কয়েক সেকেন্ডের জন্য চিতাবাঘ দুটি পথের মাঝে এসে বনে ঢুকে গেল।
Published : 12 Mar 2024, 12:02 PM
ইয়ালা ন্যাশনাল পার্ক পৃথিবীর অন্যতম লেপার্ড বা চিতাবাঘ সমৃদ্ধ একটি বন। আর শ্রীলঙ্কার দ্বিতীয় বৃহৎ জঙ্গল।
ভারত মহাসাগরের দেশ শ্রীলঙ্কা ভ্রমণের অন্যতম উদ্দেশ্যে ছিল ইয়ালা ন্যাশনাল পার্কে সাফারি করা।
ভারত মহাসাগর লাগায়ো এই বনের পরিধি প্রায় ৯শ’ ৭৯ বর্গ কিলোমিটার। শ্রীলঙ্কা সফরের তৃতীয় দিনে ইয়ালা ন্যাশনাল পার্কে সাফারি সিন্ধান্ত নিই। এর আগের দিনে নুয়ারা এলিয়া ট্রেনে চেপে রওনা হই শ্রীলঙ্কা অন্যতম সুন্দর শহর এলার উদ্দ্যেশে।
শ্রীলঙ্কায় বেড়াতে আসা পর্যটকদের ট্যুর আর্টিনারিতে ৪ ঘণ্টার এই ভ্রমণ প্রায় আবশ্যক বলা যায়। রাতের এলা শহর বেশ পরিপাটি। অনেকটা ইউরোপীয় শহরের মতো।
এলা স্টেশন ঘেঁষেই শহর। সেখানে পর্যটকদের পথচারণায় মুখর। প্রতিটি রেস্তোরাঁ পর্যটকে ঠাঁসা। রাতের এলা যেন উৎসবের নগরীতে পরিণত হয়েছে। পর্যটন মৌসুমে এমন চিত্র প্রায় প্রতিদিনই চোখে পড়ে।
এলাতে অবস্থানকালীন ইয়ালাতে সাফারির সব পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়। শ্রীলঙ্কায় বসবাসরত বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বৌদ্ধ ভিক্ষু ধর্মকৃতি থেরো আমাদের শ্রীলঙ্কা সফরে পুরো পরিকল্পনা সাজিয়ে দিয়েছেন। পরিকল্পনা মোতাবেক দুপুর ১২টায় পাহাড়ি শহর এলা ছেড়ে রওনা হলাম ইয়ালার উদ্দ্যেশে।
পাহাড়ি পথ; সড়কটি আঁকাবাঁকা। বন্ধুর পথ পেরিয়ে দুই ঘণ্টার ব্যবধানে আমরা টিস্সা শহরে এসে পৌঁছাই। ঘড়ির কাটায় তখন বেলা ২টা। দ্রুত সাফারি শুরু করতে হবে। হোটেলে চেক ইন করেই ক্যামেরা নিয়ে রওনা হলাম ইয়ালা ন্যাশনাল পার্কের উদ্দ্যেশে।
আগে থেকে হোটেলের সামনে অপেক্ষমাণ সাফারি গাড়িতে চেপে বসলাম। ছোট শহর টিস্সা পেরিয়ে যাচ্ছি। কোথাও কোথাও ছোট গ্রাম, ধানক্ষেত, লেক এসবের দেখা মিলছে। প্রায় ৪০ মিনিটের দূরত্বে সাফারির গাড়ি এসে থামল টিকেট কাউন্টারে।
সার্কভুক্ত নাগরিক হওয়াতে জনপ্রতি ২০ ডলার খরচ গুনতে হল। শ্রীলঙ্কান রুপিতে ৬ হাজার ৩শ’। চার জনের খরচ পড়ল ২৫ হাজার ২শ শ্রীলঙ্কান রুপি।
সাফারির শুরুতেই গাইড কাম চালক রতনা একাডকে বলা হল- সাফারির প্রধান লক্ষ্য লেপার্ড বা চিতাবাঘের ছবি তোলা। বিকেল ৩টার দিকে শুরু হল আমাদের অভিযাত্রিক সাফারি।
২০১৮ সাল থেকে বন্যপ্রাণীর ছবি তুলছি। তবেই এটিই দেশের বাইরে প্রথম সাফারি। এই অন্য রকম অনুভূতি।
অধরা স্বপ্ন অবশেষে বাস্তবায়িত হচ্ছে! সাফারির শুরুতেই চোখে পড়ল সুস্বাদু পানির কুমির। বেশ বড়। ২০০০ সালে আমাদের দেশে এই প্রজাতির কুমিরকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে পরিবেশ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সংস্থা আইই্উসিএন (ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনসারভেইশন অব নেচার)।
বিশ্বব্যাপী সংকটাপন্ন এই প্রাণীর দর্শন ইয়ালা সর্ম্পকে সাফারি শুরুতেই ভালো একটা ধারণা দিল। অল্প দূরত্বে বেশ কয়েকটা কুমিরের দেখা পেয়ে গেলাম। ক্যামেরায় পর্যাপ্ত ছবি তুলে এগুতে থাকলাম।
এবার চোখে পড়ল বন্য জল মহিষ। এটি আইইউসিএন এর লাল তালিকায় বিপন্ন। একাধিক বন্য মহিষের পাল পানিতে ডুবে বিশ্রাম নিচ্ছে।
সময়ের সাথে এগিয়ে চলেছে আমাদের সাফারি জিপ। ধূসর প্রান্তর। অদূরে ভারত মহাসাগরের ঢেউ আছড়ে পড়ছে। লোনা জলে ডুব দিয়ে আছে সংকটাপন্ন বন্য জল মহিষ। বনে তৃণভূমি জুড়ে হরিণ ও বন্য শুকরের বিচরণ।
ইয়ালা বন ভেদ করে চলেছে গেছে লাল মাটির রাস্তা। রাস্তা ধরে এগুলে চোখে পড়ে ময়ূর। এছাড়া এশিয়ান এলিফ্যান্ট, পেলিকন, মানিকজোড়, ঈগলসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি।
পুরো বনে এক চক্কর শেষে সাময়িক বিরতি দিয়ে আবার সাফারি শুরু হল। বলা যায় বৈকালিক সাফারির শেষটা শুরু হয়েছে।
সারাদিনে কেউ তখনও ইয়ালার মূল আর্কষণ লেপার্ড বা চিতাবাঘের দেখা মেলেনি। আমার ভ্রমণ বন্ধুদের মধ্যে অজিত বড়ুয়া চিতার দর্শন পেতে বেশ মরিয়া হয়ে উঠেছিল। কিন্তু দর্শন না পাওয়ায় সবার চোখে মুখে হতাশা।
শ্রীলঙ্কায় আমার ভ্রমণের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল লেপার্ড বা চিতাবাঘের ছবি তোলা। পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধ বন-ইয়ালা ন্যাশনাল পার্কে শ্রীলংকান লেপার্ডের মাঝে মাঝে দেখা পাওয়া যায়। ভারত মহাসাগর ঘেষা এই বিশাল বনে লেপার্ড’য়ের অস্তিৃত্ব রয়েছে।
আইইউসিএন’য়ের জরিপে লেপার্ড বা চিতাবাঘকে বিপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। স্বল্প দিনের ট্যুর আর্টিনারি অনুযায়ী ইয়ালা’র বনে অর্ধেক দিনের বেশি সাফারি করা অসম্ভব ছিল। প্রায় দুই ঘণ্টার সাফারিতে জীবনে প্রথমবারের মতো অনেক বন্যপ্রাণী ও পাখি দেখেছি।
বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা হতে চলল। লেপার্ডের কোনো সাড়া শব্দ নেই। বিভিন্ন প্রাণীর ছবি তুলে ভালো লাগছিল। কিন্তু লের্পাড দর্শন না পাওয়ায় আক্ষেপও হচ্ছিল।
সাফারির প্রায় শেষ দিকে শ্রীলঙ্কার জাতীয় পাখি- বন মোরগের ছবি তুলছিলাম। তখন আমাদের চালক কিছু একটা ইশারা করে উল্টো পথে দ্রুত এগুলোতে থাকল। অনুমান করছিল সামনে হয়ত লের্পাড পাব।
শেষ মুহূর্তে একটা নাটকীয়তা! সাফারি সড়ক ধরে লাগায়ো বনে লের্পাডের অবস্থান আন্দাজ করছিল। কিন্তু দর্শন পাচ্ছিলাম না। কিছুক্ষণ রাস্তার ওপর বসে ছিল তখন ছবি তোলার সুযোগ নেই। রাস্তা ত্যাগ করে একটা লের্পাড বনের ঘন ঝোপের আড়ালে চলে গেল। তার বের হওয়ার রাস্তা বরাবর লেন্স রেখেছিলাম। ঝোপ থেকে বেরিয়ে এল বহুল প্রত্যাশিত শ্রীলঙ্কান লেপার্ড।
একসাথে একজোড়া! চোখ দিয়ে দেখব নাকি ছবি তুলব- এমন বিভ্রান্তি কাটাতে কয়েক সেকেন্ড লেগে গেল। অবশেষে দুটোকেই ফ্রেমবন্দি করতে পেরেছি। অধরা স্বপ্ন ধরা দিল।
ছয় থেকে ১০ সেকেন্ডের মধ্যে লের্পাডগুলো বনের জঙ্গলে ডুকে গেল। ইয়ালার বনে অভিযাত্রিক সাফারি যেন পূর্ণতা পেল।
চিতার ছবি তোলার পর বন থেকে বের হওয়ার পালা। পশ্চিমের আকাশে সন্ধ্যা নামছে। রিসোর্টে ফিরতে ফিরতে ভেসে উঠছে ইয়ালার চিত্রপট। যেন এক আদিমতা রেখে ফিরে যাচ্ছি নাগরিক সভ্যতার দিকে। মনের দৃশ্যপটে আটকে আছে মায়া হরিণের চোখ।
প্রয়োজনীয় তথ্যশ্রীলংকার রাজধানী কলম্বো থেকে ইয়ালা ন্যাশনাল পার্কের দূরত্ব ৩শ’ কিলোমিটার। রির্জাভ গাড়িতে যেতে ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা সময় লাগবে। অনলাইনে যোগাযোগ করে আগে থেকেই সাফারির গাড়ি ঠিক করে নেওয়া যাবে। ইয়ালার বনে সার্কভুক্ত দেশের নাগরিকদের প্রবেশ ফি ২০ ডলার। তবে অফ সিজনে ১৫ ডলার। আধাবেলা সাফারি করতে গাড়ি ভাড়া পড়ে ১৫ থেকে ২০ হাজার শ্রীলঙ্কান রুপি। সাফারিতে পানিসহ হালকা খাবার সাথে নিতে হবে। ইয়ালা ন্যাশনাল পার্কের পাশে বেশ কয়েকটি রির্সোট আছে।