ইউক্রেইনে যুদ্ধ শুরুর প্রেক্ষাপটে মস্কো আর পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখতে গিয়ে গত কয়েক দিনে ভারতকে কূটনীতির এক কঠিন পথে এগোতে হয়েছে, যা ছিল সার্কাসের রশির ওপর হাঁটার মত।
Published : 01 Mar 2022, 07:55 PM
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে দেওয়া প্রথম বিবৃতিতে ভারত বলেছে, ইউক্রেইন প্রশ্নে কূটনৈতিক চেষ্টা আর আলোচনার যে আহ্বান আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় জানিয়েছিল, তাতে সাড়া না মেলাটা ‘খুবই দুঃখজনক’। তবে সরাসরি কোনো দেশের নাম সেখানে উল্লেখ করেনি দিল্লি।
এভাবে ভারত তার মিত্র রাশিয়ার সমালোচনা করার পথ এড়িয়ে গেছে। আবার রুশ আগ্রাসনের নিন্দা জানাতে মার্কিন খসড়া প্রস্তাবটি যখন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভোটাভুটির জন্য তোলা হল, তার আগে রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেইন ‘সঠিক কাজটি করার’ আহ্বান জানিয়েছিল ভারতকে।
ইউক্রেন ও রাশিয়া- দুই দেশই চলমান সংকটে ‘স্পষ্ট অবস্থান’ নেওয়ার আহ্বান রেখেছিল ভারতের সামনে। কিন্তু ভোটদানে বিরত থেকে দিল্লি যে বিবৃতি দিয়েছে, সেটা সতর্কভাবে পড়লে বোঝা যায়, ভারত আসলে তাদের ওই মধ্যপন্থা থেকে আরও এক ধাপ এগিয়েছে; পরোক্ষভাবে তারা মস্কোকে আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি সম্মান দেখাতে বলেছে।
জাতিসংঘ সনদ, আন্তর্জাতিক আইন, এবং রাষ্ট্রগুলোর সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর গুরুত্ব তুলে ধরে ভারত বলেছে, “একটি গঠনমূলক পথ খুঁজে বের করার জন্য জাতিসংঘের সকল সদস্য রাষ্ট্রকে এই নীতিগুলোর প্রতি সম্মান দেখাতে হবে।”
কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদে আনা নিন্দা প্রস্তাবে ভারতের ভোটদানে বিরত থাকার বিষয়টি প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে, বিশেষ করে পশ্চিমের দেশগুলোতে। প্রশ্ন উঠেছে, বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশের (ভারত) আরও স্পষ্ট অবস্থান নেওয়া উচিত ছিল কি না।
এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে বিবিসির এক প্রতিবেদনে।
আর কোনো বিকল্প নেই?
সাবেক ভারতীয় কূটনীতিক জেএন মিশ্র বিবিসিকে বলেছেন, ভারতের সামনে যে বিকল্পগুলো আছে, তার কিছু খারাপ, বাকিগুলো নিকৃষ্ট।
“কেউ একই সময়ে দুই দিকে ঝুঁকতে পারে না। ভারত কোনো দেশের নাম নেয়নি, যা থেকে বোঝা যায়, এটি মস্কোর বিরুদ্ধে যাবে না। একটি পক্ষ বেছে নিতে ভারতকে সূক্ষ্ম কৌশলের আশ্রয় নিতে হতে; ভারত সেটাই করেছে।”
বিবিসি লিখেছে, ইউক্রেইন নিয়ে এই সঙ্কটে ভারতের এভাবে কূটনৈতিক ভারসাম্য খোঁজার বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। সবচেয়ে বড় কারণ হল মস্কোর সঙ্গে ভারতের প্রতিরক্ষা এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক, যা কালের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ।
রাশিয়া ভারতের বৃহত্তম অস্ত্র যোগানদাতা হওয়ার চেষ্টা করছে, যদিও ভারত নিজের দেশে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উৎপাদনে মনোযোগী হওয়ায় রাশিয়ার ভাগ ৭০ শতাংশ থেকে ৪৯ শতাংশে নেমে এসেছে।
রাশিয়া এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্রের মত প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম দিচ্ছে ভারতকে। ফলে চীন ও পাকিস্তানের বিপক্ষে কৌশলগত জায়গায় পাল্লা দিতে পারছে ভারত। আর সে কারণেই মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকির মধ্যেও ওই ক্ষেপণাস্ত্র কেনার সিদ্ধান্ত এগিয়ে নিয়েছে ভারত।
অস্ত্রের গুরুত্ব
বেশ কয়েকটি বিষয়ে রাশিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে কয়েক দশকের ইতিহাসকে উপেক্ষা করা দিল্লির পক্ষে কঠিন। ভারতকে সাহায্য করতে কাশ্মির প্রশ্নে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভিটো দিয়েছিল রাশিয়া।
এই প্রেক্ষাপটে মনে হচ্ছে, ভারত তার জোট-নিরপেক্ষ থাকার বিখ্যাত কৌশল অনুসরণ করছে এবং সমস্যা সমাধানের জন্য সংলাপের আহ্বান জানাচ্ছে।
উইলসন সেন্টারের ডেপুটি ডিরেক্টর মাইকেল কুগেলম্যান বলেছেন, ভারতের এমন অবস্থানে তিনি বিস্মিত নন, বরং দিল্লির এখনকার অবস্থান তাদের অতীতের কৌশলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
কুগেলম্যান বলেন, “প্রতিরক্ষা এবং ভূ-রাজনৈতিক প্রয়োজনের খাতিরেই এ মুহূর্তে অন্য কিছু করার সুযোগ ভারতের নেই। যদিও ইউক্রেইন পরিস্থিতিতে ভারত যে অস্বস্তিতে আছে, সেটা বেঝাতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে কিছু কঠিন শব্দ বেছে নিয়েছে।”
ইউক্রেইন থেকে ২০ হাজার ভারতীয় নাগরিক, যাদের বেশিরভাগই শিক্ষার্থী, তাদের সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করাও ভারতের জন্য কঠিন।
এক সময় মস্কো ও লিবিয়াতে কাজ করেছেন প্রাক্তন ভারতীয় কূটনীতিক অনিল ত্রিগুনিয়াত। ২০১১ সালে সংঘাত শুরু হলে ভারতীয় নাগরিকদের লিবিয়া থেকে সরিয়ে নেওয়ার কাজটি তিনি তদারকি করেছিলেন।
তিনি বলছেন, বিদেশি নাগরিকদের সরিয়ে নিতে একটি সফল অভিযান চালাতে হলে সংঘাতে লিপ্ত সমস্ত পক্ষের কাছ থেকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রয়োজন হয়।
“নিজেদের নাগরিকদের নিরাপত্তা বিপন্ন করার ঝুঁকি নিয়ে ভারত একটি পক্ষকে বেছে নিতে পারে না। তাছাড়া, সবার সঙ্গে যোগাযোগের পথ খোলা রাখার একটি সামগ্রিক চিত্র ভারত দেখতে পাচ্ছে।”
বিবিসি লিখেছে, এভাবে ভাবলে দিল্লি একটি ‘অনন্য’ অবস্থানে রয়েছে; কারণ এখনও পক্ষ না নেওয়া কয়েকটি দেশের মধ্যে ভারত একটি, যাদের সঙ্গে ওয়াশিংটন ও মস্কো উভয়েরই সুসম্পর্ক রয়েছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রহ্মণ্যম জয়শঙ্কর ওয়াশিংটনে কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন।
মোদী ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গেও আলোচনা করেছেন। প্রাক্তন ভারতীয় কূটনীতিক ত্রিগুনিয়াত মনে করেন, ভারত উভয় পক্ষের সঙ্গে কূটনৈতিক চ্যানেল খোলা রেখে ‘ভালো’ করেছে।
“ভারত সরাসরি রাশিয়ার সমালোচনা করেনি, কিন্তু ইউক্রেনীয়দের দুর্দশার বিষয়ে ভারত চোখ বন্ধ করে রেখেছে- এমনও নয়। একটা ভারসাম্যপূর্ণ পথ তারা গ্রহণ করেছে। ভারত নিরাপত্তা পরিষদে আঞ্চলিক অখণ্ডতার পক্ষে জোরালোভাবে বলেছে, স্পষ্টত ইউক্রেইনের দুর্দশার কথা তুলে ধরাই এর উদ্দেশ্য ছিল।”
কিন্তু ওয়াশিংটন এবং তার ইউরোপীয় মিত্ররা যদি রাশিয়ার উপর নতুন নতুন কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যেতে থাকে, তাহলে মস্কোর সঙ্গে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া ভারতের পক্ষেও কঠিন হয়ে যাবে।
এ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের অবস্থান বুঝতে পারছে বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু ভবিষ্যতেও সেটা হবে, এমন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না।
সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে ভারতের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি সুনির্দিষ্ট কোনো উত্তর দেননি।
বাইডেন বলেছেন, “আমরা (ইউক্রেইন নিয়ে) ভারতের সঙ্গে পরামর্শ করতে যাচ্ছি। পুরোপুরি সমাধান এখনও হয়নি।”
রাশিয়ার এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র কেনা নিয়ে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকি এখনও রয়েছে। ‘কাউন্টারিং আমেরিকাস অ্যাডভারসারিজ থ্রু স্যাংশনস অ্যাক্ট’ (সিএএটিএসএ) জারি করে যুক্তরাষ্ট্র ২০১৭ সালে রাশিয়া, ইরান ও উত্তর কোরিয়ার ওপর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। এর আওতায় ওই তিন দেশের সঙ্গে অন্য কোনো দেশের প্রতিরক্ষা চুক্তি করতেও বাধা রয়েছে।
রাশিয়া ইউক্রেইন আক্রমণ করার আগেও ওয়াশিংটন ভারতকে কোনো ছাড় দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়নি। বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন, বিষয়টি ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি দর কষাকষিতে পরিণত হতে পারে।
দিল্লির মনোভাবে কোনো পরিবর্তন দেখলে রাশিয়াও চাপ দেওয়ার নতুন কৌশল হিসেবে ভারতের চির শত্রু পাকিস্তানের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সম্পর্ক জোরদার করার দিকে যেতে পারে।
গত দুই দশকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের ক্রমবর্ধমান সম্পর্কের বিষয়টি রাশিয়া মেনে নিলেও ইউক্রেইনের ‘রেড লাইন’ দিল্লি অতিক্রম করুক, তা তারা চাইবে না।
কুগেলম্যান মনে করেন, ওই ধরনের চূড়ান্ত পরিস্থিতি ভারতের জন্য তখনই আসতে পারে, যখন ইউক্রেইনের সংঘাত দীর্ঘায়িত হবে এবং আবার একটি দ্বিমেরু বিশ্ব তৈরি হবে।
“আসুন, আশা করি তেমন কিছু ঘটবে না। কিন্তু যদি তা ঘটে, তাহলে ভারতের পররাষ্ট্র নীতিকে তা বড় ধরনের পরীক্ষায় ফেলে দেবে।”
আরও খবর