় প্রতি বছর ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ২ মিটার করে নিচে নেমে যাচ্ছে। সেই হিসেবে গত ৪/৫ দশকে ১০০ মিটারের বেশি নিচে নেমে গেছে পানির স্তর। দেশের দক্ষিণ ও পশ্চিমের উপকূলীয় এলাকায় ১২০০ ফুট গভীর নলকূপ থেকে পানি উঠছে না। দেশের বরেন্দ্র অঞ্চলের ৪০ শতাংশেরও বেশি ইউনিয়নে পানিশূন্যতা বিরাজ করছে। বিএডিসির তথ্যমতে, দেশের ৪১ জেলার ১৯২ উপজেলায় তীব্র পানির সংকট চলছে। দেশের উত্তর ও উত্তর পশ্চিম অঞ্চল মরুকরণের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। দেশের কোথাও কোথাও ভবিষ্যতে লোনা পানির আশঙ্কা করা হচ্ছে। সরকারি হিসেব মতেই সারা দেশের নানা জায়গায় পানির স্তর ৪ থেকে ১০ মিটার পর্যন্ত কমে গেছে।
জলবায়ু পরিবর্তন হেতু চট্টগ্রাম নগরে শুষ্ক মৌসুমে লোনা পানির ব্যবহার চলছে প্রায় দুই দশক ধরে। লবণের তীব্রতায় এই পানি পানে স্বাস্থ্য সংকট সৃষ্টি হলেও নিরুপায় হয়ে ওই পানিই ব্যবহার ও পান করতে হচ্ছে। গ্রামে কৃষি ও গৃহস্থালির পানির জন্য একমাত্র নির্ভরতা ভূগর্ভস্থ পানি। কিন্তু জেলার বিভিন্ন জায়গায় পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। কোনো এলাকায় গভীর নলকূপেও পানি মিলে না। এরপর যে সব এলাকায় গভীর নলকূপে পানি পাওয়া যায় এসব নলকূপের পানি অপচয় হচ্ছে অভাবনীয়ভাবে। কোনো ব্যবহার ছাড়াই সারাদিন ডিপ টিউবওয়েল চলছে।
সেচের নামে পানির অপচয় সবচেয়ে বেশি। গৃহস্থালির ব্যবহারে পানি অপচয় কোনো ধর্তব্যের মধ্যে নেয়া হয় না। দেশে এক কেজি ধান উৎপাদনে কয়েক হাজার লিটার পানি অপচয়ের কথাও বলে থাকেন বিশেষজ্ঞরা। শিল্পেও পানির ব্যবহার এমনই উদ্বেগজনক। যেমন বৈশ্বিক হিসেব মতে, একটি সুতার টিশার্ট তৈরিতে ব্যবহার হয় চার হাজার লিটারের বেশি পানি। সেচের পানির ২০ শতাংশই অপচয় হয়। পানি অপচয়ের এমন নজির বিশ্বে কমই আছে। ভূগর্ভের প্রায় ৯০ শতাংশ পানিই ব্যবহার হয় চাষাবাদের সেচে। বিশ্বে সেচের জন্য ৪০ শতাংশ পানি ভূগর্ভ থেকে ব্যবহার করা হলেও বাংলাদেশে ব্যবহৃত হয় ৬০-৭০ শতাংশ। যাও আবার গভীর নলকূপের মাধ্যমে। প্রায় ৯০ লাখ হেক্টর জমির মধ্যে ৭৮ লাখ জমিতেই সেচ দিতে হয়।
দেশের ভূগর্ভের পানির ব্যাপক উত্তোলন ও ভূউপরিস্থ পানি ব্যবহারে নিরুদ্বেগ থাকাই আজকে বাংলাদেশের বাস্তবতা, যা অন্যতম প্রধান সংকট। একই সঙ্গেমাথাচাড়া দিয়ে উঠছে বিশুদ্ধপানির সংকটও। এই সংকটকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, শরণার্থী সংকট ও সাইবার অপরাধের উপরে স্থান দিয়েছে ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম। বস্তুত দেশের বিভিন্ন এলাকায় পানির সঙ্কটের নানা ধরন রয়েছে। মৌসুমভেদেও যা ভিন্ন ভিন্ন। আর শুষ্ক মৌসুমে পানির জন্য নিরব হাহাকার তো বাড়ছেই।
অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে দেখা যাচ্ছে পানি দূষণের ভিন্ন আরেক চিত্র। প্রভাবশালীরা অবাধে তিন দশক ধরে পাহাড়কে বনভূমি শূন্য করে ফেলেছে। গাছ কাটা হচ্ছে প্রাকৃতিক বন থেকে। সেই কাটা গাছগুলো ঝিরি ও খালে ফেলার কারণে সেগুলোর পানি দূষিত হচ্ছে। অনেক স্থানে কাঠ টানার জন্য ঝিরির উপর দিয়ে রাস্তা করা হয়েছে। হাতি দিয়ে গাছ টানা হচ্ছে। এর ফলে হাতিও ঝিরির পানি নষ্ট করছে।
দেশের বরেন্দ্র অঞ্চলের যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে তা নানা বিপর্যয়ের শঙ্কা তৈরি করেছে। যেখানে এক সময় গভীর নলকূপে পানি উত্তোলনকে উন্নয়নের হাতিয়ার হিসাবে নেয়া হয়েছিল। কিন্তু তা বুমেরাং হচ্ছে। গভীর নলকূপের বদলে সেখানে নদ-নদী সংস্কার ও খাল খননসহ নানা উপায়ে পানির যোগান বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
২০১৪-২০১৮ মেয়াদে ভূপৃষ্ঠের পানি ব্যবহারের লক্ষে রাজশাহীর কাটাখালী খাল খননের মাধ্যমে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেও লক্ষ্য অর্জন হয়নি। ১২ কোটি টাকায় কাটা খাল আবার ভরাট হয়ে গেছে। কৃষকরা আবার পাতাল ফুঁড়ে পানি তুলতে শ্যালো মেশিনে ফিরে গেছে। এছাড়া ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমাতে ২৪৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে বরেন্দ্র এলাকায় এমনই নানা প্রকল্পের কাজ শুরু করেছে সরকার। সব প্রকল্পই চলছে নদ-নদীকে জলময় করার লক্ষ্যে। কিন্তু নদীর প্রাণপ্রবাহ ফেরানোর আশা ফলবতী হচ্ছে না। বরেন্দ্র অঞ্চলের মত খরা প্রবণতা গোটা দেশকে গ্রাস করবে— এমন আশঙ্কাও করছেন অনেকে। এর প্রধান কারণই হচ্ছে বন উজাড়। বন ধ্বংসের পর নদীর ধারা ক্ষীণ হতে হতে নদী ধ্বংস শুরু হয়। এর ওপর রয়েছে নদী দখলের জন্য হামলে পড়া প্রভাবশালীরা। এভাবে শুধু নদী ভরাট-দখল এবং দূষণই নয় আমরা নিজেরাও দূষণে পচে-গলে গেছি।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের পঞ্চাশ বছরে দেশে কত সরকার আসছে-গেছে। নদীর বাঁধ ভেঙ্গেছে আবার বাঁধ হয়েছে, পৌনপুনিকভাবে এই কাণ্ডে নদ-নদীর সর্বনাশ রোধ করা সম্ভব হয়নি। নদী ও পানি নিয়ে আমাদের নানা গবেষণায় তথ্য-উপাত্তের শেষ নেই। সুপারিশ আছে, কলমে হাহুতাশ আছে। বাস্তবে সবটাই শূন্য।
দেশের নদী ও জলাশয়গুলোকে যদি সত্যিকার এবং ক্ষতি না করে শাসন করা যেত তাহলে এদেশের পানি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা অনেকটাই নিশ্চিত হত। নদী রক্ষার উপায় না পেলে মিঠা পানি, ভূগর্ভস্থ, উপরিস্থ পানি ও পরিবেশ নিয়ে নাটক মঞ্চস্থ করে কোনো ফল নেই। একশ বছরের বাদবাকি আর পঞ্চাশ বছরে দেশ বিরানভূমি হবে। হয়ত বর্ষাকালে চাতকের বারি পানে চাওয়ার মতো আমাদের ঠোঁট ভিজবে।
নদী কমিশন, নদীরক্ষা কমিশন, ওয়াটার মডেলিং ইনস্টিটিউশন, হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তর, নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট, ওয়ারপোসহ অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান হয়েছে। বাস্তবে নদীর কোনো উন্নতি হয়নি। নদীর উন্নতি না হলেশুধু পানি নিয়ে কোনো পরিকল্পনা বা প্রকল্পে সুফল আসবে না। পানির প্রাপ্যতাও কাজে দেবে না।বাংলাদেশের ভূপৃষ্টে বা ভূগর্ভের পানি ব্যবস্থাপনাও ফলদায়ক হয় না। দেশজুড়ে পরিবেশবাদী সংগঠনের নামে অনেক কিছু থাকলেও বাস্তবে বাণিজ্যিক মানসিকতার কারণে কিংবা অমনোযোগিতা-আপোসকামিতা নদীগুলোকে ধ্বংসের প্রান্তে নিয়ে গেছে। অন্যদিকে কেবল জলবায়ু পরিবর্তনের কথা বলে বাংলাদেশ তার পরিবেশগত বিষয়ে দায়িত্বে অবহেলার সুযোগ নিচ্ছে। পরিস্থিতিটাকে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট হিসাবে বোঝাতে গিয়ে এবং নানা মতলবে গোষ্ঠিস্বার্থকে প্রাধান্য দিচ্ছে।