ডিওডরেন্ট ব্যবহার কতটা দরকার

চিকিৎসা শাস্ত্র এর ব্যবহারের যৌক্তিকতা খুব একটা সমর্থন না থাকলেও ব্যক্তিপছন্দ আর সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এর ব্যবহার চলে আসছে

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Jan 2023, 07:11 AM
Updated : 13 Jan 2023, 07:11 AM

দাঁত মাজা বা মুখ ধোয়ার মত প্রতিদিন ডিওডরেন্ট ব্যবহার করাও যেন দৈনন্দিন ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা রক্ষার একটি নিয়মে পরিণত হয়েছে।

চিকিৎসা শাস্ত্র এর ব্যবহারের যৌক্তিকতা খুব একটা সমর্থন না থাকলেও ব্যক্তি পছন্দ আর সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এর ব্যবহার চলে আসছে

শারীরিক পরিচ্ছন্নতা রক্ষায় ডিওডরেন্টের ব্যবহার কতটা দরকারি, ত্বক বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে তা জানার চেষ্টা করেছে সিএনএন।

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালের ত্বকবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. নিনো বোতো সিএনএনকে বলেন, “ঘ্রাণের ক্ষেত্রে মানুষের পছন্দ-অপছন্দ আর সংবেদনশীলতা প্রবল। ইতিহাসের শুরু থেকেই মানুষ শরীরের দুর্গন্ধ ঢাকতে সুগন্ধী ব্যবহার করে আসছে।

“কিন্তু এটা দাঁত পরিষ্কার করে রাখার মত জরুরি বিষয় নয়। যেমন দাঁত নিয়মিত পরিষ্কার রাখলে আয়ু বাড়ে, এ বিষয়ে গবেষকরা এখন নিশ্চিত। শরীরে সুগন্ধী ব্যবহার সেরকম উপকারী বা জরুরি কিছু নয়।”

নিউ ইয়র্ক শহরের মাউন্ট সিনাই হাসপাতালের ডার্মাটোলজির সহযোগী অধ্যাপক ড. জশুয়া জাইচনার বলেন, “আমরা এমন একটি সমাজে বাস করি যেখানে মানুষের শরীরের গন্ধ সার্বজনীনভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। এ বিষয়টিই ডিওডরেন্ট ব্যবহারকে আপনার প্রাত্যহিক পরিচ্ছন্নতা অনুশীলনের একটি অংশে পরিণত করেছে।

“তাছাড়া ঘামের কারণে পোশাক ভিজে যাওয়া নিয়ে অস্বস্তিও এক্ষেত্রে একটি ভূমিকা রাখে। ওই কারণেই প্রতিদিনি অ্যান্টিপারসপিরেন্ট বা ঘাম নিরোধক ব্যবহার করেন অনেকে।”

ড. জাইচনার বলেন, ডিওডরেন্ট শরীরের গন্ধ দূর করে, আর অ্যান্টিপারসপিরেন্টস ত্বকের ভেজা ভেজাভাব কমিয়ে দেয়। সাধারণত একই পণ্যে এই দুই উপাদান যুক্ত থাকে।

ডিওডরেন্ট ব্যবহারের সাধারণ কারণটা মানুষ যদিও মেনে নিয়েছে, শরীরের স্বাভাবিক ঘ্রাণ সবার কাছেই কিন্তু অগ্রহণযোগ্য কিছু নয়।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যলয়ের জীববিজ্ঞান বিভাগের জ্যেষ্ঠ রিসার্চ ফেলো ট্রিসট্র্যাম ওয়েইট ‘চেজিং লাইফ উইদ ড. সঞ্জয় গুপ্তা’ শিরোনামে সিএনএনের ছয় পর্বের পডকাস্টে সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্টের একটি ঘটনা তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, ঐতিহাসিক বর্ণনা থেকে জানা যায়, নেপোলিয়ন নাকি একটি সামরিক অভিযান থেকে ফেরার সময় তার স্ত্রী জোসেফাইনকে চিঠি লিখে বলেছিলেন, তিনি তিন দিনের মধ্যে বাড়ি ফিরছেন এবং এই কয়েকদিন তার স্ত্রী যেন স্নান না করেন। এটা হচ্ছে, ‘ঘ্রাণ নেওয়ার মাধ্যমে ভালোবাসা প্রকাশের’ একটি উদাহরণ।

এ ব্যাপারে ওয়েইট বলেন, “এমন অনেক মানুষ আছেন, যারা ডিওডরেন্টের মত মানুষের শরীরের স্বাভাবিক ঘ্রাণের প্রতিও আকৃষ্ট। একজন কেন আরেকজনের গায়ের গন্ধের প্রতি আকৃষ্ট হবে? এর একটি কারণ হতে পারে তাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার ভিন্নতা।

কেন আমরা অ্যান্টিপারসপিরেন্ট বা ডিওডরেন্ট ব্যবহার করি

ড. জাইচার বলছেন, শরীরে ঘাম হওয়ার কারণ আছে। ঘাম দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। যদিও মাঝেমধ্যে মানুষ প্রয়োজনের অতিরিক্ত ঘামে। এটা হাইপারহাইড্রোসিস বা প্যাথলজিক সোয়েটিং হিসেবে পরিচিত। ঘামের নিজস্ব কোনো ঘ্রাণ নেই। তবে শরীরের চামড়ায় থাকা ব্যাকটেরিয়া ঘামকে দূষিত করে ওই বাজে গন্ধ সৃষ্টি করে।

“যদি আপনি এই বাজে গন্ধ দূর করে অ্যান্টিপারসপিরেন্ট ব্যবহার করে থাকেন, তাহলে সেটা সন্ধ্যায় ব্যবহার করাই ভালো। যেহেতু আমরা রাতে কম ঘামি, তাই রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে এটা ব্যবহার করলে তা ঘাম গ্রন্থিগুলো আটকে দিতে পারে।”

“কিন্তু যদি আপনি প্রয়োজনের অতিরিক্ত না ঘামেন, তাহলে এই পণ্য ব্যবহার সম্ভবত ভালো কিছু নয়। কারণ দেহের কিছু অংশে ঘামগ্রন্থি বন্ধ করে দিয়ে আপনি বরং অন্য অংশে বেশি ঘাম হওয়ার শঙ্কা জাগিয়ে তুলছেন,” বললেন নিউ ইয়র্ক সিটির রুসাক ডার্মাটোলজি ক্লিনিকের ত্বক বিশেষজ্ঞ ড. জুলি রুসাক।

ড. জাইচার জানান, খাদ্যাভাসও মানুষের ঘামে প্রভাব রাখে। যারা ব্রকলি, ফুলকপি বা এ ধরনের সবজি বেশি খান, তাদের ঘামের গন্ধে এসব খাবারের প্রভাব পড়ে।

“খাদ্যাভ্যাস, ত্বকের স্বাস্থ্য ও ত্বকে অনুজীবের উপস্থিতি আপনার শরীরের গন্ধকে প্রভাবিত করে। সুস্থ শরীর ও সুস্বাস্থ্যের মানুষের শরীরে দুর্গন্ধ হওয়ার কথা না।”

এই বিশেষজ্ঞরা জানালেন, আপনি যদি এসব পণ্য ব্যবহারের ক্ষেত্রে সবসময় বিদেশি পণ্য খুঁজতে থাকেন এটা চিন্তা করে যে, দেশি পণ্যে ভেজাল আছে, বা এগুলো ব্যবহার করলে ক্যানসার হতে পারে, সেক্ষেত্রে আপনার জানা থাকা দরকার যে এ ধরনের প্রচলিত ধারণা বা গুজবগুলোর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।

বরং ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা ও ত্বকের যত্নের পণ্যে অ্যালুমিনিয়াম লবণের মতো উপাদানের উপস্থিতি ভোক্তা ও উৎপাদক উভয়ের জন্যই উদ্বেগের কারণ বলে জানালেন রুসাক ডার্মাটোলজি ক্লিনিকের ত্বক বিশেষজ্ঞ ড. অ্যামান্ডা ডয়েল।

ডিওডরেন্ট ছাড়াও চলা যায়?

ডিওডরেন্ট একদমই ব্যবহার না করার ভালো ও খারাপ দুটো দিকই আছে। সেটা নির্ভর করে আপনি এবং আপনার চারপাশের মানুষ দেহের স্বাভাবিক ঘ্রাণের বিষয়ে কেমন অনুভব করছেন তার ওপর।

ড. ডয়েল বলেন, “আপনি ডিওডরেন্ট ব্যবহার বন্ধ করলে সময়ের সাথে সাথে আপনার দেহের একটি গন্ধ তৈরি হবে। যখন আপনি এসব পণ্য ব্যবহার করবেন না এবং বেশি ঘামতে থাকবেন, তখন আপনার ত্বকে ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক জন্মানোর ক্ষেত্র তৈরি হবে যা দেহের দুর্গন্ধ সৃষ্টির কারণ হবে।”

প্রতিদিন ভালোভাবে স্নান করলে এই ঝামেলা থেকে অনেকটাই মুক্ত থাকা যায় বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে মুখ, বগল ও যৌনাঙ্গের আশপাশের অংশ ভালো করে পরিষ্কার রাখা হলে দেহে ইস্ট ও ব্যাকটেরিয়া বেশি জন্মানোর সুযোগ থাকে না।

পাশাপাশি ঢিলেঢালা পোশাক, সুতির কাপড় ব্যবহার ও কাপড় ধোয়ার ক্ষেত্রে বেনজল পারঅক্সাইডের মত রাসায়নিকের ব্যবহার অতিরিক্ত ঘাম ও ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা রাখে।