একটি শিক্ষিত সমাজে অপরাধ প্রবণতা কমে আসে এবং শান্তি ও সম্প্রীতির পরিবেশ গড়ে ওঠে। শিক্ষাই সমাজের নৈতিক ভিত্তিকে শক্তিশালী করে তোলে, যা একটি সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়ে তোলার জন্য অপরিহার্য। আমরা তেমনভাবে গড়ে ওঠা একটি শিক্ষিত জাতির আশায় আছি, আশায় থাকব।
Published : 11 Dec 2024, 05:27 PM
ঘনঘন মত বদল বা বিষয় বদলে রাজনীতি অভ্যস্ত হতে পারে কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থার জন্য তা ভয়াবহ। যে সরকার পনের-ষোল বছর ধরে দেশের ঘাড়ে ভর করেছিল তার কাছে আমাদের প্রত্যাশার মূল্য ছিল না। তারা তাদের ইতিহাস তাদের মতো করে বলে-পড়ে-শিখিয়ে শেষপর্যন্ত টিকতে পারেনি। তারা ভয়াবহ একপেশে শাসনে যে সমস্যা তৈরি করে রেখে গেছে, তা আজ গিলতে চাইছে সবকিছু।
আজকাল ছেলেমেয়েদের ধৈর্য খুব কম। প্রযুক্তি এই ধৈর্যহীনতা তৈরি করেছে। যখন প্রযুক্তি ছিল সীমিত তখন আমাদের আশ্রয় ছিল বই-পুস্তক। মানুষ বই পড়ত, বই ছিল তাদের ধ্যান-জ্ঞান। এর ভেতর একধরনের শান্তি ছিল। মনে রাখতে হবে দর্শন, শ্রবণ আর পাঠ— এই তিনের সমন্বয় আছে পাঠে। এখন এর যেকোনো একটা কাজ করে। দেখা মানে দ্রুত দেখতে থাকা। তারপর সেখান থেকে সরে অডিওতে যাওয়া। এই যে টানাটানি বা দোলাচল এতে শান্তি নেই। শান্তিহীনতায় ভুগতে ভুগতে আজকের প্রজন্ম বই পড়তে ভুলে গেছে। তারা জানে না পাঠে নিমগ্ন থাকা মানে এক ধরনের মনসংযোগের ব্যায়াম। এই যে পাঠ অনীহা, এর ফলে আজ `আজই চাই' জাতীয় এক ধরনের উত্তেজনা তৈরি হয়ে গেছে।
নবীনদের সবসময় দোষারোপ করার চাইতে তাদের দিকে মনোযোগী হওয়ার সময় এসেছে। বলতে পারি সময় বয়ে যাচ্ছে। এখনই তাদের শিক্ষায় না ফেরাতে পারলে অপমান আর অবমাননার যুগ শেষ হবে না। মনে রাখা ভালো এভাবে মেধা-শ্রম আর সময়ের অপচয়ে আমরা নিজেদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করছি মাত্র। নিয়ন্ত্রণ বা জবরদস্তি যে ভালো ফল বয়ে আনে না সেটা আমরা জানতাম এবং দেখতাম, কিন্তু মানতাম না। অথচ আজকের বাংলাদেশে তারুণ্য চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে জোর করে কিছু গেলানো যায় না। বরং জোর করে ইতিহাস গেলালে তাতে যে বদহজম হয় তার ফলাফল ভয়াবহ।
দেশ গঠনে তারুণ্যের বিকল্প নেই। তাদের সহযোগিতা আর অংশগ্রহণ ব্যতীত কোনোভাবেই সমাজ বিনির্মাণ করা সম্ভব হবে না। বলা উচিত তারাই হবে চালিকাশক্তি। এই চালিকাশক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে শিক্ষার মূল বিষয়ে ফিরতে হবে। অচিরে তা না হলে এগুতে পারব না আমরা। তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে আসলে শিক্ষা কী?
শিক্ষা বিষয়ে আমরা যা ভাবি তা কিন্তু কেবল একধরনের সীমাবদ্ধ ভাবনা। অথচ রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শন মূলত চিন্তা বা ভাবনার স্বাধীনতা, হৃদয়ের স্বাধীনতা এবং ইচ্ছাশক্তির স্বাধীনতা— এই তিন প্রকার স্বাধীনতার ধারনার ওপর প্রতিষ্ঠিত। শান্তি নিকেতনের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি এই ধারণাকে ব্যাখ্যা করে উল্লেখ করেছেন, এই স্বাধীনতা কেবল মনের প্রসারতার উপর নির্ভর করে। রবীন্দ্রনাথ ব্যক্ত করেছেন, মানুষের পূর্ণতা প্রাপ্তির এই ক্রমবর্ধমান আকাঙ্ক্ষার দুটি পরস্পর সংযুক্ত উপাদান আছে— একটি ব্যক্তিগত পূর্ণতা এবং অপরটি সামাজিক পূর্ণতা। এই দুই ধরনের পূর্ণতা একে অপরের প্রতিযোগী নয়, বরং সহযোগী। একটি অপরটির পরিপূরক।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার স্ত্রীশিক্ষা প্রবন্ধে লিখেছেন, “যাহা-কিছু জানিবার যোগ্য তাহাই বিদ্যা, তাহা পুরুষকেও জানিতে হইবে, মেয়েকেও জানিতে হইবে— শুধু কাজে খাটাইবার জন্য যে তাহা নয়, জানিবার জন্যই। মানুষ জানিতে চায় সেটা তার ধর্ম; এইজন্য জগতের আবশ্যক অনাবশ্যক সকল তত্ত্বই তার কাছে বিদ্যা হইয়া উঠিয়াছে।” জ্ঞান সঞ্চারের ক্ষেত্রে কোনো লিঙ্গ, জাতি বা ধর্মের বিচার চলে না। মানুষের দ্বারা সৃষ্ট সকল জ্ঞানে সকলের অধিকার আছে। কারণ এই জ্ঞান একক ব্যক্তি বা দেশের সৃষ্ট নয়। পৃথিবীর সকল দেশের সর্বকালের সব মানুষের সৃষ্ট জ্ঞানের ধারা জ্ঞানসমুদ্র সৃষ্টি করেছে। (গ্রন্থাগার: রবীন্দ্রনাথ; অমিয় চক্রবর্তী)
জ্ঞানকে বিকশিত করার জন্য যেকোনো একমুখীনতা থেকে আলাদা করতে হয়। একের ভেতরে বহু না বহুত্বের ভেতরে এক ওই তর্কে না গিয়েও বলা যায় আমাদের দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য আর ভবিষ্যৎ ভাবনাই তৈরি করবে সঠিক পথ।
তাহলে আমাদের পথ একটাই। বিকৃত ইতিহাস আর মিথ্যা থেকে মুক্তি। এ কথা মনে রাখতে হবে যে প্রজন্মের হাতে দেশের ভবিষ্যৎ, তারা যদি সঠিকভাবে দেশ ও সংস্কৃতিকে না জানে বাংলা মায়ের দুঃখ-কষ্টের শেষ হবে না। রাজনীতি বা সরকার এসব জায়গায় যতটা প্রভাবশালী তার চাইতে অনেক বেশি প্রভাবশালী আমাদের সংস্কৃতি ও ইতিহাস। ইতিহাসের আলোকে পথ নির্মাণ করা গেলে মানুষ আর কোনোদিন পথ হারায় না। বারবার লড়াই সংগ্রাম কিংবা যুদ্ধংদেহিতায় শক্তি ব্যয় আর নিজেদের বল হারানো ছাড়া লাভ কিছু থাকে না। কষ্টার্জিত স্বাধীনতা বাঁচাতে ইতিহাসকে সমুন্নত রাখতে তারুণ্যকে শিক্ষায় ফিরিয়ে নিতে হবে।
শিক্ষা মানুষের চিন্তা ও মননকে বিকশিত করে। এটি মানুষকে যুক্তিবাদী এবং বিশ্লেষণধর্মী হতে শেখায়। শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ সঠিক ও ভুলের পার্থক্য বুঝতে পারে এবং সমাজের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়। ব্যক্তিগত এবং সামাজিক জীবনে সমস্যাগুলোর সমাধান এবং নতুন নতুন ধারণা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। একটি শিক্ষিত মানুষ কুসংস্কার ও অজ্ঞতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে এবং পরিবর্তনশীল বিশ্বে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে।
শিক্ষা দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির অন্যতম হাতিয়ার। শিক্ষিত মানুষ নিজেকে আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তুলতে পারে এবং একটি সফল পেশাগত জীবনের মাধ্যমে আর্থিক সাফল্য অর্জন করতে পারে। শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষতা ও জ্ঞান অর্জিত হয়, যা কর্মক্ষেত্রে মানুষের যোগ্যতা বৃদ্ধি করে। বিশেষ করে বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তির গুরুত্ব বাড়ছে এবং শিক্ষিত মানুষই এই প্রযুক্তির মাধ্যমে দেশের আর্থিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে।
শিক্ষা নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ গড়ে তোলে। একজন শিক্ষিত মানুষ শুধু জ্ঞান অর্জন করে না বরং মানবিক গুণাবলিও অর্জন করে। শিক্ষা মানুষকে সহমর্মী, ন্যায়পরায়ণ, এবং সৎ হতে শেখায়। একটি শিক্ষিত সমাজে অপরাধ প্রবণতা কমে আসে এবং শান্তি ও সম্প্রীতির পরিবেশ গড়ে ওঠে। শিক্ষাই সমাজের নৈতিক ভিত্তিকে শক্তিশালী করে তোলে, যা একটি সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়ে তোলার জন্য অপরিহার্য।
আমরা তেমনভাবে গড়ে ওঠা একটি শিক্ষিত জাতির আশায় আছি, আশায় থাকব।