Published : 31 Jul 2023, 10:56 AM
অন্তঃসত্ত্বা হয়েছেন তা একদমই টের পাননি তানিয়া নেওয়াজ। খানিক পেট ব্যথা আমলে নেননি শুরুতে, যতক্ষণ না তা অসহনীয় হয়ে ওঠে। আসলে তার বেলায় ভ্রুণ গর্ভে নয়, বরং ফ্যালোপিয়ান টিউবে বেড়ে উঠছিল।
যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (এনএইচএস) জানাচ্ছে, সেখানে প্রতি ৯০ জন গর্ভবতীর মধ্যে একজনের বেলায় জরায়ুর বাইরে ভ্রুণ জন্ম নেয়। প্রতি বছর সেখানে প্রায় ১১ হাজার গর্ভবতীর বেলায় এমন হয়।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের ২০১৯ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রে ১ থেকে ২ শতাংশ গর্ভধারণ জরায়ুর বাইরে হয়ে থাকে।
নারীর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এরকম গর্ভধারণকে চিকিৎসার ভাষায় বলে এক্টোপিক প্রেগনেন্সি। বাংলাদেশে কত নারীর ক্ষেত্রে এরকম হয়, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই।
বিরল এই গর্ভধারণের অভিজ্ঞতা হয়েছিল তানিয়া নেওয়াজের বেলাতেও। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি জানালেন সেই যন্ত্রণাময় অভিজ্ঞতার কথা।
২০০১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তার বিয়ে হয়। বয়স তখন একুশ পেরিয়েছে। পিরিয়ড ঠিক মতই হত, তাই অন্তঃস্বত্তা হয়েছেন বলে মনে করেননি।
যদিও তলপেটে দুয়েক সময় ব্যথা অনুভব করেছেন, তীব্র ছিল না বলে গুরুতর কিছু হতে পারে ভাবেননি। কিনতু একদিন মেলায় বেড়াতে গিয়ে শুরু হয় তীব্র ব্যথা।
তানিয়া বলেন, ”আমরা সবাই খুব ঘুরলাম। হঠাৎ আমার পেটে ব্যথা শুরু হল। এর আগেও দুয়েকদিন হালকা ব্যথা হয়েছিল। তখন তো অত কিছু জানা ছিল না, বুঝতামও না। সেদিন মেলায় ঘুরে বাড়ি ফেরার পর আমার পেটের ডান দিকে ব্যথা বাড়তে শুরু করল।”
সেসময় রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় থাকতেন তানিয়ারা। মেলা থেকে ফিরে রাতের দিকে গেলেন বাড়ির কাছে মনোয়ারা হাসপাতালে।
”জরুরি বিভাগে ওরা আমাকে ব্যথানাশক ওষুধ দিল। তারপর গাইনি ডাক্তার দেখাতে বললো। আমি বাড়ি ফিরে গেলাম।”
ব্যথানাশক ওষুধের কারণে বাড়ি ফেরার পর ঘুমাতে পেরেছিলেন তানিয়া। কিন্তু ওষুধের রেশ কেটে যেতেই ব্যথা যেন আরও তীব্রভাবে ফিরে আসে।
তানিয়া নেওয়াজ বলেন, ”সারাদিন তেমন ব্যথা বোধ করছিলাম না। তবে দুর্বল বোধ করছিলাম।সোফায় শুয়ে বিশ্রাম নিলাম দুপুরে।
”বিকালে চা বানিয়ে টেবিলে রেখে বসতে যাচ্ছিলাম, তখন মনে হল বুক থেকে পেট পর্যন্ত কিছু একটা ছিঁড়ে গেল।আমি বসার চেষ্টা করেও পারছিলাম না। আমার স্বামী তখন বাইরে। ফোন করে আসতে বললাম তাড়াতাড়ি।”
তানিয়াকে আবারও নেওয়া হয় সিদ্ধেশ্বরীর মনোয়ারা হাসপাতালে। ভীষণ যন্ত্রণাময় সেই দিনটির কথা মনে করে তিনি বলেন, ”তখন সন্ধ্যা হওয়ার দিকে। আমি রিকশায় উঠতে পারছিলাম না। বাড়ির দারোয়ানও সহযোগিতা করল। দু-তিনজনের সাহায্যে আমি রিকশায় উঠলাম। আবারও ইমার্জেন্সিতে গেলাম।
”ততক্ষণে আমার সারা শরীর যেন সাদা টিস্যুর মত হয়ে গেছে। আর পেট ফুলে উঠছিল। কিন্তু হাসপাতালে বলল, তারা ট্রিটমেন্ট করতে পারবে না; হলি ফ্যামিলিতে নিতে বলল। আমার এক বোন তখন ক্লাস করছিল। আরেক বোন একটা কনফারেন্সে। আমার স্বামী দুজনকে ফোন দিয়ে শেষমেশ বড় আপাকে ফোনে পেল।”
বড় বোনের গাড়িতে করে তানিয়াকে নেওয়া হল ঢাকার মগবাজার এলাকায় হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তানিয়া বলেন, “সেদিন জ্ঞান হারালে হয়ত আর জীবিত থাকতাম না। আমাকে নার্সরা বারবার বলে চলেছিল, ‘চোখ বন্ধ করবেন না’। আমার অবস্থা দেখে চিকিৎসকরা বুঝে গিয়েছিলেন কী হয়েছে।
“তখন ডাক্তার মেহেরুন্নেসা সম্ভবত একটা গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে ছিলেন। ফোন করা হলে অনুষ্ঠানের সাজেই উনি হাসপাতালে চলে আসেন।”
দ্রুত অপারেশন কক্ষে নেওয়া হয় তানিয়া নেওয়াজকে। ২০০২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি রাতে অপারেশন শুরু হয়।
তানিয়া বলেন, “আমাকে সিজারের মতই অপারেশন করা হল। পেটের ভেতরে ব্লিডিং হচ্ছিল। আমাকে মনে হয় তখন দুই থেকে চার ব্যাগ ব্লাড দিয়েছিল “
অপারেশন চলার সময় বাইরে অপেক্ষায় থাকা পরিবারের সদস্যদের ডাক্তাররা জানিয়ে দেন, তানিয়ার একটি টিউব ফেলে দিতে হবে। পরে তানিয়া জেনেছিলেন, তার এক্টোপিক প্রেগনেন্সি ছিল। ডান দিকের ফ্যালোপিয়ান টিউবে ভ্রুণ ছিল, যা ফেটে যায়। ঝুঁকি এড়াতে ওই নালী কেটে ফেলা হয়।
হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে রিপোর্টে বলা ছিল, তানিয়া নেওয়াজের ’রাইট সাইডেড র্যাপচারড এক্টোপিক প্রেগনেন্সি’ পাওয়া গেছে। সে কারণে ’ল্যাপারোটমি উইথ রাইট সাইডেড সালপিনগেকটমি’ করা হয়।
নারী দেহে দুটো ফ্যালোপিয়ান টিউব থাকে। টিউবের এক প্রান্ত জরায়ুর সঙ্গে যুক্ত থাকে। অন্য প্রান্ত দুটি ডিম্বাশয়কে আটকে রাখে।
প্রতি মাসে ডিম্বাশয় বা ওভারিতে যে ডিম্বাণু তৈরি হয় তা ফ্যালোপিয়ান টিউব দিয়ে জরায়ুতে যায়। শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর নিষেক ঘটে এই টিউবে; ফলে ভ্রুণ তৈরি হয়। এই ভ্রুণ জরায়ুতে এসে বেড়ে উঠতে থাকে; যাকে নারীর গর্ভকাল বলে।
ভ্রুণ জরায়ুর বাইরে যে কোনো অংশে থেকে গেলে বা বাড়তে থাকলেই তা এক্টোপিক প্রেগনেন্সি।
আমেরিকান কলেজ অফ অবসটেট্রিশিয়ানস অ্যান্ড গাইনিকোলজিস্টের (এসিওজি) ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুসারে, এক্টোপিক প্রেগনেন্সির ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে ফ্যালোপিয়ান টিউবেই ভ্রুণ পাওয়া যায়; তাই এর অন্য নাম টিউবাল প্রেগনেন্সি।
আর এই ভ্রুণ বেড়ে ওঠার সময় ফ্যালোপিয়ান টিউব ফেটে যায়। ফলে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ হতে থাকে। একে র্যাপচারড এক্টোপিক প্রেগনেন্সি বলে মেডিকেলের ভাষায়; যে কারণে নারীর মৃত্যুও হতে পারে।
এই পরিস্থিতিতে তলপেটে কেটে টিউব অপসারণ করা হয়। তারপর পেট সেলাই করা হয়। এই প্রক্রিয়াকে লাপারোটমি ও সালপিনগেকটমি বলা হয়।
ফ্যালোপিয়ান টিউব অপসারণে হবে ক্যান্সার রোধ?
কেমন দেখতে গর্ভকালের প্রথম দিকের ভ্রুণ?
ঘুমের আগে কম আলো কমাবে গর্ভকালের ডায়বেটিস ঝুঁকি?
তানিয়া নেওয়াজের বেলায় তার ডান দিকের ফ্যালোপিয়ান টিউব কেটে বাদ দেওয়া হয়। দুটির মধ্যে একটি ফ্যালোপিয়ান টিউব অপসারণের পর এই নারীর জীবনে কী বদল এসেছিল?
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, অপারেশনের পর চিকিৎসকরা তাকে শারীরিক ও মানসিক ধকল সামলে ওঠার জন্য পর্যাপ্ত খাওয়া ও বিশ্রামের পরামর্শ দেন।
”ডাক্তাররা আমাকে কোনো রকম ডায়েট করতে মানা করলেন। এক বছরের মধ্যে সন্তান নিতে মানা করলেন। কারণ একটু সময় না নিয়ে কনসিভ করলে তাতে আমার জীবনের ঝুঁকি হতে পারে।”
পরিবার থেকে কি আবার সন্তান নিতে কোনো চাপের মুখে পড়তে হয়েছিল?
তানিয়া নেওয়াজ বলেন, ”আমার স্বামী ও পরিবার খুব হেল্পফুল ছিল। আমি মানসিকভাবে চাপ বোধ করব এমন কোনো রকম আচরণ পরিবারের কেউ করেনি আমার সঙ্গে।”
একটি ফ্যালোপিয়ান টিউব থাকার পরও মাতৃত্ব আসে তানিয়া নেওয়াজের জীবনে। পরের বছর, অর্থ্যাৎ ২০০৩ সালের গোড়ার দিকে আবার অন্তঃসত্ত্বা হন তিনি।
গর্ভকালের ওই সময়ে প্রতি মাসে চিকিৎসকের অধীনে স্বাস্থ্যপরীক্ষা করতেন। সেই সঙ্গে প্রয়োজনীয় সাবধানতা মেনে চলতেন।
”আমি তখন সিদ্ধেশ্বরীতে বাড়ির কাছে একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞকে দেখাতাম। আমাকে প্রয়োজনীয় ওষুধ ও ইনজেকশন দেওয়া হত।”
ওই বছর ১২ সেপ্টেম্বর ’পানি ভাঙে’ আর ১৩ সেপ্টেম্বর সি-সেকশনে সন্তান প্রসব করেন তানিয়া নেওয়াজ।
বর্তমানে মোহাম্মদপুরের আদাবর এলাকার বাসিন্দা এই নারী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরকে বলেন, “সেই যন্ত্রণাময় দিন পেছনে ফেলে আমি পারিবারিক-সামাজিক জীবনে সক্রিয়ভাবেই জড়িয়ে আছি। আমি ও আমার সন্তান ভালো আছি। আমার একমাত্র ছেলের বয়স এখন ১৯।”