নতুন পাঠ্যক্রমের গণিত বই: অল্প অর্জন, বিশাল আশঙ্কা

সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতির অভিজ্ঞতা এবং স্কুলগুলোতে দীর্ঘদিনের চর্চার বিবেচনায় অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখনের সাম্প্রতিক পদ্ধতির সাফল্যের প্রত্যাশা কতটুকু বাস্তবসম্মত– সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।

অনিন্দ্য ইকবালঅনিন্দ্য ইকবালমুরসালিন হাবিব,এম সোহেল রহমান,মোহাম্মদ কায়কোবাদ
Published : 21 March 2023, 11:45 AM
Updated : 21 March 2023, 11:45 AM

২০২৩ সালে প্রবর্তিত পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে যে নতুন পাঠ্যক্রম বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে, তার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো শিক্ষার্থীরা তাদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করবে ও তা থেকে শিখবে। বিভিন্ন দেশের শিক্ষা-গবেষণালব্ধ ফল ও চর্চা থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে এ লক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে বলে অনুমান করা যায়। নতুন কারিকুলাম সম্পর্কে আলোচনা শুরু করা যেতে পারে আগের অভিজ্ঞতার সাফল্য-ব্যর্থতা বিশ্লেষণের মাধ্যমে। ঠিক আগের কারিকুলামটিতে সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি প্রচলনের মাধ্যমে পূর্ববর্তী প্রাক-সৃজনশীল পর্বের মুখস্থনির্ভরতা কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয় । সেক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য না পাবার কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে মানসম্মত প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের ব্যর্থতা। মাউশির জরিপ অনুযায়ী প্রায় ৪২ শতাংশ শিক্ষক ন্যূনতম মানসম্পন্ন প্রশ্ন করতে অক্ষম। নতুন শিখন প্রক্রিয়ায় প্রত্যাশা হলো বিভিন্ন সমস্যা বা ব্যবহারিক পরীক্ষার বিষয় নির্বাচিতহবে ছাত্র-শিক্ষকের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকে এবং তার সমাধান-প্রক্রিয়া পরিচালনা বা তত্ত্বাবধান করবেন শিক্ষক। অর্থাৎ, ছাত্রদের প্রস্তাবিত বা উদ্ভাবিত নানান ধারণা তিনি সংশোধন ও পরিমার্জনা করবেন এবং তা বাস্তবে রূপ দান এবং মানোন্নয়নের লক্ষ্যে ছাত্রদের দিকনির্দেশনা দেবেন। আমাদের দেশে একটি শ্রেণিতে ছাত্রসংখ্যা ৬০ থেকে ১২০ পর্যন্ত দেখা যায়। ফলে শিক্ষকদের পক্ষে ছাত্রদের সাধারণ ফিডব্যাক দেওয়াই মুশকিল হয়ে যায়। সেখানে এ ধরনের উচ্চাভিলাষী প্রস্তাবনা, যেখানে ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে নিবিড় যোগাযোগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ, বাস্তবায়নে কোনো নির্ভরযোগ্য পরিকল্পনার কথা শোনা যায়নি। সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতির অভিজ্ঞতা এবং স্কুলগুলোতে দীর্ঘদিনের চর্চার বিবেচনায় অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখনের সাম্প্রতিক পদ্ধতির সাফল্যের  প্রত্যাশা কতটুকু বাস্তবসম্মত– সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।

সাধারণভাবে সব বিষয়ের জন্যই এই প্রশ্নটি রেখে এবারে আমরা গণিতের পাঠ্যবই সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট আলোচনা করব। আশা করি, আমাদের পর্যবেক্ষণগুলো অষ্টম-দশম শ্রেণির জন্য গণিত বই রচনার সময় সাহায্য করবে এবং ভবিষ্যতে ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণির বইগুলোর যে পরিমার্জিত সংস্করণ তৈরি হবে, তার মানোন্নয়নেও সহায়ক হবে।

স্কুলের নিজস্ব আয়োজনে পর্যাপ্ত শিক্ষক-প্রশিক্ষণ এবং স্কুল কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা/মনিটরিংয়ের মাধ্যমে অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখনপদ্ধতি কোনো কোনো বিষয়ের জন্য (যেমন, ‘স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা’, ‘জীবন ও জীবিকা’) কার্যকর হতে পারে। এক্ষেত্রে ছাত্রছাত্রীরা মুখস্থনির্ভরতা কমিয়ে জীবনঘনিষ্ঠ  ফলপ্রসূ শিক্ষায় আগ্রহী ও সিদ্ধকাম হয়ে উঠবে বলে আশা করা যায়। কিন্তু গণিতের ক্ষেত্রে এ ধরনের পদ্ধতি কি পর্যাপ্ত অনুশীলনের বিকল্প হতে পারে? নতুন গণিত বইয়ে আমরা দেখতে পাই বিভিন্ন গাণিতিক ধারণা/ নিয়ম বর্ণনার পরে সংশ্লিষ্ট অনুশীলনীমূলক সমস্যার সংখ্যা বিস্ময়করভাবে কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের সমস্যা তো ছাত্ররা দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা থেকে অনুশীলন করতে পারবে না। আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ভারত কিংবা এ দেশে প্রচলিত ইংরেজি মাধ্যমের বইয়েও এমন অদ্ভুত দৃষ্টান্ত নেই।

নতুন পাঠ্যক্রম অনুযায়ী প্রণীত গণিত বইয়ে একটি নিয়ম সম্পর্কে ধারণা তৈরি, তার বাস্তব প্রয়োগক্ষেত্র বর্ণনা, কেন এ নিয়মটি প্রয়োজন, উদাহরণ হিসেবে সমস্যার সমাধানপদ্ধতি বর্ণনা– প্রভৃতিতে আগের বছরের বইগুলোর তুলনায়  উন্নতির প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে আলোচনা আরও সংক্ষিপ্ত ও সংহত করলে ভালো হতো, যেমন সপ্তম শ্রেণির বইয়ের প্রথম দিকের অধ্যায়গুলোতে।

উদাহরণস্বরূপ, সপ্তম শ্রেণির বইয়ের প্রথম অধ্যায়ের সূচক নিয়ে কারিকুরি অংশে সূচকের গুণের নিয়ম বোঝানোর জন্য যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তা আমাদের কাছে অপ্রয়োজনীয় রকমের দীর্ঘ এবং ক্ষেত্রবিশেষে কিছুটা বিভ্রান্তিকর মনে হয়েছে। আমরা মনে করি যে নিয়মটিকে আরও অনেক সংক্ষেপে সহজভাবে উপস্থাপন করা যেত। মজার ব্যাপার হলো, এরকম একটি উপস্থাপনার দৃষ্টান্তের জন্য আমাদেরকে খুব বেশি দূরেও যেতে হবে না; একই নিয়মটি এই বইয়েরই দ্বিতীয় অধ্যায়ে বীজগণিতের প্রসঙ্গে আবার আলোচনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় আলোচনাটি একই সঙ্গে প্রথমটির চেয়ে সংক্ষিপ্ত ও কার্যকরী। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে, বড় আশঙ্কার জায়গা হলো, অনুশীলনমূলক সমস্যার সংখ্যা কমিয়ে দেওয়ার ফলে অনুশীলনের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের যে দক্ষতা তৈরি হয়, তার সুযোগ সীমিত হয়ে গেছে। উদাহরণস্বরূপ,  সপ্তম শ্রেণির বইয়ে অনুপাত সম্পর্কিত সমস্যা আগে ছিল ২৬টি (অনু: ২.৩), এখন রয়েছে ৪টি। তুলনা করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের দুটো পাঠ্যবই পর্যালোচনা করে দেখা যাক। আমেরিকার অনেক স্কুলে Collegeboard নামক সংস্থা থেকে প্রকাশিত Springboard Mathematics নামের বইটি পড়ানো হয়। এই বইটির প্রথম খণ্ডের (৬ষ্ঠ শ্রেণির) ৪র্থ অধ্যায় অনুপাত সম্পর্কিত এবং সেখানে অনুশীলনীর জন্য Activity 17 ও 18 মিলে মোট ৫৮টি সমস্যা দেওয়া আছে। ভারতে বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন পাঠ্যক্রম প্রচলিত আছে। অনুসন্ধানের জন্য আমরা তামিলনাড়ু রাজ্য সরকারের প্রণীত বইগুলো tntextbooks.in থেকে বিনামূল্যে সংগ্রহ করেছি। সেই বইগুলোতে অনুপাত সম্পর্কিত সমস্যা খুঁজতে গিয়ে সেগুলো ৬ষ্ঠ শ্রেণির বইয়ে পাওয়া গেল। আমাদের নতুন বইগুলোর মতো এখানেও ছবি ব্যবহার করে চমৎকারভাবে ধারণাগুলো বোঝানো হয়েছে। তবে অনুশীলনীর সমস্যা এখানে প্রায় ৪০টি এবং অতিরিক্ত চ্যালেঞ্জিং প্রবলেম আরও ১২টি (অধ্যায় ৩.১-৩.৪ সম্মিলিতভাবে)। এ বইগুলোর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো প্রতি অধ্যায়ের শেষে একটি ICT কর্নার, যেখানে নিজেদের তৈরি সম্পূরক শিখন উপকরণ, ভিডিও প্রভৃতির লিঙ্ক দেওয়া রয়েছে। সম্পূরক শিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষকস্বল্পতা বা মান সম্পর্কিত সংকট মোকাবেলায় এটি একটি  কার্যকর বিকল্প হতে পারে। NCTB-ও পরিপূরক শিক্ষা উপকরণ ইলেকট্রনিক ফরম্যাটে দেওয়ার এমন পদক্ষেপ নেবে বলে আমরা আশা করি। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, ২০১৬-১৮ সময়কালে মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড এবং কারিগরি শিক্ষাবোর্ড আমাদের বিভাগের কারিগরি সহায়তায় Interactive Digital Textbook তৈরির একটি প্রকল্প সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করে। একই রকম প্রকল্প গ্রহণের ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে  যা এই ধরনের পরিপূরক শিক্ষা উপকরণের ক্ষেত্রে আমাদেরকে অনেক দূরে এগিয়ে নিয়ে যাবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। পাশাপশি ইন্টারনেটের কল্যাণে এখন বিভিন্ন বিষয়ের অনেক open access শিখন উপকরণ আমাদের ছাত্রদের নাগালের মধ্যে চলে এসেছে। এই সমস্ত open access শিখন উপকরণ যথাযথভাবে মূল্যায়ণ এবং যাচাই-বাছাই করে এবং প্রয়োজনে মানোন্নয়ন পূর্বক ছাত্রদের ব্যবহারের জন্য সুপারিশ ও দিকনির্দেশনা দেওয়ার কথাও ভাবা যেতে পারে। তবে open access শিখন উপকরণ ব্যবহারের নীতিমালায় একটি বিশেষজ্ঞ দল যাতে নিয়মিত বিরতিতে সেগুলো নিরীক্ষণ করতে থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে। আর সর্বোপরি এ সকল ক্ষেত্রে দেশের সকল স্তরের ছাত্রছাত্রীরা যাতে এই সুবিধা সমভাবে উপভোগ করতে পারে সেই প্রয়াসও নিতে হবে।

অপ্রতুল অনুশীলনীর বিষয়টিতে আবার ফিরে যাওয়া যাক। আমাদের উদ্বেগের কারণ হচ্ছে অনুশীলনীর সমস্যা কমিয়ে দেওয়ার ফলে শ্রেণি শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়ার প্রয়োজনীয়তা এবং গাইডনির্ভরতা বাড়বে। (উল্লেখ্য, আমরা এ দেশের বাস্তবতায় প্রাইভেট পড়ার বিষয়টি হয়তো একবারে হঠাৎ করে বিলোপ করতে পারব না, কিন্তু নির্দিষ্টভাবে শ্রেণি শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়া বা তার বাধ্যবাধকতা তৈরি হওয়া আশঙ্কাজনক এবং গাইডনির্ভরতা কমানো বর্তমান পাঠ্যক্রমের একটি ঘোষিত লক্ষ্য।) আমাদের অভিজ্ঞতা বলে যে, অধিকাংশ স্কুলেই শিক্ষকদের নিজ থেকে যথেষ্ট সমস্যা তৈরি করে দেবার চর্চা নেই। অধিকাংশক্ষেত্রে স্কুলশিক্ষকদের ওপর তেমন কোনো নিয়ন্ত্রণও দেখা যায় না যা একে নিশ্চিত করতে পারে। এখানে স্মরণ করা যায় যে নিজ স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের প্রাইভেট পড়ানো যাবে না– এমন একটি নিয়ম থাকলেও তার কার্যকর প্রয়োগ আমরা দেখিনি। তাই এ বিষয়টিকে আমরা নতুন পাঠ্যক্রমের সব বিষয় মিলে প্রধানতম নেতিবাচক দিক বলে মনে করি। অভিভাবকদের কাছে জানা যাচ্ছে, তাঁরাও বুঝতে পারছেন না বাচ্চারা কী অনুশীলন করবে। ইতোমধ্যে কিন্তু নতুন পাঠ্যক্রমে ছাত্রছাত্রীদের মাস দুয়েক পার হয়ে গেছে। ব্যক্তিগত যোগাযোগ এবং অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানতে পেরেছি যে শ্রেণি পরীক্ষার আগে ছাত্রছাত্রীরা অনেকটা অসহায়ভাবে বসে আছে গণিত বই সামনে নিয়ে। এখন ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের জন্য তাৎক্ষণিক প্রয়োজন হচ্ছে প্রতিটি অধ্যায়ের জন্য কিছু অনুশীলনী  তৈরি করে পিডিএফ আকারে তাদের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে তা ছাত্রছাত্রীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। NCTB চাইলে মাসখানেকের মধ্যে তা করতে পারে।

তবে মনে রাখতে হবে যে অনুশীলনীর সমস্যা বাড়ানোটাই মূল কথা নয়, সমস্যার মানের বিষয়টির দিকেও নজর দিতে হবে। প্রসঙ্গত আরেকটি বিষয়েও আলোচনা করা দরকার। মনে হতেই পারে যে, অনুশীলনীর সমস্যা বাড়ানোর ফলে আদতে প্রাইভেট পড়ানো এবং গাইড বই নির্ভরতা বাড়বে বই কমবে না। কেন এই কথাটা বললাম? কারণ, যখন সমস্যা কম থাকে, তখন সমস্যাসহ সমাধানের জন্য; আর যখন পর্যাপ্ত সমস্যা থাকবে, তখন সেসব সমস্যা সমাধানের জন্য, এই নির্ভরতা থাকবেই। তাই এ ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হলো শিক্ষার্থীদের জন্য নির্বাচিত কিছু সমস্যা সমাধানের ইঙ্গিত দিয়ে দেওয়া যাতে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই কিংবা নিদেনপক্ষে শ্রেণি শিক্ষকের সাহায্য নিয়ে (প্রদত্ত ইঙ্গিত ব্যবহার করে) সমস্যাগুলো সমাধান করে ফেলতে পারে। এছাড়া বইয়ের শেষে সমস্যাগুলোর উত্তর দিয়ে রাখা এবং নিশ্চিত করা যে তা সঠিক, খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এতে শিক্ষার্থীরা নিজেরা সমাধান করে উত্তর মিলিয়ে নিতে পারে; কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে  এবারে তা বাদ দেওয়া হয়েছে। ভারত, অস্ট্রেলিয়া এবং আমাদের দেশে ইংরেজি মাধ্যমের প্রচলিত বই জেনারেল ম্যাথমেটিক্সে কিন্তু উত্তর দেওয়া আছে। এই উত্তরমালার অভাব অনেক ছাত্রের জন্যই সংকটজনক, যাদের ভুল ধরিয়ে দেওয়ার মতো কেউ নেই। তাহলে কি এর মাধ্যমে গাইড বই প্রস্তুতকারীদের ওপর এই সমস্যাগুলো সমাধানের দায়িত্ব দিয়ে দেওয়া হচ্ছে? পরিষ্কারভাবেই এতে তাদের গাইডনির্ভরতা অথবা প্রাইভেট পড়ার প্রয়োজন বাড়বে বই কমবে না।

আগের যুগে গণিত সংক্রান্ত অভিযোগগুলোর প্রসঙ্গে যদি ফিরে যাই, প্রাক-সৃজনশীল যুগে প্রধান সমস্যা ছিল পরীক্ষা-পদ্ধতি সম্পর্কিত– প্রশ্ন প্রণয়ন ও খাতা দেখার পদ্ধতি দুই বিবেচনাতেই। পাবলিক পরীক্ষায় বইয়ের সমস্যা প্রায় অবিকলভাবেই চলে আসত, এবং অধিকাংশ স্কুলও তাদের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষায় এই চর্চাই অনুসরণ করত। ছাত্রছাত্রীদের নিজ থেকে নতুন নতুন সমস্যা সমাধানের বিষয়ে উৎসাহিত করা ছিল বিরল ঘটনা। বরং একই অংক বা জ্যামিতিক সম্পাদ্য / উপপাদ্য বারবার করার বিষয়ে শিক্ষক/অভিভাবকেরা তাদের তাড়িত করতেন। শিক্ষকেরা মূল্যায়নের সময় গুরুত্ব দিতেন তুচ্ছ সব বিষয়ে, যেমন ভাষাগত বর্ণনা, সম্পাদ্যের চিত্রে সামান্য দাগ পড়েছে কি না – এসবে। সামান্য হিসেবের ভুলকে সমস্যার মূল বিষয়টি ছাত্রটি বুঝেছে কি না, তার তুলনায় বেশি গুরুত্ব দেওয়া হতো এবং উত্তরপত্র মূল্যায়নের সময় এই বিষয়গুলোই যেন বেশি, এবং ক্ষেত্রবিশেষে সর্বোচ্চ গুরুত্ব পেত। ফলে একই জিনিস বারবার অনুশীলন করাই ছিল পরীক্ষায় ভালো করার অব্যর্থ পন্থা। এতে গণিতের সমস্যা সমাধানের মতো সহজাতভাবে সৃজনশীল একটি বিষয়ও মুখস্থবিদ্যার অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছিল: শিক্ষার্থীরা এই সকল সমাধানও মুখস্থ করে ফেলত এবং পরীক্ষায় খুব ভাল ফলাফলও করত গাণিতিক এবং বিশ্লেষণাত্মক সমস্যা সমাধানের উৎকর্ষ লাভ করা ছাড়াই। এই আলোচনায় আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার আরও একটি দুর্বলতার কথা বেরিয়ে আসল, যেটি হলো উত্তরপত্র মূল্যায়নের দুর্বলতা। যদিও এটি আমাদের মূল আলোচনার বাইরের বিষয়, এই প্রসঙ্গে অন্তত এটুকু বলে রাখা দরকার যে, যে কোনো প্রশ্নের উত্তর মূল্যায়নের ক্ষেত্রে যথাযথ rubric প্রস্তুত করা জরুরি এবং সেটি প্রশ্ন প্রণয়নকারীর দায়িত্ব এবং মূল্যায়নের সময় সেই rubric পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসরণ করা পরীক্ষকের দায়িত্ব।        

প্রাক-সৃজনশীল যুগের এই ‘বইয়ের অংক পরীক্ষার প্রশ্নে’ দেয়ার প্রবণতা দূর করার সহজ উপায় ছিল পরীক্ষায় বইয়ের বাইরে থেকে সমস্যা দেওয়া। বিশবিদ্যালয়ের নির্বাচনী পরীক্ষাগুলোতে যেমনটা হয়ে থাকে। তার পরিবর্তে সৃজনশীল প্রশ্ন করে এ সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠার পরিকল্পনা করা হলো। কিন্তু আমাদের ছাত্রছাত্রীরা যারা সৃজনশীল পদ্ধতিতে গণিত পড়েছে (HSC 17 ও 18 ব্যাচ), তাদের মতামত হলো বইয়ের সমস্যাই খানিকটা ভিন্ন আঙ্গিকে পরিবেশন করা হতো এ পদ্ধতিতে। ফলে অপরিচিত সমস্যা নিজ থেকে সমাধানের চর্চা খুব একটা গড়ে ওঠেনি। বর্তমান কারিকুলামে হয়তো নতুন সমস্যা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা তৈরি হবে অবধারিতভাবে, কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা তার জন্য প্রস্তুত হবে কীভাবে, সে প্রশ্ন বড় হয়ে উঠেছে। বিজ্ঞানের মতো কোনো আলাদা workbook (অনুশীলনী বই) একটা উপায় হতে পারত, কিন্তু তা দেওয়া হয়নি। অল্পসংখ্যক সমস্যা অনুশীলন করে ছাত্রছাত্রীদের পেছনের দিকে যাত্রা করানো হলো কি না– এটাই নতুন পাঠ্যপুস্তকের সবচেয়ে বড় আশঙ্কার জায়গা। আশা করি, অষ্টম ও পরের শ্রেণিগুলোর বইয়ে যথেষ্টসংখ্যক এবং মানসম্পন্ন সমস্যা দেওয়া হবে এবং আমরা এ আত্মঘাতী অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাব।

গণিতে বা সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ে (যেমন প্রকৌশল) বিশ্বমানের স্নাতক বা আরো অগ্রসর পর্যায়ে উচ্চতর দক্ষতা অর্জনের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতার কারণ হিসেবে আমাদের পরীক্ষানির্ভর শিক্ষাব্যবস্থায় বইয়ের বাইরের অদেখা চ্যালেঞ্জিং সমস্যা সমাধানের চর্চার অভাবকে অনেকে দায়ী করেছেন। গণিত অলিম্পিয়াড এদিকে কিছুটা অগ্রগতি এনেছে, কিন্তু সেতো খুবই সীমিত পরিসরে– কতজন শিক্ষার্থীই বা এই চর্চার সঙ্গে সম্পৃক্ত? এছাড়া গণিতের একেকটি পদ্ধতির প্রয়োগ কোথায় হবে, বিশেষত বীজগণিতের ক্ষেত্রে এর বাস্তব সম্পৃক্ততা– এ বিষয়গুলোতে আমাদের পাঠ্যবইয়ের আলোচনা ছিল না বললেই চলে। উদাহরণস্বরূপ, একজন ছাত্র একটি  জটিল ডিফারেনশিয়েশন করতে পারলেও একটা বাস্তব সমস্যাকে ডিফারেনশিয়েশনের একটা এক্সপ্রেশনে মডেল করার বিষয়টি তার আয়ত্তের বাইরেই ছিল। তবে সুখের বিষয় হলো এ সীমাবদ্ধতাটির উত্তরণের চেষ্টা রয়েছে নতুন কারিকুলামে। কিন্তু অন্যদিকে সাধারণভাবে সমস্যা সমাধানের দুর্বলতা আরো প্রকট হতে পারে, বিশেষত উচ্চতর গণিত নামের ঐচ্ছিক বিষয়টি সম্পূর্ণ তুলে দেওয়ার ফলে। উচ্চতর গণিতের ক্ষেত্রে শুধু বারবার অনুশীলনের (পড়ুন মুখস্থ করার) মাধ্যমে ভালো ফল করা দুষ্কর ছিল, কারণ বইয়ে প্রচুর কঠিন সমস্যা দেওয়া থাকত। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে গণিত আরো দুরূহ বিষয় হয়ে উঠবে উচ্চতর গণিত বাদ দেওয়ার ফলে। পশ্চিমা বিশ্বে বা ইংরেজি মাধ্যমে এক বা ততোধিক ঐচ্ছিক গণিত পড়ার সুযোগ রাখা হয়। আমাদের দেশে অবশ্যই নবম শ্রেণি থেকে ঐচ্ছিকভাবে হলেও উচ্চতর মানের গণিত বিষয় হিসাবে রাখা উচিত।

প্রাক-সৃজনশীল যুগে জ্যামিতির ক্ষেত্রে পরীক্ষাগুলোতে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কয়েকটি উপপাদ্য ও অধ্যায়গুলোর অনুশীলনীর সমস্যা (extra নামে সুপরিচিত) প্রমাণ করতে দেওয়া হতো এবং ছাত্রছাত্রীরা তাদের অনুশীলন সীমাবদ্ধ রাখতো অল্প কিছু ‘ইম্পরট্যান্ট’ প্রশ্নে। পরীক্ষায় উত্তর দেওয়ার জন্য খুবই সীমিতসংখ্যক extra শিক্ষক নির্বাচিত করাই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু আগ্রহী ছাত্রছাত্রীরা কেউ কেউ পরীক্ষায় আসবে না জেনেও অতিরিক্ত কিছু সমস্যা সমাধান করত আনন্দ নিয়ে বা বিরল কিছু শিক্ষকের উৎসাহে ও আনুকূল্যে। নতুন কারিকুলামে জ্যামিতিক সম্পর্ক-সূত্রগুলো ব্যবহার করে সমস্যা সমাধান করতে দেওয়া হয়েছে বটে, কিন্তু বাদ দেয়া হয়েছে এই সম্পর্কিত প্রমাণগুলো। অর্থাৎ গাণিতিক কিংবা জ্যামিতিক বিবৃতিগুলোকে একের পর এক সাজিয়ে  অকাট্য যুক্তির মাধ্যমে  কিভাবে এই সম্পর্ক-সূত্রগুলো প্রমাণ করা যায়, তা আমাদের শিক্ষার্থীরা আর শিখবে না! গাণিতিক প্রমাণ কিন্তু অনেক সময়েই কোন একটি সম্পর্ক বা সূত্র কেন সত্যি সেই সংক্রান্ত ধারণাকে প্রকাশ করে, যা সার্বিকভাবে নতুন অদেখা সমস্যা সমাধানে তথা বিশ্লেষণমূলক দক্ষতা বাড়ানোতে খুবই কার্যকরী।  যেমন, একান্তর বা অনুরূপ কোণগুলো পরস্পর সমান, এটা বোঝার জন্য তারা কাগজ কেটে বিভিন্ন আকৃতি তৈরি করবে। এতে সম্পর্কটি বুঝতে সুবিধা হবে সন্দেহ নেই, এবং এটি প্রশংসার্হ, প্রমাণভিত্তিক আলোচনা সমূহ পুরোপুরি বাদ দেবার ফলে একদিকে যেমন গণিত শাস্ত্রের একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ শাখার আলোচনা থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে তাদের ধারণাটা অসম্পূর্ণই থেকে যাচ্ছে। গত বছরের বইয়ে বা তার আগেও বিষয়টি উপপাদ্য প্রমাণের মাধ্যমে শেখানো হতো।  প্রসঙ্গত, আমাদের ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা প্রমাণভিত্তিকপদ্ধতিশেখে। উদাহরণস্বরূপ, A School Geometry বইটা পড়ানো হয় অনেক স্কুলে প্রাথমিক পর্যায় থেকেই। কোনো কোনো পশ্চিমা দেশে অবশ্য আরও পরে প্রমাণভিত্তিক অনুশীলনী (এক্সট্রা) শুরু হয়। উপপাদ্য ও তার সংশ্লিষ্ট অনুশীলনী প্রমাণ করতে শেখানো একেবারে বাদ না দিয়ে পরের শ্রেণিগুলোতে  রাখা হবে বলে আশা করি এবং সেখানে অনুশীলনীর পরিমাণ হতে হবে যথেষ্ট।

সপ্তম শ্রেণির বইয়ে দেখা যায় ৩টি অধ্যায় রয়েছে জ্যামিতি সম্পর্কে। প্রথমটির নাম ‘আকৃতি দিয়ে যায় চেনা’। এখানে সযত্নে চেষ্টা করা হয়েছে বাস্তব কাজের মাধ্যমে জ্যামিতিক আকৃতি ও তার সূত্রগুলো সম্পর্কে ধারণা দেয়ার। এ ধরনের শ্রমসাধ্য আলোচনার জন্য আমরা লেখকদের ধন্যবাদ জানাই। অধ্যায়ের পরবর্তী অংশে ত্রিভুজের বৈশিষ্ট্য ও কোণের সম্পর্ক একইভাবে আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু  জ্যামিতির বিভিন্ন আকৃতির বৈশিষ্ট্য ও তাদের অন্তঃসম্পর্কগুলো ছাত্রছাত্রীদের শেখানোর ক্ষেত্রেও অনুশীলনমূলক/প্রায়োগিক সমস্যার অভাব লক্ষণীয়, যা আমাদের উদ্বেগকে বাড়িয়ে তোলে। যেমন সপ্তম শ্রেণির বইয়ে একান্তর ও অনুরূপ কোণের সম্পর্ক-সূত্র প্রয়োগ করে সমাধানযোগ্য সমস্যা বর্তমানে মাত্র ২টি (পৃষ্ঠা ১১৮)। পক্ষান্তরে, গত বছরের বইয়ে সমতুল্য অনুশীলনী ৮-এ ছিল ১০টি সমস্যা, যার একটি ছিল প্রমাণ করার জন্য (extra নামে সাধারণভাবে পরিচিত)। ত্রিভুজ সম্পর্কিত সমস্যা আগে ছিল ৪০টি (অনুশীলনী ৯.১, ৯.২, ৯.৩); অথচ বর্তমানে রয়েছে মাত্র ৫টি (পৃষ্ঠা ১২৬)। গত দু’বছরের গণিত বইয়ের যে কোনো অধ্যায়ের মধ্যে তুলনা করলেই এই একই উদ্বেগজনক চিত্র দৃষ্টিগোচর হয়।

এবারে বীজগণিতের বিষয়টি দেখা যাক। বীজগণিত সম্পর্কিত প্রথম অধ্যায়টি হল — ‘অজানা রাশির সূচক, গুণ ও তাদের প্রয়োগ’। ক্ষেত্রফল নির্ণয়ের জন্য বর্গ রাশির ব্যবহারের বিষয়টি চমৎকারভাবে উদাহরণ দিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এখানে। এখন লক্ষ্য করুন, অনুশীলনমূলক সমস্যা এখানে রয়েছে  ১২টি (পৃষ্ঠা ৫২ ও ৫৮)। এর সঙ্গে তুলনীয় হলো গত বছরের বইয়ের চতুর্থ অধ্যায়, ‘বীজগাণিতিক রাশির গুণ ও ভাগ’। সেখানে, অনুশীলনীর সমস্যা ছিল গুণ সম্পর্কিত ২৮টি (৪.১), ভাগ সম্পর্কিত ৩৫টি (৪.২) এবং বন্ধনী ব্যবহার করে গুণ-ভাগের মিশ্র সমস্যা ৩৪টি (৪.৩)। গত বছরের বইয়ের পঞ্চম অধ্যায় ‘বীজগণিতীয় সূত্রাবলি ও প্রয়োগ’ এবারে সম্ভবত আংশিকভাবে এসেছে – শুধুমাত্র ৩য় ও ৪র্থ অংশ – যথাক্রমে উৎপাদকে বিশ্লেষণ এবং গসাগু ও লসাগু। অনুশীলনীর সমস্যা সংখ্যার পার্থক্য একইরকম। একই কথা প্রযোজ্য অন্য দুটি বীজগণিত সম্পর্কিত অধ্যায় ভগ্নাংশ ও সমীকরণের ক্ষেত্রে।

অন্য দেশের বা আমাদের আগের পাঠ্যক্রমের সঙ্গে তুলনামূলক পর্যালোচনায় আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বই থেকে কিছু টপিক এবারে প্রায় বাদ দেওয়া হয়েছে। যেমন, পাটিগণিতের লসাগু, গসাগু, লাভ-ক্ষতি (আগে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ছিল), মৌলিক সংখ্যা সংক্রান্ত বিস্তৃতআলোচনা। উল্লেখ্য যে, পঞ্চম শ্রেণিতে এগুলো যতটুকু পড়ানো হয়, তা যথেষ্ট নয় বলে আমাদের মনে হয়। আর অন্যান্য দেশে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে এগুলো গুরুত্ব দিয়ে করানো হয়। সাধারণভাবে অন্যান্য দেশে ৬ষ্ঠ-৭ম, এমনকি তারও আগে থেকেই ‘সম্ভাবনা’ অধ্যায়টি শুরু করা হয়। ক্রমান্বয়ে এর গভীরতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। একসময় স্কুল পর্যায়েই বিন্যাস/সমাবেশ-এর ধারণা ও সমস্যা সমাধান শেখানো শুরু হয়। সহজেই অনুমেয় যে যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা গবেষণার পরই তারা এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। আমরা মনে করি বাংলাদেশের নতুন পাঠ্যক্রমের পরবর্তী ক্লাসগুলোতে এ বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। পক্ষান্তরে, আমাদের সপ্তম শ্রেণির গণিত বইয়ে বাইনারি সংখ্যা পড়ানো শুরু হয়েছে। অন্য দেশের ক্ষেত্রে এটা  আমাদের চোখে পড়েনি। এটি মূলত কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আর তাই এ অধ্যায়টি বরং ডিজিটাল প্রযুক্তি বইয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। সেখানে গাণিতিক বিষয় একেবারেই নেই। আরেকটি পর্বে আমরা ডিজিটাল প্রযুক্তি বইটি সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করার আশা রাখি।   

অপর্যাপ্ত সমস্যা-সংখ্যার বিষয়টি নিয়ে আমরা অনানুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা করেছি বইগুলোর দুজন লেখকের সঙ্গে। সম্ভবত তাঁরা ব্যক্তিগত মত  জানিয়েছেন, কারণ তাঁদের উত্তরগুলো ভিন্ন ছিল। একজনের মতে সময়ের অভাবে সমস্যা কম হয়ে গেছে। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো, আগের বছরের সমস্যাগুলো আবার ব্যবহার করা হলো না কেন? অন্যজন মনে করেন সচেতনভাবেই এটা করা হয়েছে, যেন অধ্যায়গুলোর আলোচনা অংশগুলো সবাই ভালো করে পড়ে। এই ব্যাখ্যা কি আদৌ গ্রহণযোগ্য? অনুশীলনীতে যাবার আগে আলোচনা অংশটুকু কতটা গুরুত্ব দিয়ে পড়ানো হবে, সেটা মূলত নির্ভর করবে শিক্ষকের ওপর। তাঁদের প্রশিক্ষণ দেবার মাধ্যমেই আলোচনা অংশটুকু গুরুত্ব দিয়ে পড়ানো নিশ্চিত করা যেত। ইতোপূর্বেই শিক্ষক নির্দেশিকার (ম্যানুয়াল) প্রসঙ্গটি আমরা সামান্য আলোচনা করেছি, সেই আলোচনা এখানেও ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক। প্রয়োজনে আলাদা ওয়ার্কবুক করে হলেও অতিরিক্ত সমস্যা দেওয়া উচিত।

NCTB বলছে নতুন বই বা পাঠ্যক্রম বিষয়ে তারা ফিডব্যাক চাচ্ছে। কিন্তু সে বিষয়ে তাদের কোনো আন্তরিক কিংবা ফলপ্রসূ পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। লেখকদের সূত্রে আমরা যতটুকু জেনেছি, ফিডব্যাক নেওয়া হচ্ছে মূলত স্কুল শিক্ষকদের কাছ থেকে। আমাদের দেশের সংস্কৃতি এবং পদমর্যাদার সর্বব্যাপী গুরুত্ব বিবেচনায় ক্ষমতাবান হর্তাকর্তাদের কাছে শিক্ষকেরা মন খুলে কঠিন সীমাবদ্ধতাগুলো তুলে ধরবেন, তা আশা করা যায় না। NCTB-কে এ বিষয়ে আরও কার্যকর কোনো উপায় অবলম্বন করতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে যে কোনো সমস্যা সমাধান কিংবা মানোন্নয়নের প্রথম ধাপ হল সমস্যা রয়েছে সেই বিষয়টি স্বীকার করা। কিন্তু সম্প্রতি সংশ্লিষ্ট কমিটিসমূহে কাজ করছেন এরকম একজনের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলাপে মনে হলো সমস্যা বা মানোন্নয়নের অবকাশ রয়েছে সংশ্লিষ্ট অনেকেই এমন ধারণা পোষণ করেন না। যদি সত্যিই বিষয়টি এমন হয়ে থাকে তবে তা হবে খুবই দুঃখজনক এবং তাহলে অন্যান্য অনেক অপরিকল্পিত প্রচেষ্টার মত বর্তমান সম্ভাবনাময় প্রয়াসটিও পরিপূর্ণ সাফল্যের মুখ কখনোই দেখবে না।   

সবশেষে আমরা একটি বইয়ের কনটেন্ট তৈরির বিষয়ে NCTB কতটুকু গুরুত্ব দেয়, তা আলোচনা করতে চাই। বাংলাদেশে একটি পাঠ্যক্রম ও তার বই প্রায় দশ বছর প্রচলিত থাকে (কিছুটা পরিমার্জিত হয়ে)। প্রতি বছর ২০ লাখ ছাত্র একটি বই পড়ে এবং এ সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। ফলে ধরে নেয়া যায় যে, দশ বছরে দুই কোটির বেশি ছাত্র একটি বই পড়বে। পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য মতে একটি বই ছাপার খরচ ৩০ টাকা, আবার কারো মতে ৭০ টাকা। ক্রমবর্ধমান কাগজের খরচ বিবেচনায় ১০ বছরে একটি বই ছাপতে কনটেন্ট ছাড়া অন্যান্য ব্যয় ১৫০ থেকে ২০০ কোটি টাকা। অথচ যাঁরা বইটা লিখছেন, অর্থাৎ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করছেন, তাঁদের সম্মানী সম্মিলিতভাবে কয়েক লাখ টাকাও কি না সন্দেহ আছে। লেখকরা এক ধরনের সেবা হিসেবেই খণ্ডকালীনভাবে এ শ্রমসাধ্য কাজ করে থাকেন। মানসম্মত কাজের জন্য যথেষ্ট সময় তাঁরা পান না বলে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে লেখকেরা বলেছেন। পাঠ্যবই লেখার মতো দুরূহ কাজে লেখকদলে কিছু পূর্ণকালীন সদস্য, হতে পারে ছুটিতে আসা, জরুরি। পুরো বিষয়টিকে পেশাগত উৎকর্ষ ও টেকসই (sustainable) একটা প্রক্রিয়ার দিকে নিয়ে যাবার ক্ষেত্রে অবহেলা অনুভব করা যায়। লেখক নির্বাচন প্রক্রিয়াও একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোন কোন যোগ্যতার ভিত্তিতে লেখক নির্বাচন করা হচ্ছে, কারা এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত এবং এজন্য ব্যয় কত হচ্ছে এ বিষয়গুলো পাবলিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে NCTB-র প্রকাশ করা উচিত। আমরা এ বিষয়গুলো জানার চেষ্টা করে সফল হতে পারিনি। দেশের বিভিন্ন খাতে খরচের প্রতিতুলনায় এ ক্ষেত্রে ব্যয়পরিকল্পনা কেমন তা দৃশ্যমান হওয়া প্রয়োজন। তাহলে নাগরিক হিসেবে আমরা বুঝতে পারব এ মহা গুরুত্বপূর্ণ কাজটি, অর্থাৎ কনটেন্ট তৈরির বিষয়টি যথাযথভাবে হচ্ছে কি না।   

সরকারের বা তার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান/প্রকল্পের সদিচ্ছা ও সৎ প্রচেষ্টাও অনেক সময় ব্যর্থ হয়। এর পেছনে বিবিধ কারণ থাকে এবং অনেক সময়েই এই কারণ অনুসন্ধানের কিংবা বিভিন্ন মহল কর্তৃক কারণ নির্ণীত হবার পরও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া যায় না অথবা নেয়া হয় না। দুঃখজনকভাবে অনেক সময়, সমস্যা যে রয়েছে তাই অস্বীকার করার প্রবণতা দেখা যায়। এতে পরিশেষে দেখা যায় যে, যে জনগোষ্ঠীর উপকারের জন্য এ প্রয়াস, তা বরং তাদের ক্ষতির কারণই হয়ে দাঁড়ায়। এ ধরনের দৃষ্টান্তকে ২০০৫-এ প্রকাশিত The Argumentative Indian বইয়ে অমর্ত্য সেন Friendly fire বলে অভিহিত করেছেন। বাংলাদেশে সরকারি কাজের ক্ষেত্রে এমন বেশ কিছু ঘটনা শনাক্ত করেছেন ড. আকবর আলী খান, যার বর্ণনা রয়েছে তাঁর Friendly Fires, Humpty Dumpty Disorders, and Other Essays বইয়ে। গণিতের ক্ষেত্রে নতুন পাঠ্যবইগুলো কি তাহলে Friendly fire-এর আরেকটি দৃষ্টান্তই তৈরি করতে চলেছে?

লেখকবৃন্দ:

অনিন্দ্য ইকবাল, অধ্যাপক, সিএসই বিভাগ, বুয়েট

মুরসালিন হাবিব, প্রভাষক, সিএসই বিভাগ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ও কাউন্সেলর, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড

এম সোহেল রহমান, অধ্যাপক, সিএসই বিভাগ, বুয়েট এবং ফেলো, বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি, বাংলাদেশ ইনফরমেটিক্স অলিম্পিয়াড দলের দলনেতা

মোহাম্মদ কায়কোবাদ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিস্টিংগুইশড অধ্যাপক ও বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেসের ফেলো