Published : 05 Dec 2019, 05:40 PM
পৃথিবী বারবার নেতার বিকল্প হিসেবে একটি পন্থার কথা চিন্তা করেছে। কিন্তু শেষ বিচার দেখা গেছে ব্যক্তিই বড় বা মূল হয়ে উঠেছে। দূরদর্শী, সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারার ক্ষমতা ও সাহসী নেতাই পৃথিবীকে যা কিছু দেবার সেটাই দিয়েছেন। আর প্রতিক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, শেষ বিচারে ব্যক্তি নেতৃত্বই বিজয়ী হচ্ছে। এমনকি যদি পৃথিবী কাঁপানো সামাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কথা ধরা হয় তাহলে দেখা যাচ্ছে, শেষ বিচারে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপ্লব বিজয়ী হয় লেনিনের নেতৃত্বের কারণে। সাধারণত কমিউনিস্ট লিটেরেচার মতে, শ্রমিক শ্রেণির মধ্য থেকে নেতৃত্ব উঠে আসে। লেনিন কিন্তু শ্রমিক শ্রেণির ভেতর থেকে উঠে আসেননি। তিনি একজন উচ্চশিক্ষিত আভিজাত মধ্যবিত্ত। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে পৃথিবীর সবথেকে বড় সামাজতান্ত্রিক বিপ্লবটি হয়েছিলো আভিজাত মধ্যবিত্ত থেকে আসা এক শিক্ষিত নেতার হাত ধরে। অন্যদিকে পৃথিবীর সবথেকে বড় সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশ ভারত তাদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে মুক্তি পেয়েছিলো নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা এক অতি সাধারণ জীবন যাপনের নেতা মহাত্মা গান্ধীর আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। অন্যদিকে ধরে নেয়া হয়, কোনো দেশের সশস্ত্র বিপ্লব সফল হয় খুব বড় মাপের বিপ্লবী নেতার মাধ্যমে, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। এমনকি বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধও সফল হয়েছিলো নিয়মতান্ত্রিক গণতন্ত্রী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে। পৃথিবীর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এমনটিই ঘটেছে। রাষ্ট্র বিপ্লব শেষ অবধি ব্যক্তির হাত ধরে জয়ী হয়েছে।
রাষ্ট্র বিপ্লবে যেমন পন্থার থেকে ব্যক্তিই শেষ অবধি বিজয়ী হয়েছে তেমনি কোনো দেশের সমৃদ্ধি অর্জনেও শেষ বিচারে অর্থনৈতিকপন্থার থেকে দূরদর্শী নেতাই সফল হয়েছেন। সাধারণ হিসেবে দেখা যায়, অর্থনৈতিক সফলতার জন্য নির্ভর করা হয় কোনো একটি পন্থার ভিত্তিতে অর্থনৈতিক সফলতা আসবে। পুঁজিবাদ, বামপন্থা না পুঁজিবাদের থেকে এগিয়ে আজ যে মার্কেট ইকোনমি এসেছে এটাই পথ কিনা এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে বারবার। উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দী এ নিয়ে অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছে। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে এসে হিসাব মেলাতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, সবখানে ব্যক্তি সফল হয়েছে। দূরদর্শী নেতাই শেষ বিচারে সফল হচ্ছেন। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো ততদিনই সফল ছিলো, অর্থনৈতিকভাবে উন্নয়নও করেছিলো- যতদিন ওই রাষ্ট্রগুলো কোনো না কোনো দূরদর্শী, সাহসী নেতার হাতে ছিলো। ওই নেতার অবর্তমানে ধীরে ধীরে ভেঙ্গে গেছে বা ভেঙ্গে পড়ছে। আবার দেখা যাচ্ছে অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করছেন ব্যক্তি। যেমন সিঙ্গাপুরের মত একটি ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্রের মালয়েশিয়ার প্রভাব কাটিয়ে স্বাধীনভাবে উন্নত হবার কোনো উপায় ছিলো না। লি কুয়ান ইউয়ের নেতৃত্বে সেটা সম্ভব হয়। তিনি বাম অর্থনীতির নিয়ম অনুযায়ী রাষ্ট্রের হাতে সব কিছু দেননি তবে রাষ্ট্রকে ক্ষমতাশালী করেন। আবার ডান অর্থনীতির নামে সবকিছু ব্যবসায়ীদের হাতে ছেড়ে দেননি। অথচ তিনি সফল হয়েছেন। আবার তার পাশের মালয়েশিয়ায় একটু পরে এসে মাহাথিরও ব্যক্তির ক্যারিশিমায় সফল হন। তিনিও ডান-বাম কোনোটাই মেপে চলেননি। তিনি চলেছিলেন প্রয়োজনমাফিক সিদ্ধান্ত নিয়ে। এমনকি ব্যক্তির ক্যারিশমায় সফল হয়েছেন যুদ্ধবিধ্বস্ত রুয়ান্ডার পল ক্যাগেম। তাই একথা আজ অনেকখানি সত্য যে ব্যক্তির স্বৈরতন্ত্র নয় ব্যক্তির দূরদর্শীতা, ক্যারিশমা শেষ বিচারে ডানপন্থা বা বামপন্থার থেকে অনেক বেশি সফলতার নিয়ামক।
বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে বাংলাদেশ যে অনেক আগেই অনেক বেশি উন্নত হতো তা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার আগে আমাদের জিডিপি'র হার বলে দেয়। কারণ, তখন আমাদের জিডিপি ছিলো ৮.৫, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে সেটা তিনে নেমে যায়। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু দেশের জিডিপিকে যেখানে নিয়ে গিয়েছিলেন তাতে বঙ্গবন্ধু তার দ্বিতীয় বিপ্লব নিয়ে এগিয়ে যেতে পারলে অর্থনৈতিক অবস্থানে বাংলাদেশ যে ৮০ সালের ভেতর এশিয়াতে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে চলে যেত সেটা অংক করলেই বের হয়ে যায়। এ নিয়ে বির্তকের কোনো স্থান নেই। যাহোক, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরে আমাদের অর্থনীতি ডান দিকে নিয়ে যাওয়া হলো, কিন্তু আর যাই হোক সামরিক নেতা তো আর নেতা নন, যার ফলে জিডিপি সেই সাড়ে তিন, চারেই ঘুরপাক খেতে থাকে। জিডিপির এই চক্র প্রথম ভাঙ্গেন শেখ হাসিনা ১৯৯৬-তে ক্ষমতায় এসে। তবে পুরোপুরি ভেঙ্গে এগিয়ে যেতে পেরেছেন ২০০৯ থেকে ধারাবাহিক ক্ষমতায় থাকার ফলে।
এখানে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, শেখ হাসিনা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় আছেন বলে কিন্তু এই চক্র ভাঙ্গতে সফল হয়েছেন এমনটি নয়। এরশাদও নয় বছর ক্ষমতায় ছিলেন। পারেননি। চারের চক্রে আটকা ছিলেন তিনি। শেখ হাসিনা প্রথম পাঁচ বছরের মধ্যে দেশের অর্থনীতিকে ঘুরিয়ে ফেলেছেন। এর মূল কারণ তার নেতৃত্ব। তার দূরদর্শী নেতৃত্ব ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নেয়া সাহসী সিদ্ধান্তই দেশের অর্থনীতির এই পরিবর্তন এনেছে। তবে এখনও দেশের ৩০ ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নীচে। এখনও কোয়ালিটি এডুকেশনের পথে দেশ পা রাখতে পারেনি। গ্রাম পর্যায়ে কেন শহরেরও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত নয়। তাই দেশকে এখনও বহুপথ যেতে হবে। আর বর্তমান পৃথিবীর অর্থনৈতিক উন্নয়নের ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে বলা যায়, এর জন্যে উদ্ভাবিত কোনো পথ যত বেশি না কাজ করবে তার থেকে সহস্রগুণ কাজ করবে দেশ যদি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে চলে। যেকোনোভাবে হোক তার নেতৃত্বেই দেশ চলতে হবে। কারণ, বঙ্গবন্ধুর পরেই তিনি এদেশের দূরদর্শী ও প্রাজ্ঞ রাষ্ট্রনায়ক। এ মুহূর্তে দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে হলে যে কটি বড় বাধা আছে সেগুলো কেবল তিনিই কাটাতে পারবেন।
যেমন দেশের অর্থনীতি বাধাগ্রস্থ হচ্ছে, ব্যাংকিং সেক্টরের কিছু নীতির কারণে ও ব্যাংকিং সেক্টরের কিছু ব্যবস্থাপনার ত্রুটির কারণে। ব্যবসায়ীদের দাবি অনুযায়ী শিল্পঋণের সুদের হার এক অংকে নামিয়ে আনার চেষ্টায় আছে সরকার। এর ফলে সঞ্চয়ের সুদের হার কমে গেছে। দেশে স্টকমার্কেটের অবস্থা খারাপ। এমতাবস্থায় স্বাভাবিকই দেশের সেভিংস কমে যাবে। ব্যাংকিং প্রবাহে নতুন টাকার যোগ কমে যাবে। দেশের এই অবস্থায় ব্যবসায়ীরা হিসাব দেখাবেন শিল্পঋণের সুদের হার কম হলে দেশ লাভবান হবে। আবার অন্য হিসাবও আছে। দেশের সেভিংস কমে গেলে সরকার দুর্বল হয়ে যাবে, ব্যবসায়ীরা ক্ষমতাশালী হবে। বাস্তবে এই সমস্যার সমাধান নেতাকে দূরদর্শীতা ও প্রজ্ঞা দিয়েই করতে হবে। শেখ হাসিনা এ মুহূর্তে হয়তো শিল্পঋণের সুদের হার কমানোর পক্ষে তবে সেভিংস ও শিল্পের একটি সহাবস্থান তাকে সৃষ্টি করতে হবে। আর এটা করতে পারে কেবলমাত্র নেতৃত্ব, কোনো পন্থা নয়। কারণ এখানে তাকে লি কুয়ানদের মতো নিজ দেশ ও সময় অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
আগামী দিনে অর্থনীতির এমনই অনেক জটিল সমীকরণ সামনে এসে দাঁড়াবে। কারণ, দেশ উন্নয়নের ট্রেনে। অন্য দেশের সঙ্গে এর অর্থনীতি জড়িয়ে গেছে। যেমন ভারতের অর্থনীতিতে মন্দার পূর্বভাস। এটা বাংলাদেশের জন্যেও একটি অশনি সংকেত। এখান থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করে এগিয়ে নিতে পারবে কেবল নেতৃত্ব, কোনো পন্থা বা অর্থনীতির কোনো বাধাধরা নিয়ম নয়। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বন্দোপধ্যায়ও তাই মনে করেন। তিনি মনে করেন, অর্থনীতির বাধাধরা নিয়মের থেকে যেকোনো দেশের অর্থনীতি এগিয়ে নেয়ার বিষয়টি নির্ভর করে ওই দেশের নেতার ওপর। তাই বাংলাদেশ যে অর্থনীতিতে প্রবেশ করেছে এখন আর সাধারণ মাপের কোনো নেতা বা অতীতমুখীন কোনো নেতার মাধ্যমে এই দেশ পরিচালনার কোনো সুযোগ নেই। তারা পরিচালনা করতে গেলেই দেশ পিছনে চলে যাবে। যেমন মাহাথিরকে ছাড়া করতে গিয়ে মালয়েশিয়া পেছনে চলে গিয়েছিলো। আবার মাহাথিরের প্রয়োজন পড়েছে। তাই বাংলাদেশের আরো অর্থনৈতিক উন্নয়ন এ মুহূর্তে শেখ হাসিনা ছাড়া অন্য কারোর নেতৃত্বে সম্ভব নয়। এমনকি আপাতদৃষ্টিতে অর্থনীতিতে এক ধরনের যে ব্যবসায়িক আধিপত্য মনে হচ্ছে এটাকেও সঠিক পথে নেবার জন্যেও শেখ হাসিনার দরকার। তিনি যেভাবে যুবলীগকে সঠিক পথে নিয়েছেন এসবও তার কাছে অতি সহজ বিষয়। কারণ, তিনি যে বাংলাদেশের লি কুয়ান তাতে এখন আর কারো সন্দেহ নেই।