রাসেলকে ফেইসবুকে বাহবা পেতে দেখেছি এবং রাসেল যখন বেধড়ক মারধর করছিলেন নারী থেকে কিশোরীদের, আশপাশে অনেক মানুষ নির্বাক দর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন। আমার খুব জানার আগ্রহ পুলিশ এই ঘটনা সম্পর্কে কিছু জানে কিনা? উত্তর পেয়েছি তাদের এই সম্পর্কে কিছুই জানা নেই।
Published : 03 Sep 2024, 08:53 PM
সবুজ রংয়ের একটি পাইপ দিয়ে একের পর এক নারীকে পেটাচ্ছেন একজন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেইসবুকে এটি অনেকেরই দেখা হয়ে গেছে। এইচএম রাসেল সুলতান (HM Rasel sultan) নামে এক ব্যক্তি এই কাণ্ডটা ঘটিয়েছেন। সোমবার রাতে এই লেখাটি যখন লিখছিলাম ফেইসবুকে তার পাতাটি দেখা যাচ্ছিল না, যেখানে ইংরেজিতেক HM Rasel sultan লেখার পর ব্র্যাকেটে দোকানি রাসেল লেখা ছিল। তবে ভিডিওটি এখনও আছে, অন্য কারও কারও ফেইসবুক পাতায়।
রাসেল নামের ওই লোকটিকে বেশ গৌরবের সঙ্গে ঘোষণা করতে শোনা যায়, এই কাজটি তিনি দ্বিতীয় দিনের মতো করছেন।
“এইভাবে উচ্ছেদ করতে হবে পতিতাদের। এক গ্রুপকে মারছি, আরেক গ্রুপ আসছে।” নিজের ফেইসবুক পাতায় দেওয়া দোকানি রাসেলের একটি ভিডিও শুরু হয় এই কথাগুলো দিয়ে। শুরুতে তার মুখে মাস্ক পরা ছিল। এরপর মাস্ক খুলে নিয়ে কথাগুলো বললেন দোকানি রাসেল। তিনি যে একজন বিবাহিত, তার একটি কন্যাসন্তান আছে, সেগুলো তার ফেইসবুক থেকেই জানা যায়। যাদের তিনি পেটাচ্ছিলেন, তাদের ‘পতিতা ও শিশু অপহরণকারী’ বলে তকমা দিয়েছেন। যদিও একটি ভিডিওতে নির্যাতিত শাড়িপরা প্রথম নারীটিকে দেখে যথেষ্ট সংশয় জাগে তিনি পথচারী কিনা? পথচারী বা যৌনকর্মী বা শিশু অপহরণকারী যে-ই হোক না কেন, তাকে মারধর করার অধিকার এই দোকানি রাসেলকে কে দিয়েছে?
একটি ভিডিওতে দেখা যায় উন্মত্তের মতো নারীদের হামলা করতে ছুটছেন দোকানি রাসেল। ওইসব নারী দৌড়ে জান বাঁচাতে পারছেন না। রাসেলের এলোপাথাড়ি মারে রাস্তায় পড়ে গেছেন এক তরুণী। এরপরও ওই তরুণীকে পেটাচ্ছেন রাসেল। তরুণীটি তার পায়ে ধরে মাফ চাচ্ছিলেন। খোদ রাজধানী ঢাকার শ্যামলীতে পরপর এমন ঘটনা দুদিন ঘটানো হয়েছে বলে জানাচ্ছেন এএফপির ফ্যাক্ট চেকিং এডিটর কদরুদ্দীন শিশির।
শিশির লিখছেন, “ঢাকার শ্যামলীতে এমন ঘটনা অন্তত দুইদিন (তার ফেসবুকে অন্তত দুইটি ভিডিও পোস্ট করেছে) ঘটিয়েছে এবং সেসবের ভিডিও রেকর্ড করে ফেসবুকে পোস্ট করেছে।
এই ব্যক্তির নাম HM Rasel Sultan; যার আইডি লিংক: https://web.facebook.com/rasel.singer.52
হামলার বিষয়ে সে ফেসবুক পোস্টে জানিয়েছে, তার এই অভিযান ‘পতিতাদের উচ্ছেদের’ জন্য। অন্যদেরকেও এমনভাবে উচ্ছেদের নেমে পড়ার আহ্বান জানাচ্ছে। এবং লক্ষ্যণীয় হল, বহু লোকজন তার কাজটিকে স্বাগত জানাচ্ছে এবং তাকে নিয়ে গর্ব প্রকাশ করছে।
আমি জানি না বর্তমান সরকারের এসব জঙ্গিপনার বিষয়ে পলিসি কী? এদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেবে নাকি নেবে না। তবে যদি এটুকু বলা যায়, এই ধরনের ঘটনাকে আশকারা দেয়ার ফল হবে সুদূরপ্রসারী– ঘরে এবং বাইরে থেকে।”
ফেইসবুকের আইডি লিঙ্কটি এখন আর সচল নেই। তবে সেখানে একটি মজার লক্ষ্য করার মতো, রাসেল কিন্তু rasel.singer.52। এই ৫২ সংখ্যাটি কি হঠাৎ করে বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের কথা মনে করিয়ে দেয় আমাদের?
ভাবা যায় কী ভয়াবহ অবস্থা! রাসেলের ফেইসবুকে স্পষ্ট তিনি পতিত ক্ষমতাসীনদের সুবিধাভোগী ছিলেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করতে সহজ পথ হিসেবে বেছে নিয়েছে নারীর প্রতি নিগ্রহ ও অত্যাচারের পথকে। নীতিপুলিশের ভূমিকায় নেমে আইনের লঙ্ঘন আইনের প্রতি মানুষের আস্থার সংকট হবে।
কে এই রাসেল? নামটি শোনার পর আমার রাসেল ভাইপারের কথা মনে এসেছে। আসলে তো সাপ এমন নির্মম নয়, নিজেকে আক্রান্ত হওয়ার ভয় না পেলে, কাউকে ছোবল দেয় না। রাসেল সম্পর্কে জানার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখলাম একটি দৈনিকে ছোট্ট একটি খবর ছাড়া কিছু পাওয়া যায়নি। খবরটি রাসেলকে নিয়ে নয়, রাসেলের কাণ্ড সম্পর্কিত, যার শিরোনাম, ‘রাজধানীতে ভাসমান যৌনকর্মীদের মারধর’।
ওই পত্রিকাটির বিবরণ অনুযায়ী, “সবুজ রঙের পাইপ দিয়ে এক নারীকে বেধড়ক পেটাতে থাকেন। তারপর আরেকজনকে তাড়া করেন। পরে এক কিশোরীকে পেটাতে থাকেন। যুবকের পা ধরতে ধরতে মেয়েটি বারবার বলতে থাকে, ‘এ কাজ ছাইড়া দিমু।’ একপর্যায়ে মেয়েটির কাছে থেকে মুঠোফোনটিও কেড়ে নেন সেই যুবক।”
কেড়ে নেওয়া যে রাসেলদের কাজ সেটা জানেন সাংবাদিকরা। কিন্তু সংবাদপত্রে এই ঘটনার একটি মাত্র সংবাদ ছাড়া আমার চোখে কিছু পড়েনি, তবে সাংবাদিকদের অনেকেই ঘটনাটা জানেন। মোস্তফা ইউসুফ নামে আরেক সাংবাদিক ফেইসবুকে রাসেলের তিনটি ছবিসহ একটি পোস্ট দিয়েছেন– “ঢাকার শ্যামলীতে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া নারীদের যৌনকর্মীর তকমা দিয়ে পাইপ দিয়ে দেদারসে পেটানো এইচ এম রাসেল সুলতানের আসল চেহারা।”তিনি আরও লিখেছেন, “তোমরা যারা এ সুযোগসন্ধানীদের এসব নির্মম কাজকে বাহবা দিচ্ছ, মূলত তোমাদের কারণে এসব মীরজাফররা এ বিপ্লবকে খেয়ে দিবে অতি শিগগির। আওয়ামী মন্ত্রী শাহাব উদ্দিনের সাথে রাসেল আবেগঘন ছবি পোস্টাত তখন, আর এখন শিক্ষার্থীদের রক্ত শুকানোর আগে ভাইজান ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা করার মিশনে নেমে গেছে। সে বুঝতে পেরেছে কিভাবে মাঠে নামলে মানুষের সমর্থন পাবে। এবং তার অনুমানই সঠিক। প্রচুর মানুষ তাকে বাহবা দিচ্ছে।”
রাসেলকে ফেইসবুকে বাহবা পেতে দেখেছি এবং রাসেল যখন বেধড়ক মারধর করছিলেন নারী থেকে কিশোরীদের, আশপাশে অনেক মানুষ নির্বাক দর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন। আমার খুব জানার আগ্রহ পুলিশ এই ঘটনা সম্পর্কে কিছু জানে কিনা? উত্তর পেয়েছি তাদের এই সম্পর্কে কিছুই জানা নেই।
সময়ের সুযোগ নিয়ে বিচারবহির্ভূত এইসব কর্মকাণ্ড কোনোভাবেই কাম্য নয়। এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা না, প্রকাশ্যে নারীর ওপর এমন নির্যাতনে উপস্থিত লোকজনের বাধা প্রদান না করা ও তাকে বাহবা দেওয়ার ঘটনায় প্রতীয়মান হয় পুরুষ নিজেকে দেখতে চায় ক্ষমতাতন্ত্রের চূড়ায়।
‘দোকানি রাসেল’ নিয়ে কোথাও কোনো খবর না পেয়ে অনলাইনে খুঁজে পেতে তার দুটি মোবাইল নম্বর পেলাম। যতদূর বুঝতে পারছি, তিনি কোনো পণ্যের হোম ডেলিভারি দেওয়ার কাজ করতেন। ফোন নাম্বার দুটি বন্ধ। পরে এক সংবাদকর্মীর সহযোগিতায় যোগাযোগ করলাম মোহাম্মদপুর থানায়। রাসেল যেখানে কাণ্ডটি করেছেন, সেটি ওই থানা এলাকার অন্তর্ভুক্ত। সংবাদকর্মীটি জানালেন মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফার সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন। ওসি তাকে জানিয়েছেন, “এ বিষয়ে থানায় কোনো অভিযোগ করা হয়নি। এমন কোনো ঘটনা এখন পর্যন্ত আমার কানে আসেনি।”
সাম্প্রতিক সময়ে আরজি কর হাসপাতালে ঘটে যাওয়া ধর্ষণের ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গও উত্তাল। প্রতিবাদী মানুষগুলোর মধ্যে নারী অংশগ্রহণকারীদের বহিরাঙ্গে কেউ হয়তো বোরকা-হিজাব পরেছে, কেউ আছেন পশ্চিমা পোশাকে। শূন্যে তোলা হাতের শক্ত মুঠো করে একসঙ্গে হাঁটা মেয়েদের বেঁচে থাকার মধ্যে আদপেই কি কোনো প্রভেদ আছে! এই রকম ঘটনা ভারত, বাংলাদেশ বা ইংল্যান্ড গোটা বিশ্বের মেয়েদের মধ্যে ঘটে তার কোনো প্রভেদ আছে! হয়তো কোথাও কোথাও সংখ্যায় কম। আরজি করের ধর্ষণের ঘটনায় পৈশাচিকতার মাত্রা নাড়া দিয়েছে সকলকে। ভৌগোলিক পরিসর নির্বিশেষে এই ঘটনাগুলো ভয়ঙ্করভাবে এক।
ধর্ষণের বিচার দাবি জোরদার করার সঙ্গে ধর্ষণের উৎসগুলোকে খুঁজে বের করাও জরুরি। জরুরি পুরুষতান্ত্রিক শেকড়কে উপড়ে ফেলা যা ধর্ষণ নামক ক্ষমতাপ্রদর্শনের উৎস। 'পুরুষতন্ত্র' শব্দটি আসলে অবধারিতভাবে আসে 'নারীবাদ' শব্দটি। আর নারীবাদ শব্দকে এখনও নেতিবাচকভাবে দেখা হয় এর অন্তর্নিহিত অর্থ অনুধাবন না করেই। নারীবাদ একটি নিরন্তর লড়াই। যে লড়াই নারী স্বাধীনতা প্রত্যাশী, শোষিতের, বঞ্চিতের মুক্তির প্রত্যাশী। এই লড়াইটা নারী-পুরুষ-ভিন্নলিঙ্গ নির্বিশেষে সকলের। আর এও উপলব্ধি করা যে পুরুষতন্ত্র বিরোধী মানেই পুরুষবিদ্বেষী হওয়া নয়। আরেকটি বিষয় বলতে হয়, শুধু আমাদের দেশে নয়, সারা বিশ্বে যত পুরুষ পুরুষতান্ত্রিক তার সমসংখ্যক বা বেশিই নারীরা পুরুষতান্ত্রিক হবে হয়তো।
ঢাকার শ্যামলীতে নারী নির্যাতন বা আরজি করে ধর্ষণের পেছনে যে কারণ তা পৌরুষ নামক ক্ষমতাপ্রদর্শনের আকাঙ্ক্ষাজনিত। পুরুষের ক্ষমতাপ্রদর্শনের মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে প্রাচীনকালে রাজারা অধিকৃত রাজ্যের অংশে বা ভূমি দখলকারী জমিতে তলোয়ার বা লাঠির আঘাত দিয়ে জাহির করত ওই পরিসরে তার কর্তৃত্ব, একজন পুরুষও নারীর শরীরে জোর করে প্রবেশ ঘটিয়ে তার ক্ষমতা প্রদর্শন করে।
তবে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির বাইরেও শ্যামলীর ঘটনার আরেকটি দিক সম্পর্কেও ধারণা করা যেতে পারে। লাইক-কমেন্টের নেশার বাইরেও একটা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য এখানে থাকতেই পারে। দোকানি রাসেল ফেইসবুকে সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের মাধ্যমে নিজের অনলাইন ব্যবসাটা পোক্ত করা ধান্দাই হয়তো করছিলেন, করে যাচ্ছেন এখনও।
নারীকে ভোগ্যসামগ্রীর উপাদান হিসেবে দেখতে শেখানো সমাজের দীর্ঘদিনের লালিত অসুখ। সমস্যাগুলো এত গভীর যে সম্মিলিতভাবে লিখে, কথা বলে বদলানোর চেষ্টা করতে হবে এবং বদল হতেই হবে। শাস্তির ভয়ে ধর্ষণের ঘটনা আটকানোর সমান্তরালে প্রতিটি গণতান্ত্রিক দেশের মানুষ যা পারে তা হলো সামাজিক অপরাধের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে জনমত গঠন, সচেতনতা তৈরি করার চেষ্টা এবং সে অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় নীতি গ্রহণে বাধ্য করা।