করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে অনেক হাসপাতালে জরুরি চিকিৎসা ছাড়া অন্যান্য সেবা যখন মিলছিল না, চিকিৎসকরা যখন প্রাইভেট চেম্বারে রোগী দেখা বন্ধ রেখেছিলেন, তখনও অসুস্থ মানুষের চিকিৎসা পরামর্শ পাওয়ার একটি জানালা খোলা ছিল সব সময়।
Published : 04 Dec 2020, 05:59 PM
মহামারীর এই নয় মাসে জাতীয় স্বাস্থ্য বাতায়নের টেলিমেডিসিন সেবার হটলাইন ১৬২৬৩ এ ফোন করে এক কোটিরও বেশি মানুষ স্বাস্থ্য সেবা নিয়েছেন।
সেবাগ্রহীতাদের মধ্যে যাদের মধ্যে পরে কোভিড-১৯ সংক্রমণ ধরা পড়েছে, পরবর্তীতে তাদের হেল্পলাইন থেকে ফোন করেও খোঁজখবর নেওয়া হয়েছে, দেওয়া হয়েছে পরামর্শ সেবা।
করোনাভাইরাসের মহামারীর মধ্যে ১৬২৬৩ হেল্পলাইন সাধারণ মানুষের জন্য কতটা ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছে, একটি পরিসংখ্যান থেকেই তা বোঝা যায়।
২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে চালু হওয়ার পর এ হটলাইনে ফোন করে টেলিমেডিসিন সেবা নিয়েছেন ১ কোটি ৫৪ লাখ ৭৭ হাজার ৫৪৯ জন মানুষ। এর মধ্যে ১ কোটি ৫ লাখ ৭৪ হাজার ৬৪৭টি কল এসেছে গত ৮ মার্চ থেকে ২৮ নভেম্বর- এই সাড়ে আট মাসের মধ্যে।
দেশে ভাইরাসের প্রকোপ শুরুর পর থেকে হিসাব করলে প্রতিদিন গড়ে ৩৯ হাজার ৭৫৪টি করে এসেছে জাতীয় স্বাস্থ্য বাতায়নে।
এর মধ্যে করোনাভাইরাস সম্পর্কিত তথ্যের জন্য কল ছিল ৮৩ লাখ ৮৯ হাজার ৬৮৩টি। আর করোনাভাইরাসের লক্ষণ-উপসর্গ নিয়ে কল দিয়ে সেবা নিয়েছেন ১ লাখ ৩৩ হাজার ৮১৪ মানুষ।
২৮ নভেম্বর ২৪ ঘণ্টায় আসা ৯ হাজার ৫৮টি কলের মধ্যে ৩ হাজার ৬২৩টি কল ছিল করোনাভাইরাস সম্পর্কিত। সেদিন ‘অতি জরুরি’ কল এসেছে ৫১১টি।
অন্যদিকে এই সময়ে স্বাস্থ্য বাতায়নের চিকিৎসকরা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের খোঁজ খবর নিতে ২ লাখ ৫৩ হাজার ২১৩টি কল করেছেন।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, “আমরা নিরলসভাবে জাতীয় স্বাস্থ্য বাতায়নের সেবা দিয়ে যাচ্ছি। মানুষকে সেবা দেওয়ার জন্য সাধ্যের সবটুকুই করছি আমরা। হাসপাতাল সেবার পাশাপাশি মানুষ যেন টেলিমেডিসিন সেবা পায়, সেদিকে লক্ষ্য রেখেই ২৪ ঘণ্টা এ সেবা চালু রাখা হয়েছে।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এ সেবাকে কিভাবে আরো সম্প্রসারিত করা যায়, সে বিষয়টি তারা বিবেচনা করছেন।
“আমরা চাইছি, ননকোভিড সার্ভিসের একটা অংশ যদি এখানে দিতে পারি, তাহলে মানুষ ছোটখাটো সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে যাবে কম। তাতে তাদের ঝুঁকিও কমবে।”
স্বাস্থ্য বাতায়নের এই সেবা পরিচালনা করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস (মেডিকেল ইনফরমেশন সার্ভিসেস) বিভাগ। সিনেসিস হেলথ নামের একটি তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এমআইএসের অধীনে টেলিমেডিসিন সেবার কাজ করছে।
শুরুতে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ও পরামর্শ, স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ক প্রয়োজনীয় তথ্য, অ্যাম্বুলেন্স সম্পর্কিত তথ্য ও বুকিং, স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ক অভিযোগ গ্রহণ, দুর্ঘটনায় জরুরি তথ্যসেবা দিয়ে আসছিল জাতীয় স্বাস্থ্য বাতায়ন।
মহামারীর ঢেউ বাংলাদেশে আসার পর করোনাভাইরাস সম্পর্কিত চিকিৎসা পরামর্শও সেখান থেকে দেওয়া শুরু হয়।
জাতীয় স্বাস্থ্য বাতায়নের কল সেন্টারে কীভাবে একটার পর একটা কল আসছে এবং সেবাপ্রত্যাশীদের সমস্যা জেনে সমাধান দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে, সে বিষয়টি ব্যাখ্যা করলেন সিনেসিস হেলথের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ডা. নিজাম উদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, কোনো রোগী যখন পরামর্শের জন্য হেল্পলাইনে ফোন করেন, তা সরাসরি একজন চিকিৎসকের কাছে আসে। সেই চিকিৎসক রোগীর অবস্থা, তথ্য-উপাত্ত যাচাই করে রোগ নির্ণয়ের চেষ্টা করেন এবং চিকিৎসার বিষয়ে পরামর্শ দেন।
চিকিৎসার ব্যবস্থাপত্র ই-প্রেসক্রিপশন আকারে রোগীর মোবাইলে চলে যায়। পুরো প্রক্রিয়া শেষ হতে সময় লাগে তিন থেকে পাঁচ মিনিট।
“নিজে চিকিৎসক বলে ভয় থাকবে না এমন নয়। প্যানডেমিকের শুরুতে আমার পরিবারের একজন কোভিড আক্রান্ত মারা যান। কাছের কেউ চলে যাওয়ার ব্যথা আমি বুঝি। এ কারণে ভয় থাকলেও অফিস করেছি, মানুষকে সেবা দিচ্ছি।”
টেলিফোনে রোগীর কথা শুনে সঠিক চিকিৎসা দেওয়া কতটা সম্ভব হচ্ছে?
বিষয়টি যে ‘চ্যালেঞ্জিং’, তা স্বীকার করলেন ডা. মুহাম্মদ রিজভী ইসলাম। তিনি বললেন, শুরুতে একটু ঝামেলা হলেও এখন তারা মানিয়ে নিয়েছেন।
“সামনে থাকলে তাকে চোখে দেখে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসা দেওয়া যায়। এখানে রোগীর কথার ওপরই নির্ভর করতে হয়। রোগীর হিস্ট্রি ভালোভাবে শুনে সে অনুযায়ী চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করি আমরা।”
টেলিফোনে পরামর্শ নিয়ে সুস্থ হয়ে ওঠার পর অনেকে ফোন করে ধন্যবাদও দেন বলে জানালেন ডা.সুস্মিতা আইচ।
এরকম একটি ঘটনার কথা তুলে ধরে তিনি বললেন, “৭৪ বছর বয়সী এক নারী কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়েছিলেন। তার শ্বাসকষ্ট শুরু হলে তার ছেলে স্বাস্থ্য বাতায়নে কল করেন। উনাকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল সম্ভব হলে বাসায় অক্সিজেন দিতে। অবস্থা বেশি খারাপ হলে হাসপাতালে নিতে।
“তিনি আমাদের পরে ফোন করেছিলেন ধন্যবাদ দিতে। তিনি আমাদের এখান থেকে যে ইনফরমেশন এবং মেডিসিন পেয়েছিলেন, তাতে উনার মা সুস্থ হয়ে উঠেছেন।”
হেল্পলাইন ১৬২৬৩ ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে যাত্রা শুরু এ পর্যন্ত টেলিমেডিসিন সেবা নিয়েছেন ১ কোটি ৫৪ লাখ ৭৭ হাজার ৫৪৯ জন তাদের মধ্যে ৭৩ শতাংশকে চিকিৎসা ও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কিত তথ্য নিয়েছেন ১৪ শতাংশ ১ শতাংশ ফোন এসেছে অ্যাম্বুলেন্স সেবার জন্য ১০ শতাংশ ফোন কলে ১৬২৬৩ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছে ২ শতাংশ মানুষ চিকিৎসা সেবা নিয়ে অভিযোগ জানিয়েছেন |
স্বাস্থ্য বাতায়নের টেলিমেডিসিন সেবার হটলাইনে এ পর্যন্ত যত কল এসেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৩ শতাংশ মানুষ ফোন করেছেন সর্দি জ্বরের মত উপসর্গ নিয়ে। ১১ শতাংশ মানুষ করোনাভাইরাসের চিকিৎসা নিয়েছেন।
এছাড়া ৯ শতাংশ জ্বর, ৮ শতাংশ শারীরিক দুর্বলতা, ৫ শতাংশ শুকনো কাশি, ২ শতাংশ গলাব্যথা, ২ শতাংশ অ্যাসিডিটির সমস্যা, ১ শতাংশ নাক দিয়ে পানি পড়া, ১ শতাংশ অ্যাজমা, ১ শতাংশ মানুষ মানসিক অসুস্থতার চিকিৎসা নিয়েছেন।
কি বলছেন সেবাগ্রহীতারা
রাজধানীর মোহাম্মদীয়া হাউজিং সোসাইটির বাসিন্দা কামরুল হাসান জানান,তার করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ার পর স্বাস্থ্য বাতায়ন থেকে টেলিফোন করে তার খোঁজ নিচ্ছেন চিকিৎসকরা, দিচ্ছেন পরামর্শ।
নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার শিবু মার্কেট এলাকার ইকবাল হোসেনের ১১ বছরের মেয়ের হঠাৎ করেই কাশি শুরু হয়েছিল কিছুদিন আগে। যে ডাক্তারকে দেখানো হত, তাকেও সে সময় চেম্বারে পাওয়া যাচ্ছিল না। তখন ১৬২৬৩ নম্বরে কল করে মেয়ের জন্য টেলিমেডিসিন সেবা নেন তিনি।
“হঠাৎ ১৬২৬৩ এর কথা মনে হলে কল দিই। একজন চিকিৎসক আমার মেয়ের শারীরিক অবস্থা বিস্তারিত জেনে ওষুধ দিলেন এসএমএসে। ওষুধ খেয়ে মেয়ের অবস্থা আগের চেয়ে ভালো হয়েছে।”
মহামারী শুরুর পর থেকে নিয়মিত টেলিফোনে স্বাস্থ্যসেবা নিচ্ছেন গাজীপুরের বাসিন্দা শহীদুল ইসলাম।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে চিকিৎসকের কাছে গিয়ে চিকিৎসা পাওয়া কঠিন। সাধারণ অসুখ-বিসুখের চিকিৎসা স্বাস্থ্য বাতায়ন থেকেই পাওয়া যায়।
“তাছাড়া যতবারই ডাক্তার দেখিয়েছি, অনেক টাকার টেস্ট দিয়েছে। টেলিমেডিসিনে ডাক্তাররা পরীক্ষা দেয় না। যা ওষুধ লাগে, ওষুধ খাওয়ার নিয়ম সব লিখে এসএমএস করে দিচ্ছেন।”
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষের মাঝে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে টেলিমেডিসিন সেবা বিশ্বজুড়েই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এ সেবাকে আরও কার্যকর করতে একে সুসংগঠিত করার পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শক অধ্যাপক ডা. বেনজীর আহমেদ বলেন, সাধারণ কিছু রোগের চিকিৎসায় পরামর্শের জন্য স্বাস্থ্য বাতায়ন ভালো কাজে আসছে।
“তারা যে সেবা দিচ্ছে, তাতে সব ধরনের রোগের না হোক, কিছু রোগের চিকিৎসা হচ্ছে। আমরাও অনেক সময় জানি না কোথায় গেলে কোন স্বাস্থ্য সেবা পাওয়া যাবে। এখান থেকে তা পাওয়া যাচ্ছে।”
স্বাস্থ্য বাতায়ন থেকে কেমন সেবা পাওয়া যায় জানতে কয়েকবার ফোন করেছিলেন বলে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক এই পরিচালক।
তিনি বলেন, “৯৯৯ কে যেভাবে বড় আকারে সাজানো হয়েছে, সেভাবে স্বাস্থ্য বাতায়নকেও সাজাতে হবে।”