ইউক্রেইন সংকট আমাদের নৈতিক অবস্থান নিয়ে এমন উদাহরণ তৈরি করল যে, কোটি মানুষের বিপন্নতার প্রতিবাদে আমরা দাঁড়াতে পারিনি। মানবিক বোধ আমাদের কৌশলগত অবস্থানের উর্ধ্বে উঠতে পারেনি।
Published : 20 Jun 2024, 10:00 AM
ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের বর্বরতা নিয়মিতই হৃদয়বিদারক দৃশ্য সামনে আনছে, মানুষের মনকে নাড়িয়ে দিচ্ছে। যার প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বজুড়ে যুদ্ধবিরোধী মানুষ রাস্তায় নেমেছে, ঢাকায়ও প্রতিবাদ হচ্ছে। এসব তৎপরতা হয়তো যুদ্ধ থামিয়ে দিতে পারছে না, কিন্তু নিশ্চিতভাবেই পশ্চিমাদের আরও নগ্ন হওয়ার চাপে ফেলেছে।
বাংলাদেশের মানুষ বরাবরই সামরিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী আক্রান্ত হলে অর্থনীতি কিংবা নিরাপত্তার সাত-সতেরো চিন্তা না করেই তাদের আশ্রয়ের দাবিতে মিছিল করেছে। আফগানিস্তানে, ইরাকে যুদ্ধের বিরোধিতায় এদেশের প্রতিটি শহরই শান্তির সপক্ষে জনস্রোত দেখেছে।
দীর্ঘদিন ধরে চলা ফিলিস্তিন সংকটে বছরের পর বছর পথে নামছে এদেশের মানুষ। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ডান, বাম, মধ্যপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো কর্মসূচি পালন করছে। সম্প্রতি সিপিবির নেতৃত্বে সারাদেশে সংহতি সমাবেশ করেছে বাম গণতান্ত্রিক জোট। সংস্কৃতি কর্মীরাও প্রতিবাদী আয়োজন করছে। মানুষের জন্য মানুষের এই চৈতন্য আমাদের আশা দেখায়।
গেল শতাব্দীতে পারমাণবিক যুদ্ধের ক্ষত নিয়ে কবি ভাস্কর চক্রবর্তী লিখেছিলেন, “ওগো একুশ শতাব্দীর মিষ্টি সুন্দর মানুষ। তোমরা ভুলে যেয়ো, আমাদের কথা। আমরা ছিলাম রুগ্ন আর স্বার্থপর। আমরা ছিলাম হিংস্র আর বিষণ্ন।” কিন্তু একুশ শতকও যুদ্ধের বিপন্নতা থেকে রক্ষা পায়নি। এই শতকের গোড়া থেকেই একেকটি শহরের ভেঙে পড়া আমরা দেখছি।
মধ্যপ্রাচ্যে সাধারণ মানুষকে যখন বিনা অপরাধে জীবন দিতে হচ্ছে, তখন যুদ্ধের ক্ষত দীর্ঘ হচ্ছে ইউরোপের পূর্ব প্রান্তেও। সোয়া দুই বছর ধরে চলা ইউক্রেইন যুদ্ধে হাজার হাজার বেসামরিক মানুষ প্রাণ দিয়েছে। আহত হয়ে, ঘরবাড়ি হারিয়ে শরণার্থী হয়ে বিপন্নতার গল্পে নাম লিখিয়েছে লাখ লাখ সাধারণ মানুষ। ইউক্রেইন যুদ্ধের আগে-পরে সেখানকার বাংলাদেশিদের নিয়ে আমি ধারাবাহিকভাবে প্রতিবেদন তৈরি করেছি। রাশিয়ার হামলা জীবন নিয়ে তাদের চিন্তা-ভাবনাকে মুহুর্তেই তছনছ করে দিয়েছিল। অন্যান্য দেশের নাগরিকরাও একইভাবে অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হয়েছে।
পশ্চিমা দেশগুলোতে ইউক্রেনে হামলার বিরুদ্ধে মানুষ যেমন প্রতিবাদ করেছে, তেমনি ফিলিস্তিনের জন্যও বিক্ষোভ হয়েছে। অথচ আমাদের যুদ্ধবিরোধী অবস্থান একেবারে উল্টো। আশ্চর্যজনকভাবে আমরা ইউক্রেইন ইস্যুতে নীরব ছিলাম।
ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন শুরুর পর এর বিরুদ্ধে বাংলাদেশে প্রথম প্রতিবাদ হয়েছিল ঢাকার কারওয়ান বাজারে। সংবাদ প্রতিবেদন করতে গিয়ে আমি দেখেছিলাম, এমন ব্যস্ত এলাকাতেও ‘যুদ্ধের বিরুদ্ধে মানুষ’ ব্যানার হাতে দশজন মানুষও তাতে অংশ নেননি। এর বাইরে আর দুটি যুদ্ধবিরোধী কর্মসূচি ছাড়া কোন তৎপরতা চোখে পড়েনি। একুশে বইমেলা ও পল্টনের কর্মসূচিতেও হাতেগোনা কিছু মানুষ এসেছিলেন। বাংলাদেশের প্রচারমাধ্যমেও এসব প্রতিবাদ গুরুত্ব পায়নি।
দুটো যুদ্ধের ভয়াবহতাকে কোনভাবেই মেলানো যায় না। এরপরও একটা প্রশ্ন এসে যায়। আমরা কি ইউক্রেইনীয়দের পাশেও দাঁড়াতে পারতাম? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে এদেশে ‘সরব হয়ে ওঠার রাজনীতির’ দিকে তাকালে। জনসমর্থন যেমনই থাক, এখানে বিভিন্ন ইস্যুতে মূলত সোচ্চার থাকে ধর্মীয় ও বাম রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত গোষ্ঠীগুলো। এই দুটি পক্ষই পশ্চিমাদের শত্রু মনে করে। পশ্চিমা আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে রাশিয়া তাদের ভরসা দিচ্ছে। ফলে হামলাকারী রাশিয়া না হয়ে পশ্চিমা কোন দেশ হলে নিশ্চিতভাবেই আমরা ভিন্ন চিত্র দেখতাম।
তবে এই দুই বলয়ের বাইরেও তো দেশে অনেক গোষ্ঠী সক্রিয় থাকে। তারা কোথায় ছিল? এর চেয়ে অবাক করার মত ব্যাপার ছিল- গণমাধ্যমে কেউ কেউ রাশিয়ার আগ্রাসনকে জায়েজ করার চেষ্টা করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভ্লাদিমির পুতিনের বীরত্ব তুলে ধরতেও দেখা গেছে।
আসলে মানুষ কোন বিষয়ে বিক্ষোভ দেখাবে, সেটি তার একান্ত নিজস্ব বিষয়। একই সঙ্গে কোন ইস্যুতে সমর্থন দেয়া কিংবা চুপ থাকারও সম্পূর্ণ অধিকার তার থাকে। আবার এটিও সত্য যে, এসবের মধ্য দিয়ে সমাজকে পড়া যায়। ইউক্রেইন সংকট আমাদের নৈতিক অবস্থান নিয়ে এমন উদাহরণ তৈরি করল যে, কোটি মানুষের বিপন্নতার প্রতিবাদে আমরা দাঁড়াতে পারিনি। মানবিক বোধ আমাদের কৌশলগত অবস্থানের উর্ধ্বে উঠতে পারেনি।
এই শতাব্দীতে যারা যুদ্ধের ভয়াবহতার শিকার হয়েছে তারা মূলত মুসলিম। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মহড়া ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, ফিলিস্তিনকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। ইউক্রেইন যুদ্ধে আমাদের নীরবতা নিশ্চয়ই এই ধারণা তৈরি করবে যে, অন্যান্য যুদ্ধের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান ছিল মূলত ধর্ম ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। কিন্তু পৃথিবীর দেশে দেশে যারা প্রকৃত অর্থে যুদ্ধবিরোধী অবস্থান দেখিয়ে আসছেন, তারা এসব সমীকরণের চেয়ে মানুষের মূল্যকেই সামনে রেখেছেন। ইরাক যুদ্ধের আগে সংঘাত ঠেকাতে ইতালির রোমে তিন মিলিয়ন মানুষ প্রতিবাদী র্যালি করেছিল, যা মানব ইতিহাসে সবচেয়ে বড় যুদ্ধবিরোধী অবস্থান। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ইসরাইলে সাধারণ মানুষ তাদের যুদ্ধ নীতির বিরুদ্ধে সরব হয়েছে।
আমরা যদি রাশিয়ার দিকে তাকাই, তাহলে দেখব, সীমিত মত প্রকাশের স্বাধীনতার মধ্যেও সেখানে ইউক্রেইন যুদ্ধের বিরুদ্ধে অসংখ্য মানুষ প্রতিবাদে নেমেছে। যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ থামাতে হাজারো মানুষকে আটক করতে বাধ্য হয়েছে রুশ সরকার। এর মানে এই নয় যে, রাশিয়ার সিংহভাগ মানুষ ইউক্রেনে তাদের সরকারের আগ্রাসনের বিরোধী। তবে এটা সত্য যে, সেখানেও যুদ্ধবিরোধী কিছু মানুষ রয়েছে। যারা সমস্ত হিসেব-নিকাশ ভুলে বর্বরতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চান। সব দেশেই যুদ্ধের বিরুদ্ধে এমন সচেতন কিছু মানুষ থাকে। বাংলাদেশে সে ধরণের মানুষ হয়তো লোকচক্ষুর আড়ালেই চলে গেছে- ইউক্রেইন যুদ্ধ তাই প্রমাণ করল।
আমরা এমন এক সময় পার করছি, যখন পরিবেশ বিপর্যয়, খাদ্য নিরাপত্তা, দারিদ্র্য, অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে পৃথিবী ধুঁকছে। বাজার দরের উত্তাপে যুদ্ধের ঝাঁজ রান্নাঘরেও ঢুকে গেছে। নিত্য নতুন অস্ত্র তৈরি ও বিপননের প্রতিযোগিতা চলছে বিশ্বজুড়ে। ভবিষ্যতের জন্য এসব প্রকৃত হুমকি রুখতে হলে আমাদের চাপ অব্যাহত রাখতে হবে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত পৃথিবীকে বাঁচাতে মুসলিম-অমুসলিম, ডান-বাম ভুলে আমাদের প্রতিবাদ জারি রাখতে হবে। নিজের সুবিধামত অবস্থান থেকে প্রতিবাদ করলে তার আর গ্রহণযোগ্যতা থাকে না। আর যুদ্ধ দানবদের রুখতে না পারলে প্রশ্নহীনভাবে সামরিক প্রতিযোগিতা দেখা ছাড়া আমাদের কিছুই করার থাকবে না। এমন বাস্তবতা আমাদের দেখতে হবে, যেখানে মানুষের পেছনে বিনিয়োগ আরও সংকুচিত হবে; পৃথিবীর সব প্রান্তই তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এরপরও যদি আমাদের যুদ্ধবিরোধী অবস্থান হিসেব-নিকাশের ছুতোয় আটকে থাকে, তাহলে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য যে বিপজ্জনক পৃথিবী তৈরি হবে; তার দায় আমাদেরই বয়ে বেড়াতে হবে।