ছাত্রদের কোটা আন্দোলন যে শুধু চাকরির জন্য, সেটি মনে করার কারণ নেই। আড়ালে প্রাত্যহিক হতাশা, দ্রব্যমূল্য, দুর্নীতি, কথা বলতে না পারাসহ আরও বঞ্চনার দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে আছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে সরকারি অফিস-আদালতে ঘুষ আর বৈষম্যের শিকার সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ।
Published : 04 Aug 2024, 06:26 PM
সবার চোখের সামনেই তরুণদের ক্রমবিস্তৃত একটা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন ভয়ঙ্কর সহিংসতার শিকার হতে থাকল। শনিবারের পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ছিল ২১৪। আজ রোববার দিনশেষে সেই সংখ্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা অননুমেয়। সন্ধ্যা ছয়টায় নিহতের সংখ্যা ৪০ ছাড়িয়ে গেছে। জুলাই থেকে এই পর্যন্ত আহত হয়েছেন অগুণতি। শুরুতে হতাহতদের মধ্যে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বেশি থাকলেও, এখন সব শ্রেণিপেশার মানুষ মরছেন, আহতম হচ্ছেন। অনেকে শরীরে ক্ষত নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এ অবস্থা জেনেও চুপ অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, সাংবাদিক ও সম্পাদক। অনেক আগে মারা গেছেন অদ্ভুত উটের পিঠে চলছে স্বদেশের কবি, বেঁচে থেকেও চুপ দুঃশাসনবিরোধী কবিরা, কেউ কেউ মুখে কুলুপ এঁটে সুবিধা নিতে নিতে রীতিমতন রাজকবির পর্যায়ে পৌঁছে গেছেন।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে প্রাসঙ্গিক একটি ঘটনা হাজির করি। তিউনিসিয়ার গণ আন্দোলনের বিষয়টি নিশ্চয় অনেকের জানা। রাজধানী তিউনিসে রুটির দোকানে রুটি কিনতে যান অতি সাধারণ একজন। দাম বেড়ে যাওয়ায় তার পক্ষে কেনা সম্ভব হচ্ছে না। এ নিয়ে দোকানির সঙ্গে শুরু হয় তর্ক। মেজাজ খারাপ হলে আঘাত করেন দোকানি। অভুক্ত ক্রেতা মাটিতে পড়ে যান। জ্ঞান হারিয়ে ঘটনাস্থলে জীবন শেষ। সবাই তো অবাক। এ পরিণতির জন্য কেউ প্রস্তুত ছিলেন না। পথচারীদের ভিড় বাড়তে থাকে। লোকে লোকারণ্য। সবাই নিজেদের মাঝে সেই ক্রেতার ছবি খুঁজে পান। কল্পনা করেন, পড়ে থাকা ক্রেতার লাশটি যেন নিজের। অক্ষমতার ছায়া…
অগ্নিগিরি ছড়িয়ে পড়ে। মানুষের কাছে রুটির দোকান হয়ে ওঠে স্বৈরাচার সরকারের প্রতিভূ। দোকানদার পালিয়ে যান। জনতা পুড়িয়ে দেয় রুটির দোকান। শুরু হয় লাশ নিয়ে মিছিল, ঢল নামে মানুষের। জানাজায় লাখ লাখ মানুষ। দাফন হয়, কিন্তু ক্ষোভের আর দাফন হয় না, বরং বাড়তে থাকে। সহিংস থেকে সহিংসতর হতে থাকে জনরোষ।
শাসকরা ভাবলেন, রুটির দাম নিয়েই যখন সূত্রপাত, তখন রুটির দাম কমিয়ে দাও। কিন্তু দেখা গেল, দাম কমিয়ে ক্ষোভের আগুন নেভানো গেল না। আরও জ্বলে উঠল। জনবিচ্ছিন্ন শাসকেরা রুটিটাই দেখেছিল; আর মানুষ দেখেছিল রুটিতে ঝলসানো দেশ। জনতা দেখেছিল সিন্ডিকেট, স্বজনপ্রীতি, লুটপাট, অর্থ পাচারে সরকারের আশ্রয় ও সুবিধাভোগীর হাতে দেশ নামের রুটিটি ঝলসে গেছে।
রুটিওয়ালার ফাঁসি বা দোকানির লাইসেন্স বাতিল প্রাথমিক দাবি থাকলেও তা আর সেখানে সীমাবদ্ধ থাকেনি। আন্দোলনের আগুন দেশের সীমারেখা ছাড়িয়ে গিয়েছিল, বুঝতে পারেনি শাসক। যখন বুঝেছে ততক্ষণে বেশ দেরি হয়ে গেছে! তাই বাংলাদেশে ছাত্রদের কোটা আন্দোলন যে শুধু চাকরির জন্য, সেটি মনে করার কারণ নেই। আড়ালে প্রাত্যহিক হতাশা, দ্রব্যমূল্য, দুর্নীতি, কথা বলতে না পারাসহ আরও বঞ্চনার দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে আছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে সরকারি অফিস-আদালতে ঘুষ আর বৈষম্যের শিকার সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ। স্বাধীন দেশে মনে হয় দেখার কেউ নেই, নেই বলারও! বলতে চাইলেও সইবার মামলা ভয়!
দেশের কোটি কোটি মানুষ, বিপর্যস্ত হচ্ছে জনজীবন ও অর্থনীতি। সহজ করে বললে– মানুষ দীর্ঘদিনের কষ্ট প্রকাশ করতে পারেনি। চাপা ক্ষোভ দিনের পর দিন পুঞ্জীভূত। মূল্যস্ফীতি, দুর্নীতি, গরিবে-ধনীতে বৈষম্য, জীবনযাত্রার মান নিচে নেমে যাওয়া থেকে শুরু নির্বাচিত সরকার না আসা— এসব আন্দোলনে যুক্ত হয়েছে।
২.
গত মাসের ১৮ জুলাই বিকাল ৪টা। কারওয়ান বাজার থেকে রিকশা নিয়ে ঢাকা মেডিকেলের দিকে যাচ্ছি। বাংলামোটর হাতিরপুলে মোড়ে মোড়ে লাঠি নিয়ে বসে আছে কিছু যুবক। চোখেমুখে আগুন। কাঁটাবন সিগন্যালে কিছু পুলিশ মহড়া দিচ্ছে। দেখা যাচ্ছে সায়েন্সল্যাবের রাস্তা ধোঁয়ায় অন্ধকার।
পুলিশ প্রশ্ন করতে, জরুরি প্রয়োজন বলে এগিয়ে গেলাম দুরু দুরু বুকে। রাস্তার দু’পাশে মানুষ আর মানুষ, কী হচ্ছে কী হবে– ভাবনায় আতঙ্কিত। নীলক্ষেত মোড়ে এসে আবারও ভয় পেয়ে গেলাম। এত পুলিশ, অস্ত্র তাক করে আছে কেন? নিউমার্কেট এলাকায়, ইডেন রোডে কিছু দেখা যাচ্ছে না ধোঁয়ার জন্য। মানুষ আর পুলিশের আওয়াজ। কি হচ্ছে, কেউ বলে না। সবাই দ্রুত যাচ্ছে যার যার গন্তব্যে। ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে যা দেখলাম, তা একেবারে অচেনা পরিবেশ।
কল্পনায় আসছে ফিলিস্তিন, গাজা…। কিন্তু আমরা তো স্বাধীন, আমাদের কে মারল, কে মারল? অ্যাম্বুলেন্সের মুহুর্মুহু হুইসেল, হাসপাতাল কর্মীরা নামতে নামতে স্বজনদের কান্না। মিনিট পর পর লাশ না হয় রক্তাক্ত দেহ জরুরি বিভাগে আসছে।
কেউ মাথা ধরে বসে আছে, কারো রক্ত পড়ছে, কেউ এক্সরের অপেক্ষায়, কেউ সিটিস্ক্যানের অপেক্ষায়। গুলি লেগে চোখ ফুটো হয়ে আছে। আহত ব্যক্তিদের দেখেই হয়তো আঁতকে উঠেছি। পরের দিন আবার গিয়ে আবার একজন রোগীর পিঠ খুলে দেখলাম, ছোট ছোট ছররা পিঠ ভেদ করে ১৫-২০টি ক্ষত তৈরি করেছে। পিলেট বা স্প্লিন্টার ইনজুরি নিয়ে এসেছেন আগের দিন। মনে হচ্ছে যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশ। এ কোন দেশ চেনা যাচ্ছে না। বেশিক্ষণ থাকতে পারলাম না। এত রক্ত, এত বর্বরতা– মানা যায় না। না মেনেও কিছু পারছি না, অসহায়। আপনা দেশে পরবাসী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতেই মারমুখী পুলিশের বাঁধা। অসহায় স্বরে প্রক্টোরিয়াল সদস্যের কাছে ভাষা বিজ্ঞানের শিক্ষকের কাছে যাচ্ছি বলে গেলাম শহীদ মিনারের দিকে। সঙ্গে বইপ্রেমী রাসেল আহমেদ। সে বলে উত্তাল বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন এই নীরবতা! নিজেকে প্রশ্ন করেছে না আমায়, বুঝতে চাইনি। চললাম ধীরে ধীরে। জগন্নাথ হলের পাশে দুই আইল্যান্ডের মাঝে একটি কুকুর শুয়ে ছিল, আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে দৌড় দেয়।
এমন বিকেলে শতশত শিক্ষার্থীর পদচারণায় মুখরিত থাকে। কারো ক্লাস শেষে আড্ডায়, কারো থাকত বাসায় ফেরার তাড়া। তাদের জন্য রাস্তাজুড়ে থাকত লাল বাস। শাসকের তাণ্ডবে আজ প্রিয় ক্যাম্পাস রেখে শিক্ষার্থীরা কে যে কোথায় গেছে কে জানে! বাস্তবতায় বেদনা চেপে পুরো ক্যাম্পাসে ঘণ্টাখানেক হাঁটলাম। অদ্ভুত এক শূন্যতা ছাড়া কিছু দেখা গেল না। প্রাণের টিএসসিজুড়ে হাহাকার। স্বপ্নের মেট্রোরেলের কলামে বসে আছেন কেউ কেউ। ২-৩জন সাংবাদিক অপেক্ষা করছিলেন ঘটনার অপেক্ষায়। রোকেয়া হলের সামনে গাছের নুয়ে পড়া বাতাস। গুরুদুয়ারা নানকশাহীর সামনে ক্ষুধার্ত কুকুরের আনাগোনা। মানুষের অভাবে তাদের চোখও মলিন। শিক্ষার্থী শূন্য ইটকাঠের উন্নয়ন। ভিসি চত্বরের রেইন ট্রি গাছের নিচে ‘স্মৃতি চিরন্তনে’ পুলিশ সদস্যদের জটলা। পাশে একজন লুডু খেলছেন নেটের অভাবে।
আবুল কালাম নামের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স্ক কর্মচারীর দেখা পেলাম। তিনি বললেন, এমন পরিবেশ আগে দেখেননি। ভয় লাগছে মাঝে মাঝে। গত দুদিন কোনো শিক্ষার্থী তার চোখে পড়েনি। রাতের বেলায় কী ঘটে, কী ঘটেছিল, তা তিনি বলতে পারছেন না।
ক্যাম্পাসের অন্যতম প্রবেশপথ শাহবাগ মোড়, নীলক্ষেতের কাছে অবস্থিত মুক্তি ও গণতন্ত্র তোরণ, বকশীবাজার মোড়, দোয়েল চত্বর, চানখারপুল, পলাশী বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে ব্যারিকেড দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এই এলাকায় প্রবেশ করতে গেলে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। জরুরি প্রয়োজন হলে তবেই প্রবেশের অনুমতি। আপন ক্যাম্পাসে পর... এই চিত্র প্রায় সারাদেশের প্রতিটি ক্যাম্পাসের।
১৯৭১ সাল নিয়ে রচিত ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইয়ে সিদ্দিক সালিক লিখেছেন, “ভোর চারটায় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দখলে আসে পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর, মধ্যরাতে ধুম্রকুণ্ডলী এবং অগ্নিশিখা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর ছাড়িয়ে আকাশে মাথা তুললো।”
জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম তার ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮০ বছর’ বইয়ে লিখেছেন, “মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারী এবং তাদের পরিবার ও স্বজন মিলে ৩০০ জনের মত মানুষ নিহত হয়েছিলেন। মার্চের শুরু থেকে রাজনৈতিক অবস্থার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যান শিক্ষার্থীদের বড় অংশটি, অনেক শিক্ষকও তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বাসভবন ছেড়ে অন্যত্র থাকার ব্যবস্থা করেন”।
গ্রন্থাগার বিশেষজ্ঞ ফজলে রাব্বী বাংলা একাডেমিতে একাত্তরে কর্মরত ছিলেন। রফিকুল ইসলাম সে স্মৃতি উল্লেখ করছেন তার বইয়ে– “একাত্তরের দিনগুলোতে বাংলা একাডেমির এই এলাকা খাঁ খাঁ করত। পথঘাটে লোক ছিল না বললেই চলে। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া আমরা কেউ বাইরে চলাফেরা করতাম না। এক অস্বাভাবিক অবস্থা বিরাজমান ছিল সমগ্র দেশে।”
এইভাবে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ অনির্দিষ্টকালের জন্য। কবে ফিরবে ক্যাম্পাসে শিক্ষার পরিবেশ, কবে খুলবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান- তা জানে না কেউ। আন্দোলনে জড়িয়ে নিজেদের নিরাপত্তা শঙ্কা তো আছেই। শিক্ষকরা নিজেদের প্রয়োজনে এক হলেও শিক্ষার্থীদের এই দুঃসময়ে নেই। এ দিকে যাবে, না ওইদিকে যাবে। এই ভাবনায় তাদের বেলা যায়। হাতেগোনা কয়েকজন শিক্ষক পাশে আছেন নৈতিকতার প্রশ্নে।
অন্যদিকে ১৯৬৯ সালের অভ্যুত্থানের সময় যেমন অসামান্য সাহসে দাঁড়িয়েছিলেন শিক্ষক শামসুজ্জোহা– এই জোহা স্যারের মতো কেউ না থাকায় ফেইসবুকে লিখে আক্ষেপ করছিলেন অদম্য মেধাবী ছাত্র আবু সাঈদ। নিহত সাঈদের মাকে ধরে প্রধানমন্ত্রী সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, “আমাকে দেখেন, আমি অনেক কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছি।” কোটা সংস্কারের আন্দোলনে সহিংসতায় কত ছাত্র, শ্রমজীবী ও শিশু নিহত হয়েছে তার সবটুকু হিসাব এখনো অজানা। কোটা সংস্কারের মতো আপাত নিরীহ আন্দোলনটি অগাস্টে এসে আর আগের জায়গায় নেই, এটি এখন সরকার পতনের এক দফা দাবিতে পরিণত হয়েছে। জুলাইশোকে স্তব্ধ স্বদেশ অগাস্টে কোন নিদারুণ অভিজ্ঞতা নিয়ে আসবে আমাদের জন্য?
বিনয় বা অভিনয় যাই হোক, উপরের বাক্য এখন প্রতিটি মানুষের। অনেক মা কথা বলতে পারছেন না, বাবার কাঁদার শক্তি নেই। চোখের পানি আর কত ঝরবে বোনের। যে কান্না থামার নয়, যে ক্ষত মোছার নয়। স্বজনরা হয়তো বলছেন ‘দেখেন আমিও অনেক কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছি, দেখাতে পারছি না।’
এইভাবে আমরা কেউ আর ভালো নেই। কে দেখবে কাকে। ভালো থাকার আকাশে কালো মেঘ। স্বাধীন দেশে অসম্ভব অসহায় নাগরিক। নির্মমতার শিকার হয়ে আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে গেছে চেনা অচেনা স্বপ্নবাজরা। চোখ হারিয়ে অন্ধকারে শতাধিক। যত দিন গড়াচ্ছে একের পর এক বিয়োগান্ত ঘটনা সামনে আসছে। এ রকম অসংখ্য পরিবারের জন্য অন্তহীন ট্র্যাজেডি খুঁড়ে খুঁড়ে খাবে।