শিশুসাহিত্যে ‘নোবেল পুরস্কার’ এবং ছোটদের বইয়ে শব্দ কল্প গল্প ছবি

এখন তরুণ, নবাগত আর প্রতিষ্ঠিত অনেকেই ছোটদের বই সম্পাদনা, প্রকাশনা আর নকশা অলঙ্করণের সঙ্গে যুক্ত। একই সঙ্গে রয়েছে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, শিশু একাডেমি, বাংলা একাডেমি এবং শিল্পকলা একাডেমি। তাহলে শিশুদের জন্যে প্রকাশিত বইয়ে এই গলদ কেন? এত ফাঁকফোকর কেন?

আনিসুর রহমানআনিসুর রহমান
Published : 6 May 2023, 06:34 PM
Updated : 6 May 2023, 06:34 PM

ছোটদের লেখালেখি বা শিশুসাহিত্যের জন্যে জগতের সবচেয়ে মূল্যবান পুরস্কার অস্ট্রিদ লিন্ডগ্রেন স্মৃতি পুরস্কার বা সংক্ষেপে আলমা পুরস্কার। সুইডিশ কর্তৃপক্ষ এই শতকের গোড়ার দিকে পুরস্কারটি প্রবর্তন করে দেশটিতে শিশুসাহিত্যের সবথেকে অগ্রগণ্য প্রতিভা অস্ট্রিদ লিন্ডগ্রেনের নামে। এই পুরস্কারটিকে মনে করা হয় শিশুসাহিত্যে ‘নোবেল পুরস্কার’। পুরস্কারের অর্থমূল্য ৫০ লক্ষ সুইডিশ ক্রোনার বা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় পাঁচ কোটি টাকার সমান।

সারা দুনিয়ার শিশুসাহিত্যের লেখক, চিত্রশিল্পী এবং শিশুদের মাঝে পঠন প্রসারে ভূমিকা পালনকারী সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের এই পুরস্কারের জন্য মনোনীত হবার সুযোগ রয়েছে। গত প্রায় দুই যুগের ইতিহাসে এশিয়া মহাদেশ থেকে জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়া এই পুরস্কার পেয়েছে।

চলতি বছরে এই পুরস্কার গ্রহণ করছেন মার্কিন শিশুসাহিত্যিক লরি হ্যালস অ্যান্ডারসন (Laurie Halse Anderson)। গত ২ মে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় স্টকহোম কনসার্ট হলে সারা দুনিয়া থেকে আমন্ত্রিত অর্ধসহস্র অতিথির উপস্থিতিতে জাঁকজমকপূর্ণ এক অনুষ্ঠানে সুইডেনের ক্রাউন প্রিন্সেস ভিক্তোরিয়ার হাত থেকে তিনি এই পুরস্কার গ্রহণ করেন। পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে দেশটির সংস্কৃতিমন্ত্রী পারিসা লিলিস্ট্রান্ডও উপস্থিত ছিলেন। একই অনুষ্ঠান থেকে পাঁচদিনব্যাপী নবম বিশ্ব সংস্কৃতি বা কলা সম্মেলন বা আর্ট সামিট ২০২৩ উদ্বোধন করা হয়। বাংলাদেশসহ দুনিয়ার নানা প্রান্ত থেকে চার শতাধিক প্রতিনিধি এই সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেন।

সংস্কৃতির এই আন্তর্জাতিক সম্মেলন চলার সময়ে এবং শিশুসাহিত্যে নোবেল পুরস্কারসম এই পুরস্কার প্রদান উপলক্ষে দেশে দেশে ছোটদের বইয়ে শব্দ কল্প গল্প ছবি নিয়ে কিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরতে চাই।

শিশুসাহিত্যের ইতিহাস ছয় হাজার বছর মনে করা হয়। এমনকি ভারতবর্ষেই শিশুসাহিত্যের শুরু চার হাজার বছর আগে। তবে ধারণা করা যায় মানুষের আবির্ভাবের শুরু এবং মনের ভাব-ভঙ্গি প্রকাশ ও ভাষার বিকাশের সঙ্গে গল্প বলার চল ছিল, লিখিত সাহিত্যের ইতিহাসে যাই বলা থাক। আর এই গল্প বলার চলে শিশুরা নিশ্চয়ই উপেক্ষিত ছিল না। আর কেউ না বলুক, শিশুর সঙ্গে মায়ের কল্পকথা গল্পগাঁথা নিঃসন্দেহে ছিল। তাই যদি হয়ে থাকে, তাহলে শিশুসাহিত্যের ইতিহাস যে সুদূর আদিকাল থেকেই, তা ধারণার মধ্যে রাখতে দোষের কিছু কী আছে?

প্রাচীনকালে ভারতবর্ষসহ মিশর, আসিরিয়া-ব্যাবিলনিয়া, গ্রিস ছাড়াও জগতের নানা ভূপ্রান্তে শিশুসাহিত্যের হদিস পাওয়া যায়। এই সময়টায় পাথর, মাটির ফলক, প্যাপিরাসের ওপর শিশুসাহিত্য লেখা হতো। লেখার উপজীব্য থাকত রূপকথা, ইতিহাস এবং জীবনী আর কাঠামো হিসেবে বেছে নেয়া হতো গদ্য আর পদ্য।

ইউরোপে সহস্র বছর পূর্বে শিশুদের জন্যে রচিত বই থাকলেও তা আলাদা বিভাজন বা আলাদা মনোযোগের মধ্যে ছিল না। বড়দের জন্য লেখা বা প্রকাশিত বইয়ের মাঝে শিশুতোষ বইও থাকত। ওইসবের উপস্থাপনা ও আঙ্গিক অন্যসব বইয়ের মতোই ছিল।

বাংলা ভাষার দুনিয়ায় বা বঙ্গে শিশুদের জন্যে মুদ্রিত বইয়ের ইতিহাস আড়াই শ বছরের মতো। ১৮১৮ সালে কলকাতা স্কুল বুক সোসাইটির মাধ্যমে যার শুরু। এরপর বাংলার শিশুসাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে বিপুল বিশাল রচনা সম্ভারে, বিষয় আঙ্গিকে এবং বৈচিত্র্যে। পৃথিবীর আর কোন ভাষায় এত বৈচিত্র্যময় ধ্রুপদী শিশুসাহিত্য আছে? শুধু তাই নয় আমাদের শিশুসাহিত্যের জমিনটাও এক্কেবারে নিজস্ব। প্রাচ্য বা প্রতীচ্য থেকে ধার করা নয় একদমই।

ভারতবর্ষে চার হাজার বছর আগে শিশুদের নিয়ে রচিত গ্রন্থ ‘সুক্তপাঠক’। এই গ্রন্থের পর প্রাচীন ভারতবর্ষের জনপ্রিয় গ্রন্থের মধ্যে কালিদাসের ‘স্বাত্রিংশং পুত্তলিকা’, সোমদেবের ‘কথাসরিৎসাগর’, ‘হিতোপদেশ’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

শিশুদের জন্যে বা ছোটদের জন্যে লেখালেখির সাদামাটা শর্তগুলো কী?

ক. সহজ-সরল শব্দ

খ. ভারী ও কঠিন শব্দ পরিহার

গ. দৈনন্দিন ব্যবহৃত শব্দ

ঘ. শিশুমনে দোলা দেয়ার মতো শব্দের ব্যবহার

ঙ. হাসির এবং মজার শব্দ ও বাক্যের ব্যবহার

চ. বিদেশী ও তৎসম শব্দ পরিহার

ছ. দেশী ও পরিচিত শব্দের প্রয়োগ

জ. সমাসবদ্ধ এবং যুক্তাক্ষর সম্বলিত শব্দের প্রয়োগ যথাসম্বব এড়িয়ে চলা

ঝ. শব্দ ও বাক্যের অর্থের স্পষ্টতা

ঞ. কুরুচিপূর্ণ শব্দ পরিহার

এ তো গেল ছোটদের জন্যে লেখালেখির বিষয় ও আঙ্গিকের কথা। এবার এসব উপস্থাপনা বিশেষ করে প্রকাশনার আঙ্গিক কেমন হবে? অর্থাৎ বইয়ের আকৃতি, ভেতরের অলঙ্করণ এবং বাইরের নকশা কেমন হবে?

ছোটদের জন্যে লেখালেখির যে শর্ত তা মাথায় রেখেও ছোটদের একটি বই সম্পাদনা, অলঙ্করণ ও মুদ্রণের ক্ষেত্রে আরও কিছু দায়, কল্পনা এবং বিবেচনা থাকতে হয়। তবে এসবের জন্যে চিরাচরিত কোনো ব্যাকরণ বা স্বতঃসিদ্ধ কোনো রূপরেখা নেই। যা অবিরত চর্চার মধ্যে দিয়ে পরিশীলিত ও বিকাশ লাভ করে। ছোটদের জন্যে লেখা বই বলেই অলংকরণ থাকতেই হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতাও নেই।

অনেক সময় একটি শিশু অলঙ্করণ ছাড়া বইয়েও কল্পনা করার সুযোগ পায় এবং নিজে ভাবতে কৌতূহলী হতে পারে। এই ক্ষেত্রে হুমায়ুন আজাদের দুটি বইয়ের কথা উল্লেখ করতে চাই, ‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না’ আর ‘আব্বুকে মনে পড়ে’। ছোটদের জন্যে লেখালেখি এবং আঁকাআঁকি হবে, রবীন্দ্রনাথ থেকে ধার করা শব্দে বলি, ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’-এর মতো সহজাত সরল সুন্দর সাবলীল স্বতঃস্ফূর্ত।

স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর জেলখানায় বসে ১৯২৯ সালে তার দশ বছর বয়সী মেয়ে ইন্দিরা গান্ধীকে লেখা ‘মেয়ের কাছে বাবার পত্র’ ( Letters from a Father to His Daughter) এবং পরে আরও কয়েক বছরে লেখা পত্রগুলোর সমন্বয়ে ১৯৩৪ সালে লেখা ‘বিশ্ব ইতিহাসের একঝলক’ (Glimpses of World History) বইটি একরকম সরল সহজ সাদামাটা উপস্থাপনায় প্রকাশিত হয়েছে এবং হচ্ছে। তাতে কী শিশুসাহিত্যের দাবি বা মর্যাদার কোনো হেরফের হচ্ছে?

বই বা শিশুসাহিত্যের সঙ্গে বড় হয়ে ওঠা বলতে আমার পাঠ্যপুস্তকই সই। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত বাংলা বইয়ে প্রায় অবধারিতভাবে মুদ্রণ বৃত্তান্ত পৃষ্ঠা বা প্রিন্টার্স লাইনে একটি নাম অবধারিত ছিল। নকশা ও অলংকরণ হাশেম খান। এখানেই শেষ নয় ভেতরের পাতায় অলঙ্কৃত নকশার সঙ্গে নিচে বা পাশে ওই নামটিও স্বাক্ষর হিসেবে যুক্ত থাকত।

আমার মনে পড়ে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় প্রতিবছর নতুন পাঠ্যবই হাতে পাবার পর আমি আর আমার সহপাঠীরা পাতা উল্টাতাম আর গুণতাম কতবার হাশেম খান আছেন। এরপর দিন দিন বড় হয়ে উঠলাম গ্রাম-শহর-বন্দর পেরিয়ে এদেশ-ওদেশ করে মহাসাগর আর মহাদেশ ডিঙিয়েও ওই আকর্ষণ আর অনুভূতি আর কোনো বইয়ে পেলাম না। না সেই গন্ধ, না সেই শৈশবের মনে আলো ছড়ানো কল্পনার পাখা গজানো উত্তেজনা আর উচ্ছ্বাস আর পেলাম কই?

এখন প্রযুক্তির অনেক বিকাশ হয়েছে। তাতে ক্ষেত্রবিশেষে হিতের চেয়ে হিতে বিপরীত হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখার এখনই সময়। উপদ্রব বা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার কারণে। এসব উপায় ব্যবহার করে স্বয়ংক্রিয় নকশা এবং অলঙ্করণ যে কেউ পেয়ে যেতে পারেন। এখানে একটি কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। লেখালেখি মানে মনের প্রকাশ। আঁকাআঁকিও তাই। লেখা ও নকশা বা অলঙ্করণ দুয়ে মিলে যদি ‘দোস্তি না হয়ে কুস্তি হয়’ তাহলে উদ্দেশ্যটাই মাঠে মারা যাবে।

একুশে বইমেলার শিশুচত্বরে ছোটদের জন্যে প্রকাশিত কিছু কিছু বই দেখে আমার কখনও কখনও মন খারাপ হয়। এখন তরুণ, নবাগত আর প্রতিষ্ঠিত অনেকেই ছোটদের বই সম্পাদনা, প্রকাশনা আর নকশা অলঙ্করণের সঙ্গে যুক্ত। সেই সঙ্গে রয়েছে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, শিশু একাডেমি, বাংলা একাডেমি এবং শিল্পকলা একাডেমি। তাহলে শিশুদের জন্যে প্রকাশিত বইয়ে এই গলদ কেন? এত ফাঁকফোকর কেন?

এক্ষেত্রে বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোর সহযোগিতায় শিশু একাডেমি উদ্যোগটা নিতে পারে। দুই দিনব্যাপী, এমনকি প্রয়োজনে সপ্তাহব্যাপী ‘ছোটদের বই’ শীর্ষক একটি সিম্পোজিয়াম এর আয়োজন করা যেতে পারে। এতে ছোটদের বই প্রকাশনা সংশ্লিষ্ট দিকগুলো ধরে ধরে বিষয়ভিত্তিক কর্মশালা, আলোচনা, বিতর্ক এবং সেমিনার হতে পারে। প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের প্রকাশনা বিভাগ স্বল্পমেয়াদী পাঠ্যক্রমের আয়োজন করতে পারে। এসব কর্ম উদ্যোগে প্রকাশক, সম্পাদক, শিল্পী, লেখক এমনকি বইয়ের অক্ষরবিন্যাসকারী কর্মীরাও অংশ নিতে পারেন।

আমাদের দেশের বইগুলোতে দেখা যায় প্রকাশক শিল্পী বা সম্পাদকরা কালির ব্যাপারে খুব উদার আর কাগজের ব্যাপারে খুব কৃপণ। খালি পৃষ্ঠা বা খালি জায়গা রাখতে খুব নারাজ। অনেক সময় দেখা যায় প্রচ্ছদের পরের পৃষ্ঠাতেই মুদ্রণ বৃত্তান্ত, তারপরই উৎসর্গ, এরপর সূচি এবং মূল লেখা শুরু হয়ে গেল। এই যদি হয় একটা শিশুদের বইয়ের অবস্থা তাহলে শিশুর দম নেবার ফুরসৎ কী, কল্পনা করার সুযোগ কোথায়?

স্কুলের পাঠ্যবইয়ে হাশেম খানের আঁকা সাদা-কালো অলঙ্করণে যে রঙের ঝিলিক শৈশবে মনের মধ্যে খেলেছিল, এখনকার কিছু কিছু রঙের নকশাতেও সেই ঝলক নেই কেন?

এই সময়ের শিশুদের প্রকাশনার অঙ্গশৈষ্ঠবে প্রাচ্য থেকে জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়া অনুকরণীয় জায়গা অর্জন করতে পেরেছে। শিশুদের বইয়ের জাপানি অলঙ্করণশিল্পী রিওজি আরাই (Ryôji Arai) ২০০৫ সালে এবং কোরিয়ান অলঙ্করণশিল্পী বায়েক হীনা (Baek Heena) ২০১৯ সালে শিশুসাহিত্যে দুনিয়াব্যাপী সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার অস্ট্রিদ লিন্ডগ্রেন স্মৃতি পুরস্কার বা আলমা পুরস্কার জিতেছেন। এই শতকের শুরুর দিকে সুইডেন সরকার প্রবর্তিত এই পুরস্কার এশিয়া মহাদেশ থেকে এই দুই চিত্রশিল্পীই এখন পর্যন্ত পেয়েছেন। এই ঘটনা থেকে অনুমান করা যেতে পারে এশিয়ার এই দেশ দুটিই শিশুসাহিত্যের ব্যাপারে বেশ খানিকটা মননশীলতা সমৃদ্ধি অর্জন করেছে যা বাইরের দুনিয়াতেও নজর কাড়তে পেরেছে।

আফ্রিকার শিশুসাহিত্য এখনও অনেকটা মৌখিক গল্পবলার আদলে বিকাশ লাভ করছে। আফ্রিকার শিশুদের বইয়ের অলঙ্করণ, নকশা ও বইয়ের আঙ্গিক দেখে বুঝতে অসুবিধে হবে না এ যে আফ্রিকার ঐতিহ্য। ওই নিজস্বতা তাদের প্রকাশভঙ্গী এবং উপস্থাপনরীতিতে নজরে কাড়বে।

ইউরোপের শিশুসাহিত্য বেশিরভাগ দেশেই প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছে, যার ছাপ প্রকাশনার অঙ্গশৈষ্ঠবে লক্ষণীয়। বহুল ব্যবহৃত একটি প্রবাদ আমরা জানি, ‘নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো’। এই সত্য অনেক ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও, শিশুসাহিত্যের ক্ষেত্রে নয়। ছোটদের জন্যে লেখালেখিতে বা প্রকাশনায় ‘কানা মামার চেয়ে নেই মামাই ভালো’। ছোটদের জন্যে যাচ্ছেতাই প্রকাশনায় আখেরে লাভের চেয়ে ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি।

একটি শিশু একটি বই পড়ে বা হাতে নিয়ে একবার বিমুখ হলে, মনের ভেতরে একটা দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে। একটি বই পড়ে বা হাতে নিয়ে শিশু যেমন বইয়ের প্রতি ক্রমাগত কৌতূহলী হয়ে উঠবে, তেমনিভাবে যুৎসই বই যদি তার নাগালের কাছে না আসে এর উল্টোটাও ঘটতে পারে।

তাই শিশুদের জন্যে লেখালেখির ক্ষেত্রে যেমন সহজ-সরল শব্দ চাই, আঁকার বেলায় বা বইয়ের কাঠামো সাজানোতেও চাই সরল-সহজ রেখা, রঙ আর ব্যাপ্তি। ভারবাহী কঠিনেরে ভালো না বাসুন শিশুদের জন্যে লেখায় ও আঁকায়। শিশুদের বইয়ে নিয়ে আসা চাই প্রতিদিনের আলো ও রঙের সমাহার। শব্দও চাই প্রতিদিনের দেখা জগৎ থেকে, ছবিও তাই।

শিশুমনে দোলা দেবে কীসে? নিশ্চয়ই পুলিশের গাড়ি কিংবা লাশবাহী গাড়ি দেখে নয়। লেখা ও আঁকাআঁকিতে তা মনে রাখা চাই। শিশুমনে দোলা দেবে আইসক্রিমওয়ালা, ফেরিওয়ালা, বাঁশিওয়ালা, প্রাণ-পাখি-মাছ কত কী?

ভূত আর দৈত্য দানবের এত শব্দ কথা আর আজগুবি কল্পগল্প থেকে আমাদের শিশুসাহিত্যের ঠিকাদারদের মুক্তি কি মিলবে না? শিশুদের কথা গল্প এবং চেনা জগৎ ও কল্পনার সঙ্গে দাদা-দাদী, নানা-নানীর, আত্মীয়-পড়শীর বেজায় ফারাক কেন? রোবটিয় শিক্ষার পরিবেশ, দম বন্ধ করা নগরের বাইরেও পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইলের ভেতরে শিশুর জন্য কল্পগল্পের বিস্তর জায়গা রয়েছে। রয়েছে মাতৃভাষা বাংলার মধুর মধুর শব্দ।

তাই মজার আর হাসির গল্প চাইলেই কোনো গল্পবাজ খুঁজে দেখতে পারেন। সদয় হতে পারেন দেশি শব্দের প্রতি, দেশি ছবি ও দৃশ্যের প্রতি। পরিহার করতে পারেন বিদেশি শব্দ ও অযাচিত ছবি। ছবির প্রাসঙ্গিকতা যেমন জরুরি, তেমনি স্পষ্টতাও আবশ্যক। কুরুচিপূর্ণ ছবির কোনো সুযোগ নেই শিশুসাহিত্যে। এরকম ছবি শব্দ ও বাক্যের ব্যবহার অমার্জনীয় অপরাধ হিসেবে বিবেচিত।

যার ভেতরে একটি শিশুমন নেই, তার ছোটদের বই রচনা প্রকাশ ও প্রস্তুতিপর্বের ধারেকাছেও আসার দরকার নেই। অসৎ, ধান্দাবাজ, কথার বরখেলাপকারী যেকোনো লেখক-প্রকাশক-সম্পাদক ও শিল্পী যদি ছোটদের প্রকাশনা জগৎ থেকে একশ হাত দূরে থাকেন, তাহলে আমাদের দেশে ছোটদের লেখালেখির জগৎ অনেকটাই দূষণের হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে।

আমার জানার পরিধির মধ্যে বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, নেপাল আর শ্রীলংকার ছোটদের বইয়ের অঙ্গশৈষ্ঠব কাছাকাছি ভাবধারা এবং রীতি পরিগ্রহ করে চলে। যদিও এসব ক্ষেত্রে নিজ নিজ দেশের প্রকৃতি, জীবন ও সংস্কৃতির ছাপ নজরে পড়ে।

আমাদের দেশে ছোটদের বইয়ের জগৎ নিয়ে ভাবার, কাজ করার এবং আরও সমৃদ্ধ করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এর জন্যে অন্যান্য দেশের সঙ্গে অভিজ্ঞতা বিনিময়ের দরকার রয়েছে, বিশেষ করে কোরিয়া, জাপান এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে।