অকাল রজঃনিবৃত্তি হতে পারে স্মৃতিভ্রংশের কারণ

বয়স চল্লিশ পেরুনোর আগেই রজঃনিবৃত্তি? গবেষণা বলছে এমন হলে ৩৫ শতাংশ ক্ষেত্রে পরে স্মৃতিভ্রংশ বা ডিমেনশিয়া দেখা দিতে পারে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 March 2022, 02:58 AM
Updated : 13 March 2022, 02:59 AM

মেয়েদের ওভারি বা ডিম্বাশয়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ ডিম্বাণু থাকে এবং ঋতুমতি হওয়ার পর প্রতি মাসে ডিম্বাণু নিঃসৃত হয়। বয়স ৫০ পার হলে ডিম্বাণু শেষ হয়ে যায়। তখন মেনস্ট্রুয়েশন বা মাসিক বন্ধ হয়ে যায়; এটাই হল মেনোপজ বা রজঃনিবৃত্তি।

কোনো নারীর ডিম্বাশয় হরমোন উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়ার কারণে চল্লিশের আগেই যদি মাসিক চক্র থেমে যায়, তাকে বলে অকাল রজঃনিবৃত্তি। কারো এমন হলে বুঝতে হবে স্বাভাবিক সময়ের অনেক আগেই তার মেনোপজ ঘটছে।

ইউএস ডিপার্টমেন্ট অফ হেলথ অ্যান্ড হিউম্যান সার্ভিসেস অফিস অন উইমেন হেলথের তথ্য অনুসারে যুক্তরাষ্ট্রে নারীদের স্বাভাবিক রজঃনিবৃত্তির বয়স গড়ে ৫২ বছর। আর বাংলাদেশে তা ৫১ বছর বলে জানাচ্ছে বাংলাদেশ মেনোপজ সোসাইটি।

সিএনএন জানিয়েছে, ইউকে বায়োব্যাংকে সংরক্ষিত দেড় লাখের বেশি নারীর তথ্য বিশ্লেষণ করে অকাল মেনোপজের প্রভাব বোঝার চেষ্টা করেছেন গবেষকরা। এ মাসেই আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের বার্ষিক সম্মেলনে ওই গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করার কথা রয়েছে।

আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ড. ডোনাল্ড লিওড-জোনস সিএনএনকে বলেছেন, অকাল রজঃনিবৃত্তি আর ডিমেনশিয়ার মধ্যে একটি যোগসূত্র পাওয়া গেছে এ গবেষণায়।

মাসিক আগেই বন্ধ হয় কেন?

যদি কোনো কারণে অস্ত্রোপচার করে ডিম্বাশয় অথবা জরায়ু বাদ দেওয়া হয়, তাহলে মাসিক বন্ধ হয়ে যাবে। একে বলা হয় সার্জিক্যাল মেনোপজ।

আবার প্রাকৃতিকভাবেও নির্ধারিত বয়সের অনেক আগে মাসিক বন্ধ হয়ে যেতে পারে।  

লিওড-জোনস বলেন, “আসলে জৈবিকভাবে শরীরের কোষ, প্রত্যঙ্গের কার্যকারিতায় বার্ধক্য দেখা দেওয়ার সঙ্গে অকাল রজঃনিবৃত্তির সম্পর্ক রয়েছে।”

শিকাগোর নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির ফেইনবার্গ স্কুল অফ মেডিসিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই অধ্যাপক বলেন, জিনগত, পরিবেশগত অথবা স্বাস্থ্যগত জটিলতার কারণে অকালে মেনোপজ হতে পারে। বিভিন্ন পর্যায়ে শরীর সেই ইংগিত দিতে পারে, যেখানে মনোযোগ দেওয়া দরকার।

৪৫ পেরোনোর আগেই মেনোপজ?

লিওড-জোনস বলেন, ইউকে বায়োব্যাংকের এক লাখ ৫৩ হাজার নারীর তথ্য বিশ্লেষণ করার সুযোগ হয়েছে এ গবেষণায়। এই বিপুল তথ্যের যে ব্যাপ্তি, তাতে গুরুত্বপূর্ণ ধারণা পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। তবে কার্যকারণ সম্পর্কে যা যা বোঝা প্রয়োজন ছিল, তার সব বোঝা যায়নি।

এই গবেষণায় বয়স, জাতীয়তা, ওজন, শিক্ষা ও আয়, ধূমপান ও মদে আসক্তি, কার্ডিওভাসকুলার রোগ, ডায়বেটিস এবং শারীরিক সক্রিয়তার দিকে নজর দেওয়া হয়েছিল।

ফলাফলে দেখা যায়, যে নারীদের বেলায় ৪৫ বছর বয়সের আগেই মাসিক বন্ধ হয়ে যায়, তাদের ৬৫ বছর বয়সের মধ্যে ডিমেনশিয়া ধরা পড়ার ঝুঁকি ১ দশমিক ৩ গুণ বেশি। 

অনেক সময় ৪০ থেকে ৪৫ বছর বয়সের মধ্যেও নারীর মেনোপজ হতে পারে। সেটাকে অকাল মেনোপজ বলছেন না গবেষকরা।

যদিও এই দুই রকম মেনোপজ হওয়ার কারণগুলো একই রকম হতে পারে; বংশগত, দীর্ঘদিন ধরে ক্লান্তিতে ভোগাসহ অন্যান্য অটোইমিউন রোগ, এইচআইভি এবং এইডস, ক্যান্সারের কারণে কেমোথেরাপি অথবা পেলভিক রেডিয়েশন চিকিৎসা, ডিম্বাশয় অথবা জরায়ু অপসারণ এবং ধূমপানের অভ্যাস এ ধরনের কারণ।   

অবশ্য অস্ত্রোপচার করে ডিম্বাশয় বা জরায়ু অপসারণের কারণে যে মেনোপজ হয়, তাতে অকাল মেনোপজের চেয়ে ঝুঁকি কম বলে জানান লিওড-জোনস।

”আবারও বলতে হচ্ছে, এটা হয়ত একটা সতর্কবার্তা নিয়েই আসে; নিশ্চয় কোনো কোষ তার কার্যকারিতা দ্রুত হারাচ্ছে। তাই নারীকে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে স্বাস্থ্যগত দিকগুলো জানতে হবে।”  

ইস্ট্রোজেনের ঘাটতি কি দায়ী?

যখন নারীর মেনোপজ হয়, তখন ইস্ট্রোজেন হরমোন উৎপাদন কমতে শুরু করে। এর সঙ্গে গবেষণায় পাওয়া ইঙ্গিতকে মেলাতে চাইছেন এর লেখক ওয়েন্টিং হাও।

চীনের জিনান শহরে শানডং ইউনিভার্সিটির এই ডক্টরেট প্রার্থী বলেন, “আমরা জানি, দীর্ঘদিন ধরে ইস্ট্রোজেন ঘাটতি হতে থাকলে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস দেখা দিতে পারে।

“আর তাতে করে মস্তিস্কে বার্ধক্য দেখা দিতে পারে। এর ফলে আমাদের চিন্তাশক্তি কার্যকারিতা হারাতে পারে।”    

শরীরে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট প্রতিরক্ষা যখন অতিরিক্ত র‌্যাডিকেলের সাথে পেরে ওঠে না, তখন কোষের ক্ষতি দেখা দেয়; এটাকেই বলা হচ্ছে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস। ওই র‌্যাডিকেলগুলো বিপাকের উপজাত হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই শরীরে তৈরি হয়। তবে ধূমপান, দূষণ, কীটনাশক শরীরে প্রবেশ করলে এ ধরনের মৌলের উপস্থিতি বেড়ে যায়।

লিওড-জোনস বলছেন, অকালে মেনোপজ হওয়ার বিষয়টি ইস্ট্রোজেনের ঘাটতির চেয়েও বড় সতর্কবার্তা দেয়।

“গর্ভাবস্থায় ডায়বেটিস বা খিঁচুনি হওয়াও একটি লক্ষণ। অকাল মেনোপজ বলে দেয়, ওই নারী পরে হৃদপিণ্ড অথবা মস্তিস্কের জটিলতা দেখা দেওয়ার ঝুঁকিতে আছেন।

“এক্ষেত্রে খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক কর্মকাণ্ড, ওজন ও ধূমপানের মত অভ্যাস যতটুকু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, তা করা দরকার।”

এক্ষেত্রে আশার আলো দেখিয়ে ওয়েন্টিং হাও বলেন, কিছু নিয়ম অনুসরণ করে অকাল মেনোপজ পরবর্তী স্মৃতিশক্তির ক্ষয়ের ঝুঁকি কমিয়ে আনা সম্ভব।

“এর মধ্যে রয়েছে নিয়মিত ব্যায়াম, অবসর ও শিক্ষামূলক কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়া, ধূমপান না করা, অ্যালকোহল না খাওয়া এবং একটা স্বাস্থ্যসম্মত ওজন বজায় রাখা।

“এসব ঝুঁকি নিয়ে জানা থাকলে তা নারীকে নিজের স্বাস্থ্য সম্পর্কে পরিকল্পনা সাজাতে সহায়তা করে; বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তাদের স্মৃতিশক্তি কতটা কার্যকর রয়েছে, তার নজরে রাখা যায়।”