সেদিনের কথা স্পষ্ট মনে আছে। আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গিয়েছিল৷ সঙ্গে দমকা হাওয়া। ক্ষণিকের জন্য মনে হয়েছিল আজই বোধ হয় পৃথিবীর শেষ দিন।
Published : 06 May 2020, 09:04 PM
যত দূর মনে আছে তখন আমি ক্লাস থ্রিতে পড়তাম। ঘুরতে ভালোবাসতাম আমি। বনে-জঙ্গলে কিংবা ফসলের ক্ষেত, সবখানেই বিচরণ ছিল আমার। বাসায় আমার দেখা পাওয়া ছিল ভার!
দুপুরে রাজিব ভাই এসে বলল, চল বিলের ধারে।
আমি বললাম, কেন?
সে বলল, ডাঙ্গুলি খেলব।
তড়িঘড়ি করে উঠে পড়লাম। ডাঙ্গুলি আমার প্রিয় খেলা কিনা! ও হ্যাঁ, রাজিব ভাই আমার গ্রামের বড় ভাই। বয়সে বড় হলেও তার সঙ্গে আমার খুব ভাব ছিল।
বিস্তীর্ণ একটা ফসলের ক্ষেত পার হয়ে বিলে যেতে হয়। তখন গ্রীষ্মের সময়। ক্ষেতের ধান এখনো ওঠেনি, কিন্তু ধান পেকে গেছে। পাগল করা মিষ্টি ঘ্রাণ সেটারই ইঙ্গিত দেয়।
রাজিব ভাইয়ের পাঁচটা বকরিছানা ছিল। বিলের ধারে টাটকা ঘাস গজিয়েছিল। অনেকেই সেখানে গরু-বকরিকে নিয়ে আসত। উর্বর ঘাসগুলো খেয়ে গায়ে-গতরে বেশ মোটাতাজা হতো পশুগুলো।
আমি আর রাজিব ভাই যখন ডাঙ্গুলি খেলি তখন আর অন্য কাউকে নিতাম না। খেলায় ব্যাঘাত ঘটতো যে! কিন্তু রাজিব ভাই মাঝে মধ্যে চিটিং করতো। অবশ্য আমি রেগে গেলে রাজিব ভাই চিটিং করা স্বীকার করে নিতো। তবে অনেক সময় আমি রাজিব ভাইয়ের চিটিং দেখেও কিছু বলতাম না। নিজে জিতে গেলে যেমন ভালো লাগতো, রাজিব ভাই জিতে গেলেও খুব খুশি হতাম আমি।
আকাশে হালকা মেঘ জমতে থাকায় আমি রাজিব ভাইকে বললাম, চলো, বাসায় যাই। ঝড় উঠবে মনে হয়।
রাজিব ভাই আমাকে আশ্বস্ত করে বলল, আরে ধুর! কিচ্ছুটি হবে না। এরকম কত মেঘ দেখলাম জীবনে। একটু বাতাস আর ঝিরিঝিরি বৃষ্টি, তারপরই রোদ।
আমি বললাম, সবাই যে চলে গেলো!
সে বলল, ওরা তো ভীতু। তাই চলে গেছে। তুই কি ভীতু?
আমি বললাম, না না, আমি ভীতু নই। তোমার সঙ্গে থেকে কেউ কি ভীতু হতে পারে!
রাজিব ভাই হো হো করতে হাসতে শুরু করল।
পুরো মাঠ ফাঁকা ছিল সেদিন। যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই ফসলের ক্ষেত। বিল থেকে ব্যাঙের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল। গ্রামের লোকজন এই বিলকে ‘খাড়ি’ বলে। আমি রাজিব ভাইকে বললাম, ব্যাঙ ডাকলে নাকি বৃষ্টি হয়? ঝড় হয়?
রাজিব ভাই গম্ভীর মুখ করে বলল, তোকে কে বলেছে এই কথা?
আমি বললাম, মতি চাচা বলছিলেন সেদিন।
রাজিব ভাই খানিকটা রাগান্বিত হয়েই বলল, এসব আজগুবি কথায় কান দিবি না।
আমি মাথা নাড়ালাম।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেলো। অন্ধকার হয়ে গেলো চারপাশ। তুমুল গর্জন আকাশে। রাজিব ভাই বেশ ভড়কে গেলেন!
দুইটা বকরিছানা আমি নিলাম। আর রাজিব ভাই নিলেন তিনটা। দুইজন দিলাম ভোঁ দৌড়। দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ বিকট একটা শব্দ পেলাম। আশপাশে কোথাও বাজ পড়েছে। আওয়াজটা এতোই তীব্র ছিল ক্ষণিকের জন্য মনে হয়েছিল, আমি বোধ হয় বধির হয়ে গেছি।
বৃষ্টি শুরু না হলেও তুমুল গর্জন থামেনি এখনো। হঠাৎ রাজিব ভাই আমাকে থামিয়ে বলল, দ্যাখ, ওই ক্ষেতে আগুন জ্বলছে।
আমি লক্ষ্য করলাম, আগুন জ্বলছে। সঙ্গে ধোঁয়াও উঠছে৷ বললাম, ওখানে কি বাজ পড়েছে?
রাজিব ভাই বলল, হ্যাঁ, বোধ হয়। একটু আগে বাজ পড়ার আওয়াজ শুনলি না? ওটা ওখানেই পড়েছে।
ওই ক্ষেতটার কাছাকাছিই ছিলাম আমরা। রাজিব ভাই দৌড়াতে বলল।
মিনিট পনেরোর মধ্যে আমরা বাড়ির দেখা পেলাম। পথিমধ্যে বেশ কয়েকটা বাজ পড়েছে। বিকট শব্দ শুনেও পেছনে ফিরে তাকাইনি৷ শুধু দৌড়েছি আর দৌড়েছি। জিরানোর ফুরসতটুকুও পাইনি একদম। দূর থেকে আরো কয়েকটা ক্ষেতে আগুন দেখেছিলাম আমরা। যদিও একটু পরই বৃষ্টি নেমেছিল।
বাসায় ফিরে আব্বুর বকুনি আর আম্মুর মার খেয়েছিলাম। ঘটনার ভয়াবহতা শোনার পর যদিও দুজনে বুকে টেনে নিয়ে কেঁদেছিল। সত্যিই একটা ভয়ঙ্কর দিন ছিল সেটা।
লেখক পরিচিতি: শিক্ষার্থী, রাজশাহী সরকারি সিটি কলেজ
কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি,সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা [email protected]। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না! |