গত এক বছরে ১৭ জন রোগীকে কাউন্সেলিং করা হয়েছে, কিন্তু সারাহর দেখানো পথে আর কোনো ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্লান্টেশন হয়নি।
Published : 18 Jan 2024, 10:12 PM
তেইশ বছরের যুবক মোহাম্মদ সুজনের চোখে আলো ফিরেছিল ঠিক এক বছর আগে। যার দেওয়া কর্নিয়ায় দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেয়েছেন তিনি, সেই সারাহ ইসলামের জীবন প্রদীপ নিভে গিয়েছিল একই দিনে।
এখন চোখে ভালোই দেখতে পান সুজন। কিন্তু সারাহ ইসলামের কথা বলতে গিয়ে তার সেই চোখ ভরে আসে অশ্রুতে।
কান্নাজড়ানো কণ্ঠে বলেন, “এক বছর আগেও অন্ধত্বের কারণে পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিলাম। এখন চোখে দেখতে পাচ্ছি। নিজের ছোট একটি দোকান দিয়ে খেয়ে বেঁচে আছি।”
দেশের প্রথম ক্যাডাভেরিক অঙ্গদাতা সারাহ ইসলামের উজ্জ্বল প্রস্থান এবং সফল ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্লান্টেশনের এক বছর পূর্ণ হল বৃহস্পতিবার।
টিউবেরাস স্ক্লেরোসিস রোগে আক্রান্ত সারাকে বাঁচানোর উপায় ছিল না। ২০ বছর বয়সী এই তরুণীও তা জানতেন। তার ইচ্ছে ছিল, মৃত্যুর পর তার মস্তিষ্ক যেন গবেষণার কাজে লাগে।তার মৃত্যুর পর অঙ্গদানের সিদ্ধান্তে পরিবারও আপত্তি করেনি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা ২০২৩ সালের ১৮ জানুয়ারি ‘ব্রেইন ডেড’ সারাহকে মৃত ঘোষণা করেন। একই দিনে তার কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করা হয় দুজনের চোখে। তার কিডনি নিয়ে সুস্থভাবে বেঁচে আছেন শামীমা আক্তার নামে এক নারী। তবে কিডনিগ্রহীতা আরেক নারীর মৃত্যু হয়েছে।
দেশের চিকিৎসার ইতিহাসে ১৮ জানুয়ারি একটি বিশেষ দিন হয়ে আছে প্রথমবারের মত সফল ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্লান্টেশনের কারণে। দিনটি স্মরণে বৃহস্পতিবার ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) মিল্টন হলে আলোচনাসভার আয়োজন করা হয়।
মোহাম্মদ সুজন সেখানে তুলে ধরেন তার আজকের জীবনের কথা। শামীমা আক্তার নিজে না এলেও পাঠিয়েছিলেন ভিডিও বার্তা। সারাহ ইসলামের কথা স্মরণ করে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন, জানান কৃতজ্ঞতাও।
সারাহর মা শবনম সুলতানা বলেন, “আজ সুজনের চোখেই সারাহর চোখ দেখতে পেলাম আর শীমামকে দেখলাম মানে আমার মেয়ে সারাহকে দেখলাম।”
দেশে ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্লান্টেশনের বর্তমান অবস্থা, ভবিষ্যত করণীয়, বাস্তবায়নে নানা সমস্যা ও এর ইতিহাস তুলে ধরা হয় অনুষ্ঠানে। অঙ্গ প্রতিস্থাপনে ধর্মীয় বিশ্বাস, কাউন্সেলিং সংকটসহ মোট ১০টি সমস্যার কথা উঠে আসে আলোচনায়।
সভার প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী তার বক্তব্যে অঙ্গদানের গুরুত্ব তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, “আমি নিজেই একজন ডোনার। ৪০ বছর ধরে সব সময়ে নিজের সঙ্গে ডোনারকার্ড রাখছি। এছাড়া একটি লিভিং উইল তৈরি করে পরিবারকে দিয়ে রেখেছি। যেহেতু মৃত্যু খুব অনিশ্চিত, তাই আমি সিদ্ধান্ত নেওয়ার অবস্থায় না থাকলেও উইলের মাধ্যমে আমার ইচ্ছা স্বজনরা জানতে পারবেন।”
তার মতে, অঙ্গদানের সঙ্গে ধর্মীয় কিছু বিষয় জড়িয়ে থাকলেও, এটা ব্যক্তির একেবারেই নিজস্ব সিদ্ধান্ত।
“এমন সিদ্ধান্ত আইন করে চাপিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। সৃষ্টিকর্তার দেওয়া বিবেক ব্যবহার করেই অঙ্গদানের সিধান্ত নিতে হবে।”
যারা ডোনার হতে চান, কিন্তু সঠিক তথ্য পাচ্ছেন না, তাদের জন্য ন্যাশনাল ডেটা ব্যাংক চালু করার কথা জানান প্রধানমন্ত্রীর এই উপদেষ্টা।ডোনারদের সুবিধার জন্য তিনি কার্ড ব্যবস্থা চালুর অনুরোধ করেন বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষকে।
সারাহকে দিয়ে শুরু হয়েছিল এক বছর আগে, কিন্তু এরপর দেশে আর কোনো ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্লান্টেশন হয়নি।
তবে চেষ্টা যে চলছে, সে কথা তুলে ধরে বিএসএমএমইউ উপাচার্য শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, “গত এক বছরে প্রায় ১৭ জন রোগীকে কাউন্সেলিং করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে রোগী প্রস্তুত থাকলেও স্বজনদের অমতে ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্লান্টেশন হয়নি। অঙ্গদানের সঙ্গে ধর্মীয় বিশ্বাসের সম্পর্ক রয়েছে। তাই তাদের সিদ্ধান্তে সম্মান জানিয়ে আমরা সামনে এগোতে পারিনি।”
অধ্যাপক শারফুদ্দিন বলেন, দেশে প্রতি বছর ১৭ হাজার মানুষের কিডনি ডায়ালাইসিস করাতে হয়। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে তিন হাজার রোগীর কিডনি প্রতিস্থাপন দরকার। কিন্তু ২০০/৩০০ রোগীর বেশি কিডনি প্রতিস্থাপন করতে পারছে না।
“আবার অনেক রোগী চলে যাচ্ছেন দেশের বাইরে। বিদেশে কিডনি প্রতিস্থাপন করলে প্রায় ৪০ লাখ টাকার প্রয়োজন হয়। আমাদের দেশে খরচ মাত্র ৩ লাখ।তাই জীবিত ব্যক্তিদের অঙ্গদানের পাশাপাশি ব্রেন ডেড রোগীদের অঙ্গদানও সহায়তা করতে পারে। অঙ্গদানকারী রোগীর সঙ্গে প্রতিস্থাপনকারী রোগীর টিস্যু মিলে গেলেই দান সম্ভব।”
সারহা ইসলামের আরেকটি কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল অন্য এক নারীর শরীরে। তিন মাস আগে তার মৃত্যু হয়েছে বলে জানান বিএসএমএমইউ উপাচার্য।
সারাহ ইসলাম যে টিউবেরাস স্ক্লেরোসিস রোগে আক্রান্ত ছিলেন, কিডনি প্রতিস্থাপনের আগে তা গ্রহীতা বা তার স্বজনদের জানানো হয়েছিল কিনা, সেই প্রশ্ন রাখেন সভায় উপস্থিত এক সাংবাদিক।
এর উত্তরে অধ্যাপক শারফুদ্দিন বলেন, টিউবেরাস স্ক্লেরোসিস রোগে আক্রান্ত রোগীর কিডনি গ্রহণ করলে গ্রহীতার কোনো স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি হবে না।
বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে ক্যাডিভেরিক ট্রান্সপ্লান্ট সেলের নামকরণ করা হয়েছে সারাহ ইসলামের নামে। সেই সেলের সভাপতি অধ্যাপক হাবিবুর রহমান দুলাল, সদস্য সচিব মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সজীবসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন আলোচনা সভায়।
একজন জীবিত ব্যক্তি অঙ্গদান করলে তিনি নিজেও পরে নানা রকম শারীরিক জটিলতায় ভুগতে পারেন। তাই সারা বিশ্বেই বিকল্প হিসেবে গড়ে উঠেছে ক্যাডাভেরিক অরগান ডোনেশন ও ট্রান্সপ্লান্টেশন। একজন ব্যক্তি মৃত্যুর আগে নিজের আটটি অঙ্গ দান করে যেতে পারেন, সেসব অঙ্গ দিতে আটজনকে দিতে পারে নতুন জীবন।
বাংলাদেশে ১৯৯৯ সালে মানব দেহের অঙ্গ সংযোজন আইন জাতীয় সংসদে পাস হয়। পরে ২০১৮ সালে ওই আইনের কিছু সংশোধনের মাধ্যমে ব্রেন ডেড রোগীর শরীর হতে কিডনি, কর্নিয়া, লিভার, হার্ট, অগ্নাশয়সহ আটটি অঙ্গ প্রতিস্থাপনের সুযোগ তৈরি করা হয়।
ক্যাডিভারিক অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে তুরস্ক, সৌদি আরব, ইরান, মিশর ও ইন্দোনেশিয়ার মতো মুসলিমপ্রধান দেশও রয়েছে।
পুরনো খবর:
দেশে প্রথমবারের মত ‘ব্রেইন ডেড’ মানুষের কিডনি পেল দুজন