Published : 18 Apr 2016, 04:01 PM
একটি ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ। যদিও দেশটির অর্থনীতি দ্রুতবেগে শক্তিশালী হচ্ছে। তবে সেই অর্থনীতি টেকসই করার জন্য মৌলিক যে সকল সামাজিক এবং রাজনৈতিক মাচা (scaffold) অনস্বীকার্য, সেই মাচার টার্মিনালের ফেব্রিকের প্রোটিন জ্যামিতিক হারে ক্ষয়িত হচ্ছে।
আমাদেরকে বুঝতে হবে যে, সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেনের অর্থনীতি আমাদের বর্তমান অর্থনীতির চেয়ে বহুগুণ বেশি শক্তিশালী ও টেকসই ছিল। সে সব দেশে প্রতিদিন হাজার হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক চাকরি নিয়ে যেত। পাকিস্তান শিল্পে আমাদের চেয়ে সকল প্যারামিটারেই এগিয়ে ছিল। কেবল রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ধর্মীয় উন্মাদনার প্রভাবের কারণে রাষ্ট্রগুলির অবস্থা অস্থিতিশীলতার উচ্চস্তরে রয়েছে। এখন সেই সব দেশে সকাল-বিকাল রুটিন করে সাধারণ মানুষ খুন করা হয়। এমনকি ধর্মীয় উপাসনালয়গুলিও নিরাপদ নয় সেথানে।
অসহনশীলতা, উগ্রতা এবং ধর্মীয় গোঁড়ামির ফলে যে সহজাত চিরায়ত দ্বন্দ্ব, তা সুনামির মতো আমাদের সমাজের দিকে ধেয়ে আসছে। রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গে যেমন জনগোষ্ঠী, কাঠামো, সামাজিক বিশ্বাস, এমনকি রাষ্ট্র নিজেই অসহায়ভাবে প্রতিটি মুহূর্তে আক্রান্ত।
পরিষ্কারভাবে বললে, রাষ্ট্র এখন একটি অজানা একমুখী রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। ধর্মীয়ভাবে উদার এবং কট্টর দুই গোষ্ঠী রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব হাতে নেওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত। দুই গোষ্ঠীর মধ্যে যে অংশটি শক্তিশালী, রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব পরোক্ষ কিংবা প্রত্যক্ষভাবে তাদের কব্জায় চলে যাবে। তবে প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে হয়তো আগামী দুয়েক দশক আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে।
এ অবস্থায় সামাজিক জীবনে দেখা দিয়েছে তিমির অন্ধকারের ছায়া। আগামী পাঁচ বছরে দেশটির গন্তব্য কোথায়, তার উত্তর কেউ দিতে পারবে বলে মনে হয় না। দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে হয়তো দুর্বল উত্তর দিয়ে ডিফেন্ড করে রাজনৈতিক দায় এড়ানো যাবে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, আমরা ক্রমশই প্রিডিকশন রেঞ্জের বাইরে চলে যাচ্ছি।
দেশের জিডিপি ৭.০৫ এবং মাথাপিছু আয় ১৪৬৬ ডলারে উত্তীর্ণ হওয়া সত্বেও আমাদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা ও অজানা ভয় কাজ করছে। প্রশ্ন হল, সত্যিকার অর্থেই কি দেশের ভবিষ্যৎ ঝুঁকিতে রয়েছে? দেশের মানুষের মননের পরিবর্তন এবং বিদ্যমান রাজনৈতিক দলের আচার-আচরণ বিশ্লেষণ করলে প্রশ্নটির উত্তর হল, 'হ্যাঁ'। যে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ফলে একটি জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন ঘটে এবং টেকসই হয়, সেই প্রধান অনুঘটকটির নিউরনে মিউটেশন দেখা দিয়েছে। প্রধান অনুঘটক বলতে যে রাজনীতিকে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিরাপদ রাস্তার ট্রাফিক ভাবি, সেই আওয়ামী লীগের রাজনীতিকেই বুঝানো হচ্ছে।
এটি সেই আওয়ামী লীগ যে দল ১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উত্তাল সময়ে ধর্মবর্ণনির্বিশেষে সকল জনগোষ্ঠীকে সংহত করতে প্রকাশ্যে মাঠে নেমেছিল, ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। দলটি একাত্তরের মহাকাব্যিক স্বাধীনতা সংগ্রামেরও নেতৃত্ব দিয়েছে। এমনকি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মতো ন্যায়ভিত্তিক দাবির পক্ষে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গণআদালতের প্রতি সমর্থন দান করে মূখ্য ভূমিকা পালন করেছে। এক কথায়, ধর্মীয় উন্মাদনার রাজনীতি আওয়ামী লীগ প্রকাশ্যেই মোকাবেলা করেছে।
সময়ের পরিক্রমায় ও ক্ষমতার রাজনীতির কারণে দলটি আজ নিজের আদর্শিক অবস্থানে অনড় থাকতে পারছে বলে মনে হচ্ছে না। একটি সত্যিকারের উদার সমাজ বিনির্মাণে যে সকল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত তাদের নেওয়ার কথা, অনেক ক্ষেত্রে এ নিয়ে তাদের মধ্যে তেমন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। সংবিধানের পঞ্চম ও অষ্টম সংশোধনীর মতো অসাংবিধানিক পরিবর্তন বাতিল করার জন্য বিচার বিভাগের উপর কেন নির্ভর করতে হবে? এটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয় ছিল।
যে রাজনীতির ভয়ে আওয়ামী লীগ এই ধরনের উদার ও সহনশীল বিনির্মাণ-বান্ধব রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধাগ্রস্ত, সময়ের পরিক্রমায় সেই সকল গোষ্ঠী ক্ষমতার স্বাদ নিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাবুনাগরীরা যে দেশের নির্বাহী প্রধান হতে মরিয়া, ৫ মের সমাবেশের পর সে কথা আর গোপন থাকেনি।
১৯৮৮ সালের ৭ জুন সংসদে অষ্টম সংশোধনী পাশ হয়। সেই সংশোধনীর মাধ্যমে বহু ধর্মাবলম্বীদের বাংলাদেশ রাষ্ট্রধর্ম পেল। বাংলাদেশের সকল স্তরের মানুষ সে সময় এ নিয়ে প্রতিবাদ করেন। তাদের বক্তব্য ছিল, রাষ্ট্রের আবার ধর্ম কীসের? রাষ্ট্র জড় পদার্থ। মানুষের কর্মের মতো রাষ্ট্রের কর্মে পাপ ও পূণ্য বলতে কিছু নেই। মানুষের মতো রাষ্ট্রের কি পরকালে বিচার হবে? রাষ্ট্র কি ধর্মীয় আচার-আচরণ পালন করে?
দুটি বিষয়ে রাষ্ট্রের নিরপেক্ষ হওয়া উচিত। ধর্ম ও ভাষা। কোনো ভাষাবিজ্ঞানী ও ভাষা-নীতি প্রণয়নকারী কোনো নির্দিষ্ট ভাষাকে রাষ্ট্রের ভাষা হিসেবে ঘোষণা করেননি। রাষ্ট্রের এক বা একাধিক ভাষা 'দাপ্তরিক ভাষা' হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। ফলে বাংলাকে আমাদের রাষ্ট্রভাষা না বলে দাপ্তরিক ভাষা বলাই নিরাপদ ও নিরপেক্ষ। এটি নিয়েও বাংলাদেশে রাজনীতি আছে। তবে এটির ব্যাখ্যা এই পরিসরে দেওয়া সম্ভব নয়।
যাহোক, আজকের প্রধানমন্ত্রী তৎকালীন ৮ দলীয় জোটের নেত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, 'সংবিধানের সংশোধনী জনগণ মানবে না'। আওয়ামী লীগ সংশোধনীর প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করেছিল। বিএনপি নেতৃত্বের জোটের প্রধান বেগম জিয়াও দাবি করেছিলেন, 'অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ধর্মের নামে জাতিকে বিভক্ত করার চেষ্টা চলছে'। বিএনপি জোটের আরেক সঙ্গী জামায়াতে ইসলামী ক্ষমতায় গেলে অষ্টম সংশোধনী বাতিলের কথা বলেছিল। সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম প্রতিষ্ঠার প্রতিবাদে এরশাদবিরোধী আওয়ামী লীগ জোট এবং বিএনপি জোট হরতালও দিয়েছিল।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে দুই নেত্রীর একজনও রাষ্ট্রধর্ম চান না এটি প্রকাশ্যে কেন, ঘরোয়া পরিবেশেও বলার মতো সামাজিক ও রাজনৈতিক ঝুঁকি নিবেন বলে মনে হয় না। 'জঙ্গি-ম্যানুফ্যাকচারার' জামায়াতে ইসলামীর কথা নাই-বা বললাম।
সময়ের পরিক্রমায় সেই আওয়ামী লীগ ১৯৬৪ সালের মতো ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়াতে বর্তমানে দ্বিধাগ্রস্ত। ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক নানা ছত্রচ্ছায়ায় সুপরিকল্পিতভাবে দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন হয়েছে। আওয়ামী লীগ তখন বিরোধী দলে। তারা বলেছিল, ক্ষমতায় গেলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর হামলার বিচার ও শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হবে। আজ তারা ক্ষমতায়। বিচারও নেই, শ্বেতপত্রও নেই। তারা যে এটি কেবল বাইরের দুনিয়ার সমর্থন পাওয়ার জন্য বলে, তা বহুলাংশে সত্য।
দেশের হিন্দু ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। অথচ রাষ্ট্র কোনো দায় নিতেই রাজি নয়। অন্ধের ভান ধরে বসে আছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর দশকের পর দশক সিস্টেমেটিক হামলার একটির বিচারও হয়নি। রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের কর্ণধারদের কি সামান্যতম বিবেক নেই?
প্রতিদিন নিয়ম করে মন্দির ভাঙ্গা হলেও আজ পর্যন্ত কাউকে বিচারের আওতায় আনা হয়নি। অথচ কথিত ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার জন্য কুমিল্লার এক হিন্দু ধর্মাবলম্বী শিক্ষিকাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এখানে রকেট লাঞ্চারের মতো দ্রুততার সঙ্গে রাষ্ট্রের চেতনা জাগ্রত হয়েছে। ওদিকে হাজার হাজার মন্দির ভাঙ্গার পরও রাষ্ট্র অনুভূতিহীন।
বিষয়টি যে রাষ্ট্রীয় বৈষম্য তা আমরা সবাই বুঝি; তবে কেউ কথা বলি না। দীর্ঘ কয়েক দশক রাষ্ট্রীয় এই বৈষম্যের পরম্পরায় মন্দির ভাঙ্গা এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন এখন 'সামাজিক দায়িত্ব' বললে ভুল হবে না। রাষ্ট্রের বিমাতাসুলভ আচরণে মনে হয়, এই রাষ্ট্রে বসবাসকারীদের মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতি কেবল ধর্মীয় সংখ্যাগুরুদের জন্যই বরাদ্দকৃত!
খালেদা জিয়ার সরকারের পরোক্ষ নেতৃত্বে ১৯৯২-১৯৯৪ (নেতৃত্বে ছাত্রদল ছিল) এবং ২০০১-২০০৬ সালে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন হয়েছে। বহু ইস্যুতে বেগম জিয়াকে আদালতে যেতে হলেও তাঁর সরকারের সমর্থনে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের জন্য আজ পর্যন্ত তাঁকে কোনো কৈফিয়ত দিতে হয়নি। অথচ পাশের দেশ ভারতেই বিতর্কিত বাবরি মসজিদের ঘটনায় তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসীমা রাওকে আদালতের বারান্দায় ঘুরতে হচ্ছে। অন্যদিকে বাংলাদেশে হাজার হাজার মন্দির ভাঙ্গা সত্বেও খালেদা জিয়ার মতো ক্ষমতাধরের বিচার তো বাদই, একজন সাধারণ নির্যাতনকারীকেও আইনের আওতায় আনতে রাষ্ট্র অনিচ্ছুক। কারণ ধর্মীয় বিশ্বাসের পরিসংখ্যানটি রাষ্ট্রের মস্তিস্কে সক্রিয়।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ও পরে দেশব্যাপী ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর হামলা হল। ১৫৩ আসনে ভোট হয়নি। অথচ সে সব অঞ্চলের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অনেককে পরিবার নিয়ে পালিয়ে যেতে হয়েছে। বহু জায়গায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর নেতৃত্বে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়। ঘরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে জয়ী একজন আওয়ামী নেতাকেও মাঠে থাকতে দেখা যায়নি। বহু নব্য এমপি ঢাকায় বসে শীতের দিনে হাটহাজারীর হুজুরের অনুকম্পা অর্জনের চেষ্টায় ফেসবুকে ধর্মীয় ফেরিওয়ালা পর্যন্ত বনে গিয়েছিলেন। বর্তমানে যেখানে যেখানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত হচ্ছেন, তার অধিকাংশ ঘটনায় আওয়ামী লীগের দলীয় নেতাকর্মীরা জড়িত বলে গণমাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে।
ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নির্যাতনের প্রতি আওয়ামী লীগের নির্লিপ্ততার পাশাপাশি আরেকটি শ্রেণির প্রতি দলটির একই আচরণ ক্রমশ শক্তিশালী হচ্ছে। সেটি হচ্ছে মুক্তমতে বিশ্বাসীদের প্রতি। সরকার বিরোধী দলের রাজনৈতিক বিশ্বাসের প্রতি রাজনৈতিক মানদণ্ডে অসহনশীল হবে এটা আমাদের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। এটি নিয়ে সাধারণ জনগণের আগের মতো আগ্রহ নেই। তবে একজন মানুষের সামাজিক বিশ্বাস সংবিধানের আওতায় সুরক্ষা দিবে, এটাই স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত। সেই জায়গাটিতে আওয়ামী লীগ রেফারির ভূমিকা পালন থেকে ক্রমশ সরে যাচ্ছে। প্রত্যেক ব্লগারকে হত্যার পর সরকারের কর্তাব্যক্তিদের বক্তব্যে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের চিত্র ফুটে ওঠে।
নিজামউদ্দিন সামাদের মতো দলের আদর্শিক সৈনিক নিহত হওয়া সত্বেও সেটি দলীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে মুখ্য নয়, মুখ্য নিজামউদ্দিন 'ধর্মবিরোধী' কিছু লিখেছেন কি না সে তথ্য! সরকারের তরফ থেকে স্পষ্ট করে কেন বলা হচ্ছে না যে, কারও বিরুদ্ধে যদি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার কথিত অভিযোগ থাকে, দেশের প্রচলিত আইনেই তার বিচার করা সম্ভব? এ সব কথা বলার রাজনৈতিক সাহস তারা দেখাতে পারছে না সেটাই সত্য।
অভিজিৎ রায় খুন হওয়ার পর অজয় রায়ের বাসায় সরকারের মন্ত্রীদের কেন চুপিসারে যেতে হয় তা একজন আনুষ্ঠানিক শিক্ষাবঞ্চিত মানুষও বুঝে। সরকারের সাহসের স্নায়ুগুলি কী কারণে ভয়ে কাঁপছে, তা অনুমেয়। আমরা যদি ব্লগার রাজীব, বিজ্ঞানমনস্ক লেখক অভিজিৎ এবং তারপরের ব্লগার হত্যার সঙ্গে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন এবং আগামী ২০১৯ সালের নির্বাচনের সময় বিবেচনায় নিই, তাহলে সরকারের নির্লিপ্ততার পিছনের কারণটি পরিষ্কার হয়ে যায়।
আওয়ামী লীগের চিন্তা-চেতনায় একটি মিউটেশন ঘটছে সেটি নিশ্চিত। দলের বর্তমান সর্বোচ্চ নেতৃত্বের নিউক্লিয়াসটির আচার-আচরণে সে মিউটেশনের অস্তিস্ত্ব তাৎপর্যপূর্ণভাবেই প্রতীয়মান। একাত্তরের পরাজিত শক্তির ক্লোনদের মধ্যেই ভবিষ্যতে ক্ষমতায় থাকার মৌলিক জ্বালানি আওয়ামী লীগ আবিষ্কার করছে বলে মনে হচ্ছে।
ওলামা লীগের মতো জিকা ভাইরাসের সঙ্গে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক যোগাযোগ নেই এটি অবিশ্বাস্য। ওলামা লীগ খুব সম্ভবত আওয়ামী লীগের আউটসোর্সিংএর কাজ করে। প্রান্তিক পর্যায়ে সাধারণ জনগণের মাঝে যেন এটি প্রতিষ্ঠিত না হয় যে, আওয়ামী লীগ ইসলামের প্রতি উন্নাসিক। হিন্দু প্রধান বিচারপতির অপসারণ, পহেলা বৈশাখ উৎযাপন বন্ধকরণ এবং পাঠ্যপুস্তক থেকে হিন্দু ধর্মাবলম্বী লেখকদের লেখা বাদ দেওয়ার মতো সংবেদনশীল বিষয়ে যখন ওলামা লীগ দাবি জানিয়ে আসছে, তখন বুঝতে হবে, ওদের দাবির পিছনে নির্ধারিত উদ্দেশ্য রয়েছে।
আগেও উল্লেখ করেছি, ওলামা লীগ জামায়াতে ইসলামীর এক্সটেনশন মাত্র। আওয়ামী লীগ যদি ক্ষমতার বাইরে গিয়ে নির্বাচন করে, ওলামা লীগ তাদের ভোট দেবে না।
মিউটেশন যে ঘটছে সেটির সাপেক্ষে দুটি উদাহরণ দিই। যে আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী এক হয়ে অষ্টম সংশোধনীর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল, সময়ের পরিক্রমায় সেটি বিচার বিভাগের মাধ্যমেই আওয়ামী লীগ সমাধান করতে চাচ্ছে। ওরা যদি আগামী দুদশক ক্ষমতায় থাকে, তবু রাষ্ট্রধর্মের বিষয়ে বোবা হয়ে যাবে। দ্বিতীয়ত, দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর যত নির্যাতনই হোক না কেন, আওয়ামী লীগ বিষয়টি এড়িয়ে যাবে। যদি তাদের রাজনৈতিক সাহস থাকত, তাহলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দেশান্তরী হওয়া অনেকাংশে রোধ করা যেত। দলটির এমন অবস্থানে অদূর ভবিষ্যতে আমাদেরকে স্বর্গীয় সুধার স্বাদ নিতে হবে নাকি হেমলক বিষ পান করতে হবে, তা এখনই বিশ্লেষণ করা উচিত।
কদিন আগেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এক আলোচনা সভায় বলেছিলেন, 'দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা চলে গেলে আমরা ভালো থাকব না।' উনি এমন সময় কথাটি বলেছেন, যখন তাঁর নিজ দলের অনেক মহারথীর বিরুদ্ধে সংখ্যালঘুদের জায়গা-সম্পদ জোরদখলের সুস্পষ্ট অভিযোগ উঠছে। তৃণমূল পর্যায়ে দলটির অনেক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন এবং অনেক জায়গায় ধর্ষণের অভিযোগও রয়েছে।
'আমরা ভালো থাকব না' এই সত্য উপলব্ধি করার মতো মানুষ আওয়ামী লীগে দ্রুতই কমে যাচ্ছে। দলটিকে এখন হাটহাজারীর ভোটের কব্জার রোগে ধরেছে বলে মনে হয়। তাদের ১৯৬৪ সালের ভূমিকায় আর দেখার সম্ভাবনা নেই। তবে সৈয়দ আশরাফের উপলব্ধির তারিফ করতে হয়। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের তাড়িয়ে দেওয়ার ফলে একটি জনগোষ্ঠী যে কতটুকু অস্থিতিশীল হতে পারে তা বুঝার জন্য ইরাক, ইয়েমেন, মিশর, তুরস্ক, লেবানন, সিরিয়া, পাকিস্তান, আফগানিস্তানের মতো পশ্চিম এশীয় ও উত্তর আফ্রো দেশগুলির দিকে তাকাতে হবে। এই সব দেশে বহু বছর ধরে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর রাষ্ট্রের প্রছন্ন মদদে নির্যাতন হয়েছে।
ফলে একই পন্থার কারণে বাংলাদেশ যে উল্লিখিত দেশগুলির কার্বন কপি হওয়ার পথে রয়েছে তা সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের অন্তরের গভীর উপলব্ধি মাত্র। দলটিতে এমন উপলব্ধির চর্চা ও বিশ্লেষণের ক্ষেত্র ক্রমশই সংকুচিত হচ্ছে।
বাংলাদেশের উদার ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পাহারাদার আওয়ামী লীগের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দেখে একটি প্রশ্ন কেবল মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে: তবে কি তারা হাল ছেড়ে দিয়েছে?