কাদের হাতে, কীভাবে, কোন উপকরণে তৈরি হয়েছিল এটি; কোথায় আছে বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়ের অনবদ্য আসল সেই দলিল— এসব বিষয়ে তথ্য অপ্রতুল এবং অস্পষ্ট।
Published : 30 Nov 2023, 04:20 PM
বাংলাদেশের সংবিধান ছাপানো হয় দুটি ভাষায়; একটি বাংলায়, অপরটি ইংরেজিতে। বাজারে যে সংবিধান দেখতে পাওয়া যায় তা কম্পিউটারে টাইপের পর প্রেসে মুদ্রিত, অন্য আর দশটা গ্রন্থের মতোই। তবে শুরুতে কিন্তু এমনটা ছিল না। ১৯৭২ সালের প্রথম সংবিধানের সঙ্গে আজকের সংবিধানের অন্দর-বাহিরে বিস্তর ফারাক। একটি প্রস্তাবনা, ১১টি ভাগে বিভক্ত, ১৫৩টি অনুচ্ছেদ এবং ৪টি তফসিল লেখা হয়েছিল হাতে। কাদের হাতে, কীভাবে, কোন উপকরণে তৈরি হয়েছিল এটি; কোথায় আছে বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়ের অনবদ্য আসল সেই দলিল— এসব বিষয়ে তথ্য অপ্রতুল এবং অস্পষ্ট। এ বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে গোড়া থেকে শুরু করতে হয়। ফিরতে হয় পাঁচ দশক অতীতে।
১৯৭১ সালে স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের কাজ শুরু করে আইন মন্ত্রণালয়। ১৯৭২ সালের ১১ এপ্রিল আইন মন্ত্রী ড. কামাল হোসেনকে সভাপতি করে গণপরিষদের ৩৪ সদস্যের সমন্বয়ে নির্বাচিত হয় খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি। বলা হয়, গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ এই সংবিধান দেশের সাংগঠনিক ভিত সুদৃঢ় করবে। কিন্তু এমন কর্তব্যকর্ম নির্ধারণের গুরুদায়িত্ব বর্তেছে যে গ্রন্থের উপর তার গড়নেও তো আভিজাত্য আর অভিনবত্বের ছাপ থাকা প্রয়োজন। সিদ্ধান্ত হয়, সংবিধান ছাপার অক্ষরে নয় বরং তা হবে ‘হাতে লেখা’। তাই দলিলটি গতানুগতিক বাংলা টাইপ করা হয়নি। তার বদলে একজন শিল্পী প্রাচীনকালের পুঁথির মতো পাণ্ডুলিপিটি আগে হাতে লিখেছেন এবং সঙ্গে নকশার অলঙ্করণ যোগ হয়েছে। এত সূচারু হাতের কাজের উদ্দেশ্য ছিল, রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলা ভাষার মর্যাদা বৃদ্ধি। তাছাড়া সদ্য স্বাধীন একটি দেশের পরিচয়, শিল্পবোধ, রুচি এবং জাতির ইতিহাস এই শৈল্পিক কর্মের মধ্য দিয়ে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরার চিন্তাও আমাদের পূর্বজদের ছিল। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের তত্ত্বাবধানে শিল্পীদের একটি দল গঠন করলেন। বাছাই করা পাঁচ জনের দলে ছিলেন লিপিকার এ কে এম আবদুর রউফ আর অঙ্গসজ্জায় হাশেম খান, নকশা আঁকায় সমরজিৎ রায় চৌধুরী, জুনাবুল ইসলাম ও আবুল বারক আলভী। সবাই তখন আর্ট কলেজের শিক্ষক। কেবল রউফ ছিলেন সাবেক শিক্ষার্থী এবং লন্ডনস্থ বাংলাদেশ হাই কমিশনে নিযুক্ত দ্বিতীয় সচিব।
হস্তলিপির কার্যক্রম বিস্তারিত বর্ণনার আগে বলে রাখা ভালো, সংবিধানের হাতে লেখা প্রকল্পে হস্তসাধিত ও যান্ত্রিক পদ্ধতির সমন্বয় ঘটেছে তাই গোটা প্রক্রিয়াটি কারিগরি কয়েকটি জটিল ভাগে বিভক্ত। সহজভাবে বোঝার স্বার্থে শুরুতেই ধাপগুলোর একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া যাক:
(ক) সংবিধানের জন্য প্রণয়ন কমিটির খসড়াগুলো প্রথমে একজন ক্যালিগ্রাফার হুবহু হাতে লেখেন এবং সমান্তরালভাবে প্রতি পাতায় অলঙ্করণ জুড়ে দেয়া হয়। এভাবে সবগুলো পাতা হয়ে গেলে জন্ম হয় ক্যালিগ্রাফিক পাণ্ডুলিপির, যাকে মূল কপি বা ‘মাস্টারপিস’ বলা চলে। এই মাস্টারপিসে গণপরিষদ সদস্যদের সই ছিল না।
(খ) দ্বিতীয় ধাপের জন্য মাস্টারপিসের প্রতি পাতায় প্রথমে সাদাকালো নকশা বসানো হয়। এগুলো ছিল ছবি তুলে তারপর জোড়া দেয়া। রশিদ স্টুডিওতে তোলা ওইসব ছবির নকশাগুলো ছিল খালি। যেখানে শিল্পীরা রঙিন অলঙ্করণ করেন। পরের ধাপে প্রিন্টিং মেশিনের প্লেট তৈরির জন্য মাস্টারপিসের রঙিন পাতাগুলোকে অ্যানালগ ক্যামেরায় ছবি তোলা হয়। প্রতি পাতার ফিল্ম ডেভলপের পর আমরা একটি চিত্ররূপ বা ‘ফিল্ম কপি’ পাই। যেহেতু সংবিধানের অনেকগুলো কপি ছাপতে হবে তাই এই ব্যবস্থা। মাস্টারপিস স্পর্শকাতর হওয়ায় এই ফিল্ম কপি থেকে প্রথমে কয়েকটি গ্রন্থ সাধারণ কাগজে ছাপানো হয়; যাকে আমরা ‘প্রুফ কপি’ বলতে পারি। প্রুফ কপির মাধ্যমে সংবিধান একটি গ্রন্থের আকার ধারণ করল। তখনও এটি গণপরিষদে স্বাক্ষর হয়নি।
(গ) প্রুফ কপির শেষের দিকে সই করার পৃষ্ঠাগুলো ছিল না। কিছু সংশোধনের পর সেই পাতাগুলো এবং সই করার পৃষ্ঠাসমেত সবশেষে ‘ফার্স্ট কপি’ প্রস্তুত হয়। সিগনেচারের ফর্মাসহ ফার্স্ট কপি ছিল মলাটবদ্ধ। এই ফার্স্ট কপিতেই সই করেছিলেন গণপরিষদ সদস্যরা। অর্থাৎ লেখাগুলো ছবি থেকে ছাপানো কিন্তু সিগনেচারগুলো আসল। পরে এই ফার্স্ট কপি থেকেই মুদ্রিত হয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের পরবর্তী সংস্করণগুলো।
মাস্টারপিসের খোঁজে
আজকের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় যেখানে, সেখানেই ছিল অ্যাসেম্বলি ভবন। তারই একটি কক্ষে বসে শিল্পীদের পঞ্চপাণ্ডব জন্ম দিয়েছিলেন মাস্টারপিসের। আজকের দিনে অন্তর্জালের বদৌলতে আমরা চাইলেই দেখতে পারি, কেমন ছিল হাতে লেখা সংবিধান।
হস্তলিপি যে একটি শিল্প সেটা প্রমাণ করেছে বাংলাদেশের সংবিধান। তবে বাংলাদেশই হাতে লেখা সংবিধানের প্রথম বা একমাত্র রাষ্ট্র নয়। এর আগেও অনেক দেশ তাদের সংবিধান হাতে লিখেছে। খুব বেশি দূরে যেতে হবে না ছাপাখানার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সংবিধান হাতে লেখার বড় উদাহরণ প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত। বিশ্বের সবচেয়ে বড় হাতে লেখা সংবিধানের গিনেজ রেকর্ডও দেশটির দখলে। প্রায় তিনবছর লেগেছে এই মাস্টারপিস গড়তে। বাংলা সংবিধানের যেমন একজন লিপিকার ছিলেন অনুরূপ ভারতের সংবিধানে সেই দায়িত্ব পালন করেন প্রেমবিহারী রায়জাদা। এজন্য ৩৫৪টি নিব ও কলম ব্যবহার করেন তিনি। আমাদের যেমন জয়নুল তেমনি ভারতের সংবিধানের অঙ্গসজ্জা বা ইলাস্ট্রেশন করেছিলেন নন্দলাল বসুর নেতৃত্বে শান্তিনিকেতনের ছাত্র-শিক্ষকরা। তিন কেজি ৭৫০ গ্রামের ঐতিহাসিক ও অমূল্য সেই মাস্টারপিসটি সংরক্ষণের জন্য নেয়া হয় ঐতিহাসিক উদ্যোগ। দলিলে ব্যবহৃত কালি ও পার্চমেন্ট কাগজ যেন নষ্ট না হয় সেজন্য নাইট্রোজেন গ্যাস পূর্ণ একটি বাক্সে হাতে লেখা আসল সংবিধানটি সংরক্ষণ করেছে ভারতীয়রা।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগতে পারে; তাহলে বাংলাদেশ কী করেছে? কোথায় আছে আমাদের ‘মাস্টারপিস’। কী দিয়ে, কোন কাগজে, কীভাবে লেখা হয়েছিল হাতে লেখা সংবিধানের বাক্যগুলো। কোথায় আমাদের অমূল্য লেখন উপকরণসমূহ? অন্যরা যেখানে এ ধরনের দলিল ও উপকরণকে সম্পদ হিসেবে ঘোষণা ও রক্ষা করছে সেখানে মুক্তিযোদ্ধা জাতি হিসেবে আমাদের ভূমিকা কী? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হাতে লেখা কমিটির সদস্যদের দ্বারস্থ হতে হয়।
হাতে লেখা কমিটির ৫ সদস্যের মধ্যে হাশেম খান ও আবুল বারক আলভী বেঁচে আছেন। তাদের দুজনের আলাদা সাক্ষাৎকার নিই ২০২৩ সালের শুরুতে। হাতে লেখার বিষয়টি যেহেতু সংবিধানের প্রাণ তাই স্বাভাবিকভাবেই এ নিয়ে প্রশ্ন ছিল শিল্পীদ্বয়ের কাছে। কীভাবে বাছাই করা হয়েছিল সংবিধানের একক লিপিকার এ কে এম আবদুর রউফকে।
এ প্রসঙ্গে হাশেম খান ও আবুল বারক আলভীর উত্তর মিলে যায়। জানান, গোলাম সরোয়ার, কাইয়ুম চৌধুরী, প্রাণেশ মণ্ডলসহ কয়েকজনের হ্যান্ডরাইটিং প্রাথমিকভাবে যাচাই করা হয়। এঁদের সবারই নিজস্ব একটা স্টাইল ছিল যা লেখার মধ্য দিয়ে প্রকাশ হতো। কিন্তু সবার কাছে পাঠযোগ্য হয়, এমন পরিষ্কার ও ছাপার অক্ষরের কাছাকাছি ছিলেন কেবল রউফ। জয়নুল চেয়েছিলেন সংবিধানে যেন কারও লেখার স্টাইল বা প্রভাব না থাকে এবং সেটা যতটা সম্ভব গোটা গোটা হরফে লেখা হয়, এজন্যই আবদুর রউফকে লন্ডন থেকে উড়িয়ে এনেছিলেন তিনি। শুধু তাই নয়, দেশে ভালো কালি-কলম-কাগজ ছিল না বলে রউফের প্রতি জয়নুলের নির্দেশ ছিল, তিনি যেন তার প্রিয় লেখন উপকরণ ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জামগুলো অবশ্যই সঙ্গে করে নিয়ে আসেন।
হাশেম খান নিজেও দেখেছিলেন কুশলী শিল্পী রউফ ঢাকায় আসার সময় কলম ও সঙ্গে কিছু কালির দোয়াত বয়ে এনেছিলেন। কলমগুলোর মধ্যে দু-একটি ব্যবহার হয়েছিল গণপরিষদ সদস্যদের সই করার দিন। ওইদিন বেশিরভাগ সদস্যই রউফের বিলেতি ফাউন্টেন পেন বা ডেস্ক পেন দিয়ে স্বাক্ষর করেন। এছাড়া বাড়তি হিসেবে নিউমার্কেট থেকে কেনা হাশেম খানের দুটি কলমও ব্যবহার হয়। তবে কোন ব্র্যান্ডের কালি- কলম সেদিন ব্যবহার হয়েছিল বা রউফ কী কলম সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন তা মনে করতে পারেন না তাঁরা।
১৯৭২ সালে ফাউন্টেন পেনের জন্য যেসব কালো কালি পাওয়া যেত তা যথেষ্ট গাঢ় ছিল না। লেখার পর ধূসর কালো রং ধারণ করত হরফগুলো। হাতে লেখা সংবিধান ছবি তুলে তা প্রেসে ছাপানোর (চিত্র সংস্করণ) পরিকল্পনা ছিল, সুতরাং গাঢ় কালি না হলে ছবি অস্পষ্ট হবে এবং সংবিধানের ছাপাও ভালো হবে না। এই ভাবনা থেকে শিল্পী রউফ ব্ল্যাক চাইনিজ ইঙ্ক ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
কী কলম সেটা শিল্পীরা বলতে না পারলেও কলমগুলোর নিব কেমন ছিল তার কিছুটা ধারণা পাই আমরা লেখার দিকে তাকালে। আবদুর রউফের লেখার যে ধরন তাতে পরিচ্ছন্নতা, শৃঙ্খলা এবং পরিশ্রমের ছাপ স্পষ্ট। তাঁর লেখা থেকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায় যা অন্য কোন ফন্ট বা আর কারও লেখার সঙ্গে মিলবে না। সংবিধানে হাতে লেখা দুটি টাইপ মূলত দেখা যায়। প্রথমটি শিরোনাম কেন্দ্রিক বা হাইলাইট, অপরটি নিয়মিত বা সাধারণ। যেমন: প্রথম পাতায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান বা সূচিপত্র— এই শিরোনামধর্মী লেখাগুলো মোটা হরফের। ধারণা করা যায়, রউফ মাথা কাটা নিব বা বাঁশের কঞ্চি ব্যবহার করে থাকতে পারেন। ফলে এই লাইনগুলো হয়েছে গতিশীল ও নমনীয়। অন্যদিকে সাধারণ বা নিয়মিত লেখা দেখলে বলপেনের মতো মনে হতে পারে, কেননা এতে কোনো লাইন ভ্যারিয়েশন নেই। লেখার ক্ষেত্রে ফিগারগুলোর মধ্যে সমান স্পেস বজায় রাখা হয়েছে। এটা নিশ্চিত যে, শিল্পী চুবিয়ে লেখার কলম এখানে ব্যবহার করেননি। কেননা চুবিয়ে লিখলে কোথাও কালি গাঢ় হবে আবার কোথাও হালকা হয়ে থাকবে। কিন্তু তেমনটা হয়নি। বোঝাই যায় এই ঝকঝকে লেখার জন্য বিশেষ কালিরও প্রয়োজন হয়েছিল। তাই অন্য অনেকের মত আমারও প্রশ্ন জাগে, কী কলম আর কালি দিয়ে লিখেছিলেন শিল্পী?
এর উত্তর লুকিয়ে ছিল সুদূর লন্ডনে। শিল্পী রউফ যখন ঢাকায় বসে সংবিধানটি হাতে লিখে দিচ্ছিলেন তখন হাজার মাইল দূরে বিলেতে তার পরিবার। বড় ছেলে রিয়াদ রউফের স্মৃতিতে আজও তাজা সেই ঘটনা। পঞ্চাশ বছর পর রিয়াদ তার বনানীর অফিসে শোনাচ্ছিলেন সেইসব দিনের কথা:
“বাবা লেখার জন্য সাথে করে কিছু কলম ও প্রয়োজনীয় ইনস্ট্রুমেন্ট লন্ডন থেকে নিয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশে। আমরা তখন ওখানে থাকতাম। আমি নিজে কলমগুলো বাবার কাছে দেখেছি। এর মধ্যে কলম ছাড়াও কাগজ, পেন্সিল, কাটিং ইনস্ট্রুমেন্ট, স্কেল, মাপজোকের কিছু সরঞ্জামও ছিল। আব্বার স্মৃতিমাখা সেই সময়ের দুটো কলম রেখে দিয়েছিলাম আমি। এমনকি দেশে ফিরে বুয়েটে স্থাপত্যবিদ্যা পড়ার সময় সেই কলম ব্যবহারও করেছি। এগুলো তখনকার সময়ের Rotring কোম্পানির Rapidograph পেন। এটিকে Tubular Point Drafting Pen বলা হয়ে থাকে। আব্বা এই দুটি কলম সংবিধান লেখার কাজে ব্যবহার করেছিলেন; কেননা লেখার দিকে তাকালে যে ফ্ল্যাট লাইন দেখা যায় তা মূলত এই কলমের দ্বারাই সম্ভব। আব্বা ফাউন্টেন পেন ব্যবহার করেননি কেন তা কিছুটা অনুমান করতে পারি। তখনকার দিনের সাধারণ ফাউন্টেন পেনে কালি অনিয়ন্ত্রিত ছিল, কোথাও কম কোথাও বেশি পড়ে যেতে পারে। তাছাড়া ফাউন্টেন পেনের কালি কাগজ শুষে নেয় বেশি, এতে গোটা কাজটাই নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। আব্বা যে ধরণের কাগজ ব্যবহার করেছিলেন সেখানে হয়তো এই ধরনের ড্রাফটিং পেন বেশি উপযোগী মনে করেছিলেন। তিনি ড্রাফটিং পেন দিয়েই লেখা নিয়ন্ত্রণে অভ্যস্ত ছিলেন।”
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, বৈচিত্র আনতে কিছু শিরোনাম মোটা ও বড় অক্ষরে লেখা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে রিয়াদ রউফ জানান, শৈশবে তিনি বাবার কাছে নিবের মাথা কাটা এক ধরনের ফাউন্টেন পেন দেখেছেন। তাঁর ধারণা, মোটা হরফগুলো লিখতে সেই মাথা কাটা ঝরনা কলম ব্যবহার হয়ে থাকতে পারে।
শুধু কালি-কলমই নয় সংবিধানের জন্য কাগজ ব্যবহারেও সর্বোচ্চ সতর্ক ছিলেন লিপিকার আবদুর রউফ। সঙ্গে এনেছিলেন কিছু বিদেশি কাগজ। সেসব কাগজের মধ্য থেকেই একটিকে তিনি এ দেশের আবহাওয়া ও পরিবেশে দীর্ঘস্থায়ী এবং মানসম্পন্ন হিসেবে বাছাই করেন। তার সেই কাগজকে আদর্শ নমুনা ধরে তিনি চাহিদাপত্র দিলেন। জানালেন কী পরিমাণ পেপার লাগতে পারে। শুরু হলো ফরমায়েশ মোতাবেক কাগজের সন্ধান। হাশেম খান সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে বলেন:
“আজকের মতো অফসেট পেপার সেকালে ছিল না। মজবুত, উজ্জ্বল ও কালি প্রতিরোধক কাগজ বলতে গেলে কেন্ট পেপার নামের বিলেতের একটা কাগজ ছিল। কিন্তু ঢাকায় বা কলকাতায় সেই কাগজ কোথায়! আর্ট পেপার কালি শুষে নেয় বেশি, অন্যদিকে পাতলা কাগজ শক্ত নয়। তাই রউফ ভাই নিজে যে কেন্ট পেপার সাথে এনেছিলেন সেই কাগজের সাথে নমুনা মিলিয়ে আমরা খুঁজতে লাগলাম। অনেক কাগজ পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে কেন্ট পেপারের কাছাকাছি চরিত্রের একটাকে পাওয়া গিয়েছিল কলকাতায়। কলকাতা থেকে সেই পেপার কিনে ট্রাকে বহন করে আনা হয় সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে। ব্যবহার হয় সংবিধান হাতে লেখার কাজে।”
কাগজে শুধু লেখাই হচ্ছিলো না, সমান তালে চলছিল অলঙ্করণ। নকশা অঙ্কনের জন্য প্রতিটি কাগজের চারপাশে আগে নির্দিষ্ট পরিমাণ জায়গায় পেন্সিল দিয়ে মার্জিন করে আলাদা করা হতো, সেই মার্জিনের ভেতর সংবিধানের লেখাগুলো রউফ লিপিবদ্ধ করছিলেন। এই শিল্পরূপ নির্ধারণ করেছিলেন খোদ জয়নুল আবেদিন।
শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, লেখা এবং অঙ্কনের জন্য খুব সাধারণ কাগজ, কালি ও রং ব্যবহার ছাড়া উপায় ছিল না। ১৭ ইঞ্চি বাই ২৩ ইঞ্চি মাপের ডিমাই সাইজের কাগজের উপর নকশার কাজ করেছেন তাঁরা। কালি বা রংয়ের জন্য বিশেষ কোনো চাহিদা দেননি। যুদ্ধোত্তর বাজারে যা পাওয়া গেছে তাই দিয়েই করা হয় রঙিন অলঙ্করণগুলো। নকশায় কালো বা উজ্জ্বল রং এড়িয়ে গিয়ে চেষ্টা করা হয়েছে হালকা রং ব্যবহারের। রং হিসেবে সস্তা পোস্টার কালার এক্ষেত্রে ব্যবহার হয়েছে। আবুল বারক আলভী আজও মনে করতে পারেন, এ কাজের জন্য বাজার থেকে পেলিকেনের রং ও তুলি কিনেছিলেন।
গোটা সংবিধানটাই পরিণত হয়েছিল একটা ক্যানভাসে। নকশা হয়ে গেলে তাকে অঙ্গসজ্জায় রূপ দেয়াটা ছিল শিল্পীদের জন্যে বড় চ্যালেঞ্জ। নকশাকে সুশৃঙ্খল সারিতে সাজানোর কাজটি করেছিলেন শিল্পী হাশেম খান। খেয়াল করলে দেখা যায়, প্রতি পৃষ্ঠায় লেখা ও নকশার মধ্যে দুটো সরু লাইন টানা হয়েছে। হাশেম খান ব্যবহার করেছেন এক ধরনের ড্রয়িং ইনস্ট্রুমেন্ট যা “Crowquill” নিব নামে পরিচিত।
কাজের সুবিধার জন্য পৃষ্ঠার একদিকেই লেখা হয়েছে। সংবিধানের প্রতিটি অধ্যায়ের জন্য বৈশিষ্ট্য ও অর্থপূর্ণ আলাদা ডিজাইন লক্ষ্যণীয়। এছাড়া স্বতন্ত্র মোটা লাইনের নকশা আঁকা হয়েছিল প্রতি ভাগে। এগারোটি ভাগ ও তফসিলের প্রতিটির শেষে এসে জয়নুল নিজ হাতে স্কেচ করেছেন। এটাই ছিল মাস্টারপিসের কাজ। সংবিধানের মাস্টারপিসে কিন্তু সই করেননি গণপরিষদের সদস্যরা। কয়েকটি ধাপ পেরিয়ে ফিল্ম প্রিন্ট কপি, প্রুফ কপির পর ফার্স্টকপি হাতে আসে। সেই ফার্স্ট কপিতেই স্বাক্ষর করেন সবাই। ফার্স্ট কপি চামড়ার মলাটে বাঁধাই করেন সৈয়দ শাহ আবু শফি।
সংবিধানের ফার্স্ট কপি নিয়ে ১৯৭২ সালের ১৩ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন প্রতিনিধিদলের সদস্যরা। প্রধানমন্ত্রীর বেইলি রোডের কার্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সবার একটি স্থিরচিত্র ধারণ করা হয়।
ফার্স্ট কপি নিয়ে যখন এত মাতামাতি তখন মাস্টারপিসটা কোথায় ছিল? উত্তরে স্বাধীনতা পদক পাওয়া শিল্পী হাশেম খান জানান:
“মাস্টারপিসটা সংরক্ষণ করার কথা থাকলেও আমরা পারিনি। ১৯৭২ সালেই ওটা ধ্বংস হয়ে গেছে। রউফ ভাইয়ের আসল লেখা ও আমাদের ইলাস্ট্রেশন শুধু ছাপা আকারে রয়ে গেছে। হাতে লেখা পূর্ণাঙ্গ কপি সংরক্ষণের কথা ভাবা হলেও কার্যত কোনো উদ্যোগ শিল্পীদের পক্ষে নেয়া সম্ভব হয়নি। যে ঘরে বসে সংবিধান হাতে লেখা হয়েছিল সেটা তিন মাস পর সংসদ সচিবালয় ফেরত নিয়ে নেয়। সেখানে থাকা শিল্পীদের কালি, কাগজ, কলম, ব্র্রাশসহ যাবতীয় সরঞ্জাম ও ব্যবহার্য সরঞ্জাম কোথায় সরিয়ে ফেলা হয় সেটা আর জানতে পারিনি। মাস্টারপিস তো দূরের কথা ফার্স্ট কপিটারই হদিস ছিল না। অনেক বছর পর এরশাদ সরকারের আমলে সংসদ সচিবালয়ের একজন সচিব টেলিফোনে আমাকে জানান যে, একটি ড্রয়ারে ফার্স্ট কপি খুঁজে পাওয়া গেছে, সাথে কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথি। পরে আমি সেই কপিটি জাদুঘরে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করি।”
অর্থাৎ জাদুঘরে যেটা আছে সেটা হাতে লেখা সংবিধানের ফার্স্ট কপি! কোনভাবেই মাস্টারপিস নয়। চলুন দেখা যাক বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেয়া জাদুঘরের তথ্য এক্ষেত্রে কী বলে।
নিকট অতীতে জাতীয় জাদুঘরের তথ্য আর দায়িত্বশীলদের বরাত দিয়ে অসংখ্য প্রতিবেদন ও প্রবন্ধ প্রকাশ হয়েছে। এরমধ্যে ইন্টারনেটে পাওয়া যায় আর কিছু মিলবে পত্রিকার আর্কাইভে। এসব লেখায় সবখানেই মোটামুটি একটি দাবি করা হয়— ‘হাতে লেখা সংবিধানটি জাদুঘরে সংরক্ষিত’। এ অবস্থায় যে কারও প্রশ্ন জাগতে পারে, ‘হাতে লেখা’ বলতে এখানে কী বোঝানো হচ্ছে?
কেউ একে সংবিধানের প্রথম হাতে লেখা কপি বলছেন, কারও কাছে আবার হাতে লেখা সংকলন। কিন্তু এসব কোনো প্রতিবেদন বা লেখাতেই পরিষ্কার করে বলা নেই, যে কপিটি রাখা আছে সেটা আসল হাতে লেখা (মাস্টারপিস) কিনা। এই উত্তর দেয়ার বদলে ‘প্রথম মুদ্রিত কপি’ বা ‘সংকলন’ কিংবা ‘আংশিক সংবিধান’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এমন বাকচতুর ও অস্পষ্ট বিবরণ থেকে শিল্পীদের হাতে জন্ম নেয়া অমূল্য দলিলটির প্রকৃত অবস্থা ব্যাখা করে না বরং পাঠযোগ্যতায় প্রভাব ফেলে।
হাতে লেখা সংবিধানের প্রকৃত অবস্থা, অস্তিত্ব ও অবস্থান নিয়ে দুই শিল্পীর কথার সঙ্গে জাদুঘরের তথ্যের ভিন্নতা পাওয়া যায়। কোথায় কোন গ্যালারিতে বা কোন স্থানে রাখা আছে ‘হাতে লেখা’ সংবিধানটি, জানতে কয়েক দফা যোগাযোগ করা হয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। তথ্য অধিকার আইনে আবেদনের পর অবশেষে একটি চিঠিতে কর্তৃপক্ষ জানায়:
“ইতিহাস ও ধ্রুপদি শিল্পকলা বিভাগের নিয়ন্ত্রনাধীন স্টোরে শিল্পীগণের হাতে লেখা বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানের ‘মূল কপিটি’ সংরক্ষিত আছে এবং গ্যালারিতে একটি অনুকৃতি উন্মুক্ত প্রদর্শনের জন্য রাখা আছে”।
২৩ অক্টোবর ২০২৩, শিল্পী আবুল বারক আলভী ও আমাকে সেই দলিলটি দেখার আমন্ত্রণ জানানো হয়। সেখানে গিয়ে তিনটি জিনিস পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া যায় যে শিল্পীদের দাবিই সঠিক। এটি মাস্টারপিস নয় বরং সেই ফার্স্ট কপি, যেখানে ছাপানো বইয়ের শেষভাগে দুই রংয়ের কালিতে গণপরিষদের সদস্যদের সইগুলো আছে। আমার পরীক্ষার বিষয় ছিল তিনটি; প্রথমত, দুই ধরনের তরল কালি ও ফাউন্টেন পেনে গণপরিষদ সদস্যরা সই করেছিলেন। ধারণা করা হয় সই করার দুটো কালিই ছিল স্থায়ী কিংবা ন্যূনতম জলনিরোধক তরল রং। আসল সিগনেচার ছাড়া পরের দিকে ছাপানো গ্রন্থে রংয়ের এসব তারতম্য বোঝা যাবে না। এছাড়া শেষ দিকে পেন্সিলের দাগকাটা ঘরসমেত কিছু অতিরিক্ত পৃষ্ঠা এবং চামড়ায় বাঁধানো মলাট ভালো করে পরীক্ষা করলে পার্থক্যটা ধরা যায়। হাশেম খানের পরামর্শে আরও কিছু বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ফার্স্ট কপি চিহ্নিত করা গেছে।
এখানে একটা কথা বলে রাখা দরকার, হাতে লেখা সংবিধান বললে প্রথমেই মাথায় আসে এমন একটি দলিল যা কেউ হাতে লিখেছে। তাহলে আমি তো সেই হাতের লেখাটাই দেখতে চাইব। মোনালিসার ছবির মাস্টারপিস আর দোকান থেকে কেনা পোস্টার নিশ্চয়ই এক নয়। দুটোকেই হাতে আঁকা বলা যাবে কি? কাজেই মাস্টারপিসের কথা বলতেই আমার মতো অনেকেরই ছাপানো কিছুর কথা মনে আসে না। তারপরও ফার্স্ট কপিকে মাস্টারপিস হিসেবে দাবি করা হয়। কিন্তু যেখানে সব লেখা ছবির মতো ছাপানো আর শেষে কালি কলমের সই কখনোই শতভাগ লিখিত দলিল বা ‘প্রকৃত কপি’ হতে পারে না। একে ফার্স্ট কপি বলছেন শিল্পীরা। তাই ‘মূল কপি’ নামটি যথার্থ কিনা তা ভেবে দেখা দরকার।