বেনজীর যখন ক্ষমতার অপব্যবহার করে অর্থ-সম্পদ বানাচ্ছিলেন, তখন সরকার তাকে একের পর এক পুরস্কারে ভূষিত করছিল। ‘সেরা করদাতা’ ও ‘শুদ্ধাচার পুরস্কার’ ছাড়াও বেনজীরকে ২০১১ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে মোট ৫ বার পুলিশ বাহিনীর সর্বোচ্চ পদক 'বাংলাদেশ পুলিশ মেডেল' (বিপিএম) দেয়া হয়।
Published : 02 Jun 2024, 05:01 PM
বাংলাভাষায় একটি জনপ্রিয় প্রবাদ হলো ‘আগে দর্শনধারী পরে গুণবিচারী’। র্যাব ও পুলিশের সাবেক প্রধান বেনজীর আহমেদ ছিলেন তেমন দর্শনধারী একজন ব্যক্তি। স্মার্ট, সুদর্শন। কথাও বলেন সুন্দর করে গুছিয়ে। যতদিন পদে ছিলেন, ততদিন তার ‘গুণ’ নিয়েও কোনো গুঞ্জন বা প্রশ্ন ওঠেনি। এই নম্র-ভদ্র স্বভাবের ব্যক্তিটি পুলিশ প্রধান হিসেবে অত্যন্ত দাপটের সঙ্গেই তার দায়িত্ব পালন করেছেন। অবসর গ্রহণের দুই বছরের মাথায় সেই লাজুক-রাঙা সুন্দর চেহারার ‘হিরো’ মানুষটি আকস্মিকই ভিলেন হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অবিশ্বাস্য সব কাহিনি প্রকাশিত হওয়ার পর আদালত তার সব ব্যাংক একাউন্ট ‘ফ্রিজ’ ও সম্পত্তি ক্রোকের নির্দেশ জারি করেছে। আদালতের এই তোলপাড় করা নির্দেশের পর বেনজীরকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
হ্যাঁ, শত শত কোটি টাকার সম্পদ বানানোর চমকের পর তিনি আবারও চমক দেখিয়েছেন। একটি টেলিভিশন জানিয়েছে, সম্পত্তি জব্দের নির্দেশের আগেই সব বেচে দিয়ে গত ৪ মে সিঙ্গাপুরের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন তিনি। যাওয়ার আগেই নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা ব্যাংক আকাউন্ট থেকে তুলে নিয়েছেন টাকা!
বেনজীরের সম্পত্তি বানানো এবং সকল ব্যাংক একাউন্ট থেকে টাকা তুলে নিয়ে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার ঘটনাটি বর্তমানে টক অফ দ্য কান্ট্রি। সকলের বিস্ময়: তিনি এত সম্পত্তি বানালেন কীভাবে? আপিল বিভাগের সদ্য বিদায়ী বিচারপতি মুহাম্মদ আবদুল হাফিজ বিচারিক জীবনের শেষ কর্মদিবসে বিদায়ী সংবর্ধনা-সভায় বেনজীরের সম্পত্তি বানানোর দিক ইঙ্গিত করে বলেন: ‘একজন বেতনভোগী কর্মকর্তা-কর্মচারী কীভাবে কোটি কোটি এমনকি শত কোটি টাকার মালিক হন তা দেশবাসীকে হতবাক করে। তাই এগুলোকে রোধ করতে রাষ্ট্রকেই দায়িত্ব নিতে হবে।’
মহামান্য বিচারপতি যা বলেছেন, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমাদের দেশে যা হওয়ার কথা, যার যা করার কথা তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয় না। এই যেমন বেনজীর আহমেদ যখন আইজিপি হিসেবে একজন ‘সেরা করদাতা’ হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছিলেন, তখন সবাই বাহবা দিয়েছিলেন। ২০২১ সালে তাকে সেরা করদাতা নির্বাচিত হওয়ার সময়েই তিনি ও তার পরিবার ১৩৮ একরেরও বেশি জমির মালিক ছিলেন। অথচ তার সম্পদ ও আয় নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান প্রশ্ন তোলেনি। কেউ কোনো অনুসন্ধানও করেনি।
তিনি ১১২ একর জমি কিনেছেন পুলিশ ও র্যাব প্রধান থাকাকালে। অথচ কোনো সরকারি কর্মকর্তা যদি জমি কেনে, তাহলে তা কর্তৃপক্ষকে অবহিত করার নিয়ম আছে। বেনজীর সাহেব সেই নিয়ম মানেননি। সংবাদপত্রে খবর বেরুচ্ছে যে, তিনি সেই সময়, পুলিশ প্রধানের পদকে ব্যবহার করে অধস্তনদের দিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের জমি জোর করে লিখে নিয়েছেন। সেই সময় অপ্রতিহত ক্ষমতার অধিকারী বেনজীরের ভয়ে সবাই চুপ থেকেছেন অথবা সব কিছু চেপে গেছেন।
চাকরিতে থাকাকালে তিনি নীতি-নৈতিকতা-বিষয়ক পুরস্কারও জিতেছেন। বেনজীর যখন পুলিশ প্রধান ছিলেন, তখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ তাকে ২০২০-২১ সালে ‘শুদ্ধাচার পুরস্কার’ দেয়। দুর্নীতি দমন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, তিনি ও তার পরিবার সেই সময় অর্থাৎ ২০২০ ও ২০২১ সালে প্রায় ৮৭ দশমিক ৯ একর জমি কিনেছিলেন।
বেনজীর যখন ক্ষমতার অপব্যবহার করে অর্থ-সম্পদ বানাচ্ছিলেন, তখন সরকার তাকে একের পর এক পুরস্কারে ভূষিত করছিল। ‘সেরা করদাতা’ ও ‘শুদ্ধাচার পুরস্কার’ ছাড়াও বেনজীরকে ২০১১ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে মোট ৫ বার পুলিশ বাহিনীর সর্বোচ্চ পদক 'বাংলাদেশ পুলিশ মেডেল' (বিপিএম) দেয়া হয়।
সম্পত্তি বানানোর ব্যাপারে বেনজীর কেবল সরকারেরই আনুকূল্যই পাননি, দেশের বড়লোক বা তথাকথিত ভদ্রলোকেরাও তাকে ‘খ্রিস্টের সম্মান’ দিয়েছেন। আমাদের দেশে ধনীদের আড্ডা-বিনোদনের জন্য কিছু ক্লাব আছে। যেমন-ঢাকা ক্লাব, গুলশান ক্লাব, বনানী ক্লাব, উত্তরা ক্লাব, বোট ক্লাব ইত্যাদি। বেনজীর অভিজাত সব ক্লাবেরই সদস্য ছিলেন। তার পদ-পদবির-ক্ষমতার কারণে ক্লাবগুলোই তাকে সদস্য বানিয়েছে। আমাদের সমাজের অভিজাত ব্যক্তিদের এই ক্লাবগুলোতে নানা অপকর্ম হয়। বিপুল পরিমাণ টাকা নয়-ছয় হয়। দেশের পুলিশ প্রধানকে যদি ক্লাবের সদস্য বানানো যায়, তাহলে তাদের সাত খুন মাপ! এই মানসিকতা থেকেই ক্লাবগুলো দেশের ক্ষমতাবান পেশাজীবীদের ক্লাবের সদস্য বানায়। যেমন বানিয়েছিলে বেনজীরকে।
তবে বেনজীরের যে পরিমাণ সম্পত্তির বহর দেখা যাচ্ছে, তাতে আবারও মনে প্রশ্ন জাগছে, তা হলো, একজন মানুষের আসলে কত টাকা প্রয়োজন? কত জমি প্রয়োজন? এক কোটি, দশ কোটি, একশ কোটি, হাজার কোটি? নাকি অফুরন্ত?
আজ থেকে বহু বছর আগে বিশ্বখ্যাত রুশ সাহিত্যিক লিও টলস্টয় ‘হাউ মাচ ল্যান্ড ডাজ এ ম্যান রিকয়্যার’ শীর্ষক এক প্রসিদ্ধ গল্প লিখেছিলেন। গল্পটি এ রকম, এক দিন এক দরিদ্র মানুষ এসে রাশিয়ার সম্রাটের কাছে বললেন, তার কোনো জমিজমা বা খেটে খাওয়ার মতো কোনো সম্পদ নেই। তিনি চলতে পারছেন না। তখন সম্রাট তাকে বিশাল এক প্রান্তরে নিয়ে গিয়ে বললেন, সামনে যা জমি আছে, সব আমার। তুমি এই সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দৌড় দিয়ে যতটুকু জমির চারধারে ঘুরে আসতে পারবে, ঠিক ততটুকু জমি তোমার হবে।
দরিদ্র মানুষটি অমনি দৌড় শুরু করল। যত দূর যাবে, সে তত জমির মালিক হবে। তার অনেক অনেক জমি চাই। সে দৌড়াচ্ছে আর ভাবছে, আর একটু, আর একটু। আর একটু হলে বেশি চাষাবাদের জমি পাওয়া যাবে, অন্যকে বর্গা দিয়ে নিজে বসে খেতে পারবে। তারপর আবার একটু দৌড় দিয়ে ভাবে, ‘আরও একটু বেশি জমি থাকলে বাড়িটা পাকা করা যাবে, সম্রাট তো বলেছে, যতটুকু জমি সূর্যাস্ত পর্যন্ত দৌড়ে সীমানা দিয়ে ঘুরে আসতে পারব, ততটুকুই আমার। ওঃ বড্ড ক্লান্ত হয়েছি। একটু জিরিয়ে নিই। সামান্য জিরিয়ে নেওয়ার পরই সে ভাবে আজ আমার বিরতি নেওয়ার দিন নয়, আজ আমার বিজয়ের দিন, যতটা খাটব, ততটা পাব, সুতরাং দে দৌড়, আজ কোনো বিরতি নেই।’ সে দৌড়িয়েই চলছে। দৌড় দিয়ে সে জমিগুলোর অনেক ভেতরে প্রবেশ করেছে, যেখান থেকে সম্রাটের রাজ্য দেখাই যায় না। এদিকে সূর্য প্রায় ডুবু ডুবু। এখন তার ফেরার পালা। সে ডানদিকে ঘুরে একটি আয়তক্ষেত্র আঁকার চেষ্টা করল। সূর্য পশ্চিমে আরও হেলে পড়েছে। এবার তার ফিরতে হবে। সে দৌড় দিল। সূর্য ক্রমাগত পশ্চিমে নেমেই আসছে। সে আরও দ্রুত দৌড়াতে শুরু করল। সূর্য পশ্চিম দিগন্ত প্রায় ছুঁই ছুঁই করছে, তার আর সময় নেই, তাকে সম্রাটের প্রাসাদের সীমানায় যেতে হবে। সে আরও জোরে দৌড়াচ্ছে। কিন্তু লোকটি সীমানা প্রাচীরের কাছে এসেই আর টিকে থাকতে পারল না। দড়াম করে পড়ে গেল! বুকের ভেতর থেকে শেষ বাতাসটুকু বেরিয়ে গেল। লোকটি মারা গেল। কিন্তু কী পেল সে? এখানেই পাঠকরা লেখক টলস্টয়কে বলে ঋষি লেখক। আর ঋষি লেখক টলস্টয় তার এ লেখার মধ্য দিয়ে মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, একজন মানুষের প্রকৃতপক্ষে কতটুকু জমি প্রয়োজন?
উল্লিখিত গল্পটি আমরা শিক্ষিত মানুষরা প্রায় সবাই জানি। কিন্তু না, আমরা কারও কাছ থেকে কিছু শিখিনি। শিখেছি কেবল মেরে দেওয়ার, আত্মসাৎ করার শিক্ষা। যার সুযোগ যত বেশি, সে এখানে তত বড় চোর। আমাদের সবখানে ঘুষ লাগে। দুর্নীতি ছাড়া আমাদের প্রশাসন অচল। সমাজ-সংসার সব অচল। আমরা মুখে বড় বড় বুলি উচ্চারণ করি। কিন্তু বাস্তব জীবনে একেকজন অসততার প্রতিমূর্তি। যে যেভাবে পারছি, মেরে, কেটে, আত্মসাৎ করে কেবল ধনসম্পত্তি বাড়ানোর ধান্দা করছি। যে প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তি অত্যন্ত ডাটের সঙ্গে জীবন চালায়, আমরা তার অর্থের উৎস কখনো জিজ্ঞেস করি না। যে কর্মকর্তার স্ত্রী দামি শাড়ি-গহনা পরে, সন্তানদের বিলাসী জীবনে তালিম দেয়, সে নিজেও কখনো এই বিলাসের উৎস জিজ্ঞেস করে না। আমরা দামি বাড়ি-গাড়ি-ফ্ল্যাট-জমির মালিক হই। কিন্তু আয়ের উৎস প্রকাশ করি না। তার দরকারও হয় না! আমাদের ফুটানি চলে অবৈধ আয়ে। কিন্তু এসবের কোনো জবাবদিহি নেই। আমাদের দেশে দামি রেস্তোরাঁয় কারা যান? কারা দামি গাড়ি ব্যবহার করেন? কারা দামি হাসপাতালে চিকিৎসা নেন, কাদের সন্তানরা দামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করেন? কারা কারণে-অকারণে বিদেশ সফর করেন? কারা নামে-বেনামে ফ্ল্যাট-বাড়ির মালিক হন? কারা বিদেশে টাকা পাচার করেন? বিদেশে জমির মালিক হন? তাদের আয়ের উৎস কী? টাকা কোত্থেকে আসে? কে কত টাকা ট্যাক্স দেন? এসব ব্যাপারে আমরা ভীষণ উদার। আমাদের সরকার বাহাদুর আরও উদার। যারা নানা ফিকিরে অবৈধ টাকায় ‘করে-কম্মে’ খাচ্ছেন, সরকার তাদের টুঁটি টিপে ধরা তো দূরের কথা, পারলে ন্যাপকিন টিস্যু এগিয়ে দেয়!
আমাদের দেশে দুর্নীতির বিষবৃক্ষের বৃদ্ধিতে যে বস্তুটি সার হিসেবে কাজ করেছে, তার নাম লোভ। দুই অক্ষরের এই শব্দটি বাংলাদেশের মানুষকে গ্রাস করতে উদ্যত। আমাদের সম্মিলিত লোভাগ্নির কাছে নীতিনৈতিকতা-আদর্শ সব আজ জ্বলে-পুড়ে ছাই। পাওয়া আর পাইয়ে দেওয়ার নেশা, অবৈধ উপায়ে টুপাইস কামানো, আবার অবৈধ টাকার জোরে সেই দুর্নীতির ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়া, এই চক্রে আমাদের জাতীয় জীবন বাঁধা পড়ে গেছে। লোভ-মোহ-প্রলোভনে পড়ে আমরা হিতাহিত জ্ঞান বিসর্জন দিয়ে কেবল টাকার বস্তার দিকে ছুটছি।
কোথাও কোনো রক্ষাকবচ নেই। যাদের ন্যায় প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব, তারা নিজেরাই অন্যায়ের সমুদ্রে নিমজ্জিত। লোভের পরিণাম বিষয়ে ধর্মগ্রন্থে এবং প্রবচনে সেই আদিকাল থেকে বিভিন্ন সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়ে আসছে। তবু লোভ দুর্মর!