Published : 25 Feb 2020, 02:12 PM
৮৫০ সালের গ্রীষ্মকালে একদল আরব তরুণ একদিন পার্ফেকটুস নামে এক খ্রিস্টান সাধুকে পাকড়াও করলো স্পেনের আন্দালুসিয়া রাজ্যের রাজধানী কর্ডোভার বাজার এলাকা। 'বলো দেখি, কে বড় নবী, তোমাদের যীশু, নাকি আমাদের মুহম্মদ (স.)?' এক কথা দুই কথার পর, যে কোনো কুতর্কে যেমনটা হয়, এক সময় পার্ফেকটুস রাগে ফেটে পড়ে নবীর (স.) বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি কটু বাক্য বলে ফেললেন।
পার্ফেকটুসকে কারারুদ্ধ করা হলো। কাজি মৃত্যুদণ্ড দিতে ইচ্ছুক ছিলেন না, কারণ তিনি শুনেছিলেন, আরব যুবকেরা পার্ফেকটুসকে অযথা প্ররোচিত করেছিল। কিন্তু কদিন জেলে থেকে পার্ফেকটুসের মাথায় আবারও কী যেন গণ্ডগোল হয়ে গেল। তিনি কাজির সামনেও নবী মুহম্মদ (স.) কে অপমান করে বসলেন। উপায়ান্তর না দেখে কাজি পার্ফেকটুসকে কতল করার নির্দেশ দিলেন।
খ্রিস্টানদের চোখে পার্ফেকটুস শহীদ হয়ে গেলেন। তার মৃতদেহ খণ্ড খণ্ড করে একাধিক জায়গায় কবর দেওয়া হলো। একেকটা কবর হয়ে উঠলো শহীদ পার্ফেকটুসের মাজার। কদিন পর ইসহাক নামে আরেক খ্রিস্টান সাধু কাজির দরবারে এসে নবীকে (স.) বিশ্রী ভাষায় অপমান করলো। কাজি প্রথমে দুই একটা চড়-থাপ্পর দিয়ে সাধুকে হুঁসে আনতে চাইলেন। কিন্তু ইসহাক আবারও অপমান করলো নবীকে এবং অনিচ্ছাসত্তেও কাজি তাকেও কতল করার নির্দেশ দিতে বাধ্য হলেন। এভাবে ৮৫০ সালের গ্রীষ্মে প্রায় পঞ্চাশ জন খ্রিস্টান (মুসলমানদের চোখে) 'আত্মঘাতী' হলো অথবা (খ্রিস্টানদের চোখে) 'শহীদ' হলেন।
এই অস্থির অসময়ের আগে খ্রিস্টান, ইহুদি আর মুসলমানেরা মিলেমিশেই ছিল কর্ডোভায়। খ্রিস্টান যাজকেরা ইচ্ছেমতো তাদের ধর্মপ্রচার করতে পারতো। ইসলামের বিপক্ষেও যুক্তি দেখাতে পারতো তারা, শুধু নবীকে অপমান করার উপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। মুসলিম সাম্রাজ্যে নাস্তিক্য, অজ্ঞেয়বাদ বা মুক্তচিন্তাও সহ্য করা হতো, যতক্ষণ তা শালীনতার সীমা অতিক্রম না করছে, কিংবা কাউকে বেহুদা অপমান না করছে। খ্রিস্টান ও ইহুদীরা আরবি ভাষার কবিতা, দর্শন পড়তো, এমনকি সন্তানের আরবি নামও রাখতো। প্রশাসন, কর্মসংস্থান, বিচারব্যবস্থা থেকে শুরু করে কোথাও কোনো রকম বৈষম্য বরদাস্ত করা হতো না। মুসলমান শাসকদের উদারনীতি ও সুশাসনের ফলে, মুসলমান নয়, কিন্তু আরবি ভাষা ও সাহিত্যে আগ্রহী, এমন ব্যক্তিদের সংখ্যা বাড়ছিল। তাদের একটা নামও ছিল 'মোজারাব'।
খ্রিস্টানদের মাথায় হঠাৎ শহীদ হওয়ার পাগলামি ভর করলো কেন? আরব খাবার, আরব পোষাক, আরব সঙ্গীত, আরব নৃত্যে অভ্যস্ত হয়ে আন্দালুসিয়ার খ্রিস্টানেরা ইওরোপীয় এবং খ্রিস্টান ঐতিহ্য প্রায় ভুলতে বসেছিল। খ্রিস্টান নেতাদের লক্ষ্য ছিল, আন্দালুসিয়ায় খ্রিস্টান নবজাগরণের সৃষ্টি করা, যাতে তরুণ সম্প্রদায় এবং মোজারেবেরা নিজেদের ধর্ম ও ঐতিহ্যে পুনপ্রতিষ্ঠিত হয়। যুগে যুগে মৌলবাদীরা ভেবেছে, জঙ্গীবাদ দিয়ে নবজাগরণ সম্ভব।
কর্ডোভার প্রধান গীর্জার বিশপ এবং মোজারাবেরা এই খ্রিস্টান জঙ্গিবাদের নিন্দা করলেন। মুসলমান শাসকেরাও অস্বস্তিতে ছিলেন, কারণ তাদের লক্ষ্য ছিল সুশাসন এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। অন্য ধর্মের সঙ্গে সহাবস্থানের অভিজ্ঞতা মুসলমানদের নতুন নয়। মদীনায় যখন প্রথম মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন সেই মসজিদে ইহুদী ও খ্রিস্টানেরাও প্রার্থনা করতে পারতেন। এ ধরনের পরিবেশে যারা বেড়ে উঠে, তারা পান থেকে চুন খসলেই কাউকে কতল করবে – এমন অসহিষ্ণু এবং অস্থির মানসিকতার লোক হয় না।
এক সময়ে এই জঙ্গিবাদ অবশ্য দুর্বল হয়ে যায়। পরবর্তী ৬০০ বছর আন্দালুসিয়ায় আর বড়সড় কোনো ধর্মীয় বা জাতিগত সংঘাত হয়নি। কিন্তু মাঝে মাঝে পৃথিবীতে ৮৫০ সালের আন্দালুসিয় অস্থির অসময়ের পুনরাবৃত্তি হয়। কুশীলব বদলায়, সমস্যা কিন্তু একই থাকে। ফ্রিজে গোমাংস রেখেছে বলে গুজব রটিয়ে বৃদ্ধ মুসলমানকে টেনেহিঁচড়ে ঘরের বাইরে এনে পরিবার পরিজনের চোখের সামনে নির্মমভাবে খুন করা এমন কী কঠিন একটি হিন্দুপ্রধান দেশে! ফেসবুকে কোনো হিন্দু যুবকের নামে ভুয়া একাউন্ট খুলে সেখানে নবী মুহম্মদকে (স.) কটুবাক্য বলে সেই যুবকের ফাঁসির দাবিতে দাঙ্গা বাঁধানোও এমন কোনো কঠিন কাজ নয় মুসলিম প্রধান একটি দেশে।
সম্প্রতি শরিয়ত বয়াতি নামের এক বাউলকে কারারুদ্ধ করা হয়েছে ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত হানার অপরাধে। অতি সম্প্রতি অভিযোগ উঠেছে আরেক এক মহিলা কবিয়াল রীতা দেওয়ানের বিরুদ্ধে। কবিগানের আসরে ঈশ্বরের ভূমিকা নিয়ে রীতা ঈশ্বরকে বেশ দুকথা শুনিয়ে দিয়েছেন। কোনো এক শ্রোতা রীতার সংলাপগুলো রেকর্ড করে অনলাইনে ভাইরাল করে দিয়েছে। প্রতিপক্ষের কোন বিশেষ সওয়ালের পরিপ্রেক্ষিতে রীতা এই জওয়াব দিয়েছেন তা জানার উপায় নেই।
শিব-কৃষ্ণ, নারী-পুরুষ, ভারত-পাকিস্তান, মাশুক-আশেকের কবির লড়াই বাঙালি মাত্রেই উপভোগ করে আসছে আবহমান কাল ধরে। কিন্তু আগে ফেসবুক, মোবাইল ফোন ছিল না, এখন দেওয়ালের কান আছে! রীতা ইতিমধ্যে তার দুই কিশোরী কন্যাসহ সামাজিক গণমাধ্যমে দুই হাত জোড় করে ক্ষমাভিক্ষা করার পরেও তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়েছে। বছরখানেক আগে এক প্রতিবন্ধী বালকের আঁকা বঙ্গবন্ধুর ছবি দিয়ে আমন্ত্রণপত্র মুদ্রণের অপরাধে সরকারি কর্মকর্তার কারাভোগ হয়ে যাচ্ছিল প্রায়।
রীতা দেওয়ান ঈশ্বরের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো এনেছেন সেগুলো বহু পুরনো। গত হাজার বছরে এই সব অভিযোগ তুলে ঈশ্বর কিংবা ধর্মের কোনো প্রকার ক্ষতি করা সম্ভব হয়নি। ভক্তের বিশ্বাস কচুপাতার পানি নয় যে সামান্য আঘাতে গড়িয়ে পড়বে। হয়তো পরের রাতেই রীতা দেওয়ান পরম কিংবা ঈশ্বরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন এবং প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে বিপরীত যুক্তি দিতেন, যেকোনো বিতর্ক প্রতিযোগিতায় যা হয় আরকি। কিন্তু সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করলে ঘোলা জলে মৎস্য শিকার করা যায় না।
'আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবানবুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন!' 'খোদার আসন আরশ ভেদিয়া উঠিয়াছি আমি!' ইত্যাদি পঙতি লিখেছিলেন নজরুল কুড়ি-ত্রিশের দশকে। আজকের যুগে হলে তিনি অবশ্যই কারও না কারও ধর্মবিশ্বাসে আঘাত দিয়ে ফেলতেন। তার বিরুদ্ধেও কয়েকটি রিট হতো। প্রমীলা-বুলবুল-সর্বসাচী-অনিরুদ্ধকে সঙ্গে নিয়ে জাতীয় কবিকে নাকে খৎ দিতে হতো গণমাধ্যমে, রীতা দেওয়ান ও তার কন্যাদের মতো চোখেমুখে মৃত্যু-আতঙ্ক নিয়ে, 'বিদ্রোহী' কবিতা লেখার অপরাধে।
বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, ধর্মান্ধতা ও সংস্কৃতির দ্বন্দ্বে সংস্কৃতির কতটা অপূরণীয় ক্ষতি এবং ধর্মান্ধতার কতটা অন্যায় আবদার সহ্য করা আখেরে জাতির জন্যে মঙ্গলজনক হবে। একটি 'বিদ্রোহী' কবিতা লেখা না হলে একজন নজরুলের তেমন কোনো ক্ষতি হয় না। প্রকৃত ক্ষতি হয় বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতির এবং পুরো মানবতার।