মানুষ যেমন নানারকম জিনিস দিয়ে নানা কায়দায় নিজেদের বাড়ি বানায়- কেউ ইট, কেউ পাথর, কেউ বাঁশ-কাদা, কেউ মাটি; কারো এক-চালা, কারো দো-চালা- পাখিরাও সেরকম নানা জিনিস দিয়ে নানা কায়দায় নিজেদের বাসা বানায়।
Published : 13 Jul 2018, 03:43 PM
কেউ বানায় কাদা দিয়ে, কেউ বানায় ডাল-পালা দিয়ে, কেউ বানায় পালক দিয়ে, কেউ বানায় ঘাস দিয়ে; তার গড়নই বা কতরকমের- কারো বাসা কেবল একটি ঝুড়ির মতো, কারো বাসা গোল, কারো বাসা লম্বা চোঙার মতো।
এক একটা পাখির বাসা দেখলে অবাক হয়ে যেতে হয়, তাতে বুদ্ধিই বা কতো খরচ করেছে, আর মেহনতই বা করেছে কতো। পাখির বাসা তোমরা অনেকেই দেখেছ বোধহয়। কেমন সুন্দর করে শুকনো ঘাস দিয়ে বুনে তার বাসাটি সে তৈরি করে। পাছে কোন জন্তু বা সাপ আক্রমণ করে সেজন্য বাসায় ঢুকবার রাস্তা তলার দিকে। শত্রুকে জব্দ করবার আর একটা উপায় তারা করেছে- অনেক সময় বাসার গায়ে আর একটা গর্তের মতো মুখ তৈরি করে রাখে, সেটা কেবল ঠকাবারই জন্য, তার ভেতর দিয়ে বাসার মধ্যে ঢোকা যায় না।
লতাপাতা ও ঘাসের বাসা
বাবুই পাখির বাসা উল্টানো কলসির মতো দেখতে। বাসা বানাবার জন্য বাবুই খুব পরিশ্রম করে। ঠোঁট দিয়ে ঘাসের আস্তরণ সারায়। যত্ন করে পেট দিয়ে ঘষে গোল অবয়ব মসৃণ করে। শুরুতে দুটি নিম্নমুখী গর্ত থাকে। পরে একদিক বন্ধ করে ডিম রাখার জায়গা হয়। অন্যদিকটি লম্বা করে প্রবেশ ও প্রস্থান পথ হয়। কথিত আছে, রাতে বাসায় আলো জ্বালার জন্য বাবুই জোনাকি ধরে এনে গোঁজে।
বাবুই তাল, নারকেল, খেজুর, রেইনট্রি গাছে দলবেঁধে বাসা বোনে। বাবুইয়ের বাসা করার জন্য প্রয়োজন হয় নলখাগড়া ও হোগলার বন। বাবুই গোত্রের পাখিদের বলা হয় তাঁতী পাখি। চিরল পাতায় কুঁড়েঘরের মতো ঝুলন্ত বাসা বানায় বলেই এদের এ নামে ডাকা হয়।
টুনটুনি পাখি তার বাসা তৈরি করার আগে দুটি কি তিনটি পাতা সেলাই করে একটা বাটির মতো তৈরি করে; তার মধ্যে নরম ঘাস পাতা দিয়ে সে তার বাসাটি বানায়। সেলাইয়ের সুতো সাধারণত রেশমেরই ব্যবহার করে; কাছে রেশম না থাকলে যে সুতো পায় তাই দিয়ে করে। সেলাইয়ের ছুঁচ হলো তার সরু ঠোঁট-জোড়া।
বাসাটা অনেকটা দোলনার মতো ঝুলতে থাকে। খুব ছোট জাতের পাখিরা হিংস্র জন্তু আর সাপ গিরগিটির আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবার জন্য প্রায়ই ওইরকম দোলনার মতো বাসা তৈরি করে থাকে। টুনটুনিকে বলা হয় দর্জি পাখি। এরা সাধারণত ছোট এবং বড় পাতাওয়ালা গাছে বাসা বানায়। এরা দুটি পাতা উল্টিয়ে এনে গাছের আঁশ দিয়ে অপূর্ব কৌশলে জুড়ে দেয়। দুই পাতার ভেতরে থাকে তুলা, আঁশ, নয়তো অন্য পাখির নরম পালক বিছানো, যাতে পাখিরা ডিম পাড়ে। দুই পাতার ওপর অংশে থাকে সামান্য ফাঁক, যা দিয়ে ওরা যাতায়াত করে।
থুতু দিয়ে বানানো বাসা
কোনো কোনো পাখি থুতু দিয়ে বাসা তৈরি করে। তালচোঁচ পাখি এ জাতের। পালক, ঘাস এসব জিনিস থুতু দিয়ে জোড়া লাগিয়ে তার বাসা তৈরি হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া দ্বীপপুঞ্জে এক জাতের তালচোঁচ আছে, তারা কেবলই থুতু দিয়ে নিজের বাসা বানায়। চীনে এ বাসা আবার মানুষের খাবার, তারা এর ঝোল বানিয়ে খায়। এজন্য সে দেশে এ পাখির বাসার দামও খুব বেশি।
কাদা দিয়ে তৈরি বাসা
অনেক জাতের পাখি কাদা দিয়েও তাদের বাসা বানায়। আফ্রিকার ফ্লামিঙ্গোর বাসা কাদার তৈরি। একটা ঢিপির মতো কাদা সাজিয়ে তার মাঝে একটা গর্ত করে ফ্লামিঙ্গো ডিম পাড়ে। আরো অনেক জাতের পাখিও কাদার বাসা বানায়; তাদের অধিকাংশই আফ্রিকার।
অনেক জাতের পাখি আবার মাটিতেই বাসা করে; গাছে বাসা তারা পছন্দই করে না। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার বাসা তৈরিই করে না। নিজেরা গাছের আড়ালে ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে থাকে আর মাটিতে গর্ত করে তার মধ্যে ডিম পাড়ে। মোরগ, তিতির, পেরু এরা সবই এ জাতের।
গাছের গায়ে গর্তে বাসা
তোমরা অনেকেই বোধহয় কাঠ-ঠোকরা দেখেছ। এরা ঠোঁট দিয়ে ঠোকর মেরে গাছের গায়ে গর্ত করে তার ভেতর বাসা বানায়। দুষ্টু ছেলেরা ছানা চুরি করার লোভে কাঠ-ঠোকরার বাসার গর্তে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে অনেক সময় সাপের কামড় খায়, কারণ সাপেরা কাঠ-ঠোকরার বাসা ডাকাতি করতে বড় পটু।
পাখিদের মধ্য সম্ভবত সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বাসা বানায় ‘সালাংগান সুইফট’ পাখি। ইন্দোচিন, ইন্দোনেশিয়া, ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপগুলোর গিরিগুহায় এ পাখিরা নিজের মুখের আঠালো লালা দিয়ে গোলাকার বাটির মতো পাঁচ থেকে ছয় সেন্টিমিটার বাসা বানায়। এরা সাধারণত পাহাড়ের গুহা ও খাড়া দেয়ালকে বাসা বানানোর স্থান হিসেবে বেছে নেয়। এরপর বাসার অদৃশ্য নকশা এঁকে নেয়।
তারপর দুই পায়ের নখ দিয়ে পাথুরে দেয়াল আঁকড়ে মুখের আঠালো লালা দেয়ালে আটকিয়ে নেয়। মুহূর্তেই সে লালা বাতাসের সংস্পর্শে মাকড়সার জালের মতো শুকিয়ে যায়। এভাবে প্রতিদিন লালা ঢেলে গোলাকার বাদামি রঙের বাসা তৈরি করে এসব পাখি। সালাংগান সুইফট প্রতিদিন চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা কাজ করে চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ দিনে একটি বাসা তৈরি করে। আবার মৌটুসি, হামিং বার্ড এরা তুলা গাছের ডালের আঁশ মিলিয়ে ছোট আঁটসাঁট বাটি আকৃতির বাসা বানায়।
গাছের ডাল মাটিতে পুঁতে
অনেকে বলেন বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর বাসা বানায় অস্ট্রেলিয়ার বোয়ার বার্জ বা কুঞ্জ পাখি। সুন্দর ‘ইউ’ আকৃতির কুঞ্জের বাসা বানায় বলে এ পাখি বেশি সুখ্যাতি অর্জন করেছে। নীল রঙের পুরুষ পাখি লম্বা লম্বা চিকন গাছের ডাল মাটিতে পুঁতে ঊর্ধ্বমুখী ইংরেজি ‘ইউ’ আকৃতির কুঞ্জ বানায়। এ দুই পাশের ডালের সংযোগস্থলে খড়কুটা, নীল কাচ, নীল ফুলসহ বিভিন্ন নীল রঙের জিনিস কুড়িয়ে এনে এরা বাসা সাজায়। বাসা সাজানোর ক্ষেত্রে এদের নীল রংপ্রীতি এতই বেশি যে, পাখি পর্যবেক্ষকরা বোয়ার বার্ডের বাসায় নীল রঙের চশমা, চাবির রিংও খুঁজে পেয়েছেন। এদের আবার রংচঙে জিনিসের বড় সখ; ভাঙা কাচ, পাথর, রঙিন জিনিস, যা সামনে পাবে এনে বাসার চারদিকে সাজিয়ে রাখবে।
মাটির গর্তে বাসা
মাটির গর্তে বাসা বানায় মাছরাঙ্গা, বি-ইটার, গাঙশালিক, কাদাখোঁচা, স্লাইপ, সুইচোরাসহ জলচর অনেক পাখি। এরা সাধারণত লম্বা খারালে নদীর খাড়া পাড়ের মাটিতে ১৪ থেকে ১৮ ইঞ্চি গর্ত খুঁড়ে বাসা বানায়। এদের বাসায় ঢোকার মুখটা সঙ্কুচিত হলেও ভেতরের ডিম ও বাচ্চা লালন-পালনের স্থানটি যথেষ্ট প্রশস্ত। মরুভূমির এক জাতের পেঁচা আছে। এরা সমতল বালুতেই গভীর গর্ত খুঁড়ে বাসা বানায়।
শুধু বালু, পাথুরে ভূমি এবং ঝোপঝাড়ের আড়ালে মাটিতে বাসা বানায় নীল হাঁস, প্লোভার বার্ড, ববি ট্রিপ, হাজেল গ্রাউজ, বুনো মুরগি, বুনো হাঁস, করালি হাঁস, রাজ হাঁস, অ্যালবাট্রস, গাঙচিল, যাওয়ার ও হাঁস প্রজাতির পাখি। এদের বাসায় পাখির বুকের নরম পালক, শুকনো জলজ উদ্ভিদ সুন্দর করে বিছিয়ে তাতে ডিম পাড়ে। খোলামেলা মাটিতে বাসা হলেও ঝোপঝাড়, বালুর ঢিবি ও পাথরের চাঁইয়ের আড়ালে লুকানো বাসাগুলো সহজে কারো নজরে পড়ে না।
জলের ওপর ভাসমান বাসা
পানির ওপর কলমি, শাপলা, পদ্মফুল বা জলজ কোনো উদ্ভিদের ঝোপে খড়কুটা দিয়ে বাসা বানায় ডাহুক, কালিম ও অন্য কিছু জলচর পাখি। অনেক সময় পানির চলমান স্রোতে কলমি বা কচুরিপানার সঙ্গে এসব পাখির বাসাও ভেসে যেতে থাকে। সে ক্ষেত্রে ডিম বা বাচ্চাওয়ালা ভাসমান বাসার সঙ্গে বাসার মালিকও ভেসে যেতে থাকে অজানার উদ্দেশে।
ডাহুক বাসা বানায় ঝোপঝাড়, বেতঝাড়, কলমিঝোপ বা কচুরিপানার ওপর। আবার যদি কোনো প্রকার ঝুঁকি না থাকে তাহলে মাটিতেও এরা বাসা বানায়। এদের বাসা বাটির মতো গোল। অনেক সময় খেলার বলের মতো গোল। এদের বাসা হয় বেশ বড়। বাসা গোছালো নয়। বাসার উপকরণগুলো হলো শুকনো পাতা, বাঁশের শিকড় ও পাতা। কচুরিপানার শিকড়, পাটের আঁশ শেওলা, পানির ঘাস ইত্যাদি।
সমুদ্রতটে পাথুরে বাসা
ছোট জাতের ‘আডেলি পেঙ্গইন’ সমুদ্রতটের পাথুরে গিরিখাতে নয়তো পাথরের স্তুপের আড়ালে জলজ উদ্ভিদ, সমুদ্র শ্যাওলা বিছিয়ে বাসা বানায় অগোছালোভাবে। তবে বড় এমপারার বা অন্য জাতের পেঙ্গুইনরা বাসা বানায় না। এসব পাখি একটি বা দুটি ডিম পাড়ে। ডিম দুটি দু’পায়ের পাতায় রেখে ওদের তলপেটের ঘন লোমে ঢেকে তা দিয়ে বাচ্চা ফোটায়। মেয়ে-পুরুষ দুটি
পাখি মিলেই তা দিয়ে বাচ্চা ফোটানোর দায়িত্ব সারে।
আবার দক্ষিণ আমেরিকার কোকিল প্রজাতির পাখিরা পাঁচ থেকে দশটির ক্ষুদ্র একটি দল করে একটি বড় বাসা বানায় খড়কুটা দিয়ে এবং সবাই পালাক্রমে বসে ডিমে তা দেয়। সেজন্য এসব পাখির বাসায় ত্রিশ থেকে চল্লিশ বা তারও বেশি ডিম পাওয়া যায়।
বসন্ত বাউরী পাখিরা যে বিচিত্র সব বাসা বানায় তাও কিন্তু কম আকর্ষণীয় নয়। তবে সব পাখির বাসা যে সুন্দর তা কিন্তু নয়। বিশেষ করে বড় বড় শিকারি পাখি যেমন ঈগল, শকুন, বাজ, কাক, চিল এবং জলচর পাখিদের মধ্যে পানকৌড়ি, বক, হাড়গিলা এসব পাখির বাসা অগোছালো।
শালিক বা গো-শালিক বাসা করে টেলিগ্রাফ বা ইলেকট্রিক খামের তারের ওপর, গোবরে শালিক মসজিদের মাইক বক্সে বাসা বাঁধে। গো-শালিক বাদে অন্যারা দালানের ফাঁকফোকরে, গাছের কোঠরে, ভেন্টিলেটারে, হাঁড়ি, কলসির ভেতরেও বাসা বাঁধে।
দক্ষিণ আফ্রিকার কালাহারি মরুভূমিতে গেলে দেখা মিলবে এ দৃশ্যের, চড়ুই সদৃশ নীলচে ঠোঁটের ছোট্ট পাখিটির নাম ‘সোশ্যাল ওয়েভার’। সোশ্যাল ওয়েভার সাধারণত উত্তর কেপ প্রদেশ ও নামিবিয়ায় দেখা যায়। তবে এদের বেশিরভাগই কালাহারি মরু অঞ্চলে থাকে। কিন্তু এত ছোট পাখির বাড়ি এত বড়! বড় তো হবেই, কারণ এরা নিজের জন্য তো ভাবেই, সঙ্গে মাথায় রাখে ভবিষ্যত প্রজন্মের আশ্রয়ের কথাও।
এমনভাবে তারা বাসা তৈরি করে যেন গোটা গাছটিই সোশ্যাল ওয়েভারের কলোনি। যে গাছে তারা বাসা বাঁধে সে গাছে অন্য পাখির বাসা তো দূরের কথা, অন্যদের বসবারও ঠাঁই হয় না। বেচারা গাছটাও পড়িমরি করে বাসার ভারে। গাছের সঙ্গে দৈত্যাকার অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকের মতো বাড়িতে শতাধিক সোশ্যাল ওয়েভার সারাবছর বসবাস করে।
কোনো কোনো সোশ্যাল ওয়েভারের বাড়ি একশ বছরেরও বেশি সময় টিকে থাকে! মূলত শিকারি প্রাণী ও গেছো সাপ থেকে গা বাঁচাতেই গাছে ও পোলের ওপর বাসা বাঁধে এরা। তারপরও বাসায় কখনও হানা দেয় কেপ কোবরা। এক একটি বাসায় পাঁচ থেকে এক শ’ পাখি থাকে। তবে প্রতিটি বাসায় অনায়াসে চারশ পাখি থাকতে পারবে।
ফাঁকফোকরে, কোটর, হাঁড়ি-কলসির ভেতর বাসা
দোয়েল অন্য পাখিদের বাসা দখলের ক্ষেত্রে প্রথম বলতে হবে। এরা আবাবিল, কাঠঠোকরা, টিয়া, বসন্তবৌরি ইত্যাদি পাখির বাসা দখল করে বাস করে। আবার নিজেরাও বাসা বানায়। বাসা বানানোর ক্ষেত্রে বোকামি করে। মানুষ চলাচল করে এমন জায়গায় বা বন্য প্রাণীর নাগালেই বাসা করে ফেলে। এরা বাঁশের মাথার গর্তে, সুপারি গাছের গর্তেও বাসা করে। তা ছাড়া দালানের ফাঁকফোকরে, গাছের কোটরে, ফেলে দেয়া হাঁড়ি কলসির ভেতরও বাসা করে। এদের বাসাটি বাটির মতো। আবার চায়ের কাপের মতোও হতে পারে। বাসার উপকরণ টুনটুনিদের মতোই।
তথ্যসূত্র:
১. পাখির বাসা, সুকুমার রায়
২. বাংলাদেশের পাখি, শরীফ খান
৩. উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া