ফ্যালোপিয়ান টিউব অপসারণে হবে ক্যান্সার রোধ?

গবেষকরা বলছেন, ডিম্বাশয় ক্যান্সারের সূতিকাগার হল ফ্যালোপিয়ান টিউব।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 April 2023, 07:22 AM
Updated : 13 April 2023, 07:22 AM

ডিম্বাশয় ক্যান্সার শনাক্তে কার্যকর কোনো স্বাস্থ্যপরীক্ষা এখনও নেই। অনেকে জিনগত কারণে এই ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। যদি সন্তান ধারণের আর কোনো পরিকল্পনা না থাকে এবং বয়স চল্লিশের আশপাশে হয়, তাহলে ডিম্বাশয় ও ফ্যালোপিয়ান টিউব অপসারণের পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।

একটি শীর্ষ স্থানীয় গবেষণা সংস্থার বরাতে এ তথ্য জানাচ্ছে নিউ ইয়র্ক টাইমস।

গবেষণায় দেখা গেছে, ডিম্বাশয় নয়, ক্যান্সারের উৎস ফ্যালোপিয়ান টিউব। এমনকি যাদের জিনগত ঝুঁকি নেই, তাদেরও অস্ত্রোপচার করে ফ্যালোপিয়ান টিউব ফেলে দিতে বলছে ওভারিয়ান ক্যান্সার রিসার্চ অ্যালায়েন্স।

ফ্যালোপিয়ান টিউব ডিম্বাশয় থেকে জরায়ু পর্যন্ত দীর্ঘ একটি নালী। অপসারণ করা মানে, এই নালী কেটে ফেলে দেবেন চিকিৎসকরা; তবে ডিম্বাশয় ও জরায়ু অক্ষত থাকবে।

ডিম্বাশয় বিশেষ ধরনের হরমোন ‍উৎপাদন করে যা নারীর পরবর্তী জীবনে হৃদরোগ, অস্টিওপোরোসিস এবং যৌন অনাগ্রহের ঝুঁকি কমাতে কাজে দেয়।

ওভারিয়ান ক্যান্সার রিসার্চ অ্যালায়েন্স সংস্থার সভাপতি ও প্রধান নির্বাহী অড্রা মোরান বলেন, ডিম্বাশয়ে ক্যান্সার তুলনামূলকভাবে কম হয়।

”সাধারণত মানুষকে এ নিয়ে খুব একটা বলাও হয় না। এখন তাই আমরা চাই, সবাই এ ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সম্পর্কে জানুক। একই সঙ্গে ডিম্বাশয়ে ক্যান্সার হলে করণীয় নিয়েও জানা দরকার।”

যদি শরীরে রূপান্তরিত জিন বিআরসিএ১ এবং বিআরসিএ২ থাকে, তবে ডিম্বাশয় এবং স্তন ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

তাই শরীরে বিআরসিএ১ এবং বিআরসিএ২ উপস্থিত কিনা জানতে এই গবেষক দল বিনামূল্যে পরীক্ষা করার যন্ত্র দিচ্ছে আগ্রহী নারীদের। 

“ক্যান্সারের বাহক জিন থেকে মুক্ত হতে চাইলে ফ্যালোপিয়ান টিউব ফেলে দেওয়াই হবে প্রাথমিক করণীয়,” বললেন মোরান।

যদিও ডিম্বাশয় ক্যান্সার রয়েছে এমন বহু নারীর শরীরে রূপান্তরিত জিন বিআরসিএ১ এবং বিআরসিএ২ পাওয়া যায়নি।

ব্রিটেনে বহু উপাত্ত নিয়ে দেখা গেছে, স্ক্যান ও রক্ত পরীক্ষা করেও ডিম্বাশয় ক্যান্সার গোড়ার দিকে শনাক্ত করা যায় না। ফলে বহু জীবন বাঁচানো সম্ভব হয় না।  

তবে আগেভাগে শনাক্ত হলেই যে মৃত্যুঝুঁকি এড়ানো যাবে, এমন আশ্বাসও দিচ্ছেন না বিশেষজ্ঞরা।

স্ত্রীরোগ সংক্রান্ত ক্যান্সারের চিকিৎসকদের সংস্থা দ্য সোসাইটি অফ গাইনোকোলজিক অনকোলজি এখন চাইছে, জিনগত পরীক্ষা আরও সহজলভ্য করা হোক।

পাশাপাশি জিনগত ঝুঁকি নেই– এমন নারীর বেলাতেও প্রতিষেধক হিসেবে ফ্যালোপিয়ান টিউব অপসারণ করতে জোর দিচ্ছেন এই চিকিৎসকরা।  

এতে ডিম্বাশয় ক্যান্সারের ঝুঁকি কমবে। আবার মস্তিষ্ক ও হৃদযন্ত্রে জন্য ডিম্বাশয়ের সামান্য পরিমাণ হরমোন উৎপাদনেও বিঘ্ন হবে না।

দ্য সোসাইটি অফ গাইনোকোলজিক অনকোলজি সংগঠনের সভাপতি স্টেফানি ব্ল্যাংক বলেন, ”বিষয়টি এখনও পরীক্ষাধীন হলেও এর বৈজ্ঞানিক ভিত্তি রয়েছে।

”শুধু টিউব অপসারণ যদিও একই সঙ্গে টিউব ও ডিম্বাশয় ফেলে দেওয়ার মত কার্যকর নয়, তবে স্বাস্থ্যপরীক্ষার উপর ভরসা করার চেয়ে ভালো। কারণ পরীক্ষায় কিছু ধরা পড়ে না।”

আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটির প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বিল ডাহুট বলেন, ”বিশেষজ্ঞরা যে পরামর্শ দিচ্ছেন, তার পেছনে অসংখ্য উপাত্ত রয়েছে। দেখা গেছে যারা অস্ত্রোপচার করে এই অপসারণে গেছেন, তাদের বেলায় ডিম্বাশয় ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা কমে গেছে।”

আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটির তথ্য অনুসারে, নারীর ক্যান্সারে মৃত্যুঝুঁকির তালিকায় পঞ্চম স্থানে রয়েছে ডিম্বাশয়ের ক্যান্সার। নারীর প্রজননতন্ত্রের যে কোনো ক্যান্সারের চেয়ে ডিম্বাশয় ক্যান্সারে আক্রান্তদের মৃত্যুহার বেশি।

যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর ১৯ হাজার ৭১০ জন নারীর ডিম্বাশয় ক্যান্সার ধরা পড়ে। এর মধ্যে ১৩ হাজার নারীর পরিণতি হয় মৃত্যু। নীরব ঘাতক এই রোগ খুব কম ক্ষেত্রেই প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়ে।

স্তন ক্যান্সারের তুলনায় ডিম্বাশয় ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা অবশ্য কম; তবে এই অসুখে বেঁচে থাকার সম্ভাবনাও যথেষ্ট কম।

যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর দুই লাখ ৬৪ হাজার নারী এবং দুই হাজার চারশ পুরুষ স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়।

ব্ল্যাংক বলেন, ”৩৫ থেকে ৪০ বছরে বয়সে রূপান্তরিত জিন বিআরসিএ১ থাকলে এবং ৪০ থেকে ৪৫ বছর বয়সে রূপান্তরিত জিন বিআরসিএ২ থাকলে ফ্যালোপিয়ান টিউব ও ডিম্বাশয় দুটোই অপসারণ করা হয়।”

চিকিৎসকরা ধরে নেন, এই বয়সের মধ্যে ওই নারী তার পরিবারে কাঙ্খিত সন্তান জন্ম দিয়েছেন।

মিনেসোটা রাজ্যের সেইন্ট পল শহরের মনিকা মনফ্রে স্ক্যানটেলবারির বয়স ৪৫ বছর। ২০১৭ সালে তার ২৭ বছর বয়সী বোনের চতুর্থ পর্যায়ের স্তন ক্যান্সার ধরা পড়ে। ওই সময় মনিকা মনফ্রে জানতে পারেন তার শরীরে রয়েছে বিআরসিএ১ জিন।

যদিও তাদের মায়ের এই জিন ছিল না। এর অর্থ প্রয়াত বাবার থেকে এই জিন এসেছে। মনিকা মনফ্রে স্ক্যানটেলবারির বাবার মা ৪০ বছর বয়সে মারা গিয়েছিলেন স্তন ও ডিম্বাশয় ক্যান্সারে ভুগে।

এক সাক্ষাৎকারে স্ক্যানটেলবারি বলেন, পরিবারে হৃদরোগ নিয়ে কথাবার্তা হলেও নারীর ক্যান্সার নিয়ে ছিল শুধু কানাঘুষা।

২০২০ সালে বোনকে হারান স্ক্যানটেলবারি। এরপর নিজের ফ্যালোপিয়ান টিউব ও একটি ডিম্বাশয় ফেলে দেন তিনি। সেসময় তার ডিম্বাশয় কিছুটা স্ফীত হয়ে উঠছিল।

”আমি তখন ৪০ ছুঁই ছুঁই। আমার স্তন ক্যান্সার হল কি না তা নিয়ে চিকিৎসক এতো চিন্তিত ছিলেন না। বরং তার ‍উদ্বেগ ছিল ডিম্বাশয় ক্যান্সার হওয়ার জোরালো সম্ভাবনা নিয়ে।”

কিছুদিনের মধ্যে চিকিৎসকের কাছে স্ক্যানটেলবারি জানতে পারেন, অপসারণ করা তার দুটো টিউবের একটির কোষে ‍পরিণত পর্যায়ের ডিম্বাশয় ক্যান্সার মিলেছে।

এরপর জরায়ু, জরায়ুমুখ এবং ডান ডিম্বাশয় ফেলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।

এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া অবশ্য সহজ ছিল না বলে জানান স্ক্যানটেলবারি। তিনি বলেন, “কোনো সন্তান জন্ম দেব না এমন একটি সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল আমাকে; যা ভীষণ কঠিন ছিল।

“আমি এখনও স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকিতে রয়েছি। দাদির পরই আমার নাম আসে। কিন্তু অস্ত্রোপচার করে অপসারণ করার কারণে দাদির মত মৃত্যু দেখতে হয়নি আমাকে।” 

কোনো রোগীর পেলভিক অপারেশনের সময় ফ্যালোপিয়ান টিউব ফেলে দেওয়া যেতে পারে; একে সালপিনগেক্টমি বলে।

ব্রিটিশ কলম্বিয়া রাজ্যে রোগীর সেবায় সাধারণত এমন করা হয় বলে জানালেন স্ত্রীরোগ ক্যান্সার সেবার সাবেক প্রধান ডায়ান্নে মিলার।  

তিনি বলেন, “১৫ বছর আগেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে ডিম্বাশয় নয়, চূড়ান্ত পর্যায়ের এই ঘাতক রোগটির সূতিকাগার হচ্ছে ফ্যালোপিয়ান টিউব। আর এখান থেকে তারা দ্রুত ছড়িয়ে যায় শরীরে।

“নারীর তলপেটে ব্যথার মত উপসর্গ দেখা দেওয়া শুরু হলে বুঝতে হবে অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে।”


যেসব নারী ডিম্বাশয় ক্যান্সারের মাঝামাঝি ঝুঁকিতে রয়েছেন, তাদের উদ্দেশে মিলার বলেন, ”ফ্যালোপিয়ান টিউব ফেলে দেওয়া হবে উভয় কূল রক্ষা করে জিতে যাওয়ার মত।”