Published : 05 Oct 2019, 03:45 PM
বাঙালি হিন্দুর সর্বপ্রধান এবং সবচেয়ে বর্ণাঢ্য ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। আমরা দুর্গাপূজা বললেও আসলে এই পূজা মা-দুর্গার একার নয়। সঙ্গে আরও অনেকেই আছেন। মা দুর্গা আসেন সবাইকে নিয়েই৷ ভালো-মন্দ, শত্রু-মিত্র, গাছ-প্রাণী সঙ্গে নিয়েই৷ চালচিত্রে শিব আছেন, তো পায়ের নিচে অসুর৷ কলাগাছ বউ তো পেঁচা, হাঁস, ইঁদুর, ময়ূর বাহন৷ হাসিকান্না, সুজন-দুর্জন, পশুপাখি-উদ্ভিদ সমাহারে আমাদের জীবন-পথ চলাটাকেই সহজ করে চিনিয়ে দিতে চান৷
পৌরাণিক কাহিনি থেকে দুর্গা পূজার শুরু। কিন্তু ক্রমে দুর্গা যেন আমাদের ঘরের মেয়ে হয়ে উঠেছেন। সাধারণ মেয়ে, তবে দাপুটে। এই দাপুটে মেয়ের কত নাম! এক অঙ্গে বহুরূপ। এক রূপে বহুনামে চিহ্নিত মা দুর্গা। শরৎঋতুতে আবাহন হয় বলে দেবীর আরেক নাম শারদীয়া। এছাড়া মহিষাসুরমর্দিণী, কাত্যায়নী, শিবানী, ভবানী, আদ্যাশক্তি, চণ্ডী, শতাক্ষী, দুর্গা, ঊমা, গৌরী, সতী, রুদ্রাণী, কল্যাণী, অম্বিকা, অদ্রিজা এমন কত নাম আছে মায়ের। ঠিক নানী-দাদীরা যেমন আমাদের আদর করে একটা নামে ডাকে, মামার বাড়িতে আদিখ্যেতা করে অন্য নামে ডাকা হয়। আবার বাবার দেওয়া একটা নাম, মায়ের দেওয়া একটা নাম, স্কুলের জন্য একটা ভালো নাম। মা দুর্গারও তেমনি অনেক নাম। সে তো আমাদেরই ঘরের মেয়ে!
তাহলে দুর্গাকে? তিনি এক দেবী। দেবী কে? এক শক্তি। শক্তি কী? কর্ম বা কাজ করার ক্ষমতা। আমরা যেকথা বলি, কথা একটা কাজ। দেখি, শুনি, বুঝি এগুলোও কাজ। শক্তি ছাড়া কাজ হয় না। এ শক্তিকথন শক্তি, শ্রবণ শক্তি, দৃষ্টি শক্তি, বোধ শক্তি। এ শক্তির নাম সরস্বতী।
সনাতন হিন্দুধর্মমতে, ব্রহ্মা সৃষ্টির, কার্য-কারণের তত্ত্বগত ব্যাখ্যায় ঈশ্বরের ট্রিনিটি বা ত্রয়ীঅবস্থাকে গ্রহণ করা হয়েছিল। তিনি যখন সৃষ্টি করেন তখন তিনি ব্রহ্মা (সৃষ্টিকর্তা),যখন সৃষ্টি বজায় রাখেন তখন তিনি বিষ্ণু (পালনকর্তা), যখন নতুন সৃষ্টির মানসে জগৎ ধ্বংসকরেন তখন তিনি মহেশ্বর (প্রলয়কর্তা)। বিশ্বেশ্বরের এই সৃষ্টি, পালন ও প্রলয়কার্যে যেএনার্জি (শক্তি) বা 'কনসাসনেস' (চেতনা) অন্তসলিলার মতো বিশ্বজগতের সর্বত্র নিয়ত প্রবাহমানতাকে সনাতনধর্ম প্রকৃতি হিসাবে ব্যাখ্যা করেছে।
আসলে দুর্গাদেবীর কাহিনিটি রূপক মাত্র। মহিষাসুর ও মহিষাসুরমর্দিনীর সংগ্রাম এবং পরিশেষে মহিষাসুরমর্দিনী কর্তৃক মহিষাসুরের পরাভব প্রকৃতপক্ষে মানুষের অন্তরস্থিত দেবতা ও দানবের শুভশক্তি ও অশুভশক্তির সংগ্রাম এবং পরিশেষে শুভশক্তির কাছে অশুভশক্তির পরাজয়ের প্রতীক।
সুতরাং কবে,কোথায় কেন, কিভাবে দেবী দুর্গার আবির্ভাব ও সংগ্রাম-সেসব প্রশ্ন অবান্তর। পুরাণেরসংগ্রাম-কাহিনির বাস্তবতা নিয়ে বিচার গবেষণার প্রয়োজন অবশ্যই চলতে পারে, কিন্তুআমাদের অন্তর্জগতে যে নিরন্তর শুভ ও অশুভের সংগ্রাম চলছে এবং সেই সংগ্রামে আমরাপ্রতিনিয়ত ক্ষতবিক্ষত হচ্ছি তার বাস্তবতা আমরা কেমন করে অস্বীকার করব? এই সংগ্রামযেমন অনাদি, তেমনি আপেক্ষিক বিচারে তা অনন্তও। এবং এই সংগ্রাম পুরাণ-কথিতসংগ্রামের চেয়েও কঠিনতর। যতদিন সৃষ্টি থাকবে ততদিন মানুষের মধ্যে এই সংগ্রাম চলতেথাকবে। দুর্গা ও মহিষাসুরের যুদ্ধ যেমন মানুষের মধ্যে শুভ ও অশুভের চিরন্তনযুদ্ধের প্রতীক।
তবে আমাদেরদেশে যে দুর্গাপূজা হয়, তা একেবারেই লৌকিক, পুরাণের সঙ্গে এর মিল যৎসামান্য। শরৎকালেরমহাপূজাতে বাঙালির হৃদয়ে দেবীর অধিষ্ঠান হয় প্রধানত কন্যারূপে। কার্ত্তিক, গণেশকে দেবীরপরিবারভুক্ত মনে করা হয়। বাঙালি হিন্দুগণ মনে করেন শারদোৎসবের মাধ্যমে কন্যাস্থানীয়দেবী সপরিবারে চারদিনের দিনের জন্য পিতৃগৃহে আগমন করেন। এই আগমন আনন্দের ও উৎসবের।
দুই.
আমাদেরদেশে দুর্গাপূজাকে বলা হয় শারোদোৎসব। এই উৎসবে সামিল হন সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষ। তাইএকে বলা হয় সর্বজনীন শারোদোৎসব। আমাদের দেশ উৎসবের দেশ, পার্বণের দেশ। বারো মাসে এখানে তের পার্বণ। এক সময় উৎসব-পার্বণে এদেশের মানুষ আনন্দ-সুখে দিন কাটাত। প্রাত্যহিকের বেদনা ভুলে থাকতে পারত।
'প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র দীন একাকী- কিন্তু উৎসবের দিনে মানুষ বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ!'
কথাগুলো রবীন্দ্রনাথের। উৎসবের সম্মিলনে আমরা অর্জন করি 'আমরা' হবার বোধ-উপলব্ধি! উৎসব তাই সবার জন্যই সতত সুখের এবং আনন্দের। এ এক মহৎ হবার সাধনা, বৃহৎ হওয়ার সংকল্প। উৎসব হচ্ছে সবার মিলন। সবাইকে যুক্ত করার মধ্যেই উৎসবের সার্থকতা। সবার সঙ্গে মিলে মিশে উৎসব পালনের মধ্যে নিশ্চয় আনন্দ অনেক বেশি। দারিদ্র্য ও বৈষম্য-বঞ্চনা ঘুচে গিয়ে এ আনন্দ সবার জন্য যদি সত্য হয় তবে তার মূল্য অপরিমেয়। সবাইকে নিয়ে যে উৎসব তা জীবনকে নতুন তাৎপর্য দান করে। সব সংকীর্ণতা ও ভেদাভেদ ভুলে একে অপরের সঙ্গে মিলিত হওয়ার শক্তি দান করে। পরস্পরের বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী হয়ে ওঠার এক মহান উপলক্ষ হচ্ছে বিভিন্ন উৎসব।এর মধ্যে রয়েছে দুর্গাপূজা। এ ছাড়া ঈদ, বড়দিন, প্রবারণা পূর্ণিমা। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানকে ছাপিয়ে এসব উৎসব তাই এখন ঘোষণা করে মানুষে মানুষে মিলনের আহবান।
উৎসবের সঙ্গে শান্তির গভীর যোগসূত্র আছে। শান্তির কমতি থাকলে উৎসবের আনন্দেও ভাটা পড়ে। এই শান্তির জন্য চাই অনুকূল পরিবেশ। পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সম্মান ও সহমর্মিতা থেকে যে সামাজিক শান্তির পরিবেশ সৃষ্টি হয় তা উৎসবের আনন্দকে অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয়।
আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের গতানুগতিকতার ব্যত্যয় ঘটিয়ে উৎসব জীবনকে রসালো, আনন্দঘন এবং প্রাণবন্ত করে তোলে। তাই উৎসব আমাদের কাছে এত কাঙ্ক্ষিত।প্রতিদিন অবশ্য উৎসব আশা করা যায় না, এলে ভালোও লাগবে না। বাস্তব জগতে কর্মই ধর্ম, কর্মই কাম্য। তবে দীর্ঘ সময়ব্যাপী কর্মের ফলে জীবনে ক্লান্তিকর একঘেয়েমি সৃষ্টি হয়। এর হাত থেকে মুক্তি পেতে একটি বিরতির দরকার হয়। বিরতির সময়টুকু বিনোদনের মাধ্যমে নবআনন্দে জেগে ওঠার সুযোগ করে দেয়।
আমাদের দেশে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের বাস। প্রত্যেক ধর্মবিশ্বাসী মানষেরই রয়েছে আলাদা আচার-অনুষ্ঠান এবং উৎসব। আমাদের দেশের সংস্কৃতির অনন্য বৈশিষ্ট্য হল, প্রত্যেকটি ধর্মীয় উৎসবে অন্য ধর্মের মানুষের আন্তরিক অংশগ্রহণ এবং উৎসবের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেওয়ার মানসিকতা। মানবিক ঔদার্যের এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীর অন্যান্য দেশে বড় বেশি খুঁজে পাওয়া যায় না। যদিও অনেকে ধর্মকে সংকীর্ণ দৃষ্টিতে দেখে ধর্মীয় আচার ও উৎসবকে এক করে ফেলেন এবং উৎসবে সবার অংশগ্রহণের বিরুদ্ধে ফতোয়া প্রদান করেন। মুক্তবুদ্ধির মানুষদের এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে। ধর্মীয় আচার এবং উৎসব পালনকে আলাদা করে দেখতে হবে। মুসলমানরা মসজিদে যাবেন, ঈদগাহ ময়দানে গিয়ে ঈদের নামাজ পড়বেন। অন্য ধর্মের মানুষেরা নামাজ পড়বেন না, কিন্তু ঈদের কোলাকুলি, মিষ্টান্ন আহারসহ অন্যান্য আনন্দ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণে বাধা কোথায়? একইভাবে দুর্গাপূজার আনন্দ-অনুষ্ঠানে যদি অন্য ধর্মাবলম্বীরা অংশগ্রহণ না করেন তাহলে সেই অনুষ্ঠান সফল হয় কি? সেই জন্যই বলা হয়, ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। যে যার যার মতো ধর্মচর্চা করুক কিন্তু মনে রাখতে হবে ধর্ম সাধনার মূলে আছে মনুষ্যত্ব সাধনা। মানব জীবনের পবিত্রতা এবং মানুষের সুখ-শান্তি কামনার মধ্যেই ধর্ম সাধনার সারবস্তুটি নিহিত। 'জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক' ধর্মীয় প্রার্থনাটি যখন আমরা শুনি তখন এক অদ্ভুত অনাবিল প্রশান্তিতে হৃদয় মন পূর্ণ হয়। ঈদুল আযহা যেমন ত্যাগ এবং উৎসর্গের বাণী নিয়ে আসে। ঈদুল ফিতরে আনন্দ এবং আমন্ত্রণের সঙ্গে যুক্ত হয় সুস্বাদু খাবার। আচার অনুষ্ঠানের হলেও উৎসব সবার মনে যে আনন্দ, উৎসাহ এবং উদ্দীপনার সৃষ্টি করে, পারস্পরিক মিলন এবং ঐক্যের যে সুযোগ এনে দেয় তাই তার বৃহৎ অবদান ও মহৎ আশীর্বাদ।
ধর্মীয় উৎসব কিংবা অন্য যে কোনো সামাজিক সাংস্কৃতিক উৎসবের মূলে রয়েছে কল্যাণকামনা এবং শুভবোধ। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা উচ্চারণ করি শুভ, সত্য, সুন্দর এবং কল্যাণের মন্ত্র। সেই মন্ত্রের বলে আমরা যেন অশুভ শক্তি বিনাশের মাধ্যমে সবার হৃদয়ে মানবধর্ম এবং মানবিক মূল্যবোধের উদ্বোধন ঘটাতে পারি, আজকের দিনে আমাদের সেটাই হোক প্রার্থনা। সভ্যতার অগ্রযাত্রা সুর বা শুভ, সত্য এবং সুন্দর প্রতিষ্ঠার সাধনা ছাড়া আর কিছুই নয়।
তিন.
"জগৎজুড়িয়া এক জাতি আছে, সে জাতির নাম মানুষ জাতি" কবির এই কথা মনে প্রাণে বিশ্বাস করলেকোনো মানুষের পক্ষে সাম্প্রদায়িক হওয়া সম্ভব নয়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি মানুষকে অন্যেরপ্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শেখায়। দৃষ্টিভঙ্গি উদার করে। মানুষকে ঐক্যে বিশ্বাস করতে শেখায়।নিজের ধর্মের প্রতি যেমন বিশ্বাস জোরালো করে তেমনি অন্যের ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ পোষণকরা যাবে না- এই বোধও তৈরি করে দেয়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কারণেই বহু সম্প্রদায়থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন জাতি শাক্তিশালী জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
বিশ্বেরপ্রধান ধর্মসমূহের প্রতিটির মৌলিক দর্শন এক ও অভিন্ন। আর তা হলো অহিংসা, ভালোবাসা,সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ধারণা। মানবজাতি এখানে মূল উপজীব্য। মানব প্রেম ও মানব কল্যাণসাধন সকল ধর্মের মূল-শিক্ষা।
আমাদেরসমাজে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে সম্প্রীতিকে রক্ষা করতে হবে। জাতিগত, বর্ণগত,ধর্মগত বিভেদকে তুচ্ছ করে সকলের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধনকে জোড়ালো করতে হবে। সকলের প্রতিসহযোগিতা, সহমর্মিতার হাত বাড়াতে হবে, সৃষ্টি করতে হবে পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস।রাষ্ট্র ও সমাজ কর্তৃক সকলের জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। এমন পরিবেশসৃষ্টি করতে হবে যেন সংখ্যালঘুরা নিরাপদভাবে, দ্বিধাহীন ভাবে সবকিছুতে অংশ নিতে পারে।সকলের ভেতর অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশ ঘটাতে হবে। সরকার, রাজনৈতিক দল ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাকেসংখ্যালঘুদের অনুকূল হতে হবে। ধর্মান্ধতা ত্যাগ করে মানুষের প্রতি, অন্য ধর্মের প্রতি,সম্প্রদায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। আর তা হলেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সাম্প্রদায়িকসম্প্রীতি প্রতিষ্ঠিত হবে।
আরএ জন্য দায় নিতে হবে আমাকে-আপনাকে, আমাদের সকলকে। দেবী দুর্গার আদর্শও কিন্তু সমন্বয়ের; সবাইকে নিয়ে,সবার জন্য।