যে কোনো মানসিক চাপ শিশুদের বড় বয়সে ব্যক্তিত্বের বিকাশে বাধা হতে পারে।
Published : 01 Aug 2024, 02:42 PM
বর্তমান অস্থির পরিস্থিতিতে মানসিক চাপ বোধ করা অস্বাভাবিক কিছু নয়। প্রাপ্তবয়স্করা হয়ত বিষয়টা সামলে নিতে পারেন কোনোভাবে। তবে যাদের বয়স কম তাদের কী হবে?
ভয় ভীতি দমন নিপিড়ন মানবতা বিরোধী। তবে এই ধরনের পরিস্থিতির শিকার হলে মানুষের মাঝে কী পরিবর্তন আসতে পারে?
এই প্রশ্নের জবাবে এক ভিডিও সাক্ষাৎকারে, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের শিশু-কিশোর ও পারিবারিক মনোরোগবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, “যে কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত এবং প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মানুষের যখন মোকাবিলা করতে যথেষ্ট সক্ষমতা থাকে না, তখন মনের মধ্যে প্রাথমিকভাবে এক ধরনের চাপ তৈরি হয়। একে বলা হয় ‘অ্যাকিউট স্ট্রেস ডিজঅর্ডার’ বা তীব্র মানসিক চাপ।”
তিনি এই সময়ের পরিস্থিতি উল্লেখ করে আরও বলেন, “জ্বালাও পোড়াও হত্যাকাণ্ড ঘটছে- সেটা সব বয়সি, নারী পুরুষ বা সবাই প্রত্যক্ষ করছে। আর প্রতক্ষ্য না করলেও যারা এই বিষয়ে কোনো না কোনোভাবে সংযুক্ত হচ্ছেন যেমন- সংবাদকর্মী, চিকিৎসক যারা সেবা দিচ্ছেন, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এমনকি টেলিভিশন বা এরকম মাধ্যমে যারা খবরগুলো দেখছেন পাচ্ছেন। তাদের মনের মধ্যেও এই তীব্র মানসিক চাপ পড়ছে।”
আর এই চাপ যদি দীর্ঘমেয়াদে চলে, লম্বা সময় আমাদের স্মৃতিতে থাকে তবে দেখা দিতে পারে ‘পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার (পিটিএসডি)’- মন্তব্য করেন এই মনোরোগ চিকিৎসক।
যে কোনো ধরনের বড় ট্রমা বা দুর্ঘটনা, অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি, হত্যাকাণ্ড, ধ্বংসযজ্ঞ- এই যে একটা ভীতি, এসব মানুষকে পিটিএসডি’র দিকে নিয়ে যেতে পারে।
অর্থাৎ তখন সে এই স্বাভাবিক জীবন এড়িয়ে চলতে চাইবে, নিজেকে গুটিয়ে রাখবে, এই ট্রমার বিষয়গুলো তার মনে ফ্ল্যাশব্যাকের মতো আসবে। সব সময় একটা ভীতি বা ‘হাইপার ভিজিলেন্স’য়ের মধ্যে দিয়ে চলতে থাকবে।
আদীম সময়ে মানুষ টিকে থাকার জন্য প্রাণ ধারণের জন্য কলহে জড়াতো, বা মানুষ মানুষের ওপর চড়াও হত। এটা করতো আত্মরক্ষার্থে বেঁচে থাকতে বা টিকে থাকতে। পরে যখন অর্থনৈতিক পরিবর্তন ঘটল শ্রেণি চেতনা যখন তৈরি হল, ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটল তখন কিন্তু মানুষের ওপরে আধিপত্য বিস্তার করার প্রবণতা দেখা দিল।
অন্যের ওপর কর্তৃত্ব বিস্তার করার প্রবণতাকে সমাজ বিজ্ঞানিরা বলছেন ‘ম্যালিগন্যান্ট অ্যাগ্রেশন’ বা বিদ্বেষপূর্ণ আগ্রাসন।
এর ফলে মানুষের মধ্যে সংঘবদ্ধ বা জোটবদ্ধ একটা নৃশংসতা বা হিংস্রতা দেখা দিতে পারে। এই ধরনের বিষয় সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে দেখা দেছে।
ডা. হেলাল বলেন, “দেখা গেছে একদল মানুষ জোটবদ্ধ হয়ে সম্পতি ধ্বংস করছে আবার কোথাও কেউ কাউকে হত্যা করছে আর সেটা নির্মমভাবে প্রদর্শন করছে। আবার উল্টো দিকটা হচ্ছে- যারা সংগ্রাম করতে জড়ো হয়েছে সেখানে গুলি চলেছে, অনেকে মারা গেছে।”
দুদিক থেকেই বলা যায়- আহত নিহতের ঘটনা, সম্পদ বিনষ্ট হওয়ার বিষয়গুলো অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল। এখন এই প্রতিকূল পরিস্থিতি তৈরি হওয়াতে মানুষের মনের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে, প্রাথমিকভাবে একে বলা যায় ‘অ্যাক্যুউট স্ট্রেস ডিজঅর্ডার’। যা হল উৎকণ্ঠা, ভয়-ভীতি। আর দীর্ঘমেয়াদি হলে ‘পিটিএসডি’র মতো বিষণ্নতা দেখা দেবে।
“এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বের সাথে নিতে হবে আমাদের শিশুদেরকে”- বলেন এই মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক।
এই যে নির্মম ঘটনাগুলো তারা প্রতক্ষ্য করছে, হত্যা ধ্বংস দেখছে, মৃত্যুর মুখোমুখি তারা হয়েছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের সহপাঠি এবং কাছের মানুষের মৃত্যু দেখেছে এবং একদম সামনে থেকে হত্যাযজ্ঞ ধ্বংসলীলা দেখেছে।
তাদের মনোজগতে একটা দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন হতে পারে। ভবিষ্যতে ব্যক্তিত্বের যে বিকাশ সেটা বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
ডা. হেলাল বলেন, “তাদের আচরণের মধ্যে দুরকম পরিবর্তন হতে পারে, হয় প্রাপ্ত বয়স্ক সময়ে আগ্রাসী আচরণ করবে অথবা নিজেকে গুটিয়ে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নেওয়ার মতো মানসিকতা তৈরি হতে পারে।”
এই ধরনের নৃসংশতা বা সহিংসতার যে ভয়াবহ ফলাফল, তাতে বেশি আক্রান্ত হবে আমাদের শিশুরা।
মানসিক চাপ কমানোর ক্ষেত্রে ডা. হেলালের মতে, “এই ধরনের পরিস্থিতিতে চাপমুক্ত হওয়া কঠিন হয়ে যায়। তারপরও পেছনে তাকিয়ে থাকার সুযোগ নেই। স্বাভাবিক জীবনযাপনে আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হতে হবে। সামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়াতে হবে। মানুষের সাথে মিশতে হবে। নিজের যত্ন নিতে হবে।”
আর একান্তই কোনো উপকার না হলে, মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।