উড়িতেছে সোনার ঘোড়া, দ্বিতীয় কিস্তি

মোবাইল থেকে পাতলাদার বানানো সোনার ঘোড়ার ছবিটা দেখাই জুরাইন থানার পেটমোটা দারোগা সর্বনাশ মিয়াকে। তিনি খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে তাকালেন আমার মোবাইল স্ক্রিনের উপর। দেখলেন সোনা দিয়ে বানানো ঝকঝকে তকতকে ঘোড়াটাকে।

মনি হায়দারমনি হায়দার
Published : 12 August 2022, 05:16 AM
Updated : 12 August 2022, 05:16 AM

বাইর কর রে! বাইর কর! পাতলাদার বাজখাই গলার চিৎকার। আমি ঢোক গিলি, পাতলাদা কী বের করবো?

পাতলাদা সাড়ে ত্রিশ সেকেন্ড আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। টেবিলের উপর থেকে অ্যালুমিনিয়ামের জগটা তুলে মুখের উপর ধরলেন। ঢগ ঢগ ঢগ করে আধা জগ পানি খাওয়ার পর টেবিলের উপর জগটা রেখে আমার দিকে তাকাতে তাকাতে ডান হাতের পাঞ্জায় মুখে লেগে থাকা পানি মুছলেন। বললেন, তোর মাথায় গত ত্রিশ বছরে এক ফোঁটাও বুদ্ধি চালান করে দিতে পারি নাই, দুঃখ আর কারে কয়।

জুরাইন থানার নতুন দারোগা পেটমোটা সর্বনাশ মিয়া, চিকন এস আই মাখন মিয়ার সামনে পাতলাদা আমাকে এইভাবে অপমান করছে, রাগে আমার ব্রহ্মতালু জ্বলছে। ব্রহ্মতালুটা কী? মাথা চুলকাতে চুলকাতে শুরু করলাম। জ্ঞানীরা বলেছে, কোনো প্রশ্ন মাথায় আসিলে তৎক্ষণাৎ উত্তর না পারিলে নিজ মাথার চুল চুলকালে, উত্তর চলিয়া আসে। আমি চুলকাচ্ছি আমার মাথার চুল, ধমকে ওঠেন পাতলাদা, তুই চুল চুলকাচ্ছিস কেনো? পাতলাদা ব্রহ্মতালু...

আমার কারখানায় তৈরি সোনার ঘোড়া হারিয়ে যাবার সঙ্গে তোর ব্রহ্মতালুর সম্পর্ক কী? তোকে তো পাবনা পাঠাতে হবে দেখছি। তোর মোবাইলে আমার সোনার ঘোড়ার ছবি তুলেছিস না? জি জি জি জি... আমি একনাগাড়ে আট নয়বার জি জি করতে থাকি। পেছন থেকে আবার খোঁচা, কান খাড়া করি, আকুলের গলা, তোমার কী হয়েছে ভোমলাদা? তুমি জুরাইনের বিশ্ববিখ্যাত মিস্টার পাতলাদার এ গ্রেডের সহকারী, মানে সাকরেদ। সেই তুমি যদি ভয় খাইয়া উল্টাপাল্টা শব্দ কও, ইজ্জত থাকবো? এটেনশান!

সঙ্গে সঙ্গে এটেনশানে দাঁড়িয়ে মোবাইল থেকে পাতলাদার বানানো সোনার ঘোড়ার ছবিটা দেখাই জুরাইন থানার পেটমোটা দারোগা সর্বনাশ মিয়াকে। তিনি খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে তাকালেন আমার মোবাইলের স্ক্রিনের উপর। দেখলেন সোনা দিয়ে বানানো ঝকঝকে তকতকে ঘোড়াটাকে। দেখেই খপ করে আমার হাত থেকে মোবাইলটা এক ধরনের ছিনিয়েই নিলেন। নিজের হাতে মোবাইলটা নিয়ে চোখে পুরো লেন্সের চশমা লাগিয়ে এদিক সেদিক করে, উল্টো ঝুলিয়ে বারবার দেখছিলেন। দেখার পর আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, তুমি এই ছবি কোথায় পেলে?

এসআই মাখন মিয়া! জলদগম্ভীর কণ্ঠে ডাক দেন জুরাইন থানার পেটমোটা দারোগা সর্বনাশ মিয়া। সঙ্গে সঙ্গে ফাটা বেলুন হয়ে গেলেন চিকন এসআই মাখন মিয়া। জি স্যার!

আমি তুলেছি আমার মোবাইলে। দেখেতো সত্যি মনে হচ্ছে। কিন্ত ছবিটা তো স্টিল। মানে স্থির। এইসব ছবি আজকাল ছেলেমেয়েরা বাসায় বসে আঁকতে পারে। অনেকে কম্পিউটারেও আঁকে, পেটমোটা দারোগা মিস্টার সর্বনাশ মিয়ার গলায় তুমুল সন্দেহ। জি স্যার, আপনে ঠিক কইছেন, এতোক্ষণ অনেক কষ্টে নিজেকে আটকে রাখার পর চিকন এসআই মাখন মিয়া বলে, আমিও আপনেরে এই কতাটাই কইতেছিলাম স্যার। কিন্তু আপনি আমার চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান, আগেই কইয়া দিছেন। এইসব ফলস স্যার, মানে বানানো। আর আপনার আমার মতো জরুরি কাজে ব্যস্ত অফিসারদের ডেকে এনে সময় নষ্ট করার জন্য জুরাইনের জনাব পাতলা খান এবং পাতলা খানের সাকরেদকে ধরে থানায় নিয়ে যাওয়া দরকার। থানায় নিয়ে হাত পা বেঁধে গাছে ঝুলিয়ে ডান্ডার বাড়ি মেরে...

এসআই মাখন মিয়া! জলদগম্ভীর কণ্ঠে ডাক দেন জুরাইন থানার পেটমোটা দারোগা সর্বনাশ মিয়া। সঙ্গে সঙ্গে ফাটা বেলুন হয়ে গেলেন চিকন এসআই মাখন মিয়া। জি স্যার! মাথা নুইয়ে কুনির্শ করতে করতে বলেন, বলুন স্যার আপনার আদেশ।

আপনি চুপচাপ বসুন।

জি স্যার, বসছি, চিকন এসআই মাখন মিয়া বসে চেয়ারে।

পেটমোটা দারোগা সর্বনাশ মিয়া তাকায় পাতলাদার চোখের দিকে, শুনুন মিস্টার পাতলা খান, জুরাইন থানায় আসার পর আমি প্রথম টেলিফোন পাই মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়ের কাছ থেকে। তিনি আমাকে বললেন, মিস্টার সর্বনাশ মিয়া আপনি হলেন চৌদ্দ ঘাটের পানি খাওয়া এক পুলিশ অফিসার। অনেক অভিজ্ঞতা আপনার। অপরাধীর চোখ দেখে আপনি বলে দিতে পারেন... যাই হোক, নিজের মনে করে খানিকটা গর্বিত হাসি হেসে নেয় জুরাইন থানার পেটমোটা দারোগা সর্বনাশ মিয়া এতক্ষণে পাতলাদার পায়ের দুলুনি কমে কমে একেবারে স্থির। মুখে মিটিমিটি গম্ভীর হাসি। আধা চোখে আমাদের দিকে তাকালেন একবার। আমরা বিনয়ে আহ্লাদে গলে যেতে লাগলাম।

পা দোলানোটা যখন ধীরে ধীরে মানে পাতলা পাতলা নাড়েন, তখন পাতলাদার মুড ভীষণ ভালো। আর যদি পা জোড়া ঘন ঘন নড়ে বা দোলায়, বুঝতে পারি পাতলাদা মেজাজ গরমে আসমানের দিকে উঠছে। ভয়ে আমরা আশপাশে মানে ত্রিশ কিলোমিটারের মধ্যে থাকি না। ছুটে বা দৌড়ে পালিয়ে যাই।

পাতলাদা দাঁতে দাঁত লাগিয়ে পেটমোটা দারোগাকে সহ্য করে যাচ্ছেন। তিনি ডান হাতলভাঙ্গা ঐতিহাসিক চেয়ারে বসে পায়ের উপর পা রেখে দুলিয়ে যাচ্ছেন। পা দোলানোটা যখন ধীরে ধীরে মানে পাতলা পাতলা নাড়েন, তখন পাতলাদার মুড ভীষণ ভালো। তখন আমাদের আম-কলা-কাঁঠাল-লিচু-পেয়ারা-আমড়া খাওয়ান, মাঝে মাঝে ঘিয়ে ভাজা পাতলা রসগোল্লাও ভাগে পাই। আর যদি পা জোড়া ঘন ঘন নড়ে বা দোলায়, বুঝতে পারি পাতলাদা মেজাজ গরমে আসমানের দিকে উঠছে। ভয়ে আমরা আশপাশে মানে ত্রিশ কিলোমিটারের মধ্যে থাকি না। ছুটে বা দৌড়ে পালিয়ে যাই।

সর্বনাশ মিয়ার ব্যবহারে পাতলাদার পা নড়ছে, খুব ঘন নড়ছে না, আবার পাতলা বা ধীরেও নড়ছে না। মাঝারি গতিতে নড়ছে। বুঝতে পারছি, জড় ছুটবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। যে কেনো সময়ে পাতলাদা...

মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমাকে বললেন, আপনাকে জুরাইন থানায় কেনো পাঠানো হয়েছে জানেন?

না স্যার, জানি না, আমি বললাম। আমি দারোগা, আমার কাজ চোর বদমাশ বাটপার চোরাকারবারীদের ধরে ধরে ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করা। সেজন্যই স্যার, আমি যে থানায় যাই সেই থানায় বেড়াল আর ইঁদুর এক ঘাটে পানি খায়। গরু চোর, বাঘ চোর, আলু চোর, পটল চোর একসঙ্গে ঘুমায়। এখন বলুন স্যার, কী আদেশ?

শুনুন, জুরাইনে আমাদের বিশ্ববিখ্যাত পাতলাদা থাকেন।

পাতলাদা? শুনেই আমি ভিরমি খাই। আমি কতো লোকের নাম শুনেছি, কিন্তু পাতলাদা নামে কারও নাম শুনি নাই স্যার। এই পাতলা মিয়া আবার কে?

তখন মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হেসে বললেন, ওনার প্রকৃত নাম পাতলা খান। যদিও পাতলা খান নাম, কিন্তু উনি মোটেই পাতলা না। উনি বেশ স্বাস্থ্যবান আর ব্যায়ামবীর। পৃথিবীর অনেক বড় বড় ঘটনা উনি ঘটিয়েছেন, তো উনি জুরাইনের না গোটা বাংলাদেশের অহংকার। আমরা জানতে পেরেছি জুরাইনের পাতলা খানের সাফল্যে ঈর্ষাবশত পাশের ফাঁকিস্তানের একদল শত্রু...

এতক্ষণে পাতলাদার পায়ের দুলুনি কমে কমে একেবারে স্থির। মুখে মিটিমিটি গম্ভীর হাসি। আধা চোখে আমাদের দিকে তাকালেন একবার। আমরা বিনয়ে আহ্লাদে গলে যেতে লাগলাম।

স্যার! আমি দাঁড়িয়ে স্যালুট দিলাম মোবাইলেই মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে। বললাম, স্যার আপনি কোনো চিন্তা করবেন না, ফাঁকিস্তান হোক আর গুলিস্থান হোক, কেউ মিস্টার পাতলা খানের কিসসু করতে পারবে না, আমি দারোগা সর্বনাশ মিয়া বেঁচে থাকতে। মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও হেসে বললেন, সেটা জানি বলেইতো আপনাকে হাউসপুর থেকে জুরাইনে পাঠাচ্ছি। দেখবেন, মিস্টার পাতলা খানের নিরাপত্তাটা।

এতক্ষণে পাতলাদার পায়ের দুলুনি কমে কমে একেবারে স্থির। মুখে মিটিমিটি গম্ভীর হাসি। আধা চোখে আমাদের দিকে তাকালেন একবার। আমরা বিনয়ে আহ্লাদে গলে যেতে লাগলাম। সঙ্গে সঙ্গে হাঁক দিলেন, গরিলা? গরিলা?

গরিলা হচ্ছে পাতলাদার খাস বাবুর্চি। বছর খানেক আগে পাতলাদা সুন্দরবনে শিকারে গিয়েছিলেন। শিকারের ঘটনা পরে জানানো যাবে, কিন্ত একটা গরিলা নিয়ে এলেন খাঁচায় ভরে। ছোট গরিলা। সেই গরিলাকে শিখিয়ে পড়িয়ে এখন বাবুর্চি বানিয়েছেন।

পাতলাদার হাঁকে গরিলা এসে দরজার সামনে দাঁড়ায়, হুকুম করুন মালিক।

দেখেছো, আমার বাসায় কারা এসেছেন? জুরাইন থানার নতুন দারোগা মিস্টার সর্বনাশ।

মিস্টার পাতলা খান! আমার পুরো নাম পেটমোটা সর্বনাশ মিয়া, পেটমোটা দারোগা সর্বনাশ মিয়া নিজের নাম জানিয়ে দেন।

ওদের আসতে দেখেই আমি চিতাবাঘের কলিজা তেঁতুল দিয়ে ভাজি করেছি, মহাসাগরের তিমির মাংসের সঙ্গে চিংড়ি মাছ মিশিয়ে খাট্টা রান্না করেছি, পোলাওয়ের চালের সঙ্গে কাঁঠালের গোল্লা মাখিয়ে পিঠা বানিয়েছি...

পাতলাদা নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, দারোগা সর্বনাশ মিয়া আর এসেছেন মিস্টার মাখন মিয়া।

মাখন মিয়াও থামিয়ে দেন পাতলাদাকে, আমার নাম এস আই চিকন মাখন মিয়া।

পাতলাদা গোঁফে তা দিতে দিতে বলেন, বুঝলে তো? কত্তোবড় মেহমান? খাবার নিয়ে এসো।

দরজায় দাঁড়িয়ে হাসে মিস্টার গরিলা।

তুমি হাসছো কেনো?

ওদের আসতে দেখেই আমি চিতাবাঘের কলিজা তেঁতুল দিয়ে ভাজি করেছি, মহাসাগরের তিমির মাংসের সঙ্গে চিংড়ি মাছ মিশিয়ে খাট্টা রান্না করেছি, পোলাওয়ের চালের সঙ্গে কাঁঠালের গোল্লা মাখিয়ে পিঠা বানিয়েছি, রসগোল্লার রসের সঙ্গে পানের রস, সুপুরির গুড়া, গায়ে মাখা সাবানের ফেনা মিশিয়ে বোরহানি বানিয়েছি, চিলের ডানার পালক দিয়ে...

আমরা তাকিয়ে দেখি বাহারি খাবারের লোভে চকচক করছে জুরাইন থানার পেটমোটা দারোগা আর এসআই চিকন মাখন মিয়ার। এতক্ষণে আমরা রান্নাঘর থেকে চমৎকার রান্নার ঘ্রাণ পেতে শুরু করি। পাতলাদা হাই তোলেন।

আরও আছে, গরিলা রান্নার বয়ান শুরু করে, পদ্মার ইলিশের সঙ্গে পান্তা ভাতের গরম ঝোল আর পাটায় বাটা গোল মরিচের গুড়া আর কচি লাউয়ের ডিম...

গরিলা! ধমক দেয় পাতলাদা। তোমার খাবারের মেন্যু শুনেইতো জিবে জল আসছে। জলদি টেবিলে খানা দাও। আড়মোড়া ভেঙ্গে দাঁড়িয়ে যান পাতলাদা, আমাদের দিকে তাকান করুণ চোখে, কিরে তোরা খাবি? গরিলার খাবারের বিচিত্র মেন্যু শুনেইতো আমাদের জিবে পানি ভাটা মাছের গতিতে ছুটছে আর পাতলাদা কিনা বলছে, কিরে তোরা খাবি?

আমি ঘুরে তাকাই সাগরদের দিকে। সাগর, টিয়া, আকুল আর ব্যাকুল ইশারা করছে, বল আমরা খাবো। বল, তাড়াতাড়ি বল।

আমি বলার জন্য মুখ তুলতেই দেখি, রুমের মধ্যে পাতলাদা, দারোগা সর্বনাশ মিয়া, আর এসআই চিকন মাখন মিয়া নাই। তিনজন ঢুকতেই পাতলাদার ইশারায় দরজা বন্ধ করে দেয় সুন্দরবনের গরিলা। আমরা লোভ চকচকে জিভ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি গোক্ষুরের রাগে।

চলবে...

কিডজ পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!