শতবর্ষ ধরে চলা তাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় বিশেষ কিছু দিক আছে যেগুলো একজন শিক্ষার্থীকে আলাদা করে তোলে।
Published : 03 Dec 2023, 12:47 AM
জাপানে স্কুলকে জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে দেখা হয়। সেখানে বছরে ২১০ দিন স্কুলে ক্লাস চলে। জাপানি শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে অনেক দেশের মিল আছে বটে। কিন্তু শতবর্ষ ধরে চলা তাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় বিশেষ কিছু দিক আছে যেগুলো একজন শিক্ষার্থীকে অন্যান্য দেশের শিক্ষার্থীদের থেকে আলাদা করে তোলে। তাকে একজন ভালো মানুষ হয়ে বেড়ে উঠতে সহায়তা করে।
১. ক্লাসে ঘুমানো ‘ভক্তির লক্ষণ’
সাধারণত অনেক দেশে ক্লাসে ঘুমিয়ে গেলে অনেকটা ‘অপরাধ’ হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু জাপানে ক্লাসের সময় ঘুমিয়ে পড়া খুব সাধারণ দৃশ্য হতে পারে। অন্যান্য দেশে ক্লাসে ঘুমানো অসম্মান বা অলসতার লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা হলেও জাপানে এটিকে সবসময় ‘ভক্তির লক্ষণ’ হিসেবে দেখা হয়।
২. চতুর্থ শ্রেণির আগে পরীক্ষা নয়
এটা আমাদের কাছে অদ্ভুত মনে হতে পারে। কিন্তু জাপানি স্কুলগুলো জ্ঞানের চেয়ে আচরণকে প্রাধান্য দেয়। প্রথম তিন বছরের জন্য তাদের লক্ষ্য হলো শিশুর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য গড়ে তোলা, ভালো আচরণ শেখানো, শিশু কতোটা জ্ঞানী হলো সেটা বিচার করা নয়। কীভাবে উদার, সহানুভূতিশীল হতে হয় জাপানের শিশুরা তা স্কুল থেকে শেখে। জাপানি শিশুদের অন্যকে সম্মান করা, প্রকৃতিকে ভালোবাসতে শেখানো হয়। প্রাণীদের সঙ্গে ভালো বন্ধন গড়ে তোলার বিষয়টিও তারা স্কুলে থেকে শেখে।
৩. শিশুরা স্কুল পরিষ্কার করে
আমাদের দেশের স্কুল ও ক্লাসরুম পরিষ্কার করতে ঝাড়ুদার নিয়োগ দেওয়া হয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও তাই। কিন্তু জাপানে এটি করা হয় না। সেখানে শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষ, ক্যাফেটেরিয়া; এমনকি টয়লেট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করে। জাপানি শিক্ষা ব্যবস্থা বিশ্বাস করে, শিক্ষার্থীরা একসঙ্গে কাজ করলে একে অপরকে সহায়তা করতে ও দলবদ্ধ হয়ে কাজ করতে শেখে। তারা আরও বিশ্বাস করে, ডেস্ক মোছা, ঝাড়ু দেওয়া ও মেঝে পরিষ্কার করার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা নিজের কাজ ও অন্যের কাজকে সম্মান করতে শেখে।
৪. শিক্ষক-শিক্ষার্থী একসঙ্গে খাবার খায়
পৃথিবীর অনেক দেশেই শিক্ষকরা আলাদা বসে খাবার খান। কিন্তু এখানেও ব্যতিক্রম জাপান। সেখানে শিক্ষকরা তাদের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ক্লাসরুমে বসে খাবার খান। তারা বিশ্বাস করে, এটি শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে ইতিবাচক বন্ধন গড়ে তুলতে সহায়ক। তাছাড়া খাওয়ার সময় অনেক দরকারি কথোপকথন হতে পারে, যা পারিবারিক পরিবেশ তৈরিতে সহায়তা করে।
জাপানের শিশুরা শুধু বিষয়ভিত্তিক বই পড়ে না, তাদের ক্যালিগ্রাফি ও কবিতা লেখা শেখানো হয়।
আবার জাপানি শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যকর ও সুষম খাবার খাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে। তাই সরকারি প্রাথমিক ও জুনিয়র হাই স্কুলে দুপুরের খাবার পেশাদার ও যোগ্যতাসম্পন্ন শেফদের দিয়ে রান্না করানো হয়। এক্ষেত্রে মানসম্মত মেনু মেনেই খাবার রান্না করা হয়। আবার অনেক প্রাইমারি স্কুলে সপ্তাহে একবার শিশুরাই রান্না করে সহপাঠীদের খাওয়ায়।
৫. স্কুল-পরবর্তী কর্মশালা
জাপানে স্কুল-পরবর্তী কর্মশালা বা প্রস্তুতিমূলক স্কুল খুব জনপ্রিয়। সেখানে শিক্ষার্থীরা ছয় ঘণ্টার এই স্কুলের মাধ্যমে নতুন নতুন কিছু শিখতে পারে। প্রস্তুতিমূলক স্কুলের ক্লাসগুলো সাধারণত সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত হয়। বেশিরভাগ জাপানি শিক্ষার্থী এতে অংশ নেয়, যেন তারা একটি ভালো জুনিয়র হাই স্কুলে ভর্তি হতে পারে। জাপানের শিক্ষার্থীরা সাপ্তাহিক ছুটির দিনসহ অন্যান্য ছুটির দিনেও পড়ালেখা করে।
৬. জাপানি শিশুরা কবিতা ও ক্যালিগ্রাফি শেখে
জাপানের শিশুরা শুধু বিষয়ভিত্তিক বই পড়ে না, তাদের ক্যালিগ্রাফি ও কবিতা লেখা শেখানো হয়। জাপানি ক্যালিগ্রাফিকে যাকে ‘শোডো’ বলা হয়। এটি একটি শিল্প। এই শিল্পের মাধ্যম মানুষ অর্থপূর্ণ কাঞ্জি অক্ষরকে (চীনা অক্ষর যা জাপানি লিখন পদ্ধতিতে ব্যবহৃত হয়) সৃজনশীল উপায়ে লেখে। অন্যদিকে ‘হাইকু’ হলো কবিতার একটি রূপ। এর মাধ্যমে পাঠকের কাছে গভীর আবেগ প্রকাশে সহজ বাক্যাংশ ব্যবহার করা হয়। কবিতার এই রূপটির বুদ্ধিবৃত্তিক, থেরাপিউটিক ও নান্দনিক প্রভাব আছে বলে মনে করা হয়। এই উভয় ক্লাস শিশুদের শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্যকে সম্মান করতে ও তাদের সংস্কৃতিকে প্রশংসা করতে শেখায়।
৭. ইউনিফর্ম ও নামহীন রঙপেন্সিল ব্যবহার
একটি ক্লাসের সব শিক্ষার্থী একই ধর্ম-শ্রেণি-পেশা বা বিত্তের পরিবার থেকে আসে না। তাই ইউনিফর্ম তাদের একই দলবদ্ধ করে এবং কমিউনিটি বোধ জাগায়। তবে প্রত্যেকেরই আলাদা ড্রেস কোড থাকে যেন তাদের শিখন ও বেড়ে উঠা বোঝা যায় এবং সবার মাঝে থেকেও নিজেকে প্রকাশ করতে পারে। আরেকটি ব্যাপার হলো, জাপানের স্কুলগুলোতে রঙপেন্সিলের ওপর রঙের নাম লেখা থাকে না। এতে তারা আরোপিত বাধ্যবাধকতা পেরিয়ে নতুন রঙ তৈরি করতে শেখে।
ব্রাইটসাইট থেকে অনূদিত