Published : 29 Aug 2019, 04:28 PM
[পূর্বকথা: হিন্দুস্তানের বদমেজাজি বাদশাহ শাহরিয়ার তাঁর এক বেগমের পরকীয়ার কারণে স্ত্রীজাতির উপর যারপরনাই নারাজ হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, প্রতি রাতে তিনি এক যুবতীকে নিকাহ-এ-মুতা করে ভোর হলেই এক রাতের সেই বেগমকে কতল করাবেন। কয়েক বৎসর ধরে শত শত যুবতী কন্যা বেঘোরে ইন্তেকাল ফরমালো। ক্ষুরধার বুদ্ধিমতী উজিরকন্যা শেহেরজাদি স্বজাতির প্রতি করুণাপরবশ হয়ে ছোটবোন দিনারজাদির সঙ্গে সল্লাপূর্বক স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে নিকাহ করেন বাদশা শাহরিয়ারকে। জীবনের আখেরি রাতে নববধূর আবদার রাখতে বাসরঘরে ডেকে আনা হয় দিনারজাদিকে। রাত গভীর হলে পূর্বপরিকল্পনামাফিক ছোটবোন দিনারজাদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিং নিয়ে একেকটি সওয়াল পুছতে থাকেন আর বড়বোন শেহেরজাদিও কালবিলম্ব না সেই সব সওয়ালের জওয়াব দিতে শুরু করেন। সওয়াল-জওয়াব সব সময় যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় র্যাংকিংয়েই সীমাবদ্ধ থাকতো তা কিন্তু নয়, কথা পল্লবিত হতো বিচিত্র বিষয়ে। বাদশা এই আলোচনায় খুব আনন্দ পাচ্ছিলেন। কিন্তু ভোরের আজান শোনা মাত্র শেহেরজাদি জওয়াব বন্ধ করে দেন বলে কথা কখনোই শেষ হয় না। অনুসন্ধিৎসু বাদশাহ পর পর ছয় দিন শেহেরজাদির মৃত্যুদণ্ড বাতিল করেছেন। আজ সেই সওয়াল-জওয়াবের সপ্তম রাত্রি]
প্রিয় দিদি শেহেরজাদি! সামাজিক গণমাধ্যমে দেখলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শত শত প্রাক্তনী, বাংলাদেশের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের একাংশ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপর মহা খেপে আছেন। যত দোষ রবি ঘোষ। তাঁর প্রধান দোষ, তিনি নাকি গত শতকের দুইয়ের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন। এ বিষয়ে শত শত পৃষ্ঠা লেখা হয়েছে আন্তর্জালে ও মুদ্রিত গণমাধ্যমে। মোল্লারা রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে ওয়াজ করছে। এসব ওয়াজ আন্তর্জালে আপলোড করা হচ্ছে। তোমার দৃষ্টিকোণ থেকে এ ঘটনাটা একটু বিশ্লেষণ করবে কি?
কী বলবো, প্রিয় দিনারজাদি! ১৯৩৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সম্মানসূচক ডি.লিট. উপাধি দিয়েছিল, প্রায় এক শ বছর পর সেই একই বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু প্রাক্তনী বাঙালি জীবন ও মনন থেকে সেই রবীন্দ্রনাথকে 'ডিলিট' করে দিতে চাইছে। এই আচরণ অবশ্য বাঙালি স্বভাবের সঙ্গে সঙ্গতিসম্পন্ন। 'বঙ্গবন্ধু' উপাধি দিতেও দেরি নেই, বছর পাঁচেক পর পিছন থেকে শর্টরেঞ্জে গুলি করে সিঁড়িতে ফেলে দিতেও দ্বিধা নেই! তুমিই বলো বোন, রবীন্দ্রনাথ যদি ১৯১২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতাই করে থাকবে, সেই একই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯২৬ সালে কেন তাঁকে আমন্ত্রণ করে সম্বর্ধনা দেবে? কেনই বা আরও ১০ বছর পর ১৯৩৬ সালে তাঁকে ডি. লিট. দিয়ে সম্মানিত করবে এই একই বিশ্ববিদ্যালয়? ১৯১২ থেকে ১৯২৬ কিংবা ১৯৩৬ – মাত্র ১৪ কিংবা ২৪ বছরে কি ঢাকার মানুষের স্মৃতি এতটাই কি ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল যে একটা ভিলেনকে তারা নায়ক বানাবে? নাকি এর পেছনে রাজনীতির অন্য মারপ্যাঁচ আছে। 'মার' আর 'প্যাঁচ'। প্যাঁচটা আগে খুলবো, মারটা পরে বুঝিয়ে বলবো। চার রাতের কমে ঠাকুরের এই কিসসা খতম হবে না– তুমি আর তোমার বাদশা দুলাভাইকে আমি কিন্তু আগেই বলে রাখছি।
অনেকখানি পেছনে গিয়ে, আটশো বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের আদিপর্বের দিকে তাকানো যাক। মধ্যযুগের দ্বিতীয় পর্বে (১০০০-১৫০০) ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, স্পেন, জার্মানিসহ ইওরোপের বিভিন্ন দেশের নগরগুলোতে যখন রাজা, গীর্জা কিংবা নগর কর্তৃপক্ষের আগ্রহে ও উদ্যোগে একেকটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল, তখন ইওরোপের কোনো রাষ্ট্রে গণতন্ত্র ছিল না। গ্রীসের কিছু নগররাষ্ট্রে গণতন্ত্র মরে ভুত হয়ে গিয়েছিল, ধরা যাক খ্রিস্টপূর্ব যুগে। এর হাজার বছর পর, গিল্ডগুলোর অনুকরণে সৃষ্টি হয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিচালনা পদ্ধতিতে গণতন্ত্রের পুনর্জন্ম হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট, সিন্ডিকেট পরিচালিত হতো গণতান্ত্রিক উপায়ে। উপাচার্য, প্রক্টর, ডিন ইত্যাদি পদাধিকারী ব্যক্তিরা নির্বাচিত হতেন ভোটের মাধ্যমে, যখন কিনা রাষ্ট্র পরিচালিত হতো স্বৈরতান্ত্রিক পদ্ধতিতে, অনেকটাই রাজা বা রাণীর ইচ্ছায়। এর মানে হচ্ছে, এক. জনগণ কোন ধরনের শাসনব্যবস্থা চায়, তার প্রতিফলন হয়েছিল জনগণের প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় এবং দুই. মন-মানসিকতা-বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে ইওরোপের মধ্যযুগের জনগণ তাদের শাসকদের তুলনায় এগিয়ে ছিল।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো১০০% ভাগ পাশ্চাত্যের বিশ্ববিদ্যালয়ের অক্ষম অনুকরণ। এদেশে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাঅনেকটা 'উঠ ছুড়ি তোর বিয়া লেগেছে!' সরকারের (প্রধান কিংবা অপ্রধান) কোনো মন্ত্রীর ইচ্ছেহলো, কিংবা কোনো ব্যবসায়ীর খ্যাতি ও ক্ষেতির লোভ হলো, তিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনকরার উদ্যোগ নিয়ে ফেললেন। কিন্তু মধ্যযুগের ইওরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছিল তৎকালীনসমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক ও মনোজৈবনিক বিকাশের স্বাভাবিক ফলশ্রুতি।
কোনো জাতির বুদ্ধিবৃত্তিকও মনোজৈবনিক স্তর অনেকটাই গঠিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেএবং আমরা এও দেখেছি, শিক্ষিত জনগণের বুদ্ধিবৃত্তিক ও মনোজৈবনিক স্তরের প্রতিফলন হয়বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতির চরিত্রে। এটাই হবার কথা। বৃক্ষ তোমার নাম কী? ফলে পরিচয়। একটিবিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের আচরণ ও যুক্তিবোধ দেখে বোঝা যাবে,বিদ্যাদান ও জ্ঞানচর্চায় সেই বিশ্ববিদ্যালয় কতটা চৌকশ। বাঙালি জাতি বুদ্ধিবৃত্তিক ওমনোজৈবনিক চর্চার ঠিক কোন স্তরে অবস্থান করছে তা বোঝা যাবে শিক্ষিত বাঙালি, বিশেষতঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকদের কিছু আচরণ-কথাবার্তা-লেখালেখি পর্যালোচনা করলে।
ঠাকুরের পো! কোন কুক্ষণেতুমি জন্ম নিয়েছিলে এই পোড়া দেশে! বাঙালিকে কী দাওনি তুমি, অথচ যুগে যুগে তুমিই তাদেরঅহেতুক আক্রমণের শিকার, এপারে কিংবা ওপারে। আছাড় খেয়ে ব্যথা পেয়ে অপোগ- শিশু যেমন মাটিতেলাথি মারে, তেমনি কারণে-অকারণে, জেনে কিংবা না জেনে, বাঙালি আক্রমণ করে (গ্রামীণ, টেলিটককাউকে নয়!) ঐ এক রইব্যাকেই। রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে অন্যতম অভিযোগ, তিনি নাকি ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন। প্রমাণ? প্রমাণ লাগে নাকি? রিমান্ডে নিলেবুড়া নিজেই স্বীকার করতো যে সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল।স্বীকার না করলে রাতের অন্ধকারে ক্রসফায়ার বা বিপ্রতীপ গোলাগুলিতো আছেই।
রবীন্দ্রনাথকে যেহেতু রিমান্ডেনেওয়া আর সম্ভব নয়, কিংবা উপায় নেই তাকে ক্রসফায়ারে দেবার, সেহেতু উপরোক্ত অভিযোগেরলিখিত প্রমাণ লাগবে। প্রমাণ না থাকলে মিথ্যা প্রমাণই সই, যদিও রবীন্দ্রদ্বেষীরা সবাইমুসলমান এবং ইসলাম ধর্মে মিথ্যাচার হচ্ছে 'উম্মুল গুনাহ', অর্থাৎ সকল পাপের মা। একাধিকআয়াতে মিথ্যাচারকে পাপ বলা হয়েছে পবিত্র কোরানে। 'যদি সে মিথ্যাবাদীদের একজন হয়, তবেতার উপর আল্লাহর অভিশাপ নেমে আসবে!' (সুর আন-নূর, আয়াত ২৪:৮)। 'প্রার্থনা করো যেন মিথ্যাবাদীদেরউপর আল্লাহর অভিশাপ নেমে আসে!" (সুরা আল ইমরান, আয়াত ৩:৬১)। একটি হাদিসে আছে: 'পৃথিবীরসব পাপ যদি একটি কক্ষে পুঞ্জিভূত হয়, তবে সেই কক্ষের চাবিটি হবে মিথ্যাচার।'
মিথ্যাচারে বাঙালির সঙ্গে কোনো জাতিই হয়তো পাল্লা দিতে পারবে না, কারণ ঠাকুর গেয়েছেন: 'ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে!' মিথ্যাচারের লিখিত প্রমাণ: বাংলাদেশের ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রকাশিত কোনো এক পুস্তকে নাকি [আমি কিন্তু আগেই বলে রাখছি, দিনারজাদি যে বইটির কথা আমি আন্তর্জালে পড়েছি, স্বচক্ষে দেখিনি] লেখা আছে, ১৯১২ সালের ২৮ মার্চ তারিখে কলিকাতার গড়ের মাঠে এক বিশাল জনসভা হয়েছিল। খোদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন সেই জনসভার সভাপতি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা ছিল সেই জনসভার আলোচ্য বিষয়।
এই তথ্যের উপর ভিত্তি করে আহমদ পাবলিশিং হাউস ২০০০ সালে 'আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারাবাহিকতা ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা' শীর্ষক এক পুস্তক প্রকাশ করেছিল। 'রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতা করেছিলেন'– এই মর্মে 'জেনারেল' মন্তব্য করে 'মেজর' এক মিথ্যাচার করে বসেন সেই পুস্তকের লেখক, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এক মেজর জেনারেল। ইনি বীরপ্রতীক, পি.এস.সি.র সদস্য এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্ঠাও বটেন। 'একেতো নাচুনি বুড়ি, তার উপর ঢোলের বাড়ি।' প্রসঙ্গ আসুক বা না আসুক, বখতিয়ার ধর্মগুরুরা সুযোগ পেলেই ওয়াজ মাহফিলে রবীন্দ্রনাথের চৌদ্দগুষ্ঠী উদ্ধার করে থাকেন। তারা এবার নবউদ্যমে রবীন্দ্র-মুণ্ডুপাতে নেমে পড়লেন এবং সেসব বক্তৃতা অনতিবিলম্বে খোমাকিতাবে আপলোডিত হলো।
সমস্যা হচ্ছে, প্রিয় দিনারজাদি, রবীন্দ্রনাথের জীবন অন্য যে কোনো বাঙালি বুদ্ধিজীবীর তুলনায় ডক্যুমেন্টেড। তিনি কোন দিন কী করেছেন, এমনকি একই দিনের কোন বেলায় কী করেছেন, কী বলেছেন, সব তথ্য কমবেশি লিপিবদ্ধ আছে, যে কারণে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে মিথ্যা গুজব রচনা অসম্ভব না হলেও কার্যত কঠিন। পর্যাপ্ত তথ্যপ্রমাণ আছে যে ১৯১২ সালের ২৮ মার্চ তারিখে রবীন্দ্রনাথ কলকাতায়ই ছিলেন না। ১৯ মার্চ রবীন্দ্রনাথের লন্ডন যাবার কথা ছিল, অসুস্থতার জন্যে যেতে পারেননি। ২৪ মার্চ তারিখে রবীন্দ্রনাথ চলে আসেন বাংলাদেশের শিলাইদহে এবং অন্তত ১২ এপ্রিল পর্যন্ত তিনি সেখানেই অবস্থান করেন। শিলাইদহ যাবার খরচ লেখা হয়েছে সেই হিসাবের খাতা পর্যন্ত এখনও সংরক্ষিত আছে।
তিনটি গোষ্ঠী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিল বলে দাবি করা হয়: ১. পশ্চিমবঙ্গের বর্ণহিন্দু, কারণ তারা ভেবেছিল, ঢাবি প্রতিষ্ঠিত হলে কবির (কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়) গুরুত্ব এবং কবিতে সরকারি অর্থসহায়তা কমে যাবে; ২. পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান, কারণ তারা চাইছিল, ঢাকায় না হয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হোক; ৩. পূর্ববঙ্গের মুসলমান, কারণ পূর্ববঙ্গে কলেজের সংখ্যা পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় কম ছিল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার মতো যথেষ্ট কলেজপাশ ছাত্র ছিল না সে বাংলার পূর্বঞ্চলে। সুতরাং ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে পূর্ববঙ্গের নয়, বরং অন্য অঞ্চলের শিক্ষার্থীর সুবিধা হবে বলে ভেবেছিল তারা। তারা মনে করতো, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবর্তে স্কুল এবং কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলে শিক্ষার প্রকৃত প্রসার হবে পূর্ববঙ্গে। তবে এইসব বিরোধিতা ছিল একান্ত ক্ষণস্থায়ী। বর্ণহিন্দুদের অন্যতম প্রতিনিধি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায় নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যে চারটি অধ্যাপক পদ পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা থেকে সরেই শুধু আসেননি, বরং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক নিয়োগে সহায়তাও করেছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ইনস্টিটিউটের এক শিক্ষকের বক্তব্য পাওয়া যায় আন্তর্জালে: 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যে তিন শ্রেণির মানুষ বিরোধিতা করেছিলেন, তাদের মধ্যে আমরা রবীন্দ্রনাথকে তৃতীয় কাতারে রাখতে চাই। কারণ তারা ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের উচ্চবর্ণের কিছু হিন্দু সমাজ। তাদের সাথে বিশেষ করে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায় আর রাজনীতিক সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জির একাধিক বৈঠক, আলোচনা হয়েছে শিলাইদহ যাওয়ার আগেও। এ থেকে আমরা অনুধাবন করতে চাই সেখানে পূর্ববঙ্গের সার্বিক উন্নতি নিয়ে তাদের মধ্যে আলোচনা হতে পারে। তবে এরও কোনো স্পষ্ট তথ্যপ্রমাণ নেই।"
'আপনারা' কারা? কেন রবীন্দ্রনাথকে আপনারা তৃতীয় কাতারে রাখতে চান? রবীন্দ্রনাথ পশ্চিমবঙ্গের উচ্চবর্ণের হিন্দু ছিলেন– এই তথ্য আপনি কোথায় পেলেন? রবীন্দ্রনাথ যে ব্রাহ্মধর্মাবলম্বী ছিলেন সে তথ্য না জেনেই কি আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে গেছেন? রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আশুতোষ কিংবা অন্যদের বৈঠক হয়েছে সে তথ্যেরই বা উৎস কী? বৈঠক যদি হয়েও থাকে, সেই বৈঠকে আলোচনার বিষয় কী ছিল তাই বা আপনি কীসের ভিত্তিতে 'অনুধাবন করতে' চান? আবার নিজেই বলছেন, কোনো স্পষ্ট তথ্যপ্রমাণ নেই। তথ্যপ্রমাণ যদি নাই থাকে, তবে মুখের জিপার বন্ধ রাখার পরিবর্তে কোন আক্কেলে আপনি বলছেন যে রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করে থাকতে পারেন? এই শিক্ষকের সুচিন্তিত বক্তব্য থেকে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক তথা সিংহভাগ বুদ্ধিজীবীর যুক্তিসম্মত আলোচনা করার ক্ষমতার দৌঁড় সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যাবে।
প্রিয় দিনারজাদি, বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ বিশ্বাস করে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল পূর্ববঙ্গের মুসলমানের উচ্চশিক্ষা প্রদান। উচ্চবর্ণের হিন্দুরা যেহেতু মুসলমানদের চিরশত্রু, সেহেতু তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করারই কথা। রবীন্দ্রনাথের পক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা করাটা খুব স্বাভাবিক তাদের দৃষ্টিতে, কারণ তিনি ছিলেন (তাদের মতে) বর্ণহিন্দুর প্রতিনিধি। তথ্য-প্রমাণ যদি না পাওয়া যায়, তবে সেটা একান্তই বাংলাদেশের মুসলমানদের দুর্ভাগ্য। সহজ-সরল সমীকরণ। দুয়ে দুয়ে সব ক্ষেত্রে চার হয় না, কারণ অনেক দুয়েও বাঁট থেকে দুধ আসে না অনেক সময়। মানুষ মরণশীল। রবি মরণশীল। সুতরাং রবি একজন মানুষ। আরস্তুলীয় যুক্তিবিদ্যায় এই ধরনের যুক্তিবিন্যাস বা সিলোজিসমের নাম 'ফ্যালাসি' বা 'অ্যাবডাকশান'। এর বাংলা প্রতিশব্দ হতে পারে 'বিরোহন' ('আরোহন', 'অবরোহন'-এর অনুসরণে। জানি না অন্য কোনো প্রতিশব্দ আছে কিনা যুক্তিবিদ্যায়)। বিরোহন দিয়ে কোনো গ্রহণযোগ্য, যুক্তিসম্মত উপসংহারে আসা যায় না। প্রমাণ: 'রবি' বাংলাদেশের একটি ফোন কোম্পানীর নাম এবং যেহেতু যোগাযোগমন্ত্রী যে কোনো মুহূর্তে লাইসেন্স বাতিল করে রবিকে খুন করতে পারেন, সেহেতু রবিও মরণশীল।
রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে উপরোক্ত 'বিরোহিত' কুৎসার কোনো ভিত্তি থাকুক না থাকুক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের একটি বিশাল অংশ বিশ্বাস করে বসে আছে যে রবীন্দ্রনাথ আসলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন। সিডনি থেকে ঢাবির এক পুরুষ প্রাক্তনী লিখেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথের বিরোধিতার সপক্ষে কোনো প্রমাণ নেই, কিন্তু খুঁজলে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে (তিনি নাকি ঢাকা গিয়ে ঢাবির উপাচার্যকে জিগ্যেস করবেন, ওঁর কাছে কোনো প্রমাণ আছে কিনা!)। এক প্রাক্তনী মহিলার বক্তব্য ছিল এরকম : মানুষ মাত্রেই ভুল করে। রবীন্দ্রনাথ সারা জীবনে যত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, ভুলবশত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করে থাকলেও সে সব অবদান মিথ্যা হয়ে যায় না।
শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে বাঙালিরা এক অদ্ভুত জাতি, দিনারজাদি। তাদের কথা হচ্ছে, বিচার মানি বা না মানি, তালগাছ সব সময়ই আমারই থাকতে হবে। গত কয়েক দশকে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে উপরোক্ত অভিযোগ খণ্ডন করে শত শত পৃষ্ঠা লেখা হয়েছে মুদ্রিত ও সামাজিক গণমাধ্যমে। কিন্তু সেসব পড়ার প্রয়োজনবোধ করছেন না কেউ। এর অর্থ হচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিজের স্নাতকদের যুক্তিশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। তবে 'যুক্তিশীল' না হোক, প্রাকৃতিক কারণেই যে এই সব ছত্রাক 'মরণশীল'– এই যা ভরসা। প্রিয় দিনারজাদি, আমি স্বপ্ন দেখি, বিষাক্ত, নঞর্থক এই সব ছত্রাক চিরকালের মতো (চট্টগ্রামে যেমন বলে) 'যমের দক্ষিণ দুয়ারে গিয়ে' বাঙালির চিন্তালোক একদিন নতুন স্বাস্থ্যকর, সদর্থক ফুলেফলে ভরে উঠবে।
[গল্প শেষ না হলেও থামাতে হয় শেহেরজাদিকে, কারণ ইতিমধ্যে পূবের আকাশে সুবেহ-সাদিকের চিহ্ন ফুটে উঠেছে এবং ভোরের আযানও শোনা গেছে। ফজরের নামাজ আদায় করে দুই বোন নকশি-লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লেন। বাদশা শাহরিয়ারও বেরিয়ে গেলেন ফজরের নামাজ আদায় করতে এবং অতঃপর রাজকার্যে। কিছু বাঙালির ভিত্তিহীন রবীন্দ্রবিদ্বেষের এসব প্যাচাল বাদশা আগেও পড়েছেন আন্তর্জালে, যদিও শেহেরজাদি ছাড়া অন্য কেউ এই কারণগুলো বিহগ, সিংহ ও কীটদৃষ্টিকে বাদশাকে দেখাতে সক্ষম হননি। সময় ও অনুশীলনের অভাবে বাদশারা সাধারণত জ্ঞানী হন না, কিন্তু সঙ্গগুণে কারও কারও জ্ঞানতৃষ্ণা প্রবলতর হয়ে উঠতে পারে। বাদশা শাহরিয়ারেরও তাই হয়েছে। শেহেরজাদির মৃত্যুদণ্ড অষ্টম দিন পর্যন্ত মুলতবী হলো।]