Published : 30 Jan 2018, 06:42 PM
জানুয়ারির ৩০ তারিখ মহাত্মা গান্ধীর ৭০তম মৃত্যুবার্ষিকী গেল। ১৯৪৮ সালের এই দিনে বিরালা মন্দিরের প্রার্থনাসভায় তাকে আরএসএস-এর নাথুরাম গডসে গুলি করে হত্যা করেছিলো। ভারতীয় পার্লামেন্ট ভবনের সেন্ট্রাল হলের দেয়ালে বড় আকারের একটা ফটো রয়েছে মহাত্মা গান্ধীর, ফটোটি দেয়ালে ঝুলিয়েছিলেন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ। ফটো ঝোলানোর সময় নেহেরু, প্যাটেল, মাওলানা আজাদও ছিলেন। তারা ভারতীয়দের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীর ছবিটি ঝুলিয়েছিলেন শ্রদ্ধাভরে।
দীর্ঘদিন এ ফটোটি এককভাবে ছিলো। ২০০৩ সালে সেন্ট্রাল হলের দেয়ালে গান্ধীর ফটোর মুখোমুখি করে রাষ্ট্রপতি আব্দুল কালাম আরেকটি ফটো ঝুলিয়েছিলেন। আর তার সঙ্গে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী, লালকৃষ্ণ আদভানী, মুরলী মনোহর যোষী। ছবিটি বীর সাভারকারের। তিনি হচ্ছেন আরএসএস-এর প্রতিষ্ঠাতা। ভারতের ইতিহাসে এটি বিরাট এক রসিকতা। সাভারকার আরএসএস এর রাজনৈতিক প্লাটফর্ম হচ্ছে ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি।
এখন বিজেপি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ১৯৯৯ সালেও একবার বিজেপি ক্ষমতায় এসেছিলো। তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন অটল বিহারী বাজপেয়ী। সাভারকার তাদের 'ধর্মপিতা'। পৌরাণিক জাতীয়তাবাদের স্বপ্নদ্রষ্টা। ভারতের গো-বলয়ে ২৫ লক্ষ ক্যাডার রয়েছে আরএসএস-এর। তারা সবাই একনিষ্ঠ পৌরাণিক জাতীয়তাবাদী।
লালকৃষ্ণ আদভানী সোমনাথ মন্দির থেকে রথ নিয়ে বের হয়ে ১২ শ মাইল অতিক্রম করে বাবরী মসজিদ গিয়ে উপস্থিত হবার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন। মাঝপথে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী লালু প্রসাদ যাদব তাকে গ্রেপ্তার না করলে সেইবারই বাবরী মসজিদ ভেঙ্গে দিতেন। কারণ অযোধ্যায় করসেবকরা প্রস্তুতি নিয়ে বসেছিলো। দ্বিতীয় বার অবশ্য ব্যর্থ হননি। বাবরী মসজিদ ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়েছেন। সারা ভারতব্যাপী সম্প্রদায়িক দাঙ্গায় তখন কয়েক হাজার মুসলমানও হত্যা করা হয়েছে।
লালকৃষ্ণ আদভানী, মুরলি মনোহর যোশী, উমা ভারতী প্রমুখ বিজেপি নেতৃবৃন্দ খুবই দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। গান্ধী কিন্তু ভাওতাবাজির জোরে কখনও জাতি গড়তে চাননি। তিনি শেষদিন পর্যন্ত তার আদর্শে অবিচল ছিলেন। যদিও বা তার মৃত্যুর আগে তার পায়ের নিচে মাটি হারিয়ে ফেলেছিলেন দাঙ্গার আগুনের স্ফুলিঙ্গে আর লাশের স্তুপে। কী হিন্দু, কী মুসলমান, কী শিখ- কেউই তার কথা শুনেনি।
পানিপথ রেল স্টেশনের স্টেশন মাস্টার ছিলেন মুসলমান। হিন্দুরা আর শিখরা মিলে প্লাটফর্মে এনে ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর স্টেশন মাস্টারকে জবেহ করে হত্যা করেছিলো। নোয়াখালি থেকে দিল্লিতে গিয়ে গান্ধী যখন স্টেশন মাস্টারের নির্মম হত্যাকাণ্ডের কথা শুনলেন আর জানলেন যে পানিপথের এক লক্ষ মুসলমান দিশেহারা হয়ে পানিপথ স্টেশনের চতুর্দিকে অবস্থান নিয়েছেন পাকিস্তান চলে যাবার জন্য- তখন গান্ধী সেখানে গিয়ে মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বললেন- "হে মুসলমানেরা তোমরা পানিপথের প্রথম ও দ্বিতীয় যুদ্ধে জিতেছিলে, আজ আমি তোমাদেরকে নিয়ে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ করতে চাই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। তোমরা পাকিস্তান যেও না, এখানে অবস্থান গ্রহণ কর আমি অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে দেবে।"
ভীত সন্ত্রস্ত মুসলমানেরা গান্ধীর কথা শুনল না, চলে গিয়েছিল পাকিস্তানে। ভারত বিভক্তির সময় ইন্ডিয়ান রিজার্ভ ব্যাংকের অর্থের ভাগ পেয়েছিলো পাকিস্তান ৫০ কোটি রুপি। কিন্তু নেহরু সরকার তা দিতে গড়িমসি করেছিলো। তখন বিরলা ভবনে অনশনে গেলেন গান্ধী- ১৯৪৮ সালের ১৭ জানুয়ারি। তার দাবী "পাকিস্তানকে তার ভাগের টাকা দিয়ে দিতে হবে আর ভারতে যত মসজিদ ভেঙ্গেছে তা পুনঃনির্মাণ করে দিতে হবে।"
অ্যালান ক্যাম্বেল জনসন ছিলেন মাউন্টব্যাটেনের ব্যক্তিগত সচিব ও ছায়াসঙ্গী। অ্যানেল ক্যাম্বেল জনসন- এর লেখা বই 'মিশন উইথ মাউন্টব্যাটেন' এ পড়েছি এ অনশনের সময় শিখেরা মিছিল করে শ্লোগান দিয়েছে- 'গান্ধীর মৃত্যু হোক'। এর ১৩ দিন পরেই তো গান্ধী গুলিবিদ্ধ হয়ে ইহধাম ত্যাগ করেছিলেন।
আইরিশ নাট্যকার জর্জ বার্নার্ড শ'-এর শোকবাণীটি ছিলো, "এ থেকেই বোঝা যায় যে এত ভাল মানুষ হওয়ার দায় কত।"
সত্যিই গান্ধী হচ্ছেন ভারতের বৌদ্ধ ধারার শেষ মহান পুরুষ। যাদের মুক্তির জন্য তার আবির্ভাব হয়েছিলো তাদের হাতেই নিহত হলেন তিনি। যেন দ্বিতীয় ক্রুশবিদ্ধ কোনও যিশু।
এখন ভারতের দৃশ্য সম্পূর্ণ উল্টে গেছে। রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা এখন সময়ের ব্যাপার। শক্ত নেতৃত্বে রয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে উঠা জাতীয়তাবাদ এখন চূড়ান্ত আদর্শ। ক্ষমতার সর্বত্র নাগপুরের লোকেরা বসে আছেন। এখন হিন্দুত্ববাদ প্রতিষ্ঠার স্বর্ণযুগ। গান্ধীও কিন্তু কোনও কোনও সময় রামরাজত্বের কথা বলতেন। রাম মিথের প্রতি গান্ধীর ছিলো প্রবল দুর্বলতা। রামকে তিনি সর্ব সত্যের আঁধার মনে করতেন।
ভারতের আশি শতাংশ লোক হিন্দু এবং হিন্দুদের মাঝে শুদ্ধতা প্রতিষ্ঠা করতে হলে রামকেই তো বিশ্বাসের মূল স্তম্ভ হিসাবে দাঁড় করাতে হয়। গান্ধীর রাম আর সাভারকারের রাম এক ও অভিন্ন নয়। গান্ধী ভারতের বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রাম করেছেন। তিনি যা বিশ্বাস করতেন তা নিজের জীবনে প্রতিষ্ঠা করে দেখাতেন।
দিল্লীর ধাঙ্গর মহল্লায় গিয়ে তিনি তাদের সঙ্গে আহার-বিহার করেছেন। নিজ হাতে তাদের মলমূত্রও পরিষ্কার করেছেন। ব্রিটিশরা নিম্নবর্ণের হিন্দু আর মুসলমানদের জন্য আলাদা নির্বাচনের ব্যবস্থা করেছিল। গান্ধী তার বিরুদ্ধে গেলে হিন্দুদেরটা বাতিল করা হয়। কেন অনশনে গেলেন সে কারণে নিম্নবর্ণের হিন্দু নেতারাও তার সমালোচনা করতেন। কারণ তাদের মতে মুসলমানের মতো তারা পার্লামেন্ট তাদের সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করা থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
গান্ধীর যুক্তিছিলো নিম্নবর্ণের হিন্দুরাও হিন্দু সমাজের অংশ, উভয়ের মাঝে কিছু কারণে বোঝাবুঝি রয়েছে-সেখানে তারা আলাপ আলোচনা করে দূর করবে-পৃথক করে দিলে তো ভুল বোঝাবুঝি দূর হবে না, বরঞ্চ হিন্দুসমাজ জনমের মতো পৃথক হয়ে যাবে। তাতে ভারতের হিন্দু সমাজের অপূরণীয় ক্ষতি হবে।
গান্ধীর এ কথা তো মিথ্যে নয়। একজন উচ্চবর্ণের হিন্দু টমটম চালাতো। একবার সে টমটমওয়ালা আম্বেদকরকে তার টমটমে নেয়নি। কারণ ব্যারিস্টারি পাস করা স্বত্ত্বেও আম্বেদকর ছিলেন ঝাড়ুদারের সন্তান। অনুরূপ কঠিন পরিস্থিতির বিরুদ্ধে ছিলো গান্ধীর সংগ্রাম। গান্ধী চেয়েছিলেন সবাইকে সম্মানের আসনে বসিয়ে ভারতের ঐক্য গড়তে। বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্যের সূত্র এটাই।
এখন যারা ভারতের ক্ষমতায় তারা ভিন্ন পথের অনুসারী। মোদি প্রাথমিক জীবন থেকে আরএসএস-এর অনুসারী। তিনি বলছেন, কংগ্রেসকে ভারতের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করতে হবে। কংগ্রেস একমাত্র দল যারা এখনও গান্ধীর পথের কথা বলে। ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদ থেকে যারা এখনও সরে যায়নি। ভারতের ধর্মের ধারা অহিংসা, বহুধর্মের ধারাকে অব্যাহত রাখা। সাভারকারের "দি হিন্দু" বইটি সে পথ অনুসরণের কথা বলে না। সাভাবারকার দেশভক্তির যে পথ দেখিয়েছেন সে পথ অলিক পথ আর মহাত্মা গান্ধী হচ্ছেন দেশপ্রেমের সুসম্মত প্রতীক।