রাজভাষায় আলোকপ্রাপ্ত মানুষ গরু অপেক্ষা ছাগলের সঙ্গে নিজেকে অধিক সন্নিবিষ্ট জ্ঞান করে বলেই আপন এবং অপরের সন্তান-সন্ততিদের ‘কিড’ বলে সম্বোধন করে। অভিধানে স্পষ্ট লেখা আছে, কিড শব্দের আক্ষরিক অর্থ ছাগবৎস। এক্ষেত্রে মনুষ্য-ছাগ মিলে-মিশে একাকার।
Published : 20 Jun 2024, 04:56 PM
ছাগল একটি নিরীহ প্রাণী। গল্প আছে; একজন অতি আধুনিকা মা তার শিশুপুত্রকে কিন্ডারগার্টেন স্কুলে প্লে গ্রুপে ভর্তি করে দিয়ে এসেছেন। ক্লাসটিচার শিশুটিকে যতই জিজ্ঞেস করেন তার পিতার নাম কী, সে উত্তর দেয়, ‘ড্যাডি’। অবশেষে মরিয়া হয়ে টিচার ‘তোমার মা তোমার বাবাকে কী বলে ডাকেন?’ জিজ্ঞেস করতেই সে ঝটপট জবাব দিল, ‘ছাগল’। গল্পটির মধ্যে যথেষ্ট হাসির খোরাক থাকলেও একটা নির্মম সত্যও আছে বটে। জগৎ-সংসারে এমন কিছু লোক আছেন, যারা এতটাই নিরীহ প্রকৃতির যে তাদের আপনজন তাদের স্নেহবশত ‘ছাগল’ আর স্নেহের আধিক্য হলে ‘রামছাগল’ বলে অভিহিত করতে কার্পণ্য করেন না।
পক্ষকাল ধরে আমাদের দেশে আলোচিত প্রসঙ্গের নাম হচ্ছে: ছাগল। ঈদ চলে গেছে। কিন্তু কোরবানির পশুর হাটে ভাইরাল হওয়া ১৫ লাখ টাকার ছাগল এখনো আলোচনায় রয়ে গেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ওই ছাগল ও তার ক্রেতা ইফাত নামের এক তরুণকে নিয়ে চলছে বিস্তর আলোচনা। প্রথমে ইফাত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তা মতিউর রহমানের ছেলে বলে নানাজন দাবি করে। তবে সরকারি এই কর্মকর্তা বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।
ওদিকে ছাগলের মালিক বলছে, আলোচিত ছাগলটি এখনো বিক্রিই হয় নাই, ইফাত নামে এক যুবক ১ লাখ টাকা বায়না দিয়েছে মাত্র। বাকি টাকা পরিশোধ করে নাই, ছাগলও নেয় নাই। এখন আলোচনা চলছে, ছাগল ক্রেতা ইফাত আসলে কে? তার বাবা যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তা মতিউর রহমান— এটা কে রটালো? কেন রটালো? মতিউর রহমানই বা এত দিন কেন মুখ বুজে রইলেন? যে ছাগল নিয়ে এত কাণ্ড, তার পরিণতিই বা কী হবে?
স্বাধীনতার পর কোনো ছাগল নিয়ে এমন কাণ্ড আর ঘটেছে বলে জানা যায় না। এটি যেন-তেন ছাগল নয়। এর ওজন ১৭৫ কেজি, উচ্চতা ৬২ ইঞ্চি। সচরাচর দেখা যায় না এত বড় ছাগল। এবারের কোরবানির ঈদে ঢাকার সাদিক এগ্রো এই ছাগলটি এনে দাম হেঁকেছিল ১৫ লাখ টাকা। এত দামের পেছনে তাদের ব্যাখ্যা ছিল উন্নত জাত ও বংশ মর্যাদা।
১২ লাখ টাকায় ছাগলটি কিনে আলোচিত হন মুশফিকুর রহমান ইফাত, একইসঙ্গে ওই দামী ছাগলটি। ফেইসবুকে ভাইরাল হয় ইফাতের একটি ভিডিওক্লিপ। ভিডিওতে তাকে হাসিমুখে বলতে শোনা যায়, ‘স্বপ্ন ছিল এরকম একটা খাসির। এরকম খাসি আগে কখনও দেখিনি। এই প্রথম দেখা। এটা আমার হবে জানা ছিল না। আল্লাহ নসিবে রাখছে তাই হইছে।’
সেই ভিডিওতেই তিনি জানিয়েছিলেন, এখনই ছাগলটি বাড়ি নিচ্ছেন না তিনি। থাকবে সাদিক এগ্রোর খামারে। আগামী ১১ জুন বাড়িতে নিয়ে যাবেন তিনি।
কিন্তু এর মধ্যে সেই ছাগলের রশি ধরে টান পড়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তা মতিউর রহমানের। ইফাত তার ছেলে বলে ফেইসবুকে আলোচনা ছড়িয়ে পড়ে। আর এই ছাগলের সঙ্গে ইফাতের নানা ব্র্যান্ডের গাড়ির ছবিও আসে সামনে। তা ধরে মতিউর রহমানের সম্পদ নিয়ে ওঠে প্রশ্ন।
তুমুল আলোচনার মধ্যে মতিউর সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, ইফাত তার ছেলে নন। এমনকি আত্মীয় বা পরিচিতও নন। এদিকে ইফাতেরও দেখা পাচ্ছে না সাদিক এগ্রো। ১৭ জুন কোরবানির ঈদ হলেও ছাগলটি আর নেননি তিনি। এতে করে ‘উচ্চ বংশীয়’ ও এখন পর্যন্ত দেশে সবচেয়ে দামী ছাগলটির ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে।
কী এক অজ্ঞাত কারণে ছাগল সম্পর্কে আমাদের রয়েছে একটা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। ছাগলের দোষ ধরতেই আমাদের সমাজ যেন বেশি তৎপর। ছাগলের নামে সবচেয়ে বড় কলঙ্ক সম্ভবত তাকে সর্বভুক হিসেবে গণ্য করা। অথচ এটা সর্বৈব মিথ্যা। ছাগল তৃণভোজী, সে চিকেন, মাটন, বিফ, পর্ক, মাছ, ডিম প্রভৃতির সামান্য পরিমাণও স্পর্শ করে না, খাওয়া তো দূরের কথা। বিপাকে পড়ে কদাচিৎ সে প্লাস্টিকের প্যাকেট, ঈদসংখ্যা ম্যাগাজিন, হাওয়াই চটির স্ট্র্যাপ, শাড়ির আঁচল, শিশুর ডায়াপার বা বাজারের ফর্দের মতো বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দ্রব্য গলাধঃকরণ করে থাকে, সে কথা সত্য। কিন্তু সাধারণভাবে তৃণ ও কাঁঠালপাতার প্রতিই তার মনোযোগ বেশি ন্যস্ত থাকে। এ বিষয়ে সে মানুষের মতো খুঁতখুঁতে নয়। যেসব মানুষ আগ্রহ নিয়ে কাঁঠাল খায়, তারাও হয় খাজা নতুবা রসালো— এই দুইয়ের একটিকেই অধিকতর পছন্দ করে। ছাগল কাঁঠালপাতা পাওয়ামাত্র উদরস্থ করে, সেটা খাজা না রসালো, তা পরীক্ষা করবার প্রয়োজন বোধ করে না।
শুধু এই কারণেই ছাগলকে সর্বভুক বলে গালি দেওয়া নিতান্তই অন্যায্য। ছাগলকে আমরা পশু বললেও তারা মদ-গাঁজা-ভাং-ইয়াবা খায় না। এখন পর্যন্ত কোনো ছাগলকে সমাজবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হতে দেখা যায়নি। আপাতদৃষ্টিতে ছাগলের দুটি দোষ দেখা যায়। ছাগল ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে বেশি। আর তাদের নিজস্ব স্যানিটেশন ব্যবস্থা না থাকায় যত্রতত্র মল-মূত্র ত্যাগ করে পরিবেশ দূষিত করে। আসলে দোষে-গুণে ছাগল। কোনো ছাগলই ভুলের ঊর্ধ্বে নয়।
হিন্দুরা গরুকে প্রয়োজনের অধিক মাথায় তুলে নৃত্য করে, অথচ ছাগলকে গালি দেয়। অথচ ছাগল গরু অপেক্ষা অধিক সংস্কৃত প্রাণী। তৃণ, কাঁঠালপাতা, পালং চারা, প্লাস্টিক, দৈনিক পত্রিকার অংশ, সে যা-ই ভক্ষণ করুক, পশ্চাদ্দেশ থেকে হজমোলার গুলির মতো সমান মাপের ট্যাবলেট নিষ্ক্রমণ করে থাকে। ছাগলের নাদি অনাদিকাল থেকেই প্রযুক্তির এক অসীম বিস্ময়। গরু হাজার জীবনেও এইরূপ গোবর ক্যাপসুল প্রদানে অক্ষম। সে ক্ষমতা যদি তার থাকত তবে গ্রামের বধূরা কষ্ট করে ঘরের প্রাচীরে ঘুঁটে বানাত না।
ছাগলের প্রতি এই বিমাতৃসুলভ আচরণ শুরু হয় প্রাথমিক বাংলা পাঠাভ্যাসের শুরু থেকেই। প্রথম পৃষ্ঠাতেই শিশুদের শিক্ষাদান করা হয়, ‘অ-এ অজগরটি আসছে তেড়ে’ বলে। অথচ আমরা বাস্তব জীবনে কয়জন অজগর দেখবার সুযোগ পেয়েছি? যাদের অজগর কী, সে সম্পর্কে কোনো ধারণাই নাই, তাদেরকে প্রথম থেকে এমন কুশিক্ষা প্রদানের জন্যই ভবিষ্যতে তারা রাজনৈতিক নেতা বনে অজগরের ন্যায় সর্পিল হয়ে জনগণের প্রতি ধাবমান হয়। অথবা সরকারি কর্মকর্তা হয়ে প্রকল্পের টাকা অজগরের মতো বিশাল ক্ষুধা নিয়ে গিলে ফেলে। অজগরের অর্ধেক হলো অজ অর্থাৎ ছাগ বা ছাগল, যা বহু শিশুর কাছে অতিপরিচিত প্রাণী, যা ক্ষুদ্রতর শব্দ, যার উচ্চারণ অজগর অপেক্ষা সহজতর। অজকে উপেক্ষা করে অজগরকে প্রাধান্য দেওয়া বাংলা শিক্ষার এক চরম ভুল, এটা অস্বীকার করলে বলতে হবে বঙ্গবাসীর চামড়া পুরু।
বাংলা ছেড়ে ইংরেজিতে দৃষ্টিপাত করা যাক। রাজভাষায় আলোকপ্রাপ্ত মানুষ গরু অপেক্ষা ছাগলের সঙ্গে নিজেকে অধিক সন্নিবিষ্ট জ্ঞান করে বলেই আপন এবং অপরের সন্তান-সন্ততিদের ‘কিড’ বলে সম্বোধন করে। অভিধানে স্পষ্ট লেখা আছে, কিড শব্দের আক্ষরিক অর্থ ছাগবৎস। এক্ষেত্রে মনুষ্য-ছাগ মিলে-মিশে একাকার। বালক-বালিকাদের ‘কাফ’ জাতীয় সম্বোধন এখনো পর্যন্ত দেখা যায়নি।
ছাগলের বাচ্চা হয় সাধারণত দুটি, কখনোবা তিনটিও হয়। সে ক্ষেত্রে দুটি ছাগশিশু যখন মায়ের দুই স্তনের বোঁটায় মুখ লাগিয়ে দুধ পান করতে থাকে, তখন তৃতীয়টি কেবলই লাফায়। আর এ থেকেই বাংলা ভাষায় ‘ছাগলের তিন নম্বর ছানাটির মতো লাফানো’ উপমাটির উৎপত্তি। যা আমরা হামেশাই করে থাকি।
গরুর দুধের চেয়ে ছাগলের দুধকে অধিক উপকারী জ্ঞান করেছিলেন মহাত্মা গান্ধী, রোজ সকালে এক ঘটি ছাগদুগ্ধ পান না করলে তিনি সত্যাগ্রহে মনোনিবেশ করতে পারতেন না। ছাগের প্রতি বিরূপতার কারণেই বুঝি সত্যের প্রতি আগ্রহ আজ স্তিমিত, যৎপরোনাস্তি ভুল ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তথ্য দ্বারা জনগণকে বিভ্রান্ত করার কাজে ব্যস্ত আজ কর্মকর্তা ও নেতৃবৃন্দ, তা সচেতন ব্যক্তিমাত্রই স্বীকার করবেন।
পুনশ্চ: যে ছেলে ১২ লাখ টাকায় ছাগল কিনে, ছাগলের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করে আলোড়ন তুলেছেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচিত সেই ছেলেকে দ্রুত খুঁজে বের করে জিজ্ঞাসাবাদ করা। তার পিতৃপরিচয় বের করা। এটা সম্ভব না হলে সরাসরি আলোচিত ছাগলটিকে রিমান্ডে নেওয়া। তাকে জিজ্ঞেস করা, হে মহান ছাগল, আমরা জানি তুমি আর যাই কর, কখনো মিথ্যা বলো না। এবার সত্য করে বলো দেখি, তুমি আসলে কার? ইফাত নামে ছেলেটিরই বা পিতার নাম কী?
প্রবলকে না হোক, নিরীহকে রিমান্ডে নিয়ে সত্য বের করার কেরামতি নিশ্চয়ই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জানা আছে। সেই কেরামতিটা অন্তত এবার তারা দেখাক! ছাগল নিয়ে জটিলতা যে আর আমাদের প্রাণে সয় না!