Published : 09 Oct 2019, 06:02 PM
[পূর্বকথা:হিন্দুস্তানের বদমেজাজি বাদশাহ শাহরিয়ার তাঁর তথাকথিত চরিত্রহীনা এক বেগমের পরকীয়ারস্ত্রীজাতির উপর যারপরনাই নারাজ হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, প্রতি রাতে তিনি এক যুবতীকে নিকাহ-এ-মুতা করেভোর হলেই এক রাতের সেইবেগমকে কতল করাবেন। কয়েক বৎসর ধরে শত শত যুবতীকন্যা বেঘোরে ইন্তেকাল ফরমালে ক্ষুরধার বুদ্ধিমতী উজিরকন্যা শেহেরজাদি স্বজাতির প্রতি করুণাপরবশ হয়ে ছোটবোন দিনারজাদির সঙ্গে সল্লাপূর্বক স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে নিকাহ করেন বাদশা শাহরিয়ারকে। জীবনের শেষ রাতে শেহেরজাদির আবদার রাখতে বাদশার আদেশে বাসরঘরে ডেকে আনা হয় শ্যালিকা দিনারজাদিকে।রাত গভীর হলে পূর্বপরিকল্পনামাফিক ছোটবোন দিনারজাদি বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে একেকটি সওয়াল পুছতে থাকেন আর বড়বোন শেহেরজাদিওকালবিলম্ব না সেই সবসওয়ালের জওয়াব দিতে শুরু করেন। বাদশা সওয়াল-জওয়াব শুনতে খুব মজা পাচ্ছিলেন। কিন্তু ভোরের আজান শোনা মাত্র জওয়াব বন্ধ করে নকশি লেপ মুড়ি দিয়ে দুই বোন শুয়ে পড়েন বলে কোনো রাতেই কথা শেষ হয় না। অনুসন্ধিৎসুবাদশাহ পর পর বারোদিন শেহেরজাদির মৃত্যুদণ্ড বাতিল করেছেন। আজ সেই সওয়াল-জওয়াবের দ্বাদশ রাত্রি]
প্রতি রাতের মতো আজও ভোর হবার অল্প আগে দিনারজাদি বড় বোন শেহেরজাদির ঘুম ভাঙায়। সংস্কৃতে এক শ্লোক আছে: 'কাকচেষ্টা, বকধ্যানম, স্বননিদ্রা, স্বল্পাহারী, গৃহত্যাগী – বিদ্যার্থী পঞ্চলক্ষণং!' এর মধ্যে 'স্বননিদ্রা' বা কুকুরের মতো পাতলা ঘুম একজন শাসকেরও বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত, কারণ শাসকের শত্রুর অভাব নেই এবং ঘুমের মধ্যে কখন কে আক্রমণ করে বেঘোরে হত্যা করে তার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে! যাইহোক, দুই বোনের গুজুর-গাজুর, ফুসুর-ফাসুরে বাদশার পাতলা ঘুম ভেঙে যায়– হয়তো গত এগারো রাতে একটা অভ্যাসও দাঁড়িয়ে গেছে। বাদশা শুনতে পায় দিনারজাদি বলছে: 'দিদি, পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্র রচনা নিষিদ্ধ হয়েছিল। এখনও আন্তর্জালে রবীন্দ্রসঙ্গীত, রবীন্দ্র রচনা নিষিদ্ধ করার, জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের আহ্বান দুর্লভ নয়। তুমিতো আগের তিন রাতে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ খণ্ডন করেছো। তবু কেন বিশেষ একটি গোষ্ঠী রবীন্দ্রনাথকে আক্রমণ করছে বারবার? আমার কী মনে হয় জানো, রবীন্দ্রনাথ অবশ্যই এখানে প্রকৃত লক্ষ্য নয়। এর পেছনে রাজনীতির জটিল কোনো 'মারপ্যাঁচ' আছে। প্যাঁচটা তুমি একটু খুলে দাও, মারের প্রসঙ্গটাও এড়িয়ে যেও না।
বিছানার উপর উঠে বসে চোখ কচলাতে কচলাতে শেহেরজাদি বলে: 'রাজনীতি' মানে কী, সেটা আগে বলে নেই। সোজাসাপটা কথাতেই বলি। কেক ছোটো, খানেওয়ালা বেশি। প্রত্যেকে কেকের বেশি অংশ খেতে চায়, কিংবা জমিয়ে রাখতে চায় উত্তরপুরুষের জন্যে। এটা মানুষের সহজাত তাড়না। এই তাড়নার কারণে মানুষ যুথবদ্ধ হয় বিচিত্র অজুহাতে: কখনও ধর্ম, কখনও আদর্শ, কখনও ভাষা, কখনও গাত্রবর্ণ, কখনওবা জাতীয়তা, কখনও বা নারীবাতিকগ্রস্তদের মতো শ্রেফ গাত্রদাহ কিংবা জঘন কণ্ডুয়ন। বিরোধীপক্ষকে মেরে ফেলতে পারলে কিংবা কেকের ভাগ দিতে না হলে আমার, আমাদের পক্ষের সুবিধা। কিন্তু কেকের অন্য শরিকেরা কি সহজে কেকের ভাগ ছেড়ে দেবে? দেখিব খেলাতে কে হারে, কে জেতে! অন্যকে, অন্যদের, অন্য সব other ব্যাপারিদের কত কম দিয়ে কত বেশি কেক অবলীলায় ছিনিয়ে নিয়ে এসে নিজের, নিজেদের 'জাহাজে' এনে তোলা যায়– সেই কলাকৌশলের নাম হতে পারে 'রাজনীতি'।
যে কোনো দেশে কিংবা সমাজে একাধিক প্রতিযোগী গোষ্ঠী থাকে। বহু বিচিত্র ঐতিহাসিক-সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কারণে সংস্কৃতি ও ধর্মের প্রশ্নে বাংলাদেশের জনগণ কমপক্ষে তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে আছে। প্রথম (কিংবা এ) দল বাঙালি সংস্কৃতি আর ইসলাম ধর্ম উভয়ই ষোল আনা বজায় রাখার পক্ষপাতী। দ্বিতীয় (কিংবা বি) দল শুধু ইসলাম ধর্মকে রাখতে ইচ্ছুক, বাঙালি সংস্কৃতিকে তারা বেমালুম বাদ দিতে চায় (এরা প্রকৃতপক্ষে ধর্মপ্রাণ মুমীন, নাকি বকধার্মিক সে প্রশ্নটিও বিবেচনায় নেওয়া দরকার)। তৃতীয় (কিংবা সি) দলটি রাষ্ট্রের সাথে ধর্মকে মেলাতে চায় না। তাদের কথা হচ্ছে: ধর্ম যার যার, সংস্কৃতি সবার। এ, বি, সি– এই তিন দলের সদস্যসংখ্যা বাড়ে কমে। আজ যে বি-দল করছে সে কিংবা তার উত্তরপুরুষ এ-দল করতে পারে। আবার বি দলের অনেক সুযোগ সন্ধানী এ দলে ঘাপটি মেরেও থাকে।
তিন দলের মধ্যে মিলটা লক্ষ্য করো, দিনারজাদি। এ, বি, সি– কোনো দলই কিন্তু ধর্ম পালনের বিরুদ্ধে নয়। সমস্যা বাঙালি সংস্কৃতিকে নিয়ে। বি দল বাঙালি সংস্কৃতিকে বেদাত হিন্দু সংস্কৃতি মনে করে পরিহার করতে চায়। মনে রাখা দরকার, প্রাক-হিন্দু যুগের ভারতবর্ষের আদিবাসি সংস্কৃতি হিন্দু সংস্কৃতির অন্যতম ভিত্তি। ভাষা আর সংস্কৃতি হচ্ছে দইয়ের মতো, পুরনো দইয়ের সঙ্গে নতুন দুধ মিশিয়ে দই তৈরি হয়। হিন্দুরা যে মুসলমানদের মতো পাজামা-পাঞ্জাবি পরে, বাংলা অঞ্চলের যত দোকান-বাজার, একাধিক কক্ষযুক্ত গৃহ, বাগান… এ সবই আরব দেশ থেকে আসা সংস্কৃতি। বাঙালি হিন্দুর জীবনাচরণ পিরালী (জোরাসাঁকোর ঠাকুরেরা ছিলেন পিরালী ব্রাহ্মণ) কিংবা মুসলমানিতে সয়লাব। বাংলা ভাষাতেই দেখো না, কত কত সংস্কৃত আর আরবি-ফার্সি শব্দ ('বিয়েশাদী' শব্দে যেমন) শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করছে। হিন্দুরা আরবিয় সংস্কৃতি ধারণ করলে কোনো সমস্যা নেই। মুসলমানের গায়ে ভারতবর্ষের সংস্কৃতির ছোঁয়া লাগলেই যত বিপত্তি।
এই আচরণও স্বাভাবিক। দেশে দেশে এমনটাই হয়েছে কালে কালে। ধর্ম আর সংস্কৃতি অনেক ক্ষেত্রে মিশে যায়, কিন্তু সবটা মিশে না। কিন্তু 'ধর্ম=সংস্কৃতি' কিংবা 'সংস্কৃতি=ধর্ম'– এই অবস্থা হোমোসাপিয়েন্সের ইতিহাসে কখনো ঘটেনি। উদাহরণস্বরূপ, আরব উপদ্বীপে ছিল জ্বীন, পারস্যে ছিল পরী, ভারতে ছিল ভূত আর প্যালেস্টাইন অঞ্চলে ছিল শয়তান আর ফেরেস্তা। জ্বীন-পরী-ভূত-শয়তান-ফেরেস্তা সবাই অশরীরি, কিন্তু আমরা শরীরিদের মতো তাদের মধ্যেও প্রকৃতি ও গুরুত্বে অনেক অমিল আছে। মধ্যপ্রাচ্যের সব অশরীরিকে ইসলাম আত্মস্থ করে নিয়েছে। বাদ পড়েছে ভূত বেচারা, কারণ (হয়তো দূরত্বের কারণে) ভুতের সঙ্গে আরবদের পরিচয় ছিল না। অনেক মুসলমান মনে করে, ইসলাম ছাড়া মুসলমানের কোনো সংস্কৃতি নেই। এই মনে করাকে ভুল প্রমাণ করতে, দিনারজাদি, আমি দুটি যুক্তি দেবো: প্রথমত, ইসলামের একাধিক বিশ্বাস ও নিয়মকানুন (জ্বীন, মেহরাব বাঁধা, কাবাশরীফ তাওয়াফ, হজরে আসওয়াদে চুম্বন) ইসলামপূর্ব যুগের জাহিলিয়া সংস্কৃতির অংশ। হজরত ইব্রাহিমের আমলে কাবাশরীফ তাওয়াফ কিংবা হজরে আসওয়াদে চুম্বন করা হতো কি? দ্বিতীয়ত, পারসিক, তুর্কি, ভারতীয় মুসলমানের সংস্কৃতি এক নয়, এক ছিল না কখনই। সব জাতির মুসলমান এক খাবার দিয়ে ইফতার করে না, এক ধরনের কাপড় পরে না। ধর্ম আর সংস্কৃতি যে এক নয় কিংবা ধর্ম যে কখনোই জাতি গঠন করতে পারে না, তার প্রমাণ ইরাক আর আলজেরিয়ার সংস্কৃতি এক নয়, তার প্রমাণ পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশের জন্ম।
সন্দেহ করার বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই যে এ, বি, সি– এই তিন দলের পূর্বপুরুষই (খুব বেশি 'পূর্ব'ও নয় অবশ্য, 'অনতিকাল পূর্বপুরুষ' বললে ভালো হয়!) ছিল হিন্দু। হিন্দুদের পূর্বপুরুষ ছিল প্রধানত এদেশের ভূমিপূত্র আদিবাসীরা যাদের অস্তিত্ব হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বাঙালিদের সবার দেহে লীন হয়ে আছে। এ ও সি দল এই সত্য অস্বীকার করতে চায় না, কিন্তু বি দলের প্রত্যেকে মনে করে, তারা বিদেশাগত আরব-ইরান-তুর্ক-মোঘলদের পবিত্র বীর্যজাত সন্তান! মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন হানাদার জাতির যৌন ও প্রজননশক্তিতে সন্দেহ করার সাহস ভেতো বাঙালির নেই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, ঐসব 'মহান' যোদ্ধারা তাদের বৌঝিদের সঙ্গে নিয়ে আসতে পারেনি বাংলার 'পূণ্যভূমিতে'। বাংলা পূণ্যভূমি, কারণ বাঙালিরা কখনও জাতিকে আক্রমণ করতে যায়নি (যাবে কীভাবে, সেই ক্ষমতাই তাদের ছিল না!)।
সুতরাং ঔরস যারই হোক, এতদ্দেশীয় হিন্দু নারীর 'না-পাক' (কারণ এই ঘটনা পাকিস্তান হবার অনেক আগের) গর্ভেই বি দলের পূর্বপুরুষদেরও জন্ম হয়েছে। 'বৌদ্ধ নারী' বলছি না, দিনারজাদি, কারণ বৌদ্ধদের আগেই মেরে হাপিস করে দিয়েছিল হিন্দুরা!)। অন্তত বংশগতির দিক থেকে এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে বাংলা অঞ্চলের বিভিন্ন আদিবাসী এবং স্থানীয় হিন্দুরাই বর্তমানের সিংহভাগ বাঙালি মুসলমান ও হিন্দুর পূর্বপুরুষ। জিনপরীক্ষা করলেই আমার এই দাবি সপ্রমাণ হবে। কানাডা-আমেরিকায় শ খানেক ডলারে ব্যক্তির জিনমানচিত্র তৈরি করানো যায়। বাংলাদেশ সরকার বিনা পয়সায় কিংবা অল্প পয়সায় এ সুযোগ দিলে পরিষ্কার হয়ে যাবে, যে বংশগর্বকে খাঁটি দুধ মনে করে আহ্লাদে লাফাচ্ছে অনেকে, সে দুধে সাড়ে তিনভাগ পানি, কারণ গোয়ালারা কী এ যুগে (আড়ং, মিল্কভিটা), কী সে যুগে কখনও সাধু ছিল না।
'আপনারা রবীন্দ্রসঙ্গীত লিখতে পারেন না?' প্রশ্ন করে বিখ্যাত হওয়া পূর্বপাকিস্তানের গভর্নর আইয়ুব খানের স্বঘোষিত চামচা পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খানের পিতামহ লেংড়া মুন্সি নাকি হিন্দু ছিলেন। কথাটা গাফফার চৌধুরীর এক লেখায় পড়েছি। পাকিস্তান আমলেই তথ্যটি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত, প্রতিবাদহীনভাবে প্রমাণিত। এতে অবাক হবার কিছু নেই। আগেই বলেছি, বাংলার ভারতবর্ষের সিংহভাগ মুসলমানের পিতামহ যদি হিন্দু নাও হয়ে থাকেন, বৃদ্ধপ্রপিতামহের বৃদ্ধপ্রপিতামহ অবশ্যই হিন্দু ছিলেন। যাইহোক, সেই মোনায়েম খান একবার পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম নেতা আবুল হাসিমকে নাকি বলেছিলেন: 'আমি গোঁয়ার-গোবিন্দ মানুষ, কখন কী বলে ফেলি, কিছু মনে নিবেন না!'। আবুল হাসিম সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেন যে 'গোবিন্দ' হিন্দুধর্মের দেবতার নাম এবং নিজেকে 'গোবিন্দ' বলা মোনায়েম খানের উচিত হচ্ছে না!' মোনায়েম খান সলজ্জ কণ্ঠে জবাব দিয়েছিলেন: 'দীর্ঘদিন হিন্দুদের সঙ্গে আছি, এভাবে কথা বলা অভ্যাস হয়ে গেছে। অভ্যাসটা ছাড়তে পারছি না।' ঘটনাটি পাবেন সরদার ফজলুল করিমের 'সেই সে কাল, কিছু স্মৃতি কিছু কথা' শীর্ষক পুস্তকে।
হিন্দু এবং ইসলাম দুটিই বহিরাগত, বিদেশি ধর্ম বাংলাদেশের জন্য, কিন্তু শার্ট-সালোয়ার-বিরিয়ানি-লুঙ্গির মতো এই দুই ধর্ম এবং আনুষঙ্গিক সংস্কৃতি বাংলাদেশ নিজস্বীকরণ করে নিয়েছে। সেই নিজস্বীকরণের প্রক্রিয়া, জাতি গঠনের প্রক্রিয়া এখনও যে শেষ হয়নি তারই অন্যতম প্রমাণ রবীন্দ্র নিন্দা, জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের দাবি, পহেলা বৈশাখকে 'হিন্দুয়ানি' বলা ইত্যাদি। এমনতরো হাস্যকর প্রশ্ন ইউরোপে আর তেমন ওঠে না, কারণ ইউরোপে জাতিগঠনের পরে রাষ্ট্রগঠন হয়েছে। বাঙালিরা রাষ্ট্রগঠনের পর জাতিগঠনের কোশিশ করছে। এ অনেকটা ঘোড়ার আগে গাড়ি জোতার মতো, যার ফলে গাড়ি কিংবা ঘোড়া কোনটাই খুব বেশি নড়ছে না এবং বাঙালিরাও কোথাও পৌঁছাচ্ছে না– ভূতে পাওয়া মানুষের মতো এক জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
আমরা কেন এই সত্যটা মানতে পারি না যে একদল বাঙালি ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক-সামাজিক কারণে হিন্দুই থেকে গেছে, অন্যদল ধর্ম পরিবর্তন করে মুসলমান হয়ে গেছে। এর কোনটা দুর্ঘটনা, কোনটা ঘটনা, সেটা দৃষ্টিভঙ্গীর ব্যাপার। এর উল্টোটাও ঘটতে পারতো, কারণ জন্মের উপরতো কারও হাত নেই। যে লোক আজ দেশকে 'মা' ডাকতে গিয়ে 'ধর্ম গেল!' বলে গলা শুকাচ্ছে (যদিও ঘুষ-দুর্নীতি-সুদণ্ডঋণখেলাপ নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই!), হিন্দু পরিবারে জন্ম হলে (হতেই পারতো!) সেই একই লোকই হয়তো ভিন্ন আচরণ করতো। এক আল্লাহ কিংবা ঈশ্বর যদি তাকে হিন্দু কিংবা মুসলমান পরিবারে জন্ম দেবার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, তবে সেই সিদ্ধান্ত আমি হিন্দু কিংবা মুসলমান পরিবর্তন করার কে? খোদার উপর খোদকারী কেন করতে যাই আমরা?
মানব-ইতিহাসে অনেকটাই বিপরীতধর্মী ধর্ম ও সংস্কৃতির মিশ্রণ যখনই হয়েছে, যেখানেই হয়েছে, তখনই এবং সেখানেই এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে, ঘটাটাই স্বাভাবিক। সুস্থ জাতি অতীত কিংবা বর্তমান নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগে না। গ্রীক-রোমান দেবদেবী নিয়ে ইউরোপীয়দের কোনো সমস্যা নেই। আরবরা ইমরুল কায়েসের বেদাত রচনা এখনও আগ্রহ নিয়ে পড়ে। মোনায়েম খানরা নিজের অতীতকে সহজভাবে নিতে পারে না, কারণ তারা মানসিকভাবে অসুস্থ। মোনায়েম খান একা নন। নরেন্দ্র মোদীরাও নিজের দেশের ইতিহাসকে সহজভাবে নিতে পারে না। এরাও কি সুস্থ? রোগ হিন্দু-মুসলমান বিচার করে না এবং রোগই সংক্রামক, স্বাস্থ্য নয়। মোনায়েম খানেরা জোর করে বিশ্বাস করতে এবং করাতে চায়, তারা তুর্ক-মোঘল হানাদারদের পবিত্র বীর্যজাত। নরেন্দ্র মোদীরা বিশ্বাস করতে এবং করাতে চায়, তারা আর্য হানাদারদের মহান বীর্যজাত। এই দুই প্রকার ইমপোর্টেড বিদেশী বীর্যের হানাহানিতে পুরো উপমহাদেশ 'নিবীর্য' হয়ে পড়েছে। ৪৭-এর দেশভাগ, ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ- সব কিছুর মূলে আছে এক কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভিত্তিহীন বীর্যগর্ব এবং বীর্যদ্বন্দ্ব। নিজের বাপের খোঁজ রাখে না, পরের বাপকে নিজের বাপ দাবি করে ভাইয়ে ভাইয়ে মারপিট করে– পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ঘটনা সম্ভবত বিরল।
মাত্র দুই পুরুষ আগে মুসলমান হওয়া এই মোনায়েম খান যে কিনা অনেক চেষ্টা করেও কথায় হিন্দুয়ানি লফজ্ এড়াতে পারতো না, সেই লোক পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্র সঙ্গীত নিষিদ্ধ করাতে ভূমিকা রেখেছিল। ইংরেজিতে একটা কথা আছে: মোর ক্যাথলিক দ্যান পোপ। চট্টগ্রামে প্রবাদ আছে: 'নোয়া নোয়া মুসলমান অইলে গরু-খাইয়ার যম অয়'। মোনায়েম খানেরা প্রমাণ করতে চান, তারা আইয়ুব খানের চেয়ে বেশি না হলেও আইয়ুব খানের সমান মুসলমান। প্রমাণ করার দায় আছে তাদের চেতন-অবচেতনের কোথাও না কোথাও। মূলত এটাই তাদের অ-সুখ কিংবা অসুখের কারণ, যদিও এই অসুস্থতাও, আগেই বলেছি, স্বাভাবিক ঘটনা দেশে দেশে, যুগে যুগে।
পাকিস্তান কায়েম হবার পর বি দল ভেবেছিল, এ ও সি দলকে তারা চিরদিনের মতো পরাজিত করেছে। পাকিস্তান আমলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান ছিল ক্ষমতাসীন বি দলের বিরুদ্ধে এ ও সি দলের সাংস্কৃতিক প্রতিবাদ। ১৯৭১ সালের গণহত্যা এ ও সি দলের উপর বি দলের মরণ-কামড়। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর এ দল ভেবেছিল, বি দল বুঝি চিরদিনের জন্যে পরাজিত হলো। কিন্তু ১৯৭৫ সালের পনেরোই অগাস্টের পর বি দলের বৃহস্পতি আবার তুঙ্গী হয়ে উঠে। ভূপৃষ্ঠের টেকটোনিক প্লেটগুলোর মতো বাংলাদেশের এই তিনটি জনখণ্ড পরস্পরকে ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে এবং এই সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হবে সন্দেহ নেই। এতে কে জিতবে তার উপর নির্ভর করবে নিকট ভবিষ্যতে ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতি গঠন করা সম্ভব হবে কিনা।
দিনারজাদি, তুমি হয়তো মনে মনে অস্থির হচ্ছো এটা জানতে যে বেচারা রবীন্দ্রনাথ কেন আক্রমণের শিকার? বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম প্রতীক 'রবীন্দ্রনাথ'। রবীন্দ্রনাথকে আক্রমণ করা আর বাঙালি সংস্কৃতিকে আক্রমণ করা সমর্থক। প্রমাণ চাও? পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্র-সঙ্গীত নিষিদ্ধ হয়েছিল, কারণ তখন বি দল ছিল ক্ষমতায়। এ দল এবং তার আদর্শকে সমাজ-মানস থেকে সমূলে উৎপাটিত করা ছিল পাকিস্তানপন্থী বি দলের উদ্দেশ্য। একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে ১৯৭১-এর ঘাতক ও বঙ্গবন্ধুর হত্যকারীদের সুবিচার ও শাস্তি কার্যকর হবার পর বি দল আবার অস্তিত্ব সঙ্কটে ভুগছে। রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধীতার মিথ্যা অভিযোগের পেছনে অন্যতম কারণ সম্ভবত এই যে বি দল ইদানিং কঠিন সময় পার করছে। রবীন্দ্রনাথকে আক্রমণ করে তারা হয় মনের ঝাল মেটাচ্ছে, অথবা নতুন করে, ঝোপ বুঝে তীব্রতর কোনো 'কোপ মারার' মহড়া দিচ্ছে।
যদিও সব রবীন্দ্রদ্বেষীই বি দলের সমর্থক, তবু গত কয়েক দশকের রবীন্দ্রনিন্দকদের তিনটি প্রধান টাইপ বা বর্গে বিভক্ত করা যেতে পারে। প্রথম বর্গের রবীন্দ্রদ্বেষীরা প্রমাণছাড়া মিথ্যা তথ্য সৃষ্টি করে, যেমনটা করেছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত সেই বইয়ের লেখক, কিংবা আমাদের মেজর জেনারেল বীর উত্তম। মুক্তিযোদ্ধাদের সবাই এ দলের– এটা ভেবে থাকলে ভুল করবে দিনারজাদি। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এ দলের অনেকেরই মোহভঙ্গ হয়েছে। বি দলের কারোর অবশ্য কখনই মোহভঙ্গ হয় না! বি ধরনের রবীন্দ্রদ্বেষীরা বলে যে 'কোনো প্রমাণ অবশ্য নেই, তবু আমি যেন কোন অতীতে (ল্যাংটা কালে?) কোনো এক বইয়ে (বা বইগুলোতে) কোথায় জানি পড়েছিলাম যে রবীন্দ্রনাথ এই বলেছেন, এই করেছেন।' ব্যাস, ভিমরুলের চাকে ঢিলটা লেগে গেল। 'কে দেখেছে, কে দেখেছে, দাদা দেখেছে। দাদার হাতে কলম ছিল ছুঁড়ে মেরেছে!' তৃতীয় ধরনের রবীন্দ্রদ্বেষীরা (যারা কিনা প্রথম ও দ্বিতীয় দলের তুলনায় সংখ্যায় দশ-বিশগুণ বেশি) প্রথম ও দ্বিতীয় দলের ভিত্তিহীন কথাকে সরল মনে বা ইচ্ছে করে সত্য ভেবে নিয়ে, 'হাজার হাজার প্রমাণ আছে' বলে ঘোষণা দিয়ে কোমরবেঁধে সদলবলে রবীন্দ্রমুণ্ডুপাতে লেগে পড়ে। 'ঘরে আছে হুলো বিড়াল, কোমর বেঁধেছে।' অর্ধশিক্ষিত, যুক্তিচর্চায় অনাগ্রহী বঙ্গপুঙ্গবেরা বিশ্বাস করতে শুরু করে দেয়, 'যাহা রটে তাহা কিছুটাতো বটে!' পদ্ধতিটা নতুন নয়। হিটলারের মন্ত্রী গোয়েবলস এর সফল ব্যবহার করেছিলেন। কোনো ব্যক্তিকে পছন্দ না হলে তাকে 'কুকুর' নামে ডাকুন, অনেকেই বিনাপ্রশ্নে আপনার দেখাদেখি সেই লোকটিকে কুকুর মনে করতে শুরু করবে। এভাবেই প্রপাগাণ্ডা করতে হয়।
আলোচনার উজানে রবীন্দ্রবিরোধিতার মূলে রাজনীতির মারপ্যাঁচ থাকার কথা লিখেছিলাম। প্যাঁচতো কমবেশি খুললাম, মারটা কী? ইদানিং কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়লেও বি দল আবার বাংলার মসনদ দখল করতে চায় এবং এবার চিরদিনের মতো। এতে সমস্যা কী? সমস্যা হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যর অন্ততপক্ষে একটি ও উপমহাদেশের 'অগ্নিস্থান' (তৎসম 'পাবক' থেকে তদ্ভব 'পাক'; পাবকের প্রতিশব্দ 'অগ্নি')– এই দুটি দেশের আদর্শ ও পরামর্শে বি দল চলে। এই রাষ্ট্রদুটির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, দুই রাষ্ট্রই ভূতের মতো। ভূতের পা নাকি থাকে পিছন দিকে এবং সে কারণে ভূত যতই সামনে এগোতে চায়, ততই সে পিছিয়ে যায়। ভূত বলেই এই দুই রাষ্ট্র এবং তাদের ধামাধরা বি দল কখনই বাঙালির স্বপ্ন ও বাস্তবের নাগাল পাবে না, পেলেও সাময়িক। কিন্তু ভূতের আছর ছাড়াতে সময় লাগে এবং বঙ্গবন্ধুর মতো ভালো ওঝাও সর্বযুগে সুলভ নয়। ভূতের আছর দীর্ঘস্থায়ী করার জন্যেই হয়তো বি দল ওঝাকে সপরিবারে হত্যা করেছিল। বি দল বেঁচে থাকবে আরও বহুকাল এবং তারা আবারও ক্ষমতায় আসতে পারে। বি দল যদি কেবলা না বদলায় এবং এ দলের অবিমৃষ্যকারীতার কারণে বাঙালি জাতির নেতৃত্ব আবার যদি তাদের হাতে গিয়ে পড়ে, তবে বাঙালি জাতি কেবলই পেছাতে থাকবো। মনে আছে, দেশের গুমর (উভয়ার্থে) ফাঁক (ইংরেজি বানান কিংবা উচ্চারণ নয়) হয়ে যাবে– এই অজুহাতে বি দল বাংলাদেশকে সাবমেরিন কেবল প্রকল্পে যোগ দিতে দেয়নি?
এই প্রশ্নও আমাদের করা দরকার যে বি দল এই আচরণ কেন করছে। বি দল অবশ্যই ক্ষমতা চায়। ক্ষমতা কে না চায়, কারণ ক্ষমতায় থাকা না থাকার উপর দলের অস্তিত্ব নির্ভর করে। (ইদানিং) প্রকাশ্যে না হলেও, বি দল অন্তরে ভারত-বিরোধী। বাংলা অঞ্চলে ভারতবিরোধিতার কারণ খুঁজতে গেল ইতিহাসে কুলাবে না, প্রাগৈতিহাসের দিকে এগোতে হবে। সেই মহাভারতের আমল থেকে উত্তর ভারত পূর্বভারতকে 'দাবায়ে রাখতে' চেষ্টা করছে। উত্তর ভারত (পাকিস্তানও যার অংশ) মনে করে, ভারতবর্ষ শাসন করার অধিকার শুধু তাদেরই। বিরিয়ানি, শেরোয়ানি, সালোয়ার কামিজ, শিক কাবাব খেতে শিখে পূর্ব ভারত উত্তর ভারতকে কখনও সমীহ করে, আবার কখনও বিদ্রোহও করতে চায় বৈকি দাদাদের বিরুদ্ধে। যেহেতু কার্যকর বিদ্রোহ করার ক্ষমতা তার নেই, খুব কম সময়েই ছিল, সেহেতু মাঝে মাঝে সংখ্যালঘুর ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে, দুর্গামূর্তির মাথা ভেঙে কিংবা রবীন্দ্রনাথের মুণ্ডুপাত করে উধোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে তারা ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করে। তারা বোঝে না যে উত্তর ভারতকে মেনে নিয়েই কৌশলে সারা ভারতবর্ষকে অতিক্রম করতে হবে। ভারত বড় ভাই হতে পারে, কিন্তু পরিবারে ছোট ভাইয়ের গুরুত্ব বড় ভাইয়ের চেয়ে বেশি হতে পারে, যদি তার অর্জন বেশি হয়। এটাই পূর্ব ভারতের অন্যতম মোড়ল বাঙালিদের যুগান্তরের অবচেতন পরিকল্পনা। সম্ভবত এই রাজনীতিই এ দল অনুসরণ করছে রয়েসয়ে। বাংলাদেশে যে দলই ক্ষমতায় আসুক, এই রাজনীতিই তাদেরকে অনুসরণ করতে হবে, কারণ আপাতত এটাই সঠিক রাজনীতি।
বিদলের ভারতবিরোধিতা প্রকৃতপক্ষে যুগান্তরের উত্তর ভারত বিরোধিতা। এই সমস্যা সমাধানেরচাবিকাঠি আছে একমাত্র ভারত সরকারের হাতে। বাংলাদেশ ভারতকে প্রতিনিয়ত যে সুবিধা দিচ্ছে(এই যেমন ধরো, ১. বাংলাদেশের কারণেইভারতের পূর্বাঞ্চল সুরক্ষিত! ২. প্রতি বছরবহু লক্ষ ভ্রমণকারী এবং বাংলাদেশে কর্মরত বিপুল সংখ্যক ভারতীয়দের কারণে ভারতের বৈদেশিক মুদ্রার অর্জনের অন্যতম উৎস বাংলাদেশ!) তার বিনিময়ে ভারত যদি এ, বি, সিসব দলের মনের অন্তস্থলে থাকা সবগুলো দাবিও পূরণ করে দেয়, তবুও ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে যথেষ্ট প্রতিদান দেওয়া হবে না। বাংলাদেশ যা যা চায়,ভারত সহজেই তা দিতে পারে(কিন্তু দেবে না, উত্তর ভারত দিতে দেবে না) এবং যদি দিয়ে দেয়, তবে বি দলের অস্তিত্ববাংলার ইতিহাস থেকে মুছে যাবে। এতে আখেরে উত্তর ভারতেরই লাভ, কিন্তু ভারতের বোকা নীতিনির্ধারকেরা (চট্টগ্রামে যেমনটা বলে) 'বেগুন তোলা' চেনে, 'মূলা তোলা'-র খবর রাখেনা।
বি দলের দুটি বড় ঘাটতি আছে: ১নায়ক ঘাটতি ও ২. ভিলেন ঘাটতি। শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দী এবং অবশেষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব– এ দলের মহান নায়কদের মতো একজন নায়কও বি দলে নেই। এ দলের কোনো নায়ক বি দলের ভিলেন নয়, অথচ বি দলের নায়ক সবেধন জিয়ামণি এ দলের ভিলেন। বি দলের নাটক জমছে না, কারণ আক্রমণ করার মতো তেমন কোনো ভিলেন তাদের সামনে নেই। যদিও বঙ্গবন্ধুই তাদের দৃষ্টিতে প্রধান ভিলেন, কিন্তু তিনি আবার রাষ্ট্রপিতা, তাঁর বিরুদ্ধে কুৎসা রচনায় আইনগত বাধা আছে। আক্রমণযোগ্য ভিলেনের অভাব এতটাই প্রকট যে আসল ভিলেন না পেয়ে বি দল জোর করে, যে কাউকে ভিলেন বানাতে চেষ্টা করছে। রবীন্দ্রনাথ সেই জোর করে বানানো ভিলেনদের অন্যতম। মূর্খতার ডেঙ্গু আর পশ্চাৎপদতার চিকনগুনিয়ায় আক্রান্ত বি-দলের বাঙালি (মুসলমান বলা যাবে না, কারণ গয়ার ঈশ্বর কিংবা তাঁর পুত্রবধূ গোস্বা হবেন!) মশা তাড়াতে গিয়ে হন্তদন্ত হয়ে এমন এক ভুল 'গোয়ালে ধোঁয়া দিচ্ছে' যার নাম 'শান্তিনিকেতন'। গরজ বড় বালাই।
প্রিয়দিনারজাদি, আমি বিভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে বি দলের রবীন্দ্রবিদ্বেষেরযথাসাধ্য জওয়াব দিতে চেষ্টা করলাম। আমার জওয়াব যদি সত্য হয়, তবে রবীন্দ্রদ্বেষীদের সওয়াল মিথ্যা হবার সমূহ সম্ভাবনা আছে। মিথ্যাকে ইসলামে 'উম্মুল গুনাহ' অর্থাৎ সকল পাপের মা বলা হয়েছে।বাক্য ও লিপিতে রবীন্দ্রনাথেরবিরুদ্ধে মিথ্যা সব বিষ উগরেদেবার কী ভীষণ শাস্তি,রবীন্দ্রনাথের জীবনদেবতা, আইয়ামে জাহিলিয়া যুগের বৃষ্টি ও সৃষ্টির দেবতা,কিংবা মুসলমানদের সৃষ্টিকর্তা ঐসব মিথ্যাবাদীদের দেবেন, কল্পনা করে আমি শিহরিত হচ্ছি, কারণ পবিত্র গ্রন্থে বার বার বলা হয়েছে: 'নিশ্চয়ই তিনি ভঙ্গ করেন না অঙ্গীকার!' তবেএকটাই আশা এই উম্মুল গুনাহগারদের,মধ্যপ্রাচ্যের ধর্মগুলোতে তওবা করলে শাস্তি মওকুফ হবার সম্ভাবনা থাকে। 'নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল ও দয়াবান!' আমিন।
[সওয়াল জওয়াব আপাতত শেষ। ইতিমধ্যে পূবের আকাশে সুবেহ-সাদিকের চিহ্ন ফুটে উঠেছে এবং ভোরের আযানও শোনা গেছে। ফজরের নামাজ আদায় করে দুই বোন নকশি-লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লেন। বাংলাদেশে রবীন্দ্রবিদ্বেষের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বাঙালির, বাংলাদেশের ইতিহাসই যেন বিশ্লেষণ করে দেখালেন শেহেরজাদি। অজু করতে করতে বাদশা শাহরিয়ার মুগ্ধ হয়ে ভাবছিলেন, যে গলাটি দিয়ে এত চমৎকার সব যুক্তিপূর্ণ কথা বের হয়, সেটি কেটে দুফাঁক করে ফেলা কি ঠিক হবে? শেহেরজাদির মৃত্যুদণ্ড ত্রয়োদশ দিন পর্যন্ত মুলতবী হলো।]