Published : 07 Jun 2008, 02:49 PM
একটি সাম্প্রতিক ঘটনা: "ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র তথাকথিত সাদা বর্ণের শিক্ষকদের হত্যার হুমকি দিয়েছে! দুদিন পরে সাংবাদিকেরা ছুটলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, স্বনামধন্য বুদ্ধিজীবীদের দরজায়, মিডিয়াকর্মীরা গেলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক ভিসি, তার কাছেও। মিডিয়ায় প্রতিবাদ না করলে দেখতে খারাপ লাগে, ঠিক চৌকস হওয়া যায় না। তাই প্রত্যেকেই তাদের দায়িত্ব সারলেন নিন্দা জানিয়ে ।"
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রী এবং বর্তমান শিক্ষক, এই অবস্থান থেকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু শিক্ষককে দেখার এবং জানার সৌভাগ্য হয়েছে আমার । তবে পেশাগত অথবা ছাত্র জীবনে কাউকেই নীল কিংবা সাদা চোখে দেখার সময় হয় নি, পরেনি প্রয়োজন । এই নীল/সাদা বর্ণবাদ বহুকাল ধরেই আছে সেখানে, দলাদলি, চেচামেচি, চামচামি অনেক কিছুই চলে । তবে সাম্প্রতিক এই বর্ণবাদ (বর্ণবাদ বলাই শ্রেয়, রং যখন এদের আদর্শগত পার্থক্যকে প্রতিফলিত করে তোলে) এর তীব্রতায় এবং শিক্ষককে হত্যার হুমকি, নাটোরের মিজানুরের মৃত্যু ইত্যাদির কারণ খুঁজতে গিয়ে একটি উপলব্ধিতে পৌছালাম, সময় হয়েছে আত্মসমালোচনার! দলীয়করণ, ইভ টিজিং ইত্যাদি নামে এই ঘটনাগুলোকে যতই সরলীকরণ করার চেষ্টাই করা হোক না কেন, পচন বোধ হয় ধরেই গেছে জাতির বিবেকে। নইলে, একটি ছাত্র, রাজনৈতিক মতভিন্নতার জন্য তার শিক্ষককে হত্যার হুমকি দেবে কেন? তার চেয়েও ভয়াবহ বিষয়, আমাদের, শিক্ষকদের, এই অসভ্য, অমানবিক আচরণ ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে হবে!
বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের দেশপ্রেম নিয়ে সন্দেহ না করলেও, এটা সত্য, অধিকাংশই ব্যস্ত পরস্পরের সাথে চুলোচুলিতে ও গলাবাজিতে । অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে এই চুলোচুলি আজ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে, প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পরেছে মহামারীর মত! আদালত, প্রশাসন, বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, প্রচার মাধ্যম, সামরিক প্রতিষ্ঠান সবখানেই রাজনীতি! বিশ্ববিদ্যালয় আর বাদ যাবে কেন?
বিদ্বজ্জনেরা বিদ্যার সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত হবেন, তারা ভিন্ন ভিন্ন মতের অনুসারী হবেন, এমনটিই স্বাভাবিক! কেননা জ্ঞানচর্চা regimentation-এ বিশ্বাস করে না! এই প্রসঙ্গে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ-এর নিষ্ফলা মাঠের কৃষক বইটির শেষ অধ্যায়ের কথা বিশেষ ভাবে বলা দরকার! লেখক তার ছাত্রজীবনের দুজন শিক্ষকের কথা লিখেছেন সেখানে–যারা চিন্তায়, মননে ছিলেন অত্যন্ত intelligent এবং স্মার্ট! কিন্ত এরা বিশ্বাস করতেন পাকিস্তানি আদর্শে, যে কারণে যথাযথ শাস্তিও পেয়েছিলেন তারা! তাদের মধ্যে একজন ছিলেন ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান! মুক্তিযোদ্ধারা বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে শরীরকে বিদ্ধ করে গুলিস্তানের সামনের কামানের পাশে ফেলে যায় (১)! তবে এই প্রসংগে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ-এর মতামত এবং শব্দ চয়ন একালের অনেক প্রগতিশীলকে চমকে দেবার মত, ভালো বাংলায় "চক্ষুচরকগাছ" করে দিবে! তাকে সরাসরি উদ্ধৃত করা হলো "এদের বিশ্বাস ছিল ভুল, এবং সেই ভ্রান্তির শাস্তিও পেয়েছেন তারা। তবু একটা কারণে শত্রু হলেও তারা সম্মানের যোগ্য! এদের অধিকাংশই ছিলেন বিশ্বাসের শহীদ! সে বিশ্বাস আমাদের বিপরীত হতে পারে, কিন্তু বিশ্বাসের একাগ্রতায় কোনো খাদ ছিল না! ব্যক্তিগত লাভালাভের জন্য এরা প্রায় কিছুই করেননি! বিত্তের দিক থেকে ছিলেন নেহাতই সাধারণ মানুষ !"(১) শেষ দুই লাইনেই যেন সব প্রশ্নের উত্তর! এইখানেই, ঠিক এইখানেই আমাদের সাথে, একালের অধিকাংশ শিক্ষকদের সাথে সাবেক শিক্ষকদের পার্থক্য। আজ যখন কোনো আদর্শের কথা বলা হয়, যতটুকু শুদ্ধতা বরাদ্দ থাকে " বিশ্বাস"-এর প্রতি, তার থেকে বেশি "শুদ্ধ" থাকে "কি পাব" এই প্রশ্নটি! রাষ্ট্রদূত, পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান, আহ ! বিবেক, আদর্শ আর প্রাপ্তি, সব একাকার হয়ে যায় ! সাদা কিংবা নীল বর্ণের ছানি নিয়ে আমাদের আর কিছুতেই দেশপ্রেমিক হয়ে ওঠা হয় না! আমাদের ভিতরকার শক্তি ও আত্মবিশ্বাস হয়ে পরে সাধারণ, অত্যন্ত সাধারণ! বোধ হয়, এ কারণেই, আমার সহকর্মী যখন আঘাত পায়, আমরা রুখে দাঁড়াতে পারি না!
রাজনীতিবিদদের দুর্নীতি নিয়ে আমরা পত্রিকায় কলাম লিখে কিংবা টক শোতে আলাপ করে রাজনীতির পাড়া গরম করে তুলি, শরিক হই সংবিধান বদলানোর অথবা রক্ষার পবিত্র আন্দোলনে, অথচ সহকর্মীর হত্যার হুমকিতে মৌনতা পালন করি, কেননা , ঐ যে, পেট্রোবাংলা, রাষ্ট্রদূত, এগুলো যে বড়ই মূর্ত, প্রত্যক্ষ; শিক্ষকতার মত বিমূর্ত তো নয়, অনর্থকরি তো নয়ই!
অস্ট্রেলিয়ার শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত অবস্থায় কিছুদিন আমার পাঠদানের সুযোগ ঘটেছিল! নিঃসন্দেহে এদের ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি ক্যাজুয়াল! প্যারিস হিলটনের সেক্সুয়ালিটি নিয়ে ছাত্র কোনো সরস মন্তব্য করলে শিক্ষকের চোখ কপালে উঠবে না। কিন্তু এর সুযোগ, ছাত্র এবং শিক্ষক, কেউ কখনো নেন না! যখন ভাবনায় আসে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়, প্রশ্ন জাগে, পৃথিবীতে আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয় আছে কি, যেখানে ক্যাম্পাসে জ্ঞান, অর্থনীতি, বিজ্ঞান কিংবা স্পোর্টস না, বরং শোনা যায়, সন্ত্রাসের গল্প, ছাত্রের হাতে AK – 47 এর গল্প, শিক্ষককে মেরে ফেলার গল্প? নব্বই-এর দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচিত ছিল বিশ্বের সবচেয়ে ভায়োলেন্ট ক্যাম্পাস হিসেবে- (নিউ ইয়র্ক টাইমস তাই বলে)(২)! বিশ বছর পরে এই চিত্রের কোনো পরিবর্তন হয়েছে কি? হয় নি, এবং এর মূলে আমরাই! দীর্ঘকাল ধরে শিক্ষকেরা রাজনৈতিক দলগুলোর লেজুরবৃত্তি করেছে একেবারে দল বেধে! এটা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। পৃথিবীর আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষদের ডীন শিক্ষকেরা নির্বাচিত করে কিনা জানা নেই তবে আমরা এতই গণতন্ত্রমনা, ডীন ও নির্বাচিত করি ভোটে! এবং তাও , সাদা এবং নীল "দল" মনোনীত প্রার্থী হতে হবে! তারা আবার নির্বাচনের আগে প্রচারণা চালান! প্রকৃতপক্ষে, পারস্পরিক বিশ্বাস এবং একটি নির্ভরযোগ্য, আধুনিক, বিশ্বমানের ব্যবস্থার অভাবেই এই " গণতান্ত্রিক" নির্বাচনের অবতারণা একাডেমিক ডীন নিয়োগে!
এক স্বাপ্নিক হৃদয় নিয়ে, এক দারুণ মেধাবী তরুণ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয় শিক্ষক হিসেবে । ফেলে আসে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের মোটা বেতনের সম্ভাবনাময়, ঝামেলাহীন চাকরি! দুচোখে স্বপ্ন থাকে, দেশের সর্ববৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের সদস্য হয়ে উজ্জল সুশিক্ষিত নাগরিক-সমাজ তৈরিতে অংশ নিবে! সে স্বপ্ন দ্রুত দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়, যখন সে উপলব্ধি করে, জাতীয় জীবনের দুর্ভোগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও ধীরে ধীরে অকেজো, অচল করে ফেলছে! ছাত্রী বলে বসে, "আমরা এতটাই ভাবলেশহীন–আজ যদি আমেরিকার সৈন্য বাংলাদেশ আসে তথাকথিত "মুক্তি" আনবার জন্য, কিছুই যায় আসবে না আমাদের, যতদিন না পেটে ভাতের অভাব না হয়!" কী ভয়ঙ্কর সত্য, শিউরে উঠতে হয়! তবে এটাই বাস্তবতা! রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের ব্যর্থতা পুরো জাতিকে শুধু বিভক্তই করেনি, করেছে নির্লিপ্ত, এবং অতি সাধারণ! মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজ হয়ে পড়ছে সহজেই ভোগবাদী!
এই প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশে একজন মেধাবী, নির্দলীয়, শিক্ষকের কোনো জায়গা আছে কিনা, এটি একটি বিব্রতকর অথচ প্রয়োজনীয় প্রশ্ন। তাদের প্রতিনিয়ত বিব্রত হতে হয় প্রতিভা আর সৌভাগ্যের কাছে! একটি দরিদ্র দেশে টিকে থাকার জন্য অনেক কিছুর সাথে সমঝোতা করতে করতে বিদ্বানেরা আজ বিক্রি আর সমঝোতার মাঝে পার্থক্য ভুলে গেছে! বিক্রি হচ্ছে আদর্শ, মূল্যবোধ, শিক্ষা, সর্বোপরি মনুষত্ব–পাইকারি দামে! এখানে সমাবেশ হয়েছে আমাদের মত কিছু নিরুপায় আশাবাদী আর বেশ কিছু ধূর্ত-স্বার্থ-সর্বস্ব মানুষদের! উপায়হীন মানুষদের হা-পিত্যেশ দিয়ে আর যাই হোক, মহৎ প্রতিষ্ঠান তৈরি হয় না! অসম্ভবকে স্পর্শ করার আবেগ–স্পর্ধা না নির্বুদ্ধিতা–এনিয়ে রিয়ালিস্ট ও অপটিমিস্টদের মাঝে তর্ক হয়েছে চিরকাল। আমি কোন দলে বুঝতে পারি না। তবে এই আত্মসমালোচনার শেষে, চারপাশের পরাজিত মুখগুলোর মাঝে, না হয় আরো একবার আশাবাদী হয়ে ওঠা যাক!
(১) নিষ্ফলা মাঠের কৃষক, আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ, পৃষ্ঠা ১৯৮, মার্চ ২০০৬
শামারুহ মির্জা : শিক্ষক, গবেষক। বর্তমানে তিনি অস্ট্রেলিয়া ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির "জন কার্টিন স্কুল অফ মেডিকেল রিসার্চ " এ গবেষণারত।