নিজের সম্পর্কে নেতিবাচক ভাবনা বন্ধ করার কৌশল

আত্মমূল্যায়ন আর নিজের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করা- দুটো এক বিষয় নয়।

লাইফস্টাইল ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Nov 2023, 02:10 PM
Updated : 20 Nov 2023, 02:10 PM

সারাদিনই যদি নিজের সম্পর্কে নেতিবাচক কথা মাথায় ঘুরপাক খায় তাহলে বুঝে নিতে হবে এটা এক ধরনের মানসিক সমস্যা।

যুক্তরাষ্ট্রের ‘দি ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন’ এর তথ্যানুসারে রিয়েলসিম্পল ডটকম’য়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানানো হয়, আমাদের চিন্তাভাবনার ৮০ শতাংশ নেতিবাচক এবং ৯৫ শতাংশ পুনরাবৃত্তিমূলক।

বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে যে কোনো বিষয়ই অতি রঞ্জিতভাবে উপস্থাপিত হয়। আর মানুষের ভেতরে অন্যের সাথে নিজের তুলনা করার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। ফলে মানুষের মাঝে নিজের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার জন্ম হতে থাকে।

সারাক্ষণ একই বিষয় মাথায় ঘুরপাক খাওয়া ও আত্মগ্লানিতে ভোগা মানসিক স্বাস্থ্য এবং জীবনযাত্রাকে অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে।

নেতিবাচক স্ব-বুলি বলতে যা বোঝায়

লস অ্যাঞ্জেলেস ভিত্তিক ‘লাইসেন্সড ম্যারেজ অ্যান্ড ফ্যামিলি থেরাপিস্ট’ নাটালি মুর বলেন, “নেতিবাচক স্ব-বুলি বলতে এক ধরনের চিন্তন পদ্ধতিকে বোঝায় যেখানে ব্যক্তি ক্রমাগত নেতিবাচক চিন্তায় মগ্ন থাকেন। এতে সব সময় ব্যক্তি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে পোষণ করেন এবং নিজের সাথেই নেতিবাচক বাক্য বিনিময় করেন।”

যেমন- অফিসে কোনো একটা প্রেজেন্টেশন দেওয়ার সময় ছোটখাট একটা ভুল হলে অথবা শব্দ উচ্চারণে সমস্যা হলে নিজের মনের ভেতরেই নেতিবাচক বাক্য বিনিময়ে শুরু হয়ে যায়- ‘বাহ খুব ভালো করেছো। নিজেই সবকিছু ঘেটে দিয়েছো! এখন আর কেউ তোমার কথা গুরুত্ব সহকারে শুনবে না।’

মনের ভেতরে যখন এই ধরনের আলাপচারিতা চলতে থাকে তখন তার প্রভাব পড়ে বাহ্যিক ক্ষেত্রে। কিন্তু এর পরিবর্তে যদি নিজেকে এভাবে বুঝ দেওয়া যেত- ‘যা হয়েছে, হয়েছে! আমি আমার পরিবেশনটা চালিয়ে যাই। কেউ হয়তো ভুলটা খেয়াল করেনি।’

এতে মনোবল বৃদ্ধি পায় এবং যে কাজটা করা হচ্ছে তা সুন্দরভাবে সম্পন্ন করা যায়।

এমন নেতিবাচক অভ্যাস কোথা থেকে আসে?

মুরের মতে, “নেতিবাচক আত্মবচনগুলো সাধারণত শিশুকালে বেড়ে ওঠার সময় নিজ, নিজের মেধা, যোগ্যতা ও ক্ষমতা সম্পর্কে শোনা বাক্যগুলো থেকেই তৈরি হয়। যদি অভিভাবক, শিক্ষক অথবা প্রশিক্ষক সবসময় কঠোর আচরণ করেন বা নেতিবাচক বাক্য ব্যবহার করেন অথবা অসম্মানমূলক শব্দ ব্যবহার করে থাকেন, সেগুলো ধীরে ধীরে মানুষের মনে নেতিবাচক চিন্তাভাবনার জন্ম দেয়।”

আরও একটা বিষয় এমন নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য দায়ী তা হল, যদি আশপাশের মানুষেরা তাদের নিজেদেরকে সবসময় ছোট করতে থাকে অথবা নিজেদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে।

যদি শিশুরা দেখে যে, অভিভাবক বা বড় কেউ ছোটখাট ভুলের জন্য নিজেদেরকে ক্রমাগত দোষারোপ করছে তাহলে শিশুর মস্তিষ্কে স্থায়ী হয়ে যায় এবং ধীরে ধীরে সেটা নেতিবাচক চিন্তাভাবনায় বিকাশ পেতে থাকে।

কেন আমরা নেতিবাচক স্ব-কথায় নিযুক্ত হই?

নেতিবাচক স্বকথোপকথন এখন শুনতে বিরক্তিকর লাগলেও মানুষের মাঝে নেতিবাচক এই অভ্যাস রয়েছে। আমাদের মস্তিষ্ক প্রাকৃতিকভাবেই কিছুটা এই পদ্ধতিতে কাজ করে।

মুর বলেন, “মানুষ প্রাকৃতিকভাবেই ইতিবাচক জিনিসের তুলনায় নেতিবাচক জিনিসের প্রতি বেশি মনোযোগী হয়। কারণ এটা তাদের বিভিন্ন ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হাত থেকে সুরক্ষিত রাখতে সহায়ক হয়। অন্যদিকে নেতিবাচক আত্ম-কথোপকথন নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে চেষ্টা করার একটি ধাপ।”

নেতিবাচক স্ব-কথোপকথন অনেক ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ হুমকি থেকে বাঁচাতে সহায়তা করে।

মুর বলেন, “এখানে সমস্যা হল নেতিবাচক স্ব-কথোপকথন অনেকটা সংকেতের মতো। এটা হুমকির বিষয়ে আগে থেকে অবহিত করতে সহায়তা করে। তবে হুমকি কে নিরস্ত্র করতে এটা অকেজো।”

তিনি আরও যোগ করেন, “এই ধরনের চিন্তাভাবনা প্রেজেন্টেশনের সময় মানুষকে ভুল এড়াতে সহায়তা করে না বরং ঘটে যাওয়া ভুলের প্রতি বেশি মনোযোগী করে তোলে যা পরে উদ্বেগ বাড়ায় ও আরও বেশি ভুল হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি করে।”

ফলাফল হল

মুর বলেন, “তীব্র নেতিবাচক স্ব-কথোপকথন মানুষের মাঝে ভিন্ন ভিন্ন মানসিক সমস্যার যেমন- হতাশা, উদ্বেগ, আত্মবিশ্বাসের অভাব সম্পর্কে জটিলতা এবং কর্মক্ষেত্রে অযোগ্যতার প্রমাণের জন্য দায়ী।”

এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি মানুষকে সমস্যা থেকে বাঁচানোর পরিবর্তে বরং ভুলত্রুটি বেশি করার মাধ্যমে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি ঘটায় এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় অযোগ্য করে তোলে।

ফলে নিজের প্রতি আরও নেতিবাচক ধ্যান ধারণা সৃষ্টি হয়। এটা একটি চক্রের মতো কাজ করে।

নেতিবাচক স্ব-কথোপকথন বাদ দেওয়ার উপায়

ইতিবাচক অথবা নিরপেক্ষ আত্ম দৃষ্টিভঙ্গি: নিজের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এড়াতে ইতিবাচক ধ্যান-ধারণা পোষণের দিকে বেশি মনোযোগ করতে দিতে হবে।

মুর বলেন, “নিজের সম্পর্কে ইতিবাচক অথবা নিরপেক্ষ ধ্যান-ধারণা পোষণ এবং এরূপ বাক্য বিনিময় করা উচিত যাতে নিজের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ও ভাবের পরিবর্তন করে।”

সারাদিনে এমন দুতিনটি কাজ খুঁজে বের করা, যা খুব ভালোভাবে আপনি সম্পন্ন করেছেন এবং এরপরে এসব কাজের জন্য নিজেকে বাহবা দেওয়া নিজের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্যই ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে।

আত্ম সহানুভূতির চেষ্টা: মনে রাখতে হবে, একটি খারাপ ঘটনা সারাদিনকে নষ্ট করে দেওয়ার বা জীবনে জন্য খারাপ এমনটা নয়। মাঝে মধ্যে দিন খারাপ যেতেই পারে। তা নিয়ে ধরে বসে না থেকে বরং সামনে এগিয়ে যাওয়া উচিত ।

খারাপ কোনো ঘটনা ঘটলে এক হাত নিজের বুকের ওপর এবং অন্য হাত নিজে পিটের ওপর রেখে বলতে হবে যে, “এটা একটা কঠিন মুহূর্ত। আমি তোমার সাথে আছি।”

নিজের সমালোচনা গ্রহণ করা ও বিনয়ের সাথে উত্তর দেওয়া: নেতিবাচক কথোপকথনের ক্ষেত্রে আন্ত-অভ্যন্তরীণ সমালোচককে মাঝে মধ্যে বলতে হবে, ‘আমি জানি তুমি আমাকে সহায়তা করার জন্য রয়েছো। আমি আমার ভুল খুঁজে পেয়েছি এবং তা সমাধানের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি তোমার সক্রিয়তার জন্য ধন্যবাদ।’

নিজের পরিচর্যার রুটিন খুঁজে বের করা: ভালো থাকতে নিজের পরিচর্যা করার কোন বিকল্প নেই।

মুর বলেন, “সঠিক আত্ম পরিচর্যার রুটিনের মাধ্যমে নেতিবাচক আত্ম-কথোপকথনের ও দৃষ্টিভঙ্গি ভেঙে ফেলা সম্ভব।”

নিজের প্রতি দয়াশীল হলে এবং ক্ষমাশীল আচরণ করলে মস্তিষ্কে অবচেতন ভাবে শক্তিশালী বার্তা পৌঁছে দেয়। পাশাপাশি ভালোবাসা ও প্রশংসা পেলে সময়ের সাথে সাথে তা প্রতিফলিত হতে থাকে।

সহায়তা করতে পারে এমন ব্যক্তির শরণাপন্ন হওয়া

মুর বলেন, “মাঝেমধ্যে ইতিবাচক চিন্তা-ভাবনা অনুশীলনের জন্য আমাদের বাইরের থেকে ছোটখাট সাহায্যের প্রয়োজন হয়।”

পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী অথবা সঙ্গী এক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। নিয়মিত পাশে থাকে এবং যারা ভালোবাসে এমন ব্যক্তিদের আশপাশে থাকা উচিত। এটা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে।

নিবন্ধিত মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়া

সম্ভাব্য কার্যকর পদ্ধতিগুলো কাজে না দিলে, মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করার কথা বলেন, মুর।

বিশেষজ্ঞ ও থেরাপিস্টরা মানুষের সামনে তাদের ইতিবাচক দিকগুলো জোরালোভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয় যা তাদের ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে প্রয়োজন অনুযায়ী নিজের সম্পর্কে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ এবং ইতিবাচক বাক্য কথোপকথনে সহায়তা করে।

আরও পড়ুন

Also Read: নীচু মনের সহকর্মীর সঙ্গে মানিয়ে চলার উপায়

Also Read: বেশি চাপে সন্তানের ক্ষতি

Also Read: অকৃতজ্ঞ মানুষ চেনার উপায় ও তাদের সামলানোর পন্থা