মোঘল সাম্রাজ্য পতনের কারণগুলো

ইতিহাসের দিদিমণি খুব কড়া প্রকৃতির মানুষ। প্রতিদিন ক্লাসে পড়া ধরেন।

তপন রায়চৌধুরীতপন রায়চৌধুরী
Published : 31 May 2023, 10:15 AM
Updated : 31 May 2023, 10:15 AM

ইতিহাসের দিদিমণি খুব কড়া প্রকৃতির মানুষ। প্রতিদিন ক্লাসে পড়া ধরেন। আজ আবার একটু অন্যরকম শাসন। ক্লাসের সবাইকে লিখতে দিয়েছেন একটা প্রশ্ন- ‘মোঘল সাম্রাজ্য পতনের কারণগুলো উল্লেখ কর।’

এই হচ্ছে আজকের পাঠ্যবিষয়। সবাইকে লিখে উত্তর দিতে বলেছেন। এই সুলেখা আন্টির ক্লাসে সবাইকে পড়া শিখে আসতে হয়। না হলে খুব বকাঝকা করেন, কান ধরে বেঞ্চির ওপর দাঁড় করিয়ে দেবেন, কিংবা আরও অন্যরকমের শাস্তি।  

রুমুও তটস্থ থাকে। সে চেষ্টা করে ঠিকমতো পড়া শিখে আসতে। কিন্তু ইতিহাস বিষয়টাতে সে তেমন উৎসাহ পায় না। রুমু সবসময় সত্য কথা বলে। ওর এ গুণ সুলেখা আন্টিকে মুগ্ধ করে। তাছাড়া রুমুর ব্যবহার এতই মিষ্টি যে পড়া না পারলেও সুলেখা আন্টির শাস্তির হাত থেকে সে কখনো কখনো রেহাই পেয়ে যায়।

সুলেখা আন্টির দেওয়া প্রশ্নের উত্তর সবাই লিখছে মন দিয়ে। আন্টি বসে আছেন চেয়ারে। ক্লাসে পিন পড়লে আওয়াজ পাওয়া যায়। রুমু আজ একেবারেই তৈরি হয়ে আসেনি। সে বসে আছে চুপটি করে। এক অক্ষরও ইতিহাস বেরোচ্ছে না কলম দিয়ে। হঠাৎ কেমন যেন আনমনা হয়ে যায় রুমু। তারপর কী হল কে জানে, তার মনের মধ্যে গান ভেসে উঠল।

কিন্তু আজ ইতিহাসের ক্লাসে বিভিন্ন গানের কলি বারবার ভেসে আসছে কেন তার মনে! রুমু ভেবে পায় না। চেষ্টা করেও সে নিজেকে সামলাতে পারছে না যেন!

ছোটবেলা থেকেই রুমু গান করে। তার গানের গলা খুব সুরেলা। গাইতে বললে রুমু আর কিছুই চায় না। না খেয়ে রুমু অনেকক্ষণ থাকতে পারে, কিন্তু একদিন গান না করতে পারলে নাভিশ্বাস উঠবে। এককথায় গান আর রুমু যেন সমার্থক। চোখ বুজে রুমু যখন গান করে তখন দেখে মনে হয় ধ্যান করছে। রুমু এখন ক্লাস সেভেনে পড়ে। এই ছোট বয়সেই সে অনেক বড় বড় জায়গায় গানের ফাংশন করে চলেছে। রবীন্দ্রসঙ্গীত, আধুনিক, হিন্দি, প্রায় সবরকম গানেই রুমুর পারদর্শিতা আছে। তবে মূলত রবীন্দ্রসঙ্গীতের জন্যই রুমুর ডাক পড়ে। স্কুল কর্তৃপক্ষ তো রুমুকে নিয়ে গর্ব করে। নানারকম গানের প্রতিযোগিতায় রুমু সবার সেরা সবসময়।

কিন্তু আজ ইতিহাসের ক্লাসে বিভিন্ন গানের কলি বারবার ভেসে আসছে কেন তার মনে! রুমু ভেবে পায় না। চেষ্টা করেও সে নিজেকে সামলাতে পারছে না যেন! সে খাতার পাতায় গানের কথাগুলো লিখতে শুরু করে দিল। এক একবার ভাবে, কাজটা ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু কী করে সে নিজেকে থামাবে, ভেবে পায় না। গানের পর গান লিখে চলল রুমু এক অদ্ভুত আনন্দে। তার মনে হল, সে যেন কোনো এক অজানা আনন্দ সাগর পাড়ি দিচ্ছে।

একসময় থামল রুমুর কলম। হঠাৎ সুলেখা আন্টির কথা তার কানে ভেসে এল, ‘কী হল রুমু, লেখা হয়ে গেছে?’ রুমু এক তীব্র আশঙ্কায় শিউরে উঠল। এই বুঝি সুলেখা আন্টি তার খাতা চেয়ে বসেন। জিজ্ঞেসও করলেন আরেকবার, ‘মোঘল সাম্রাজ্যের পতনের কারণগুলো লেখা হয়ে গেছে?’ রুমু সম্মোহিতের মতো সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ল। চেয়ারে বসেই সুলেখা আন্টি বললেন, ‘ঠিক আছে, খাতাটা বন্ধ করে রেখে দাও।’

যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল রুমু। যাক, তাহলে খাতাটা চাননি! কিছুক্ষণ বাদেই সুলেখা আন্টির কী যেন মনে হল, রুমুর কাছে গিয়ে ওর খাতাটা দেখতে চাইলেন। রুমুর অবস্থা তখন ভয়ঙ্কর সঙ্গিন। খাতাটা বন্ধ অবস্থাতেই রুমু সেটা দিয়ে দিল সুলেখা আন্টির হাতে। খাতার পাতায় পাতায় গানের পর গান লেখা, তাই দেখে সুলেখা আন্টির চক্ষু চড়কগাছ! বিস্ময়ে হতবাক হয়ে রুমুর দিকে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ, তারপর রুমুকে বকা শুরু করলেন ভয়ঙ্কর রকম।

এখানেই থামলেন না সুলেখা আন্টি, ক্লাসের অন্যান্য মেয়েদের সবাইকে পড়ে শোনালেন রুমুর কীর্তিকলাপ। রুমু অসহায়ের মতো কাঁদতে থাকল। শেষ পর্যন্ত রাগে সুলেখা আন্টি ক্লাস ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। রুমুর বন্ধুরা হতবাক হয়ে চেয়ে রইল। রুমু কাঁদতে থাকল অঝোরে।

কিছুক্ষণ পর রুমুর ডাক পড়ল হেড আন্টির ঘরে। সেখানে গিয়ে রুমু দেখল, হেড আন্টির ঘরে সুলেখা আন্টি বসে আছেন। রুমুর বুঝতে বাকি থাকল না, ইতোমধ্যে হেড আন্টি সব জেনে গেছেন। হেড আন্টি জিজ্ঞেস করলেন, ‘এসব কী লিখেছো তুমি? এগুলো মোঘল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ?’ রুমু চুপ। আরও কয়েকবার হেড আন্টি প্রশ্নটা করলেন রুমুকে। রুমু মাথা নিচু করে রইল। রুমুকে বলা হল, পরের দিন বাবাকে সঙ্গে নিয়ে স্কুলে আসতে।

বাড়িতে ফিরে রুমু মনমরা হয়ে থাকল কিছুক্ষণ। আজকের স্কুলের দিনটা তার একাধারে আনন্দের এবং দুঃখের। আনন্দের কারণ, সে যখন ইতিহাসের ক্লাসে গানের কলি দিয়ে পাতার পর পাতা ভরিয়ে তুলছিল তখন যেন সে অদ্ভুত এক ভালোলাগার আবেশে ডুবে ছিল, সেই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। কিন্তু তারপর থেকে চলছে নানা হেনস্তা। কিন্তু রুমু অবাক হয়, এক্ষেত্রে সত্যিই তার করণীয় কিছুই ছিল না, সেকথা বোধহয় ও নিজে ছাড়া আর কেউ বুঝবে না। রুমু সত্য কথা বলে। সে বাবাকে সবকিছু খুলে বলল। যথারীতি বাবার কাছ থেকে যথোপযুক্ত তিরস্কার পেল সে।

তারপর সাত বছর কেটে গেছে। সেদিনের রুমু আজ উনিশ বছরের তরুণী। স্কুল পাশ করে রুমু এখন কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী।

পরের দিন বাবার সঙ্গে স্কুলে গেল রুমু। একেবারে হেড আন্টির ঘরে। কিছুক্ষণ পর সুলেখা আন্টিকেও ডেকে পাঠানো হল। রুমুর বিচার হবে এখন। হেড আন্টি এবং সুলেখা আন্টি, দুজনে মিলে রুমুর বিরুদ্ধে সব নালিশ তার বাবাকে জানালেন। রুমুর বাবা করজোড়ে ক্ষমা চাইলেন হেড আন্টির কাছে, প্রতিশ্রুতি দিলেন, রুমু কখনো এ ধরনের কাজ আর করবে না।

তারপর একসময় হঠাৎ ঘটলো এক কাণ্ড। সুলেখা আন্টি রুমুর খাতাটা নিয়ে সবার সামনেই ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেললেন। সেই দৃশ্য রুমু সহ্য করতে পারল না। হঠাৎ আর্তনাদ করে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল সে। সবাই হতবাক। চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিয়ে রুমুর জ্ঞান ফেরানো হলো। চোখ মেলে রুমু দেখতে পেল, তার চোখের সামনে গোটা আকাশ, সে শুয়ে আছে একটা বেঞ্চের ওপরে। কী ঘটেছিল, তার সবকিছু মনে পড়ে গেল এক নিমেষে। হতাশায় অবসন্ন হয়ে ক্ষণিকের জন্য চোখ বুজে ফেলল। সে আর কাউকেই দেখতে চায় না। এই পৃথিবীটাকে খুব নির্মম বলে মনে হলো তার।

তারপর সাত বছর কেটে গেছে। সেদিনের রুমু আজ উনিশ বছরের তরুণী। স্কুল পাশ করে রুমু এখন কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। বিষয় কম্পিউটার সায়েন্স অনার্স। কিন্তু এখনো সে গান-পাগল। গান রুনুর সমস্ত সত্তা জুড়ে। নানা ঝড়ঝাপটার মধ্য দিয়ে বড় হয়েছে রুমু। সে যখন ক্লাস টেনে পড়ে, তখন তার মা মারা যান। বাবা স্বর্ণ-ব্যবসায়ী। জলখাবার খেয়ে বেরিয়ে যান সকাল আটটায়, দোকানে বসেন। ফেরেন দুপুর তিনটে নাগাদ। দুপুরের খাওয়া সেরে বিশ্রাম করেন ঘণ্টাখানেক। তারপর আবার দোকানে গিয়ে বসেন, ফেরেন রাত দশটায়।

রুমুর একটা ছোট ভাই আছে। তার পড়ালেখা এবং অন্যান্য যাবতীয় কিছু দেখাশোনা রুমুই করে আসছে। সে এখন অনেক ম্যাচিউরড। নিজের পড়াশোনা এবং ভাইয়ের সবকিছু দেখাশোনার পাশাপাশি সে সঙ্গীতচর্চাও করে যাচ্ছে নিয়ম করে।

একদিন ভাইয়ের স্কুলে যাচ্ছিল রুমু। স্কুল থেকে বইয়ের লিস্ট দেবে। রুমুর কাজ ছিল ভাইয়ের জন্য বইয়ের লিস্ট আনা। অটোতে চেপেই রুমু দেখল, একজন বছর চল্লিশের নারী বসে আছেন অটোতে, বাইরের দিকে মুখ করে। খুব চেনা মনে হল রুমুর। হঠাৎ মনে পড়ে গেল, সেই সাত বছর আগের ঘটনার কথা, রুমু ‘মোঘল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ’ লেখার বদলে খাতাভর্তি লিখে গিয়েছিল গানের পর গান। এ তো সেই সুলেখা আন্টি!  বিস্মিত রুমু বলে উঠল, ‘আমাকে চিনতে পারছেন আন্টি, আমি সেই রুমু, যে আপনার ক্লাসে ইতিহাসের বদলে গানের পর গান লিখে খাতা ভরিয়ে দিয়েছিল?’ সুলেখা আন্টির সেসব ভোলার কথা নয়। প্রথমটায় তিনি বেশ হকচকিয়ে গেলেন, তারপর মাথা নিচু করলেন। হয়তো লজ্জা পেলেন তার সেদিনের ব্যবহারে।

কিন্তু পরমুহূর্তে রুমুর সরল নিষ্পাপ হাসির কাছে তিনি হার মানলেন। আবেগে জড়িয়ে ধরলেন রুমুকে, তারপর এক নিশ্বাসে বলে গেলেন, ‘সেদিন আমি তোমার সঙ্গে খুব অন্যায় করেছিলাম, আমাকে ক্ষমা করো। আজ তোমাকে দেখে আমার খুব ভালো লাগছে।’ কথাগুলো বলতে বলতে সুলেখা আন্টির দু’চোখ জলে ভরে উঠলো। তিনি রুমুকে কাছে টেনে নিলেন এবং কপালে গালে চুমোয় ভরিয়ে দিলেন।

রুমুর ভেতরটা আনন্দে ভরে উঠলো, চোখের জলে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে গেল। শেষে রুমু আর সামলাতে পারলো না নিজেকে। সে তার সুলেখা আন্টিকে জড়িয়ে ধরে অঝোর ধারায় কেঁদে চলল সমানে।