জাপানের মতো উন্নত দেশ, ইন্দোনেশিয়ার মতো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ যদি ঋতুস্রাবকালীন ছুটির ব্যবস্থা করতে পারে, তবে আমরা পারব না কেন?
Published : 01 Mar 2023, 04:30 PM
বাংলাদেশে নারীদের হেনস্তা বা হয়রানি সম্পর্কে আমাদের একটা ধারণা আছে। আমদের পরিবারের নারীরাই তো বিভিন্ন দপ্তরে কাজকর্ম করেন। তাই বিষয়গুলো আমাদের অজানা নয়। শহরের একটা বড় সংখ্যক কর্মজীবী নারী পোশাকশিল্পে কাজ করেন। কেউ কেউ কুটির শিল্পসহ অন্যান্য শিল্পেও কাজ করেন। বাংলাদেশ জন্মের মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে প্রগতিশীল, জনকল্যাণকর কিছু সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয়েছিল। নানাবিধ কারণে আমাদের গুণগতমান নিম্নমুখী হয়েছে। মেরিটাইম নিয়ে একটা আইন জাতিসংঘ বানাতে পেরেছিল জন্মের তিন যুগ পরে, আমরা পেরেছিলাম মাত্র আড়াই বছরের মধ্যে; জাতিসংঘের আট বছর আগে। আমরা পারি। আমাদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা দিয়ে অতীতে অনেক কিছুই করেছি। যোগ্য ও মেধাবী আইনপ্রণেতা, সৎ ও সুশিক্ষিত নীতিনির্ধারক পেতে হলে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তনের দরকার। শিক্ষার গুণগত পরিবর্তনেই সফল্য আসবে।
বাংলাদেশের বয়স ৫২ বছর চলে। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রসহ সংবিধানের ঘোষণা ছিল নারীর প্রতি কোনোরকম সহিংসতা, অন্যায়, জুলুম, বৈষম্য সহ্য করবে না বাংলাদেশ। সংবিধানের একাধিক জায়গায় লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য দূর করার কথা বলা হয়েছে। এমনকি আদালত দ্বারা বলবৎযোগ্য করা হয়েছে এমন বিধান। কিন্তু দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে, এমনকি শহরের তৃণমূলেও নারীকে প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতায়িত করা যায়নি।
নারীদের ঋতুস্রাব একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জৈবিক বিষয়; মায়েদের এই চক্রের ফলেই আমরা সন্তান হিসেবে ভূমিষ্ঠ হতে পেরেছি। এটা লুকানোর বা লজ্জা পাবার মতো কিছু নয়৷ কিন্তু এই সময়টায় কর্মজীবী নারীর প্রতি অমানবিক ও পৈশাচিক আচরণ করি আমরা, আমাদের সমাজ। আমাদের পরিবারের নারীরাও সেই পৈশাচিক আক্রমণের শিকার হন। এই সময়ে নারীকে দৈহিক অভ্যন্তরীণ সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তৈরি হয় নানান জটিলতা। এটা তো ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর দেশ না, এ তো স্বাধীন বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধকে যদি লালন করতাম তবে কর্মজীবী নারীর জন্য মাসে অন্তত ৩ দিন ছুটির ব্যবস্থা করতাম।
জাপানের মতো উন্নত দেশ, ইন্দোনেশিয়ার মতো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ যদি ঋতুস্রাবকালীন ছুটির ব্যবস্থা করতে পারে, তবে আমরা পারব না কেন? আর তাদের উদাহরণই বা লাগবে কেন? পৃথিবীতে একটি মাত্র দেশেও যদি এরকম ছুটির ব্যবস্থা না থাকে তারপরও বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা ও সংবিধান আমলে নিলে এই দেশে এরকম ছুটির ব্যবস্থা থাকা উচিৎ। বাংলাদেশই বিশ্বকে পথ দেখাবে– এমনটাই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে এই ছুটির বিধান থাকলেও বাংলাদেশে নেই।
মাসে তিনটি দিন ছুটিতে পোশাকশিল্পের কোনো ক্ষতি হবে না। উৎপাদনশীলতা বরং বাড়বে। কারণ নারী মাসিকের সময়কালীন অস্বস্তিকর অবস্থা সামলে বাকি সময়ও ঠিকভাবে কাজ করতে পারেন না। কিন্তু যদি মাসিকের জন্য ছুটির ব্যবস্থা করা হয় তবে মাসের বাকি সময়টা খুবই স্বস্তি নিয়ে কাজ করতে পারবেন তারা। কর্মস্থলে একটা সুষ্ঠু কর্মপরিবেশ তৈরি করা সম্ভব হবে, প্রাণের সঞ্চার হবে। প্রতি মাসের অস্বস্তি আর অস্বাস্থ্যকর অবস্থা দীর্ঘমেয়াদে নারীর কর্মক্ষমতা হ্রাস করে। কিন্তু যদি প্রয়োজনীয় ছুটি পর্যাপ্ত থাকে তবে নারীর কর্মক্ষমতা দীর্ঘদিন পর্যন্ত সচল রাখা সম্ভব হবে। আরেকটা ব্যাপার হলো প্রজনন স্বাস্থ্য৷ রক্তঃস্রাবের সাথে এটি অঙ্গাঙ্গীভাবে সম্পৃক্ত। সুস্থ, সুন্দর, আরামদায়ক, মনোরম ও নিরাপদ পরিবেশে মাসিকের সময়টা অতিবাহিত করতে পারলে নারীর প্রজনন স্বাস্থ্যও সুন্দর ও স্বাভাবিক থাকবে। এতে স্বাস্থ্যবান সন্তান জন্ম দিতে নারীরা সক্ষম হবেন, আমাদের আগামী প্রজন্ম হবে সমৃদ্ধ। পরিস্থিতি বর্তমান সময়ের চেয়ে উন্নত হবে। সামষ্টিকভাবে দেশ ও জনগণ লাভবান হবে৷
আইন করে একদিনের সাপ্তাহিক বন্ধ দুই দিন করতে পারি, আরও কত আইনই তো করি। জনসংখ্যার অর্ধেকই হচ্ছে নারী। নারীদের বিরাট অংশ নানান সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত। কর্মজীবী নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপর জুলুম করার অধিকার কি সমাজের আছে? কিন্তু সমাজ ওই নারীর সাথে অবিচার করে রীতিমতো আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে। নারীর জন্য কর্মজীবী হওয়াটাই যেন একটা অপরাধ! না পারছি নারীর স্বাস্থ্যের ঠিকঠাক খেয়াল রাখতে, না পারছি একটা সুন্দর ও স্বাস্থ্যবান ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পাবার ব্যবস্থা করতে?
নারীর স্বাস্থ্যের তো বারোটা বাজাচ্ছি, পাশাপাশি পরবর্তী প্রজন্মেরও অগ্রীম ক্ষতি করে দিচ্ছি আমরা। যে মায়ের গর্ভে সন্তান আসবে অত্যাচারটা তো ওই মাকেই করছি। আর এমন একটা বিষয়ে অবিরত অত্যাচার চলছে যেটার সাথে প্রজনন স্বাস্থ্য সরাসরি জড়িত। সময় অনেক হয়েছে, সত্যি বলতে অনেক দেরিই হয়ে গিয়েছে। তাই একটা বিধান করে ফেলা দরকার। মাসে তিনটা দিন নারীর জন্য ছুটির ব্যবস্থা থাকা উচিৎ। সব ক্ষেত্রেই থাকা উচিৎ। কোনো উপ-আইন, প্রবিধান বা নীতিমালা না; সংসদেরই আইন করে দেওয়া উচিৎ। এই বিধান ভঙ্গ করলে কোনো নারীকে সরাসরি এসে তার ক্ষয়সাধন বা ক্ষতিগ্রস্থতার প্রমাণ দিতে হবে না। কারণ এই বিধানের ব্যত্যয়ই নারীর জন্য, তথা সারা দেশের মানবসম্পদের জন্য ক্ষতিকর, চরম হানিকর। এই বিধান ভঙ্গ করলে কর্মস্থলভেদে শাস্তির বিধান থাকতে হবে। শাস্তি শুধু কারাদণ্ডই নয়; জরিমানা, ভৎসনা, বার বার করলে অনুমোদন বাতিল ইত্যাদি বিধান থাকা চাই। সাধারণ ক্ষেত্রে ছয় দিন থেকে ছয় মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা আর্থিক জরিমানা (প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির সামাজিক অবস্থান বিবেচনায় অর্থের পরিমাণ বিচারক ঠিক করবেন) অথবা উভয় শাস্তির বিধান রাখা যেতে পারে।
নারীর জন্য যদি সুষ্ঠু কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে চাই। কর্মস্থলকে যদি নারীর জন্য বিরক্তি-অনুশোচনা আর আপদের কারণ করতে না চাই, নারীর কর্মদক্ষতা ও ক্ষমতা যদি বাড়াতে চাই ও গতিশীল রাখতে চাই এবং সর্বোপরি সুস্থ-সবল ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়তে চাই তবে প্রত্যেক কর্মজীবী নারীর নিজ কর্মস্থলে মাসিক ছুটি ন্যায্যভাবেই প্রাপ্ত হবার কথা। এটা তাদের প্রাপ্য, হক, অধিকার; কোনো দয়ার দান, ভিক্ষা বা করুণা নয়। এই ছুটি কোনো উচ্চভিলাষ না বরং নিজেদের অস্তিত্ব, শিকড় যদি আঁকড়ে ধরতে চাই তবে এমন বিধান শুধু প্রয়োজনই না, এটা না করতে পারলে জাতির সাথে সুবিচার করা হয় না। অবিচারের যে ধারা প্রবাহমান সেই ধারাই অব্যাহত থাকবে।
সংবিধান নামক যেই পবিত্র চুক্তিটি রাষ্ট্রের সাথে জনগণের আছে যদি কেবল নারীর জন্য মাসিক ছুটির বিধান করতে পারি তবেই সেই চুক্তির সাথে সামাঞ্জস্যপূর্ণ একটা কাজ হবে৷ অর্থাৎ সংবিধানের মূল্যবোধকে যদি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি ও মানি তবে অবশ্যই নারীর জন্য মাসিক ছুটির ব্যবস্থা করব আমরা। নারীর জন্য মাসিক ছুটির বিধান না রাখা অসাংবিধানিক বৈকি? সংবিধানের চেতনাকে যদি সত্যিকার অর্থেই হৃদয়ে ঠাঁই দেই তবেই বুঝতে পারব যে ন্যায়সঙ্গত ও যৌক্তিকভাবে নারীরা এই ছুটি পাবার অধিকারী।