রাজনীতি আর জীবনে প্রত্যাশাই সবকিছু।
Published : 26 May 2015, 07:09 PM
তবে গত তিনদশকে ভারতের জনগণের প্রত্যাশা সাধারণত তেমন বেশিকিছু ছিল না। তারা তাদের সীমিত আয় আর রাষ্ট্রের নানা অভাব-অনটনের মধ্যেই নিজেদের খাপ খাইয়ে চলেছে। স্বপ্ন দেখা অবশ্য তবুও থেমে থাকেনি। স্বপ্ন তারা দেখেছে, তবে তা ছিল ভারতের মধ্যবিত্ত জীবনধারার পরিমিত ও সংযমী স্বপ্ন।
তারপর ধীরে ধীরে ১৯৯০ এর দশক থেকে ২০০০ এর দশকে ভারতীয়দের দৃষ্টিভঙ্গি আরো প্রসারিত হয়েছে, আরো মুক্তমনা হয়েছে তারা। বেড়েছে তাদের চাওয়া-পাওয়া, একইসঙ্গে বেড়েছে প্র্যতাশাও। ভারত আরো বড় কিছু অর্জন করতে পারে- এ আশা তারা করতে শুরু করেছে।
আর ঠিক সে সময়টাতেই প্রধানমন্ত্রী হয়ে ভারতের ক্ষমতায় এসেছেন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতা নরেন্দ্র মোদী। তাই আজ তার ক্ষমতার এক বছর পূর্তিতে প্রশ্ন একটাই, প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে কি?
আকাশ-ছোঁয়া প্রত্যাশা:
মোদী যত বড় বড় প্রত্যাশা পূরণের আশ্বাস আর সুবক্তব্য দিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন ভারতের আর কোনো রাজনীতিবিদই সম্ভবত তেমনটি করেননি।
২০১৪ সালে তার নির্বাচনী প্রচারের দিকে পেছন ফিরে তাকালে দেখা যায়, বহু সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়ে এক উৎসাহ-উদ্দীপনাময় প্রচার চালিয়েছিলেন মোদী।
ভারতীয়রা টয়লেটের সমস্যায় ভুগছে? চিন্তা নেই, সরকার ৫ বছরেই এর সমাধান করে দেবে, যোগাযোগে সমস্যা? আছে ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া,’ পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান নেই? আছে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রচার, ভারত অপরিচ্ছন্ন? চলবে ‘ক্লিন ইন্ডিয়া’ অভিযান, বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করছে না? আমরা ভারতকে ব্যবসা-বান্ধব করে ফেলব।
কিন্তু প্রতিটি ভারতীয় নাগরিকের এ স্বপ্ন বাস্তব রূপ পাওয়া এখনো অনেক দূরের পথ।
অর্থনীতি:
মোদীর সবচেয়ে বড় আশ্বাস ছিল ঝড়ো গতিতে আর্থিক সংস্কার আর সুদিন ফিরিয়ে আনার। কিন্তু তার শাসনের একবছরে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চোখে পড়ার মতো পরিবর্তন কিছু ঘটেনি।
দেশের বাজারে চাহিদা নেই। বিদেশের অবস্থাও তেমনি। ফলে হাত গুটিয়ে আছে দেশি-বিদেশি সব লগ্নিকারীরাই। শিল্প উৎপাদনে কমেছে সূচক বৃদ্ধির হার কমেছে।
কারখানা, নির্মাণ শিল্প, হোটেল ব্যবসা, পরিবহন, যোগাযোগ, আবাসন আর্থিক পরিষেবা সব জায়গায়ই চিত্রটা একই।
মোদী ক্ষমতায় আসার পরপরই তাকে ঘিরে শিল্পপতিদের যে আগ্রহ ছিল এক বছর পর তা নেই বললেই চলে। বেশির ভাগ বিনিয়োগকারীই তার সরকারের একবছরের কাজকর্মে খুশী নন। তবে অনেকেই অবশ্য আশা প্রকাশ করে বলছেন, একটি সরকারকে বিচার করার জন্য একবছরই যথেষ্ট নয়। তাই পরিস্থিতির ওপর নজর রাখা হচ্ছে।
কিন্তু মোদীর এক বছরে বিনিয়োগের পরিবেশ যেমন বদলায়নি, তেমন কাজের সুযোগও বাড়েনি। সুদিনের প্রতিশ্রুতি শুধু বলার জন্যই বলা ছিল- এমনটিই এখন মানতে শুরু করেছেন অনেকে।
অভিনব নানা উদ্যোগ:
গতবছর বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই মোদী হাতে নিয়েছেন অভিনব নানা উদ্যোগ, প্রকল্প ও প্রচার-প্রচারণা। এতে করে কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রশংসা আর সমালোচনা -দুইয়ে মিলিয়েই আলোচনার কেন্দ্রে থেকেছেন তিনি।
ভারতের দরিদ্র মানুষদের জন্য বীমা সহ ব্যাংক এ্যাকাউন্ট প্রকল্পের সাফল্যে প্রশংসা পেয়েছেন মোদী। পাশাপাশি তার ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রচারাভিযান, গঙ্গা নদীকে দূষণ মুক্ত করার উদ্যোগ, দেশব্যাপী পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালানোর কিছু উদ্যোগেও তিনি সুনাম কুড়িয়েছেন। তবে তাতে কাজের কাজ এখনো তেমন হয়নি।
ধর্মীয় উদ্বেগ:
মোদীর এক বছরে ভারতে ধর্মীয় সহনশীলতা কমেছে বলে সমালোচনা হচ্ছে। বিশেষ করে, সংখ্যালঘুদের ওপর বেশ কয়েকটি হামলার ঘটনায় তার সরকারের নীতিকে দায়ী করা হচ্ছে।
কট্টরপন্থী হিন্দু সংগঠন আরএসএস এর মুসলিম ও খ্রিষ্টানদের হিন্দু ধর্মে দীক্ষিত করা নিয়ে মোদী নীরব থেকেছেন। তার জন্যেও সমালোচিত হয়েছেন তিনি।
এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক দাতব্য সংগঠন ফোর্ড ফাউন্ডেশনকে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা নজরদারিতে রেখে এবং ভারতীয় একটি গ্রুপকে এ ফাউন্ডেশনের অর্থায়ন থেকে বিরত রেখেও সমালোচনার শিকার হয়েছেন মোদী।
২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গার ঘটনার পাশাপাশি দেশে ধর্মীয় সহিংসতা নিয়ে ভারতীয় ওই গ্রুপটির আয়োজিত ওয়ার্কশপে ফোর্ড ফাউন্ডেশন অর্থায়ন করাতেই তাদের বিরুদ্ধে এ পদক্ষেপ নেয় মোদী সরকার।
বৈদেশিক নীতি:
ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই মোদী একের পর এক সফর করেছেন নানান দেশ। এক বছরে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনসহ ১৮ টি দেশে সফর করেছেন তিনি।
জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মোদী নতুন মুখ হওয়ায় বৈদেশিক নীতিতে তাকে খুব সফল নেতা হিসাবে দেখার আশা করেছিলেন খুব কম মানুষই। কিন্তু তারপরও এ অঙ্গনে কিছুটা সফলতার ছাপ রাখতে পেরেছেন তিনি।
বিশেষ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ভারত সফরকে দুদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের জন্যে মোদী সরকারের বড় সফলতা হিসাবেই দেখা হচ্ছে। কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টের একই দেশে দু’বার সফর বেশ বড় ব্যাপার বৈকি।
পাশাপাশি জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গেও তিনি যে সখ্যতা গড়ে তুলেছেন তাও যথেষ্ট ফলদায়ক। বিশেষ করে বাণিজ্যসহ অন্যান্য নানা সুযোগ-সুবিধার জন্য তো বটেই।
বহির্বিশ্বের জন্য ভারতের দ্বার খুলে দিয়ে মোদী দেশের জন্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুযোগ-সুবিধার পথই সুগম করেছেন।
আগামী ৩৬৫ দিন:
সবশেষে ভারতের মানুষ মোদীর সাফল্য বিচার করবে তাদের জীবনযাত্রামান উন্নয়নের নিরীখে।
উন্নয়নের পথে এগিয়ে চলা ভারত আগামী দিনগুলোতেও এগিয়ে চলবে। কিন্তু বিগত দিনের প্রজন্মের চেয়ে ভারতের বর্তমান প্রজন্মের প্রত্যাশা বেশি।
বাস্তবতা হচ্ছে প্রত্যাশামাফিক কাজের ফল আসতে সময় লাগে। বিশেষ করে ভারতের মত দেশে। মোদী দেশ ও জাতিকে যতটুকু দিতে পারবেন তার চেয়েও বেশিকিছু করার আশ্বাস দিয়ে অনেক কঠিন লক্ষ্য স্থির করেছেন।
বিশ্ব বাজারে তেলের দাম আরো বেড়ে গেলে মোদীর কাজ আরো অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। গত এক বছরে তেলের দাম পড়ে গিয়ে জিনিসপত্রের দাম কমে ভারতে পাইকারি বাজারে এরই মধ্যে মূল্যবৃদ্ধি চলে গেছে শূন্যের নীচে।
তার ওপর অকালবৃষ্টিতে ফসল নষ্ট হয়ে চাষীদের রোজগার আরো কমেছে। ফলে কমেছে তাদের কেনাকাটও। আমজনতাও হাত খুলে কেনাকাটার কথা না ভাবায় অর্থনীতিতে আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে। চাহিদা না থাকায় হচ্ছে না প্রবৃদ্ধিও।
ফলে এখনো করার বাকী আরো অনেককিছুই। আগামী দিনগুলোতে আরো বেশি কাজ করে দেখাতে হবে মোদীকে, বিশেষ করে দেশে। ইতিহাসে ভারতের রূপান্তর ঘটানোর সবচেয়ে খ্যাতিমান নেতা হওয়ার জন্য সব হাতিয়ারের পাশাপাশি জনগণের আস্থা এখনো তার আছে।