বাংলাদেশ যেভাবে পৌঁছাল মেট্রোরেল স্টেশনে

২০১৬ সালে ২৬ জুন প্রধানমন্ত্রী এ প্রকল্পের নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করেছিলেন; তিনিই টিকেট কেটে হলেন প্রথম যাত্রার যাত্রী।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Dec 2022, 10:32 AM
Updated : 28 Dec 2022, 10:32 AM

সাড়ে ছয় বছর আগে উত্তরায় মেট্রোরেলের যে নির্মাণযজ্ঞ শুরু হয়েছিল, ঢাকায় নির্বিঘ্নে চলাচলে তা পরিণতি পেল ২০২২ সালের শেষে এসে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার দেশের প্রথম এ মেট্রোরেল উদ্বোধন করেছেন, বৃহস্পতিবার শুরু হবে বাণিজ্যিক যাত্রী পরিবহন। 

রাজধানীর যানজট নিরসনে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ২০১৬ সালে ২৬ জুন এ প্রকল্পের নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করেছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যাই। তিনিই দেশের প্রথম এ বৈদ্যুতিক রেলের প্রথম যাত্রী হয়েছেন।

ঢাকায় অসহনীয় হয়ে ওঠা যানজট নিয়ন্ত্রণে বিশ্ব ব্যাংকের সহযোগিতায় ২০০৫ সালে কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি) প্রণয়ন করে বাংলাদেশ সরকার। ২০ বছর মেয়াদি (২০০৪-২০২৪) ওই পরিকল্পনায় মেট্রোরেল, বাসভিত্তিক উন্নত গণপরিবহন ব্যবস্থা-বিআরটিসহ নানা প্রকল্প বাস্তবায়নের পরামর্শ আসে। 

পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায় তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন বোর্ড (ডিটিসিবি), যার বর্তমান নাম ঢাকা পরিবহন কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)।

২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে মেট্রোরেল নির্মাণের উদ্যোগ নেয় আওয়ামী লীগ। জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থার (জাইকা) অর্থায়নে সমীক্ষা পরিচালনার উদ্যোগ নেয় তৎকালীন ডিটিসিবি।

২০০৯ সালের মার্চ থেকে ২০১০ সালের মার্চ পর্যন্ত একবছরের ওই সমীক্ষায় সবার আগে ‘এমআরটি লাইন-৬’ নির্মাণের সুপারিশ আসে। পরের বছরই ওই প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করে জাইকা। 

জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থার (জাইকা) অর্থায়নে সমীক্ষা পরিচালনার উদ্যোগ নেয় তৎকালীন ডিটিসিবি। ২০০৯ সালের মার্চ থেকে ২০১০ সালের মার্চ পর্যন্ত একবছরের ওই সমীক্ষায় সবার আগে ‘এমআরটি লাইন-৬’ নির্মাণের সুপারিশ আসে। পরের বছরই ওই প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করে জাইকা। 

ওই সমীক্ষায় প্রথমে উত্তরা থেকে সায়েদাবাদ পর্যন্ত মেট্রোরেল নির্মাণের প্রস্তাব আসে। পরে তা পরিবর্তন করে মতিঝিলের বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত (২০.১০ কিমি) বিস্তৃত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।  

জাইকার কাছ থেকে কারিগরি ও অর্থায়নের প্রাথমিক প্রতিশ্রুতি নিয়ে ২০১১ সালে ‘ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) লাইন-৬ নির্মাণ’ প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার। পরের বছরের ১৮ ডিসেম্বর একনেক সভায় প্রকল্পটির চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। 

তখন প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয় প্রায় ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রকল্প সহায়তা হিসেবে ১৬ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা জাপান সরকারের আর বাকি ৫ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা সরকারের নিজস্ব তহবিলে থেকে যোগান দেওয়ার কথা ছিল। প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়ার সময় ২০১২ সাল থেকে ২০২৪ সালে মধ্যে মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। 

মেট্রোরেল 

  • মোট ট্রেন: ২৪টি

  • প্রতি ট্রেনে কোচ: ৬টি

  • উত্তরা থেকে কমলাপুর: ১৭ স্টেশন

  • উত্তরা থেকে আগারগাঁও: ৯ স্টেশন

  • স্টেশনের উচ্চতা: তিন তলা

  • উত্তরা থেকে কমলাপুর: সময় লাগবে ৪০ মিনিট

  • উত্তরা থেকে আগারগাঁও: সময় লাগবে সর্বোচ্চ ২০ মিনিট

  • একযাত্রায় যাত্রী পরিবহন: সর্বোচ্চ ২৩০৮ জন

  • ঘণ্টায় যাত্রী পরিবহন: ৬০ হাজার

  • দিনে যাত্রী পরিবহন: ৫ লাখ

  • ভাড়া: প্রতি কিলোমিটারে ৫ টাকা, সর্বনিম্ন ভাড়া ২০ টাকা

  • উত্তরা-কমলাপুর মোট ব্যয়: ৩৩ হাজার ৪৭১ কোটি ৯৯ লাখ টাকা

  • জাপানের প্রকল্প সহায়তা: ১৯ হাজার ৭১৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকা

  • সরকারের সংস্থান: ১৩ হাজার ৭৫৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা

  • উত্তরা থেকে কমলাপুরের দৈর্ঘ্য: ২১ দশমিক ২৬ কিলোমিটার

  • উত্তরা থেকে আগারগাঁওয়ের দৈর্ঘ্য: ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার

  • উদ্বোধন: ২৮ ডিসেম্বর ২০২২

  • প্রথম যাত্রী: উদ্বোধন করে প্রথম যাত্রী হবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

  • জাপানের সঙ্গে ঋণচুক্তি: ২০১৩ সালে

  • পরামর্শক নিয়োগ: ২০১৪ সালে

  • নির্মাণকাজ উদ্বোধন: ২৬ জুন ২০১৬

  • নির্মাণকাজে মোট প্রতিষ্ঠান: ৭টি কোম্পানি ও যৌথ উদ্যোগ 

উড়াল এই মেট্রোরেল বাস্তবায়নে ২০১৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি জাইকার সঙ্গে ঋণ চুক্তি করে সরকার। সেবছরই সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীনে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি (ডিএমটিসিএল) নামে বাস্তবায়ন ও রক্ষণাবেক্ষণকারী কোম্পানি গঠন করা হয়।

পরের বছরের ২৮ অগাস্ট ট্রাফিক জরিপ এবং ২৮ ডিসেম্বর চূড়ান্ত নকশার কাজ শেষ হয়। পরের দু বছরে প্রত্নতাত্বিক ও পরিবেশসহ বিভিন্ন জরিপের কাজ শেষ হয়। ২০১৫ সালে জাপানের সহায়তায় এসটিপি সংশোধন (আরএসটিপি) করে মেট্রোরেলের রুট সংখ্যা বাড়ানো হয়। পরের বছরের ২৬ জুন এ প্রকল্পের নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এ প্রকল্পের সঙ্গে জড়িয়ে আছে শোকের ঘটনাও। উদ্বোধনের পরপরই ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলায় দুই নারীসহ সাত জাপানি নাগরিক নিহত হন। 

এরপর জাইকা ও ঢাকায় নিযুক্ত জাপানি রাষ্ট্রদুতসহ বাংলাদেশে দায়িত্ব পালন করা বেশির ভাগ জাপানি নিজ দেশে ফিরে যান। পরে বাংলাদেশের তরফে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে সেপ্টেম্বরে জাপানিদের ফিরিয়ে আনা হয়। 

২০১৬ সালের শেষ ভাগে মেট্রোরেলের ডিপো নির্মাণে কাজ শুরু হয়। পরের বছর দুটি প্যাকেজের মাধ্যমে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণে পাইলিংয়ের কাজ শুরু করে।

এরপর ২০১৮ সালে এক একনেক সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বাধীনতার ৫০ বছরে মেট্রোরেল উদ্বোধনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ২০১৯ সালের ২৬ জুন জাতীয় সংসদে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মেট্রোরেল উদ্বোধনের ঘোষণা দেন।

তবে কয়েক মাস বাদেই বাধ সাধে কোভিড মহামারী। লকডাউনের কবলে পড়ে পিছিয়ে যায় নির্মাণকাজ। ফলে শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আর স্বপ্নের পথচলা শুরু করা সম্ভব হয়নি।

গত ১৯ জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত একনেক সভায় প্রকল্পটির মেয়াদ দেড় বছর এবং প্রায় ১১ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা ব্যয় বাড়িয়ে সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়। ফলে মোট ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা।

সংশোধনী প্রস্তাব অনুযায়ী মতিঝিল থেকে কমলাপুর রেলস্টেশন পর্যন্ত আরও ১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার মেট্রোরেল বাড়ানো হবে। সেই অতিরিক্ত কাজসহ প্রকল্পটির মেয়াদ ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।

এর মধ্যে ২৮ ডিসেম্বর উদ্বোধন হচ্ছে উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশ। বাস্তবায়নকারী কোম্পানি ডিএমটিসিএলের ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে আগারগাঁ থেকে মতিঝিল অংশ উদ্বোধন করা হবে। আর ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে কমলপুর পর্যন্ত পুরো পথে যাত্রী পরিবহনের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। 

মেট্রোরেলের সময়ক্রম

  • ২০০৫: বিশ্ব ব্যাংকের সহযোগিতায় ২০ বছর মেয়াদি কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি) প্রণয়ন সরকারের। তিনটি মেট্রোরেল ও তিনটি বিআরটিসহ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের পরামর্শ। 

  • ২০০৯-১০: এসটিপির বাস্তবায়ন সক্ষমতা যাচাই করে জাইকা; অগ্রাধিকারের রাখা হয় ‘এমআরটি লাইন-৬’ নির্মাণকে। 

  • ২০১০-১১: এমআরটি লাইন-৬ বা উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত রুটের সম্ভাব্যতা যাচাই। 

  • ১৮ ডিসেম্বর ২০১২: ‘ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) লাইন-৬ নির্মাণ’ প্রকল্প অনুমোদন দেয় একনেক। 

  • ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৩: জাইকার সঙ্গে ঋণচুক্তি। 

  • ৩ জুন ২০১৩: মেট্র্রোরেলের পরিচালন, তদারকি ও সার্বিক তত্বাবধায়ক হিসেবে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) গঠন। 

  • ৩১ অক্টোবর ২০১৩: ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। 

  • ২৯ নভেম্বর ২০১৩: এমআরটি-৬ এর পরামর্শক নিয়োগ। 

  • ২৬ জানুয়ারি ২০১৫: মেট্রোরেল আইন সংসদে পাস। 

  • ২০১৫-১৬: ২০০৫ সালের এসটিপি পর্যালোচনা ও পুনর্মূল্যায়ন করে জাইকা। প্রস্তাব আসে মোট ছয়টি মেট্রো লাইন করার এবং এমআরটি-৬-কে কমলাপুর পর্যন্ত সম্প্রসারণের। 

  • ২৬ জুন ২০১৬: দেশের প্রথম মেট্রোরেল নির্মাণ কাজের উদ্বোধন। 

  • ৩১ মার্চ ২০২১: জাপান থেকে মেট্রোরেল কোচের প্রথম চালান পৌঁছায় দেশে। 

  • ২৯ অগাস্ট ২০২১: ভায়াডাক্টের ওপর প্রথমবারের মতো মেট্রোরেলের পরীক্ষামূলক যাত্রা। 

  • ২৯ নভেম্বর ২০২১: উত্তরা উত্তর থেকে মিরপুর-১০ স্টেশন পর্যন্ত পারফর্মেন্স টেস্ট শুরু। 

  • ১২ ডিসেম্বর ২০২১: উত্তরা উত্তর থেকে আগারগাঁও স্টেশন পর্যন্ত পারফর্মেন্স টেস্ট শুরু। 

  • ২৮ ডিসেম্বর ২০২২: উত্তরা উত্তর থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। 

  • ডিসেম্বর ২০২৩: আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশ চালুর সম্ভাব্য সময়। 

  • ডিসেম্বর ২০২৪: কমলাপুর পর্যন্ত পুরো লাইন চালু হতে পারে।