অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে জারি করা সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫ (সিপিও) এবং ব্যক্তিগত উপাত্ত সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫ (পিডিপিও)-এ ডিজিটাল ইকোসিস্টেমের সামগ্রিক দিক বিবেচনা করা হয়নি। পূর্বের বিতর্কিত আইনগুলোকেই সামান্য পরিবর্তন করে দায়সারাভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
Published : 12 Mar 2025, 05:49 PM
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ প্রযুক্তির আধুনিকায়নে ব্যক্তিজীবন কিছুটা সহজ হলেও নিরাপত্তার প্রসঙ্গটি ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। বিভিন্ন সময়ে সাইবার স্পেসে হওয়া সহিংসতা; বিশেষত নারীর ওপর আক্রমণ শঙ্কা তৈরি করছে। কিন্তু ওই অনুযায়ী ডিজিটাল বা সাইবার পরিসরে সরকারের সুরক্ষা ব্যবস্থা কি যথেষ্ট?
বর্তমানে বাংলাদেশ নানা জটিলতার মধ্যে দিয়ে গেলেও স্বস্তির বিষয় হচ্ছে রাষ্ট্র সংস্কারসহ বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে কাজ হচ্ছে। কাজের কাজ কতটা হচ্ছে ওই তর্কে যাচ্ছি না অবশ্য।তবে ওই স্বস্তিটাই অস্বস্তিতে রূপ নেয় যখন লক্ষ্য করি, বৃহত্তর সমাজ-রাষ্ট্র কিংবা সাইবার কাঠামোর সংকটগুলো চিহ্নিত বা মোকাবেলা না করে বরং তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ অথচ বিতর্কিত বিষয়গুলো সংস্কারে বেশি মনোযোগ দেয়া হয়। উদাহরণ হিসেবে, বর্তমান সরকারের সময়ে জারি করা সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫ (সিপিও) এবং ব্যক্তিগত উপাত্ত সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫ (পিডিপিও)-এর খসড়ার দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে। যা ডিজিটাল ইকোসিস্টেমের সামগ্রিক দিক বিবেচনা না করেই নেওয়া হয়েছে। পূর্বের বিতর্কিত আইনগুলোকেই সামান্য পরিবর্তন করে দায়সারাভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যেখানে অংশীদারদের মতামত এবং প্রমাণভিত্তিক ব্যবস্থার অভাব স্পষ্ট।
এই অধ্যাদেশগুলো অনেকাংশেই অস্পষ্ট, অনির্দিষ্ট এবং জটিল বিধানে পূর্ণ, যা বাস্তবতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। পূর্বের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ বা তথ্য প্রযুক্তি আইন ২০০৬-এর বিতর্কিত ধারাগুলোও এখানে বহাল রয়েছে, যা রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বী, সাংবাদিক ও অধিকারকর্মীদের হয়রানির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। কিছু নির্দিষ্ট ধারাতেই মামলা হতো, যার অধিকাংশই পুলিশ ও রাজনৈতিক কর্মীদের পক্ষ থেকে করা হতো। ব্যক্তির মানবাধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে আইনের ওইসব ধারাতে।
ওই একই উপাদানগুলোই বহাল রয়েছে অর্ন্তবর্তী সরকারের উদ্যোগেও। সরকারের এই উদ্যোগ ডিজিটাল পরিসরকে সুরক্ষিত করার পরিবর্তে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। অথচ, বৈশ্বিক নীতিমালা ও বাজারের সুযোগগুলো কাজে লাগিয়ে বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে সুরক্ষা নিশ্চিত করা যেত।
সোশ্যাল ডিলেমা নামক একটি প্রামাণ্যচিত্রে দেখানো হয়েছে, আপনার-আমার ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহার করে সোশ্যাল মিডিয়ার নিউজ ফিড নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। আমরা ভাবছি সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে সুবিধা নিচ্ছি, কিন্তু প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোও আমাদের ব্যবহার করছে তাদের লাভের জন্য। ট্রিলিয়ন ডলারের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পরিকল্পিতভাবে মানুষকে অভ্যস্ত করা হচ্ছে, যার ফলে মানুষের আচরণ ও অভ্যাস বদলে যাচ্ছে এবং সামাজিক সংকট তৈরি হচ্ছে। ওইসব তথ্য কখনো নেওয়া হয় আমাদের অগোচরে, আবার কখনো স্বেচ্ছায়ই আমরা দিয়ে দেই। আগামীতে তথ্যের নিয়ন্ত্রণই ক্ষমতার মূল চাবিকাঠি হবে।
এদিক থেকে পাশ্ববর্তী দেশ ভারত বেশ খানিকটা এগিয়ে। অ্যান্ড্রয়েড প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করে ভারতীয় বাজারে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার অভিযোগে গুগলকে ১৩ বিলিয়ন রুপি বা ১৬১ মিলিয়ন ডলার জরিমানা করেছে দেশটির প্রতিযোগিতা কমিশন (কম্পিটিশন কমিশন অব ইন্ডিয়া বা সিসিআই)। অন্যদিকে, জার্মানির ফেডারেল কার্টেল অফিস (এফসিও) এফসিও ২০১৯ সালে আবিষ্কার করে, ব্যবহারকারীদের সম্মতি ছাড়াই তাদের ডেটা সংগ্রহ করে বাজার ব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে মেটা। এফসিও মেটাকে এই ডেটা সংগ্রহ বন্ধ করার নির্দেশ দেয়। অথচ, বাংলাদেশের ব্যক্তিগত উপাত্ত সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫ এই বিষয়ে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনও ডিজিটাল পরিসর নিয়ে ভাবছে না।
অন্যদিকে, গণমাধ্যমসূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০০১ (বিটিআরএ) সংশোধনের প্রস্তাব, যেখানে ‘বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন’ প্রতিষ্ঠানটি সামগ্রিকভাবে নজরদারি, ফোনে আড়িপাতা এবং বিভিন্ন সময়ে ইন্টারনেট বন্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত; তা এখনো জনসাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছে। যার মধ্যে নজরদারির বৈধতাও রয়েছে এর ৯৭(ক) ধারায়। সর্বশেষ জুলাই-অগাস্ট আন্দোলনেও ইন্টারনেট বন্ধ, কল রেকর্ড ফাঁস ইত্যাদি ঘটনা ঘটলেও, কর্তৃপক্ষ দায় এড়িয়ে বিভিন্ন সংস্থার উপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করে। কখনো ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (ডিজিএফআই), কখনো ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি), কখনো তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ (আইসিটি ডিভিশন) ইত্যাদির নাম বলা হয় দায় এড়ানোর জন্য!
এই ধরনের অস্পষ্ট আইন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনমূলক কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের সংবিধানের ধারা ২৭, ৩১ এবং ৩৯(২) এর অধীনে ব্যক্তির মৌলিক অধিকারকে লঙ্ঘিত করে। এরূপ পরিস্থিতিতে ওই নির্দিষ্ট আইন বা ধারাটি বাতিল বা সংস্কারের বিধানও আছে কিন্তু সাংবিধানিকভাবেই। এর নজির দেশেই রয়েছে, আফজালুল আবেদীন বনাম বাংলাদেশ এবং ড. নুরুল ইসলাম বনাম বাংলাদেশ মামলার রায়ে। যেখানে, জননিরাপত্তা (বিশেষ বিধান) আইন, ২০০০-কে অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হয়েছিল— এর অস্পষ্টতা এবং বস্তুনিষ্ঠ মানদণ্ডের অভাবে।
সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫-এও অস্পষ্ট ও জটিল বিধান রয়েছে, যা অপব্যবহারের সুযোগ তৈরি করে। অথচ এসব বিষয় তোয়াক্কা না করেই একের পর এক এই জাতীয় আইন প্রণয়ন বা খণ্ডিত সংস্কার ডিজিটাল পরিসরকে আরও বেশি অনিরাপদ করে তুলেছে। একইভাবে ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া এবং ওটিটি প্ল্যাটফর্ম-২০২১-এর খসড়াতেও অবাধে কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারির সুযোগ রাখা হয়েছে।
পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১২-এর মতো আইনগুলোও সনাতনী পদ্ধতিতে চলছে, যেখানে ডিজিটাল পরিসরের কাঠামো উপেক্ষিত। শুধু পর্নোগ্রাফি তথ্য-উপাত্ত সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে এখানে। যা ব্যক্তিভেদে আলাদা ব্যাখ্যার সুযোগ আছে। এমনকি সম্মতিমূলক কিংবা অসম্মতিমূলক পর্নোগ্রাফির মধ্যে কোনো ধরনের পার্থক্য তো দূর; বরং অস্পষ্টতা রেখে দেওয়া হয়েছে। বিদ্যমান আইনে শিশু যৌন নিপীড়ন সংক্রান্ত উপাদানও সুনির্দিষ্টভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। নারী ও শিশুর ওপর হওয়া বৈষম্যমূলক নির্যাতনের বিরুদ্ধে সুরক্ষা নিশ্চিতে প্রণয়ন করা হয়েছিল নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০। তবে এই আইনেও শিশু যৌন নির্যাতন ও প্রযুক্তি-সহায়ক সহিংসতার বিরুদ্ধে শক্তিশালী বিধানের অভাব রয়েছে।
একইভাবে অশ্লীলতা আইন, ধর্মীয় অবমাননা আইন, রাষ্ট্রদ্রোহিতা আইনের ক্ষেত্রেও ডিজিটাল ইকোসিস্টেমের বিষয়টি বিবেচনা করা হয়নি। সনাতনী বিধানগুলোকেই সংস্কারহীনভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে। যা এই পরিসরকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।