মেনোপজে নারীর পাশে প্রযুক্তি

মেনোপজের শারীরিক ও মানসিক ধকল সামলাতে যুক্তরাজ্যে নারীর পাশে এসেছে প্রযুক্তি। রিস্টব্যান্ড ও অ্যাপ থেকে তথ্য-পরামর্শ নিয়ে নিজেকে সামলে নিচ্ছেন অনেক নারী।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 March 2023, 09:10 AM
Updated : 15 March 2023, 09:10 AM

ডেবি ডিকিনসন ২০১৯ সালে প্রথমবারের মত হট ফ্ল্যাশ অনুভব করলেন।

”আমি তখন ঘরেই ছিলাম। বেশ অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করলাম।”

৫৫ বছর বয়সী এই নারী বিবিসিকে বলছিলেন তার সেই শারীরিক ও মানসিক অস্থিরতার কথা।

”আমি বুঝতে পারছিলাম না আমার শরীরে কী ঘটছিল।তারপর বুঝতে পারি, বড় কিছু একটা হতে চলেছে আমার।”

আর এই বড় কিছু হচ্ছে মেনোপজ।

ফ্লোরিডার মিয়ামি শহরের বাসিন্দা ডেবি আর দেরি করেননি। মাসিক বন্ধ হওয়ার আগে ও পরের উপসর্গের সঙ্গে কী করে মানিয়ে চলবেন তা জানতে বয়স্ক নারী আত্মীয়দের কাছে পরামর্শ নিতে শুরু করেন।

মেনোপজ কারো বেলায় দেরি করে হলেও মোটামুটি ৫১ বছরের মধ্যে হয়ে থাকে।

মেনোপজ কী?  এর উপসর্গই বা কেমন?

এর মধ্যে ডেবি অনেক রকম ডিআইওয়াই (ডু ইট ইয়োরসেল্ফ) মানে বুদ্ধি খাটিয়ে নিজে করি ধরনের সমাধান চেষ্টা করে দেখেছেন। যেমন – ফ্রিজের দরজা খুলে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা। 

ভালো কোনো পরামর্শ না পেয়ে জীবনের এই পর্ব সামলাতে অনেকটাই অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন ডেবি।

তিনি বলেন, “মেনোপজ নিয়ে আমাদের মাঝে একেবারে নামেমাত্র ধারণা আর শিক্ষা রয়েছে। কুসংস্কার ও বয়স নিয়ে নেতিবাচক মনোভাব থেকেই এমনটা হয়। অথচ মেনোপজ হওয়া খুবই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।”

একদিন গাড়িতেও হট ফ্ল্যাশ হয় ডেবির। এরপরই তিনি এমন একটি যন্ত্র নিয়ে ভাবতে থাকেন, যা নারীকে শীতল রাখবে।

ডেবি এক সময় কাজ করেছেন স্বাস্থ্যসেবার বড় প্রতিষ্ঠান জনসন অ্যান্ড জনসনে। সে কারণে এ খাতের বিশেষজ্ঞ অনেকের সঙ্গে তার যোগাযোগ রয়েছে।

সেই যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে ১৫ লাখ ডলার সংগ্রহ করে ফেলেন এই নারী। প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকদের একটি দলের সঙ্গে শুরু করেন কাজ।

তারা বানালেন রিস্টব্যান্ড বা গোড়ালিতে পরা যায় এমন একটি যন্ত্র যার সংযোগ থাকবে থার্মাব্যান্ড নামে অ্যাপের সঙ্গে। 

এই ব্রেসলেট মূলত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন সফটওয়ার দিয়ে পরিচালিত হবে। ব্যবহারকারী নারী এই ব্রেসলেট হাতে পরলে তার শরীরের তাপমাত্রা পরিমাপ করবে এআই। যখনই হট ফ্ল্যাশ শনাক্ত হবে, ডিভাইসটি নারীর শরীরে শীতল অনুভূতির সঞ্চালন করবে। আবার এর উল্টো ঘটলে, প্রয়োজনে শরীর উষ্ণ করতে পারবে এই ডিভাইস।

এই রিস্টব্যান্ড শরীরের রক্তচাপ ও হৃদস্পন্দনও মাপবে। এই সব তথ্য দেখা যাবে অ্যাপে। ডেবির মেয়ে মারকিয়া থার্মাব্যান্ড প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনায় সহায়তা করছেন। তাদের এই অ্যাপটি বাজারে মিলবে এই বছর থেকেই।

নারীর শরীরের হরমোনের প্রতিক্রিয়ার চূড়ান্ত ধাপ এই মেনোপজ। আরেকটু ব্যাখ্যায় বলা যায়, মেয়েদের ওভারিতে (ডিম্বাশয়) নির্দিষ্ট পরিমাণ ডিম্বানু থাকে। ঋতুমতি হওয়ার পর সময়ের নির্দিষ্ট চক্র মেনে প্রতিমাসে ডিম্বানু নিঃসৃত হয়। বয়স ৫০ থেকে ৫২ পেরুলেই ডিম্বানু তৈরির কার্যক্ষমতা শেষও হয়ে যায়। তখন শরীরে হরমোনের কম বা বেশি নিঃসরণের কারণে মাসিক (মেনস্ট্রুয়েশন) বন্ধ হয়ে যায়। এটাই হল মেনোপজ বা রজঃনিবৃত্তি।

মেনোপজ নিয়ে বছরের পর বছর ধরে অজ্ঞতা ছিল। তবে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন এ নিয়ে সচেতনতা গড়ে উঠছে এবং আলাপ হচ্ছে।

আর এতে অনেক বড় বড় প্রচারকদের মত ভূমিকা রেখেছেন টিভি উপস্থাপক ডেভিনা ম্যাককল। তিনি এ বিষয়ে ২০২১ সালে একটি অনুষ্ঠান করেছিলেন চ্যানেল ফোরের শোতে।

মেনোপজের মধ্যে দিয়ে যাওয়া নারীরা যেন কর্মক্ষেত্রে ছুটি নিতে পারেন, সেই প্রচারাভিযানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন রক্ষণশীল দলের সাংসদ ক্যারোলিন নোকস। যদিও পরীক্ষামূলকভাবে ইংল্যান্ডে এই ব্যবস্থা চালু করার প্রস্তাব গত জানুয়ারিতে বাতিল করে দিয়েছে যুক্তরাজ্য সরকার।      

নারী যখনই মেনোপজের কোনো উপসর্গ অনুভব করবেন, তখনই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। সচেতনতার মাত্রা বাড়াতে কাজ করছে টেক কোম্পানিগুলো। এই খাতে এদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। অনেক প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্বেও দিচ্ছেন নারীরা।

এসব প্রতিষ্ঠানের নতুন পণ্যগুলো নারীকে মেনোপজ সামাল দিতে সহায়তা দিচ্ছে। মেনোপজে স্বাস্থ্যসেবায় হরমোন ও খাদ্যাভাসে সাপ্লিমেন্ট চিকিৎসাও রয়েছে তাদের।

এই বাণিজ্য ২০৩০ সালে ২৪ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছঅবে। এ বছর এই খাতে ১৬ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হবে।

একটি প্রোপার্টি ফার্মের অপারেশন ম্যানেজার মনিকা স্কটের বয়স এখন ৪৬। মেনোপজের উপসর্গ বুঝতে গত কয়েক বছর ধরে তিনি  ইউকে ডিজিটাল হেলথ অ্যাপ পেপি ব্যবহার করছেন। 

লন্ডনের এই বাসিন্দা বলেন, “আমার বেলায় একটি গুরুতর সমস্যা ছিল ঘুমাতে না পারা। খুবই উদ্বেগজনক।

”আর ঘুম থেকে জেগে উঠে আমি ক্লান্ত বোধ করতাম। মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে থাকত। আমার ত্বক শুষ্ক হতে থাকল এবং অত্যধিক রক্তপাত হত পিরিয়ডে। আমার বোন মেনোপজের সময় যথেষ্ট ভুগেছিল। তাই যখন আমি পেপি অ্যাপটা দেখলাম, এটি ব্যবহার করতে আগ্রহী হয়ে উঠি।”

এই অ্যাপের মাধ্যমে মেনোপজ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে এককভাবে ভিডিও বা মেসেজে আলাপ করার সুবিধা রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন কোর্সে নিবন্ধন করা যাবে, চাহিদা মত ভিডিও পাওয়া যাবে এবং লাইভ অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া যাবে।

জেনারেল ফিজিশিয়ান ও মেনোপজ বিশেষজ্ঞ ফিলিপা কে বিশ্বাস করেন, এ ধরনের প্রযুক্তি নারীকে বলিষ্ঠ করে তুলছে।

তিনি বলেন, “অ্যাপ শনাক্ত হওয়া লক্ষণগুলো কাজে দেবে। কারণ মানুষ সব ধরনের উপসর্গ সব সময় বুঝতে পারে না। আর এই অজানা জায়গাটা পূরণ করে দিতে পারে অ্যাপ।”

তবে একটু সতর্ক হওয়ার কথা তুললেন এই চিকিৎসক।

ফিলিপা কে বলেন, “মেনোপজ নিয়ে কথা বলার একটা স্রোত বইছে এখন। আর মেয়েদের স্বাস্থ্য বিষয় ব্যবহার করে দীর্ঘদিন ধরে অনেকেই অর্থ কামিয়ে চলেছে। 

“যদি মানুষ ভালোভাবে যাচাই করা তথ্য পেতে চায়, তবে ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের ওয়েবসাইট থেকে পেতে পারে তারা।”

যুক্তরাজ্যে আরেকটি মেনোপজ অ্যাপ রয়েছে স্টেলা নামে; যার সহ-প্রতিষ্ঠাতা অ্যানড্রিয়া বারকোউইজ।

নারী স্বাস্থ্য নিয়ে এ প্রতিষ্ঠান চালু করার সময় তিনি মেনোপজ খাতে কিছু শূন্যতা অনুভব করেন।

অ্যানড্রিয়া বারকোউইজ বলেন, “নারীস্বাস্থ্য খাতে প্রযুক্তি মূলত প্রজনন উর্বরতা ও মাসিক নিয়ে কাজ করছে।”

স্টেলা অ্যাপের মাধ্যমে নারীকে ব্যক্তিগত চিকিৎসার পরিকল্পনা দেওয়া হয়। মেনোপজের উপসর্গ শনাক্তে সাপ্তাহিক নির্দেশনাও দেওয়া হয়। এছাড়া এইচআরটি বা হরমোন থেরাপি নিয়ে আলাপ করার সহায়তাও দেওয়া হয় অ্যাপটির মাধ্যমে।

ব্যক্তি অনুসারে সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রটি খুব জরুরি বলে মনে করেন অ্যানড্রিয়া। তিনি বলেন, “একেক নারীর একেক উপসর্গ দেখা দিয়ে থাকে।

”কারও হয়ত ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে, কারও বেলায় মন খারাপ ও প্রস্রাব আটকাতে না পারার সমস্যা হয়, যা আলাদাভাবে যত্ন প্রয়োজন।”

স্টেলা অ্যাপটি ২০২১ সালে চালু হয়। এখন তারা চেষ্টা করছে এই অ্যাপ যেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মানবসম্পদ নীতিমালার অংশ হয়ে ওঠে।

“এই অ্যাপ সবার জন্যই, তবে আমরা কর্মক্ষেত্রগুলোতে গুরুত্ব দিচ্ছি”, বললেন অ্যানড্রিয়া।

“নারীর এই সহায়তা পেতে বাড়তি অর্থ খরচ করা উচিৎ নয়। আমরা এমন কর্মক্ষেত্র খুঁজছি যারা এক্ষেত্রে পাশে থাকবে।”

পোশাক খাতের ব্র্যান্ড বারবার, বেটারস্পেস ও হিকা তাদের কর্মীদের এই সেবা দিতে অ্যাপটির সঙ্গে চুক্তি সই করেছে।

অ্যাপটির জন্য জরুরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মান বাড়ানো নিয়ে এখন কাজ করছেন বলে জানালেন অ্যানড্রিয়া।

“এতে করে কোনো ধরনের উপসর্গে কী কী চিকিৎসা দেওয়া যায় এ নিয়ে অ্যাপটির আরও পোক্ত ধারণা গড়ে ওঠে।”

যুক্তরাজ্যে এ ধরনের প্রযুক্তি ভিত্তিক স্টার্টআপের প্রসার ঘটছে। অপরদিকে গত কয়েক বছরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মেনোপজ নীতিমালা চালু করেছে।

রয়েল মেইল ও সুপার মার্কেট ব্র্যান্ড টেসকো এখন কর্মীদের মেনোপজ নিয়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। কর্মীদের ইউনিফর্ম বানাতে এখন আরও হালকা কাপড় ব্যবহার করা হচ্ছে, যেন হট ফ্ল্যাশে আরাম হয় তাদের।

রিস্টব্যান্ড পরার পর থেকে জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে বলে বিবিসিকে জানালেন ডেবি।

তিনি বলেন, “এখন অনেক অস্থিরতা কমে এসেছে। উপসর্গগুলো আগের চেয়ে কম ভোগাচ্ছে। এই সময়টা সামলানো এখন অনেকটাই স্বস্তিদায়ক হয়ে উঠেছে।”