Published : 29 Oct 2019, 10:35 PM
এমন একটি সংবাদের জন্য বাংলাদেশের কেউ প্রস্তুত ছিল না। বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা সংবাদটি শোনার পর চরম আঘাত পেয়েছে। বাংলাদেশের ক্রিকেট যার হাত ধরে ভিন্ন এক উচ্চতায় পৌঁছেছে, তাকেই কি না ক্রিকেট থেকে নির্বাসন? হ্যাঁ, দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সংস্থা (আইসিসি) বাংলাদেশের অধিনায়ক সাকিব আল হাসানকে সব ধরনের ক্রিকেট থেকে দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ করেছে। আইসিসির দুর্নীতিবিরোধী নীতিমালার তিনটি আইন লঙ্ঘনের অপরাধে সাকিবকে এ শাস্তি দিয়েছে আইসিসি। বাংলাদেশের সেরা ক্রিকেটোর এবং টেস্ট ও টি–টোয়েন্টি দলের অধিনায়ক অবশ্য এর দায় মেনে নিয়েছেন। দায় না মেনেও কোনো উপায় ছিল না। আইসিসি তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সাকিব ভুল করেছেন জানিয়ে বলেছেন, 'যে খেলাটি ভালোবাসি, সেখান থেকে নিষিদ্ধ হয়ে আমি অবশ্যই অসম্ভব কষ্ট পাচ্ছি। কিন্তু আমার কাছে অনৈতিক প্রস্তাব আসার পরও না জানানোর ফলে আমার শাস্তি আমি মেনে নিয়েছি। আইসিসির দুর্নীতিবিষয়ক কমিটির দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই খেলোয়াড়দের ওপর নির্ভর করে। এ ঘটনায় আমি আমার দায়িত্ব পালন করতে পারিনি।'
এটা একটা মস্ত বড় ভুল। এই ভুলটিকে কেউই মেনে নিতে পারছে না। সাকিব জুয়াড়িদের কাছ থেকে একাধিকবার ম্যাচ পাতানোর প্রস্তাব পেয়েও তা আইসিসি বা বিসিবিকে জানাননি। ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সংস্থার দুর্নীতি দমন আইনে এটি মারাত্মক অপরাধ। তাইতো ভুল স্বীকারের পরও সাকিবকে ছাড় দেয়নি আইসিসি। তাকে দুই বছরের জন্য সব ধরনের ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
সবচেয়ে হতাশার ব্যাপার হলো সাকিব দেশের শ্রেষ্ঠ খেলোয়ারই নয়, সবচেয়ে অভিজ্ঞ একজন ক্রিকেটারও বটে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের এই নিয়মগুলো তার অজানা নয়। সে এ ব্যাপারে অনেকগুলো ক্লাসেই অংশ নিয়েছে এবং এ কোডের অধীনে তার দায়িত্বের কথা জানে। তার উচিত ছিল এসব প্রস্তাবের কথা জানানো। কিন্তু সে কেন বিষয়টি চেপে রেখেছিল, সেটাই বিস্ময়ের। এটা শুধু সাকিবের জন্যই নয়, দেশের ক্রিকেট ভক্তদের জন্যও একটা বড় আঘাত। অনেক অর্জন একটা ভুলে শেষ হয়ে গেল। সাকিবের মতো বড় মাপের খেলোয়াড়ের কাছ থেকে এমন ভুল কেউ আশা করেনি!
অনেকে এর মধ্যে 'ষড়যন্ত্র তত্ত্ব' খুঁজছেন। বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে ক্রিকেটারদের আন্দোলন, বিসিবি ও খেলোয়ারদের মধ্যে আলোচনার পর এই আন্দোলন মিটমাট হওয়া, এর পর পরই বিসিবি সভাপতির সাক্ষাৎকার-মন্তব্য, তার পরই খেলোয়াড়দের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে সাকিবের অনুপস্থিতি, সর্বশেষ আইসিসির নিষেধাজ্ঞা-সব কিছু মিলিয়ে অনেকে 'ষড়যন্ত্রের'ও আভাস পাচ্ছেন। যদিও এসব ঘটনায় 'ষড়যন্ত্র' আছে বলে মনে হয় না। ক্রিকেটারদের আন্দোলন আর আইসিসি–র নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত কাকতালীয়ভাবে একই সময়ে হয়ে গেছে-এই যা!
(বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড বা বিসিবির কর্মকর্তাদের অন্তত এ ব্যাপারে দায়ী করা যুক্তিযুক্ত নয়। বিসিবির কর্মকর্তাদের কথায় পরামর্শে আইসিসি চলে না। দীর্ঘ সময় নিয়ে ধাপে ধাপে তথ্যানুসন্ধান করে, সেসব তথ্য পর্যালোচনা ও সত্যতা যাচাই করে আইসিসি সাকিবের ব্যাপারে এ সিদ্ধান্ত এসেছে। সাকিব নিজ থেকে স্বীকার করে শাস্তি কিছুটা লাঘব করেছেন। সাকিব যে ভুল করছে এটা আইসিসির কাছে ভুল নয়, অপরাধ। তিনবার একই ধরনের ভুল করার পর সেটা না শোধরানোটা শুধু অন্যায় নয়, অপরাধও বটে। সাকিবকে এরই খেসারত দিতে হয়েছে।
আর আইসিসিকে নিয়েও বিষোদ্গারের কিছু নেই। অনিয়ম পেলে আইসিসি সবার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিয়েছে। আজহারউদ্দিন, হ্যান্সি ক্রনিয়ে, গিবস, সেলিম মালিক, সালমান বাট, শ্রীশান্ত, ডেভিড ওয়ার্নার, স্টিভ স্মিথের মতো ক্রিকেটারদেরও শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে। সাকিবের মতো তথ্য না জানানোর অপরাধে শ্রীলংকার ক্রিকেট তারকা জয়সুরিয়াকেও আইসিসির দণ্ড ভোগ করতে হয়েছে। তবে কেউ টেলিফোনে ঘুস সাধার পর সেই তথ্য না জানালে (হোক তিন বার), তাকে এত বড় দণ্ড দেওয়া সঙ্গত কিনা, সে প্রশ্নটা অফিসিয়ালি তোলা যেতে পারে।
অনেকরই ধারণা সাকিব না থাকলে বাংলাদেশ দলের সবকিছু শেষ হয়ে যাবে। এটাও এক ধরনের ভাবাবেগ। একজন ব্যক্তির জন্য নিশ্চয়ই কোনো কিছু আটকে থাকবে না। ক্রিকেট দলীয় খেলা। দলের প্রত্যেকের অবদানই এখানে গুরুত্বপূর্ণ। হ্যাঁ, সাকিবের মতো একজন বিশ্বমানের অলরাউন্ডার ও নেতাকে নিশ্চয়ই সকলেই মিস করবে, কিন্তু এ জন্য যদি সব কিছু নিঃশেষ হয়ে যায়, তাহলে তো সেটা ক্রিকেটের উন্নতি নয়! দলকে এবং ক্রিকেটকে এগিয়ে নিতে এখন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সবাইকেই এখন একজন করে সাকিব হতে হবে। সব ধরনের নেতিবাচক চিন্তা ঝেড়ে ফেলে আগামী দিনে ক্রিকেটকে আরও এগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে সকলকে শপথ উচ্চারণ করতে হবে। ভারত সফরে নিজের সর্বোচ্চাটা দিয়ে, ভালো ফল করে বুঝিয়ে দিতে হবে, যে, আমাদের ক্রিকেট সামর্থ্য কারও চেয়ে কম নয়। ব্যক্তিবিশেষের উপর বাংলাদেশের ক্রিকেট নির্ভরশীলও নয়।
সাকিবের জন্য খুব বেশি দুশ্চিন্তারও কিছু নেই, ২০২০ সালের ২৯ অক্টোবর থেকে সে আবার খেলায় ফিরতে পারবে। তার মানে পরবর্তী টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বের ম্যাচেও তার খেলার সুযোগ রয়েছে। স্মিথ, ওয়ার্নাররা যেভাবে নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে আরও শক্তিশালী হয়ে অস্ট্রেলিয়া দলে ফিরে এসেছেন, সাকিবও নিশ্চয়ই তেমন ধারালো হয়ে ক্রিকেট মাঠে ফিরে আসবেন।
সাকিবের এই ঘটনাটি থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। সাকিব নিজেও বলেছেন, ভবিষ্যতে তরুণ কোনো ক্রিকেটার যেন এমন ভুল না করে, সেটা নিশ্চিত করতে চান তিনি। এ ব্যাপারে আইসিসিকে পূর্ণাঙ্গ সহযোগিতা করতে চান, 'বিশ্বের অধিকাংশ ক্রিকেটার ও সমর্থকের মতো আমিও চাই দুর্নীতিবিরোধী খেলার পরিবেশ। আমি আইসিসির দুর্নীতিবিষয়ক কমিটির সঙ্গে এ ব্যাপারে কাজ করার অপেক্ষায় আছি। তরুণ ক্রিকেটারদের শিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নেব এবং নিশ্চিত করতে চাই, তরুণ ক্রিকেটাররা আমার ভুল থেকে শিক্ষা নেবে।' সাকিবের এই উচ্চারণ অত্যন্ত ইতিবাচক। মানুষ ভুল করতেই পারে। সেই ভুলকে স্বীকার করা এবং ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করাটাই প্রকৃত মহত্ত্ব। সাকিবের এই অঙ্গীকারের জন্য তাকে অভিনন্দন জানাই।
বিসিবি জানিয়েছে, তারা সব সময় সাকিবের সঙ্গে আছে এবং তাকে সব ধরনের সহযোগিতা করবে। প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, আমরা সাকিবের পাশে আছি। শুধু প্রধানমন্ত্রী বা বিসিবি বা নয়, গোটা বাংলাদেশই সাকিবের পক্ষে আছে। সাকিব আইনি লড়াই চালিয়ে দ্রুত আবার ক্রিকেটে ফিরে আসবেন বলেই সবার প্রত্যাশা। আপাতত কাদা ছোঁড়াছুড়ি, দোষারোপ, বিষোদগার, 'ষড়যন্ত্র তত্ত্ব' বাদ দিয়ে সাকিবের ঘটনাটিকে বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য একটি দুর্যোগ হিসেবে দেখতে হবে। আর এই দুর্যোগে সাকিবের পাশাপাশি বাংলাদেশ ক্রিকেটের পক্ষে দরকার জাতীয় ঐকমত্য। সবার সহযোগিতা, সমর্থন ও ইতিবাচক মানসিকতা। যে ক্রিকেট আমাদের জাতীয় জীবনে আনন্দ-গৌরবের বিষয়ে পরিণত হয়েছে, যে ক্রিকেটে সাকিবের মতো ক্রিকেট-মহানায়কের জন্ম হয়েছে, সেই ক্রিকেটকে এগিয়ে নিয়ে যেতে নিশ্চয়ই আমরা আরও অনেক বেশি ইতিবাচক, আন্তরিক ও সৎ হব। কেবল ভাবাবেগ নয়, বুদ্ধিবিবেচনা দিয়ে সব কিছু বিচার করব।
পুনশ্চ: যে কারণেই হোক, আমাদের বর্তমান ক্রিকেট বোর্ডের কর্মকর্তারা খেলোয়ারসহ ক্রিকেটসংশ্লিষ্টদের আস্থাভাজন হতে পারেননি। সভাপতি থেকে শুরু করে বোর্ডের অন্য সদস্যদের দক্ষতা, যোগ্যতা, গ্রহণযোগ্যতাও তলানিতে। ক্রিকেটের স্বার্থে বর্তমান ক্রিকেট বোর্ডের কর্মকর্তাদেরও পরিবর্তন দরকার। একথা ঠিক যে, আমাদের দেশে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু বর্তমানে যারা রয়েছেন, তাদের চেয়ে অধিক যোগ্য, দক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও আস্থাভাজন ব্যক্তি নিশ্চয়ই দেশে অনেক আছেন। তাদের দিয়ে অনতিবিলম্বে ক্রিকেট বোর্ডকে ঢেলে সাজানোও এখন খুব জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছে। কেবল একগুঁয়েমি বা জেদ নয়, দেশের স্বার্থে, ক্রিকেটের স্বার্থেই এই কাজটা করা দরকার।