Published : 24 Jun 2019, 02:20 PM
জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ছাড়া বাজেটের ভিন্ন কোনও অর্থ আমজনতার কাছে বোধগম্য বলে মনে হয় না। 'আমজনতা' মানে যাদের রুটি-রুজির পুরোটাই দৃশ্যমান; রিকশাচালক, হকার, শ্রমিক, ফুটপাতের ব্যবসায়ী, সাধারণ চাকুরে— নানা পেশাজীবী মানুষ। যাদের অপ্রদর্শিত বা অঘোষিত আয়ের কোনো বালাই নেই; অপ্রদর্শিত থাকে কেবল তাদের দুঃখ-দুর্দশা, যা জরিপ, পরিসংখ্যান বা গবেষণায় ধরা পড়ে না। মসনদ থেকে তাদের ভাঙাচোরা জীবনের চৌহদ্দিও বহুদূর। বাজেট ঘোষণায় তাই নিজেদের ক্ষত ঢাকতে এই মানুষদের আরেকটু সতর্ক হতে হয়। হিসেবি মনটাকে তারা আরেকটু কষে বাঁধেন, মনে মনে ঠিক করে নেন, সামনের দিনগুলোয় নিত্যপ্রয়োজনীয় কোন কোন জিনিস কেনায় আরেকটু লাগাম দিতে হবে। ছেলেমেয়ের পড়ালেখার খরচ তো কমানোর উপায় নেই, রোজ টিফিনের সেদ্ধ ডিমটা না হয় বন্ধ করে দেবেন! কোনও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়া, কেতাবি জানকারির বাইরে বাস্তবতার ঠোক্করে শেখা এমন সাংসারিক হিসাবে চলে কম রোজগেরে সাধারণ মানুষের জীবন। সেখানে প্রদর্শিত-অপ্রদর্শিত আয়ের উচ্চারণ করুণ প্রহসন বৈ আর কিছু নয়।
ভিক্ষুক, ছিন্নমূল মানুষেরও আয় আরও দৃশ্যমান; হররোজ হাত পাতেন তারা দিনে-দুপুরে সূর্যের আলোয়, রাতে স্ট্রিট লাইটে। কবে বাজেট ঘোষিত হলো, কবে থেকে কার্যকর বা নতুন-পুরনো অর্থবছরের গতায়াত তাদের দিন-রাতের কোনও হেরফের ঘটায়— জীবনঘনিষ্ঠ এমন কোনও কথা কোনও কর্তৃপক্ষের বরাতে এখন পর্যন্ত শোনা যায়নি। রেকর্ড আকারের বাজেট ঘোষণার দিনও তাদের সমান অসহায়ত্বে, একই তাড়নায় হাত পাততে হয়; নইলে পেটে দানাপানি পড়ে না। এই বাস্তবতায় বাজেটের অঙ্ক যে কেবল 'ডাবল আয়' থাকা মানুষের, তা বলাই বাহুল্য। এবং এ-ও বলা বাহুল্য, বাজেট এ কথারই 'সিলমোহর'।
২.
ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুইয়ের অর্থমন্ত্রী জ্যঁ ব্যাপটিস্ট কোলবার্টকে উদ্ধৃত করে অর্থমন্ত্রীর জবানিতে যে নীতিগত অবস্থানের কথা উচ্চারিত হলো বাজেট বক্তৃতায়, রাজহাঁসের গোটা খামারটাই তার কাছে সুরক্ষিত থাকার কথা। যেমন দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, খেলাপি ঋণ এক টাকাও বাড়বে না। হ্যাঁ, তিনি একশ' পয়সা সমান এক টাকার কথাই বলেছিলেন। কিন্তু মাস কয়েকের ব্যবধানে বেড়েছে ১৭ হাজার কোটি টাকা। হ্যাঁ, এখানেও কোনও ভুল হয়নি, ১৭ হাজারের পরে একটা 'কোটি' শব্দ আছে।
ব্যাংকিং খাতকে 'রাজহাঁস' উপমিত করলে সেটির ব্যথা পাওয়ার কোনও আলামত কি স্পষ্ট হয়? খেলাপি ঋণ এখন ১ লাখ ১০ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ দেশের ইতিহাসে ঘোষিত সবচেয়ে বড় বাজেটের মাত্র এক-পঞ্চমাংশ।
সংশ্লিষ্টদের অনেকে কবুল করেছেন, ঋণখেলাপিদের জন্য অর্থমন্ত্রী এমন 'জামাই আদর'-এর ইন্তেজাম করতে যাচ্ছেন, যারা নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধ করছিলেন তারাও সটান বন্ধ করে দিয়েছেন। সততার 'মূল্য' যখন নেই, তখন 'পুরস্কৃত' হতে খেলাপি হওয়াই শ্রেয়!
তবু বলার কথাটি হলো, সিদ্ধান্তের এপার-ওপার দুই পারের মানুষেরই নীতিগত অবস্থানই কিন্তু বেঠিক। খেলাপি ঋণ উদ্ধারের 'কৌশল' হিসেবে এমন সুযোগ ও সুবিধা ঘোষণা করলেন যে আদালতে পর্যন্ত তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। অন্যদিকে ঋণ নিয়ে পরিশোধের দায়িত্ব আপনার; (অসৎ) সুবিধার প্রশ্নে অসৎ মানুষের পদাঙ্ক অনুসরণ করাটা নৈতিকতার পরিপন্থী, আইনবিরুদ্ধ এবং অবশ্যই নিজের প্রতি নিজের অসম্মান প্রদর্শন। সুতরাং দেশের একজন নাগরিক হিসেবে যে শর্তে ঋণ নিয়েছেন, সে অনুযায়ী পরিশোধের বাইরে নিজের পক্ষে আর কোনও যুক্তি খাড়া করাতে পারেন না; এটা পুরোদস্তুর ওয়াদার বরখেলাপ। সুতরাং কোনও পক্ষের অবস্থানই সমর্থনযোগ্য নয়। অথচ এমনই এক ভঙ্গুর অবস্থা ও ব্যবস্থা এখন দৃশ্যমান; কী ঘরে, কী বাইরে— সবখানে।
গ্লোবাল ইন্টেগ্রিটির হিসাবে, গত ১০ বছরে দেশ থেকে পাচার হয়েছে ৭ হাজার কোটি ডলার বা ৫ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। ঘোষিত ২০১৯-২০ অর্থবছরের রেকর্ড বাজেটের চেয়েও অঙ্কটি বড়। এই প্রেক্ষাপটে রাজহাঁসের বেঁচে থাকার প্রশ্নটিই প্রথমে ওঠে, সেটির পালক থাকা না-থাকাটা গৌণ; ব্যথা পাওয়া না-পাওয়ার বিষয়টিও সমানভাবে আমল অযোগ্য। কীভাবে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগতিতে (কুইকেস্ট গ্রোইং) পয়সাওয়ালা তৈরির কারখানায় পরিণত দেশ, তার কিছু পরোক্ষ ধারণা পাওয়া যায় বৈকি। শেয়ারবাজার লুটের কাহিনিও এখানে স্মর্তব্য।
পূর্বসূরীর দেখানো পথে হাঁটতে হাঁটতেও যদি অর্থমন্ত্রী এদিক পানে একটু নজর দিতেন, তাহলে অন্তত খামারের কিছু রাজহাঁস বেঁচেবর্তে থাকে!
৩.
বিজিএমইএ সভাপতির বিচক্ষণতার তারিফ করতেই হয়। চার দশকেও 'হৃষ্টপুষ্ট' পোশাক খাতে সাবালকত্বের ঘাটতি যদি থাকে, তাহলে তার জন্য জীবনভরই বিশেষ ব্যবস্থার প্রয়োজন হওয়ার কথা। দেশের রফতানি আয়ের ৮০ শতাংশের হিস্যা থাকা সত্ত্বেও তাই পোশাক খাতকে 'দুর্বল শিশু' অভিহিত করে প্রকারান্তে সেই কথাটিই বললেন বিজিএমইএ সভাপতি। নিজের অবস্থানের পক্ষে তুলে ধরেছেন গোটাকয়েক কারখানা বন্ধ হওয়ার 'অপরিসীম ক্ষতি'র ফিরিস্তি। ৬-৭ হাজার কারখানার মধ্যে ১০-২০টা বন্ধ হওয়ায় কোনও খাততে যদি 'সংকটাপন্ন' বলে আহাজারি করা হয়, তাহলে সংকটের বাইরে কেবল দেশে নয়, বিশ্বের কোনও দেশের কোথাও কোনও খাত বা শিল্প নেই; তেমন 'সংকটহীন' কোনও সেক্টর থাকা কার্যত অসম্ভব।
আরও কথা আছে, যে কয়টা কারখানা বন্ধ হওয়ায় এত হা-হুতাশ, সেগুলোর আকার-আয়তন কেমন ছিল, সেগুলোর মার্কেট শেয়ারই বা কতটা? একটা-দুটো বন্ধ হওয়ার বিপরীতে নতুন নতুন কারখানাও যে গড়ে উঠছে, এ ব্যাপারে প্রকাশ্য শুকরিয়া না হলেও বিজিএমইএ'র মৃদু স্বীকারোক্তি আশা করা নিশ্চয়ই অন্যায় হয় না। এক শ্রমিক ছাড়া অন্য কোনও সূচকে পোশাক খাতের অধোগতির চিত্র কোনও জরিপ-গবেষণা-পরিসংখ্যান-প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বলে জানা নেই। বিজিএমইএ সভাপতি তার নিজের কারখানাগুলোর দিকে একবার তাকালেই বোধ করি, গোটা পোশাক খাতের উল্লম্ফন-গ্রাফ দেখতে পাবেন।
তবে দেশের ইতিহাসে প্রথম নারী বিজিএমইএ সভাপতি অবশ্য শ্রমিক দুর্দশার কথাটি পরোক্ষে মেনে নিয়েছেন। তিনি পোশাক শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা খাতের অধীনে না আনায় নাখোশি জানিয়েছেন।
'পর্যাপ্ত' বেতনভাতা দেওয়া পোশাক শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা খাতের আওতায় নেওয়া মানে তো আপনাদেরই শরমিন্দা করা! পোশাক শ্রমিকরা কি বঞ্চিত, অবহেলিত, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মানুষ? তারা তো আপনাদের তৈরি কর্মসংস্থানে জীবনের 'সংস্থান' করতে পেরেছেন। সমাজে প্রতিষ্ঠিত এই সম্মানীয় কর্মজীবীদের জন্য এই করুণা ভিক্ষা কতটা অসম্মানের হতে পারে, ভেবে দেখেছেন একবারও!
আশির দশক থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ফুটো পয়সাটি ট্যাক্স দিতে হয়নি আপনাদের, বরং ফিবছর পেয়েছেন প্রণোদনা। এখনও পাচ্ছেন। চাওয়ার তুলনায় এক পয়সা কম হলেই সংবাদ সম্মেলন; অর্থনীতিতে পোশাক খাতের অবদানের গর্বিত উপস্থাপন। এরপর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই আবদার, প্রণোদনা বাড়ান, ডলারের অবমূল্যায়ন করুন… ইত্যাদি।
৪০ বছরেও যদি ঘুরে দাঁড়াতে না পারেন, খয়রাতি জারি থাকলেও আগামী ৪০ বছরেও তা পারবেন বলে মনে প্রতীতি জন্মায় না। বেনিয়াবুদ্ধিহীন মানুষের এই কথায় দ্বিমত করার অবকাশ হয়তো থাকতে পারে। তবে দ্ব্যর্থহীনভাবে এ কথা বলা যায়, কৃষির সঙ্গে পোশাক খাতকে এক করে দেখার ন্যূনতমও কারণ নেই। তবে রক্ত জল করা পরিশ্রমে কাহিল কৃষক আর শ্রমে-ঘামে, অপুষ্টিতে বিবর্ণ পোশাক শ্রমিকের চেহারা অভিন্ন, তাদের তকদিরও এক। কৃষকের বাম্পার ফলনে গর্বিত সরকার, 'মেড ইন পোভারটি'-তে পোশাক শ্রমিকের নিরলস উৎপাদনে বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ পোশাক রফতানিকারকের স্বীকৃতিতে গর্বিত বিজিএমইএ— এই মিলটুকুর কথাও অবশ্য দ্ব্যর্থহীন স্বীকার করি।