ফোনের মধ্যে ডুবে থাকা নেশা নয়, অভ্যাস। আর এর থেকে পরিত্রাণের রয়েছে উপায়।
Published : 06 Apr 2025, 05:05 PM
এক ঘণ্টা কেটে গেছে— অফিসের জন্য প্রেজেন্টেশন তৈরি করা তো দূরের কথা, এখনও ফেইসবুকের একটা রিল শেষ করে অন্য আরেকটিতে ঢুকছেন। এই দৃশ্যটি অনেকের জীবনেই ঘটে।
ভাবুন তো, অফিসের গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ করতে বসেছেন বা পড়াশোনা শুরু করেছেন। হঠাৎ ফোনে একটা বার্তা আসলো, সেটার উত্তর দিতে গিয়েই খুলে ফেললেন ইনবক্স, সেখান থেকে ইন্সটাগ্রাম, তারপর ইউটিউব।
এরপর মনে হল, ‘আরে, একটা শার্ট বা কুর্তিতে অফার চলতেছে, একটু দেখে নিই!’ আর এভাবেই কাজ না করে সময় পেরিয়ে যাচ্ছে।
অনেকেই এই পরিস্থিতিতে দোষ দেন মোবাইল ফোনকে। তবে সম্প্রতি একটি গবেষণা বলছে, সমস্যাটা কেবল ফোনে নয়— আমরা নিজেরাও দায়ী।
এই গবেষণা করেছেন যুক্তরাজ্যের ‘ইউনিভার্সিটি অব দ্য আর্টস লন্ডন’-এর মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং ‘লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্স’-এর গবেষক ও অতিথি অধ্যাপক ডা. ম্যাক্সি হাইটমায়ার।
‘ফ্রন্টিয়ার্স ইন কম্পিউটার সায়েন্স’-এ সাময়িকীতে প্রকাশিত এই গবেষণায় ২২ জন অংশগ্রহণকারীদের দুটি পাঁচ ঘণ্টার কম্পিউটার-ভিত্তিক কাজ করার সময় পর্যবেক্ষণ করা হয়।
একবার তাদের মোবাইল ফোন ছিল হাতে পৌঁছানোর মতো জায়গায়, অন্যবার ফোন রাখা হয়েছিল দূরে, যেখানে পৌঁছাতে হলে উঠে যেতে হয়।
দেখা যায়, ফোন কাছে থাকলে তারা দ্বিগুণ সময় ফোনে কাটিয়েছেন। কিন্তু যখন ফোন দূরে ছিল, তখন তারা ফোনের পরিবর্তে কম্পিউটারেই অন্য কাজ বা বিনোদন খুঁজেছেন।
“এই গবেষণায় উঠে এসেছে এক গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতা— আপনি চাইলে ফোন ছাড়াও মনোযোগ হারাতে পারেন! অর্থাৎ ফোনটা সমস্যার মূল নয়, বরং আপনার অভ্যাস ও আচরণই অনেক বেশি দায়ী”- সিএনএন ডটকম’য়ে মন্তব্য করেন এই গবেষক।
শিক্ষার্থী, চাকরিজীবী কিংবা গৃহিণী— প্রায় সবার জীবনে মোবাইল ফোন একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। তবে একই সঙ্গে এটি হয়ে দাঁড়িয়েছে সময় নষ্টের বড় কারণও।
অনেক শিক্ষার্থী পড়তে বসে ফেইসবুক বা ইউটিউবে ঢুকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় নষ্ট করে ফেলে। অফিসে বসেও মাঝে মাঝে ‘একটু রিল দেখি’ বলতে বলতে দুপুরের খাবার সময়টাও পার হয়ে যায়।
এই গবেষণার আলোকে দেখা যাচ্ছে, মোবাইল ফোন নিষিদ্ধ করলেই যে সমস্যা মিটে যাবে, তা নয়। ফোন নিষিদ্ধ করলেও মানুষ বিকল্প উৎস থেকে মনোযোগ হারাতে পারে— যেমন: কম্পিউটার, পাশের সহকর্মী কিংবা জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকা।
ডা. হাইটমায়ারের বক্তব্য অনুযায়ী, “আসল সমস্যা আমাদের অভ্যন্তরে। মস্তিষ্ক প্রায়ই নিজেই একটি ‘ব্রেক’ খুঁজে বেড়ায়। সে বিরতির সময় অনেকেই আমরা ফোন বা অন্যান্য স্ক্রিনে আশ্রয় নিই।”
তিনি ২০২১ সালে আরও একটি গবেষণায় দেখিয়েছেন, কোনো নোটিফিকেশন বা আওয়াজ না করলেও ৮৯ শতাংশই ফোন পরখ করেছেন নিজ ইচ্ছায়।
তখন মনে হয়— ‘কিছু মিস হয়ে যাচ্ছে না তো?’ আর এই ‘ফিয়ার অব মিসিং আউট’ বা ফোমো (FOMO)-ই ফোনের কাছে টেনে নিয়ে যায়।
কী করা যেতে পারে?
ডা. হাইটমায়ার বলেন, “যদি ফোন কম ব্যবহার করতে চান, তাহলে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হল ফোনটিকে দৃষ্টির বাইরে ও হাতের নাগালের বাইরে রাখা।”
গবেষণায় দেখা গেছে, ফোন দূরে থাকলে মানুষ তা ব্যবহার করতে দ্বিগুণ অনিচ্ছুক হয়, কারণ তখন তাকে উঠে গিয়ে ফোন আনতে হয়।
তিনি বলেন, “ফোন যদি পৌঁছানোর জন্য উঠতে বাধ্য করে, তাহলে মানুষ অনেক সময় সেটা করতেই চান না।”
তবে তিনি আরও বলেন, “এই আসক্তি নেশার মতো নয়। বরং এটি অভ্যাসের বিষয়।”
নেশায় সাধারণত সময় যত যায়, চাহিদা তত বাড়ে। কিন্তু ফোনের ক্ষেত্রে এর উল্টো— যত বেশি ফোন ব্যবহার করবেন, ততই ফোনে আটকে পড়বেন।
আর যত কম ব্যবহার করবেন, ততই অন্য কিছুতে মনোযোগ দিতে পারবেন।
একই মত দিয়েছেন কানাডার ‘ইউনিভার্সিটি অব আলবার্টা’র ভোক্তা আচরণ বিষয়ক অধ্যাপক ডা. নোয়া ক্যাসেলো।
তিনি বলেন, “ফোনে ইন্টারনেট ব্লক করে দিলে মানুষ পড়াশোনা, বই পড়া, সামাজিকতা বা ব্যায়ামের মতো গঠনমূলক কাজে বেশি সময় ব্যয় করে।”
এদিকে, মায়ামি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. পল পাভলো ২০২১ সালের এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, ক্লাসে মোবাইল নিষিদ্ধ করলে শিক্ষার্থীরা ভালো ফল করে।
তবে ফোনকে শিক্ষায় সহায়ক হিসেবে ব্যবহার করলে ফলাফল আরও ভালো হয়।
এই অবস্থায় ডা. হাইটমায়ার বলেন, “আমরা সব দায় ফোনের ওপর দিয়ে দিই। তবে আসল সমস্যা নিজের অভ্যাসে। যদি বুঝতে পারেন কীভাবে কোন অ্যাপ মনোযোগ ধরে রাখে, তাহলে সেই ফাঁদে কম পড়বেন।”
তরুণদের জন্য বার্তা কী?
যুক্তরাষ্ট্রের সাংবাদিক ও লেখিকা এবং ‘দ্য ডিসএনগেইজড টিন’ বইয়ের সহ-লেখক জেনি অ্যান্ডারসন বলেন, “কিশোর-কিশোরীদের মাঝে প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে আলোচনায় বসা জরুরি। তারা কী দেখছে, কত সময় ধরে দেখছে আর সেই দেখার পর তারা মানসিকভাবে ক্লান্ত না চাঙা— এসব প্রশ্ন তাদের কাছে করা উচিত।”
অর্থাৎ এখন এমন একটি যুগ চলছে, যেখানে ‘ডিজিটাল লিটারেসি’ মানে শুধু নিরাপত্তা বা তথ্য যাচাই নয়, বরং এটি বোঝাও দরকার যে- কখন নিজে প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণে আছেন, আর কখন নিজেই নিজের সময়ের নিয়ন্ত্রণে আছেন।
গবেষণা বলছে, মোবাইল ফোন নিজে থেকে মনোযোগ নষ্ট করে না, বরং নিজেরাই বারবার সেই প্রযুক্তির দ্বারস্থ হই।
তাই ফোনের ব্যবহার কমাতে হলে প্রযুক্তিকে দোষ না দিয়ে নিজের অভ্যাসে পরিবর্তন আনাই সবচেয়ে কার্যকর পথ।
ফোনটা যদি একটু দূরে থাকে, হয়ত ফোনের বদলে তখন প্রকৃতিতে একটু হাঁটতে বেরিয়ে যাবেন—সেটাই তো ভালো, তাই না?
আরও পড়ুন
যৌন জীবন নষ্টের পেছনে স্মার্টফোন
সন্তানের ফোনের ব্যবহার কমাবেন যেভাবে