বই: স্পর্শের রকমফের, লেখক: সঙ্গীতা ইমাম, প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: সঙ্গীতা ইমাম, প্রকাশক: পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি., স্টল: প্যাভিলিয়ন নম্বর ১৯, পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৩৬, মূল্য: ২০০ টাকা
Published : 24 Feb 2020, 12:42 PM
শিশুসাহিত্য কি কেবল শিশুর কল্পনা জগতের সারথি? চিরায়ত শিশুসাহিত্যের অধিকাংশই শিশুর মন ও কল্পনাকে প্রসারিত করে। কিন্তু আমাদের এই ছোট্ট পৃথিবী আজ এমন এক বধির সময়ে এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে আমাদের শিশুরাও নোংরা সব অনাচারের শিকার হচ্ছে।
এই সময়, এই পৃথিবীর যাবতীয় নিষ্ঠুরতা দাঁত-নখ খিঁচিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করছে আমাদের শিশুদের মন ও মনন, নষ্ট করে দিচ্ছে তাদের অনাবিল শৈশব। এই রূঢ় বাস্তবতার মঞ্চে দাঁড়িয়ে শিশুসাহিত্যিক সঙ্গীতা ইমামের ‘স্পর্শের রকমফের’ শিশুদের জন্য একটি বাস্তবতার বই। বা উলটো করে বললে বলা যায় এই বইটি বড়দের জন্য একটি শিশুবিষয়ক বই।
গণমাধ্যমে আমরা শিশুদের ওপর নানা ধরনের নির্যাতনের সংবাদ দেখি। কিন্তু এর বাইরেও নির্যাতিত অনেক শিশু-কিশোরের আর্তনাদ চাপা পড়ে থাকে। এই চাপা পড়ে থাকা কান্নাগুলোর হদিস আমরা কখনো পাই না। যদিও বা পাই, সেগুলো আড়াল করতেই ভালোবাসি। কারণ, শিশু-কিশোরদের ওপর এই নির্যাতন অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিশুদের কাছের মানুষ দ্বারাই সংঘটিত হয়।
ফলে এ বিষয়টি নিয়ে আমাদের আলাপচারিতাও কম। পরিবারের শিশুদের এ বিষয়ে সচেতন করার পরিবর্তে আমরা বরং তাদের এগুলো আড়াল করতেই শিখাই। আমাদের এই ভুল পদক্ষেপে বিবর্ণ হয়ে যায় আমাদের শিশুদের শৈশব, অনেক ক্ষেত্রেই এই শিশুরা বড়ো হয় এক তীব্র মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে।
‘স্পর্শের রকমফের’ এর বিষয়বস্তু বইটির নাম থেকে আন্দাজ করা খানিকটা কঠিন। কঠিন এ কারণেই যে, বাংলা ভাষায় এর আগে এ বিষয়টি নিয়ে শিশুদের জন্য কোনো বই লেখা হয়নি। ইংরেজিতে ‘গুড টাচ, ব্যাড টাচ’ বাক্যাংশের সঙ্গে আমরা সবাই কম-বেশি পরিচিত। পাশ্চাত্যের নানা দেশে, এমনকি আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত, নেপাল বা শ্রীলঙ্কাতেও এ বিষয়গুলো নিয়ে শিশুদের উপযোগী নানা ধরনের বই আছে। শ্রেণিকক্ষেও শিশুদের এ বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হয়।
কিন্তু আমাদের দেশের শিশুদের ক্ষেত্রে আমরা নীরব ভূমিকা পালন করি। এই নীরবতায় সঙ্গীতা ইমামের ‘স্পর্শের রকমফের’ একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘা। দীর্ঘ সময় ধরে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনের কারণে একদিকে তিনি যেমন শিশু-মনস্তত্ত্বের গূঢ় বিষয়গুলোর সঙ্গে পরিচিত, তেমনি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি নির্মাণ করতে পারেন সমাজ-ঘনিষ্ঠ ভাষা। এই ভাষা যতটা না বড়োদের, তার চেয়েও বেশি শিশু-কিশোরদের।
ফলে ‘স্পর্শের রকমফের’ বইটির বিষয়বস্তু সংবেদনশীল হলেও তাকে তিনি শিশুদের ভাষ্যে নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। গল্পের আদলে বর্তমান সময়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও অনালোচিত বিষয়টি নিয়ে তিনি ক্রমাগত লিখে গেছেন, শিশুদের নিয়েই নির্মাণ করেছেন মুখ্য চরিত্রগুলো এবং ধীরে ধীরে শিশুদের সংলাপেই তিনি তাদের সমস্যা ও বেদনাগুলো সমাজের দৃষ্টিগোচর করেছেন। কাজটি নিঃসন্দেহে কঠিন। কেননা, এই বইটি দিনশেষে সবার বই হয়ে উঠেছে, অর্থাৎ সব বয়সী পাঠকের ভাষাকেই লেখককে শেষ পর্যন্ত বিন্যস্ত করতে হয়েছে।
ইংরেজিতে ‘গুড টাচ, ব্যাড টাচ’ নিয়ে যখন আলোচনা হয় তখন সেখানে ব্যাড টাচের যে সংজ্ঞায়ন করা হয় তা পৃথিবীব্যাপি প্রায় একই রকম। কিন্তু গুড টাচের সংজ্ঞায়ন অনেকটাই নির্ভর করে বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ওপর। ‘স্পর্শের রকমফের’ বইটি এই দিক থেকে সফলতার পরিচয় দিয়েছে। অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শের বিষয়ে শিশুদের সচেতন করা, প্রতিবাদ করতে শেখানো এবং প্রতিকারের জন্য আত্মরক্ষার কৌশলগুলো যেমন গল্পের পরতে পরতে উঠে এসেছে, তেমনিভাবে কাঙ্ক্ষিত স্পর্শ বা গুড টাচের বিষয়গুলোও সমানভাবে তৈরি করা হয়েছে। ফলে শিশু-কিশোরদের মানসে সচেতনতার বীজ রোপিত হলেও মানুষ সম্বন্ধে যেনো কোনো অবিশ্বাস বা অনাস্থা তৈরি না হয় সেদিকটিও নিপুণভাবে তুলে ধরেছেন সাহিত্যিক সঙ্গীতা ইমাম।
আগেই বলেছি এই বইটি বড়দের জন্য একটি শিশুবিষয়ক বই। এই বক্তব্যের কারণ হলো বইটিতে অভিভাবক ও শিক্ষকদের দায়িত্বগুলোও গল্পের আখ্যানে উঠে এসেছে। ফলে অলংকরণে শিশুদের মেজাজ থাকলেও, এই বইটি আসলে সব বয়সী পাঠকের জন্যই। আজকের সমাজ বাস্তবতায় যে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্বহ ঘটনার মধ্য দিয়ে আমরা জীবনযাপন করছি তা থেকে পরিত্রাণের উপায় তো কেবল শিশু-কিশোরদের সচেতন করাই নয়; বরং আমাদেরও সচেতন হতে হবে। আর এই সচেতনতার সাঁকো নির্মাণ করেছেন সাহিত্যিক সঙ্গীতা ইমাম তাঁর ‘স্পর্শের রকমফের’ বইটিতে।
আমরা শিশু-কিশোরদের জন্য একটি নিরাপদ ও নির্মল পৃথিবী চাই। এই চাওয়া কেবল চাইবার অধিকারেই সীমাবদ্ধ হতে পারে না, এর জন্য আমাদের মন ও মানসিকতারও পরিবর্তন ঘটাতে হবে। আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটলেই বরং আমরা আমাদের শিশু-কিশোরদের এই বিষয়ে সচেতন করে গড়ে তুলতে পারব। এই কর্মযজ্ঞে সঙ্গীতা ইমামের ‘স্পর্শের রকমফের’ একটি অবশ্য পাঠ্য বই।
কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি,সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা [email protected]। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না! |