বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, পেশাজীবী, সরকারের দায়িত্বশীল মানুষ সেন্ট মার্টিন ঘিরে নিজেরা নিজেদের মতোই বক্তব্য প্রদান করছেন। আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই নিয়ে একের পর এক মিথ্যাচার, বিভ্রান্তকর তথ্য, গুজব তৈরি করা হচ্ছে।
Published : 16 Jun 2024, 10:00 PM
মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সংঘাতের ঘটনা অনেক দিনের। এই সংঘাতের জের ধরে টানা ছয় মাস ধরেই কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলার সীমান্তবর্তী এলাকা ঘিরে উত্তেজনা রয়েছে। সীমান্তের মানুষ কিছুটা অস্বস্তিতে থাকলেও খুব বেশি আতংকিত এই কথা আমার পক্ষে বলা সম্ভব না। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এ পর্যন্ত সীমান্তবর্তী যে সকল মানুষের সাথে কথা বলেছি, তারা সকলেই বলেছেন মিয়ানমারের সরকারি বাহিনী ও আরাকান আর্মির সাথে চলমান সংঘাত তাদের একান্ত অভ্যন্তরের। এটা নিয়ে অস্বস্তিটা হলো এপারে গুলি-মর্টার শেল এসে পড়াসহ কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা।
এর মধ্যে গত কয়েকদিন ধরে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত এবং বিদেশে অবস্থানরত কিছু পরিচিতজন আমাকে ফোন করেছেন। তারা সেন্ট মার্টিন নিয়ে পরিস্থিতি জানতে চেয়েছেন। প্রকাশ করছেন উদ্বেগও। কিন্তু সকলকেই আমি বলেছি, সেন্ট মার্টিন, সেন্ট মার্টিনই আছে আগের মতো। এখানে উদ্বেগের কোনো কারণ নেই। যারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তাদের কাছেও আমি উদ্বেগের সুনির্দিষ্ট কারণ জানতে চেয়ে উত্তরটা পেলাম না।
এর মধ্যেই সেন্ট মার্টিন দেশ-বিদেশে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, পেশাজীবী, সরকারের দায়িত্বশীল মানুষ সেন্ট মার্টিন ঘিরে নিজেরা নিজেদের মতোই বক্তব্য প্রদান করছেন। আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই নিয়ে একের পর এক মিথ্যাচার, বিভ্রান্তকর তথ্য, গুজব তৈরি করা হচ্ছে। এমনকি একজন আহত রোহিঙ্গাকে ব্যবহার করে সেন্ট মার্টিন বিষয়ক একটি মিথ্যা গল্পও উপস্থাপন হয়েছে নানা মাধ্যমে।
ফলে আমার ভেতরে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে, সেন্ট মার্টিন ঘিরে উদ্বেগের কারণ কী? যারা উদ্বেগ প্রকাশ করছেন তারা কি প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে জেনে বলছেন, নাকি বলতে হচ্ছে বলে একটা কিছুই বলছেন। এ ক্ষেত্রে আমার নিজস্ব ভাবনা, দ্বীপবাসী ও সীমান্তবর্তী মানুষের সাথে আলাপ করে প্রাপ্ত তথ্য, আর বিভ্রান্ত হওয়ার গল্পসমূহ নিয়ে লেখার প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়েছে।
সেন্ট মার্টিন নিয়ে ঘটনার সূত্রপাত ও কারণ
সেন্ট মার্টিন নিয়ে মন্তব্য করার আগেই ঘটে যাওয়া ঘটনাসমূহ একবার জেনে নিতে হবে। একইসঙ্গে ঘটনাটি কেন হয়েছে এটাও জানা প্রয়োজন।
টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন রুটে নৌযান চলাচলের শুরু দ্বীপের সৃষ্টিলগ্ন থেকেই। নাফ নদীকে ব্যবহার করে এই দ্বীপে আসা-যাওয়া। কিন্তু ওই নৌ রুটে জটিলতা তৈরি হয় শাহপরীর দ্বীপের সর্বদক্ষিণের অংশ বদরমোকাম এলাকাটি বঙ্গোপসাগরে বিলিন হওয়ার পর। ওখানে একের পর এক চর জেগে ওঠে। স্থানীয় জেলেদের কাছে এই চরটি ঘোলারচর নামে পরিচিত। চর জেগে ওঠার কারণে সেন্ট মার্টিন রুটে নৌযান চলাচলের স্রোতও বদলাতে হয়েছে। নাফ নদীকে ব্যবহার করে সেন্ট মার্টিনের ট্রলার বা জাহাজ চলাচলের জন্য দীর্ঘদিন ধরে আমাদেরকে ব্যবহার করতে হয় মিয়ানমারের জলসীমার কিছু অংশ। আর সেই অংশটির নাম নাইক্ষ্যংদিয়া। বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) ও মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমেই কোনোপ্রকার অঘটন ছাড়াই এই অংশটি ব্যবহার করে আসছিল নৌযানসমূহ।
এর মধ্যে মিয়ানমারের সংঘাত চলছে। সীমান্তবাসীসহ নানা সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, ইতোমধ্যে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের ৯০ শতাংশ এলাকাতেই মিয়ানমার সরকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। দখল করেছে বিদ্রোহী আরাকান আর্মি। আর সেই নাফ নদীর নাইক্ষ্যংদিয়া পয়েন্টটিও আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। আর আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার পরপরই তৈরি হয়েছে সমস্যা।
গত ১ জুন বিকালে টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিনে যাওয়া ১০ জন যাত্রী ও পণ্যবাহী একটি ট্রলার লক্ষ্য করে নাইক্ষ্যংদিয়া এলাকা থেকে কয়েক রাউন্ড গুলিবর্ষণ করা হয়। গত ৫ জুন সেন্ট মার্টিনের স্থগিতকৃত একটি কেন্দ্রে টেকনাফ উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান পদের ফলাফল নির্ধারণের জন্য ভোট গ্রহণ করা হয়। ভোট শেষে ফেরার পথে দায়িত্বরত ম্যাজিস্ট্রেটসহ নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ ফেরা আরেকটি ট্রলারকে আবারও গুলি করা হয় একই পয়েন্টে। গত ৮ জুন আরও একটি ট্রলারকে গুলি করা হয় ওই একই পয়েন্টে। সর্বশেষ ১১ জুন একটি স্পিডবোটকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করা হয়। তবে এই গুলিবর্ষণের ঘটনাগুলো বাংলাদেশের অভ্যন্তরের জলসীমায় ছিল। মিয়ানমারের জলসীমা থেকে ট্রলারযোগে এগিয়ে এসেই এই গুলিবর্ষণের ঘটনাটি ঘটানো হয়। একইভাবে ৪ বার গুলিবর্ষণের ঘটনায় কোনো হতাহত ছিল না যদিও।
ঘটনার শিকার ট্রলার মালিক, স্পিডবোট মালিক ও যাত্রীরা বলছেন, এই গুলিবর্ষণের ঘটনাটি আরাকান আর্মির সদস্যরা করেছে। ওই এলাকাটি আরাকান আর্মির দখলেই। আর আরাকান আর্মির সাথে বাংলাদেশ সীমান্ত বাহিনীর এখনও কোনো যোগাযোগ স্থাপন হয়নি বলেই আমি জানি। মূলত এই কারণেই নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন রুটে নৌযান বন্ধ হয়ে যায়। এতে দ্বীপে খাদ্য সংকট ও জরুরি আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ১২ জুন জরুরি সভা করে বঙ্গোপসাগরকে ব্যবহার করে যাত্রীদের আসা-যাওয়া ও পণ্য পরিবহনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৩ জুন থেকে টেকনাফের সাবরাং মুন্ডার ডেইল উপকূল ব্যবহার করে যাত্রী আসা-যাওয়া শুরু হয়। ১৪ জুন কক্সবাজার শহর থেকে পণ্য নিয়ে গেল জাহাজ। এই সিদ্ধান্ত মতে দ্বীপের প্রয়োজনে বিকল্প রুটটি ব্যবহার অব্যাহত থাকবে।
এর মধ্যে ১২ জুন নাফনদীর সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের জলসীমায় মিয়ানমারের একটি বড় জাহাজ দেখা যায়। জাহাজটি আসার পর ওই পয়েন্টে দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি ও বিস্ফোরণের শব্দও শোনা গেছে। ১৫ জুন সকাল থেকে সেই জাহাজ আর নেই।
এর মধ্যে সেন্ট মার্টিন নিয়ে এত আলোচনার কারণটা এখনও আমার কাছে পরিষ্কার না।
গুলি বর্ষণ ও জাহাজ দেখা কি প্রথম?
মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সংঘাতের জের ধরে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গুলি বা মর্টার শেল বর্ষণের ঘটনাটি কোনোভাবেই প্রথম না। নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে, উখিয়ার সীমান্তে, টেকনাফের হোয়াইক্যং সীমান্তে এর আগেও অনেকবার গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এপারে এসে পড়েছে মর্টার শেলও। হয়েছে হতাহত। ওই সমস্যা বা জটিলতাটি যেমন নাফনদীর ঘটনাটিও একই বলে আমার মনে হয়েছে। এমন ঘটনাও নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে হয়েছে আমাদের দেশের দায়িত্বশীল লোকজন অবিস্ফোরিত মর্টার শেল বিস্ফোরণের শব্দ শুনে মিয়ানমারের অভ্যন্তর থেকে গুলিবর্ষণ করেছে। উভয় সীমান্তের ঘটনার জন্য সমান উদ্বেগ রয়েছে। এখানে সেন্ট মার্টিন নিয়ে আলাদা উদ্বেগ কী কারণে হলো?
এটা যদি মিয়ানমারের বড় জাহাজ দেখার কারণে হয় তাহলে এই জাহাজ দেখার ঘটনাটিও প্রথম না। গত এক বছরে কম করে হলেও সীমান্তের ওপারে ২০ বারের অধিক এমন জাহাজ দেখা গেছে। আবার জাহাজ ফিরেও গেছে। কোনোসময় সীমান্তের ভিন্ন কোনো জটিলতা দেখিনি। দেখেছি মিয়ানমারের অভ্যন্তরের সংঘাত জটিলতা। এখানে সেন্ট মার্টিন দখল হয়ে যাচ্ছে, আক্রমণ হচ্ছে, এমন কোনো লক্ষণের কথা দ্বীপবাসী আজ পর্যন্ত বলেনি। সর্বশেষ ১৬ জুন দ্বীপের মানুষ স্বস্তিতে রয়েছেন বলে জানিয়েছেন।
এর মধ্যে নানা মাধ্যমে আহত এক রোহিঙ্গা ব্যক্তি নিয়ে একটি মিথ্যা গল্প প্রচার হলো। কক্সবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা ওই রোহিঙ্গা ব্যক্তি মিয়ানমার থেকে ছোঁড়া গুলিতে আহত হয়েছেন বলে প্রচার চালানো হলো। কিন্তু শেষপর্যন্ত দেখা গেল, ওই রোহিঙ্গা গুলিবিদ্ধই হননি। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন তিনি ভিন্নভাবে আহত। আর ওই রোহিঙ্গাও বলেছে, সেন্ট মার্টিন থেকে ফেরার সময় ট্রলার থেকে নামতে গিয়ে আহত হন।
এরপর থেকে সেন্ট মার্টিন নিয়ে যত সব আলোচনার। আর এই আলোচনার অনেকেই বলছেন সেন্ট মার্টিন চলে যাচ্ছে। কিন্তু সেন্ট মার্টিন কোথায় যাচ্ছে আমার কাছে পরিষ্কার না।
সেন্ট মার্টিনের জন্য যা করা জরুরি
শাহপরীর দ্বীপ এলাকায় নাফ নদী এবং বঙ্গোপসাগরের মোহনায় ঘোলারচর নামক এলাকাটি দুই কিলোমিটার জুড়ে। ঘোালারচর থেকে আনুমানিক ৫-৭ কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগরের মধ্যবর্তী স্থানে নাইক্ষ্যংদিয়া নামক স্থানে এক কিলোমিটারের মধ্যে আরও একটি বালুর চর ভাটার সময় জেগে ওঠে। ফলে টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিনের উদ্দেশে যাওয়া জাহাজ, ট্রলার, সার্ভিস বোট এবং স্পিডবোটসহ সব ধরনের নৌযান জেগে ওঠা ওই বালুর চরের কারণে ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম বাউন্ডারি লাইনের (আইএমবিএল) মিয়ানমার অংশের নাইক্ষ্যংদিয়া এলাকা ব্যবহার করতে হয়। আর ওই চর দুটি ড্রেজিং করা হলে ভবিষ্যতে মিয়ানমারের জলসীমা আর ব্যবহারের প্রয়োজন হবে না। আমাদের সেন্ট মার্টিনে আসা-যাওয়ার সমস্যাও হওয়ার কথা না। যদি তখনও গুলিবষর্ণের মতো ঘটনা ঘটে আমাদের রাষ্ট্রীয় বাহিনী নিশ্চয়ই চুপ থাকবেন না। আমরা যুদ্ধ করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনা বীরের জাতি। আমাদের ভুখণ্ডের ওপর ভিন্ন কোনো হস্তক্ষেপ যেমন রাষ্ট্র মেনে নেবে না, একইভাবে কোনো বাঙালিও মেনে নেবে না।
বর্তমান পরিস্থিতিতে সেন্ট মার্টিন নিয়ে কারণবিহীন উদ্বেগ অপ্রয়োজনীয়। আর যারা ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্যে গুজব তৈরি করে মিথ্যা ছড়াচ্ছেন তাদেরও চিহ্নিত করতে হবে।