সড়ক দুর্ঘটনায় চার জনের মৃত্যুর ঘটনায় গত ১৯ জানুয়ারি রাতে জৈন্তাপুরের এই হাসপাতালে ব্যাপক ভাঙচুর হয়েছিল।
Published : 06 Mar 2024, 07:06 PM
সিলেটের জৈন্তাপুরে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার চার ছাত্রলীগ কর্মীর মৃত্যুর পর যে হাসপাতালে তুলকালাম হয়েছিল, সেখানে এবার কর্মঘণ্টায় পরিদর্শনে গিয়ে চিকিৎসকের দেখা পেলেন না খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন।
সেই হাসপাতালের আরো চিত্র দেখে বিস্মিত হয়েছেন মন্ত্রী। তিনি দেখতে পান, সেখানে ঝুলছে সরকারি চিকিৎসকদের প্রাইভেট চেম্বারের বিজ্ঞাপন।
এরপর মন্ত্রীর নির্দেশে সাময়িক বরখাস্ত হন অনুপস্থিত উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা রেন্টু পুরকায়স্ত, যিনি পরে সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেছেন, তিনি দাপ্তরিক কাজেই বাইরে ছিলেন।
বুধবার সকাল দশটার দিকে সিলেটের জৈন্তাপুরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স পরিদর্শনে যান মন্ত্রী। সে সময় সেখানে ছিলেন না উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা রেন্টু।
মন্ত্রীর নির্দেশে তাকে তাৎক্ষণিক সাময়িক বরখাস্তের আদেশের পর কর্মস্থলে হাজির হন রেন্টু। অনুপস্থিতির ব্যাখ্যায় সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “আমি অফিসিয়াল কাজেই বাইরে ছিলাম। স্যার (স্বাস্থ্যমন্ত্রী) আসার খবরে আমি তড়িঘড়ি করে অফিসে ছুটে আসি।
“কিন্তু আমি আসার আগেই স্যার এসে পড়েছিলেন। তাই আমাকে অফিসে না পেয়ে এমন নির্দেশ দিয়েছেন। তবে স্যারের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে।’’
জৈন্তাপুর উপজেলা সদরের বাসিন্দা আব্দুল হান্নান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, এই হাসপাতালে ডাক্তার না থাকার বিষয়টি এক স্বাভাবিক ঘটনা।
তিনি বলেন, "এখানে নানা অনিয়ম হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। ডাক্তাররা ঠিকমতো চিকিৎসা সেবা দেন না। বেলা ১২টার পর গেলে চিকিৎসকদের পাওয়াই যায় না। রাতের বেলা কোনো দুর্ঘটনা হলেও ডাক্তারদের দেখাই মেলে না: এ নিয়ে কিছুদিন আগে ঝামেলা হয়েছিল। তারপর এলাকাবাসী ক্ষুব্ধ হয়ে হাসপাতাল ভাঙচুর করেন।”
গত ১৯ জানুয়ারি রাতের একটি ঘটনায় এই হাসপাতালটি জাতীয় পর্যায়েও আলোচনায় আসে।
জৈন্তাপুরে গাড়ি খাদে পড়ে চার ছাত্রলীগ কর্মীর মৃত্যুর পর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভাঙচুর চালায় তাদের অনুসারীরা।
পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে স্বাস্থ্য কর্মকর্তার সরকারি গাড়ি, ভাঙচুর করা হয়েছে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্স। চিকিৎসকদের বাসভবনের জানালার কাচও ভাঙা হয়েছে।
জৈন্তাপুর মডেল থানার ওসি তাজুল ইসলাম সে সময় সাংবাদিকদের বলেন, “দুর্ঘটনার পর তাদের উদ্ধার করে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হলে চিকিৎসকেরা পরীক্ষা করে তাদের মৃত হিসেবে পান। তবে তাদের ‘ডেথ ডিক্লেয়ার’ করার জন্য একটি ইসিজি করা হয়। ওই হাসপাতালের ইসিজি যন্ত্রটি তখন বিকল ছিল।
“তাদের অনুসারী-বন্ধুরা অ্যাম্বুলেন্স চাইলে হাসপাতাল থেকে তা দিতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। এসব নিয়ে ‘চিকিৎসা গাফিলতির অভিযোগ’ তুলে হাসপাতাল কমপ্লেক্সে ভাঙচুর চালান তারা।”
এই ঘটনায় তিনশ জনকে আসামি করে একটি মামলা হয়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী ঢাকায় এক প্রতিক্রিয়ায় চিকিৎসকদের নিরাপত্তায় জোর দিয়েছিলেন।
এবার তিনি নিজেই সেই হাসপাতালে গিয়ে নিজের চোখে দেখলেন অগ্রহণযোগ্য চিত্র। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চত্বরে সরকারি চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারের স্থান পরিবর্তন সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন দেখে বিস্ময় প্রকাশ করে কারণ ব্যাখ্যা করার নির্দেশও দিয়েছেন তিনি।
মন্ত্রী বলেন,"একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের ভেতরে দৃষ্টিগ্রাহ্য স্থানে চিকিৎসকদের স্থান পরিবর্তন সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন কীভাবে থাকতে পারে? প্রাইভেট ক্লিনিক ও চেম্বারের সঙ্গে এই সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কারো স্বার্থ না থাকলে এটি হতে পারত না।"
স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজেই হাত জীবাণুমুক্ত করতে হ্যান্ড স্যানিটাইজার চেয়েও পাননি। একে অসন্তোষ প্রকাশ করে তিনি বলেন,"একটি সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র চলছে, অথচ সেখানে কোনো হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করা হয় না। এটি কীভাবে হতে পারে?
“একটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এ সরকার কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে উপজেলার মানুষদের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য। কিন্তু স্বাস্থ্যসেবা যারা দেবেন তারা যদি দায়িত্বশীল না থাকেন তাহলে তো সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে না। সরকার যে জন্য বিনামূল্যে মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দিতে চাচ্ছে সেটিও পূরণ হবে না। আমি পরিষ্কার ভাষায় এখানে বলে যাচ্ছি, আমি শুধু বেসরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ত্রুটিই দেখব না। সরকারি হাসপাতালে এ ধরনের অব্যবস্থাপনা হলে সংশ্লিষ্ট কেউই মাফ পাবে না।"
এরপর হামলা ও ভাঙচুরে ক্ষতিগ্রস্ত কক্ষও পরিদর্শন করেন সামন্ত লাল সেন।
জৈন্তাপুর থেকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী যান বিশ্বনাথ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সেখানে তার যাওয়ার আগেই হাজির হন সব চিকিৎসক।
কর্মীদের উদ্দেশে মন্ত্রী বলেন, “চিকিৎসা সেবা দিতে সবাইকে আরও সতর্ক থাকতে। আমি কোনো মিডিয়ায় এই স্বাস্থ্যকেন্দ্র নিয়ে নেতিবাচক খবর দেখতে চাই না। স্বাস্থ্যকেন্দ্র মানুষের স্বাস্থ্যসেবার জন্য। কাজেই মানুষ যেন সঠিক সেবা পায়, রোগীরা যেন অসম্মানিত না হয় সেটি সবার আগে সবাইকেই খেয়াল করতে হবে।"
সামন্ত লাল সেন পরে সাংবাদিকদের বলেন, “গ্রামীণ এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পারলে শহরের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে রোগীরা ভিড় করবে না।
“মেডিকেল কলেজগুলোতে শুধু সেবা না, শিক্ষা নেওয়ার জায়গা। এখানে গবেষণা করতে হবে, আমাদের সেই পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে।’’
মন্ত্রী বলেন, ‘‘বিশ্বনাথ আমার জন্মভূমি; এখানে আমার বাবা ও মায়ের বাড়ি। অনেকদিন পর এখানে আসতে পেরে নিজেকে গর্বিত মনে করছি।’’
সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকদের অনুপস্থিতি বাংলাদেশে একটি মামুলি ঘটনা। উপজেলা ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে চাকরি নিয়েও নিয়মিত কাজে যোগ না দেওয়ায় চিকিৎসা প্রত্যাশীদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। তাদেরকে বেশি টাকা দিয়ে বেসরকারি হাসপাতালে বা প্রাইভেট চেম্বারে ছুটতে হয়।
এই বিষয়টির সমাধানে বহু বছর ধরে সরকার নানা আশ্বাস ও উদ্যোগের কথা বলে আসছে। হাসপাতালে বায়োমেট্রিক উপস্থিতির ব্যবস্থা করলেও অভিযোগ আছে সেগুলোর একাংশ ইচ্ছা করে বিকল করে ফেলা হয়েছে। প্রায়ই পত্রপত্রিকায় উঠে আসে, কদিন পরপর চিকিৎসকরা কর্মস্থলে গিয়ে উপস্থিতির সই দিয়ে চলে আসেন।
এই বিষয়টি নিয়ে আগের স্বাস্থ্যমন্ত্রীরা কথা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিকবার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। বলেছেন, কর্মস্থলে না গেলে চাকরি ছেড়ে দিতে। কিন্তু কোনো কিছুতেই কিছু হয়নি। কয়েক বছর আগে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে তিন বছর ধরে অনুপস্থিত এক চিকিৎসকের ব্যাংক হিসাবে নিয়মিত টাকা পাঠানোর খবর আসে গণমাধ্যমে।
দুটি উপজেলা সরকারি হাসপাতাল পরিদর্শন করে সিলেট শহরে ফিরে সার্কিট হাউসে বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য), সিভিল সার্জন এবং উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাগণের সঙ্গে মতবিনিময় করেন সামন্ত লাল সেন।
পরে তিনি দক্ষিণ সুরমায় বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গা পরিদর্শন করেন।
স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী, সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবিএম খুরশীদ আলম, চিকিৎসকদের সংগঠন বিএমএর মহাসচিব এহতেশামুল হক চৌধুরী, সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক রজতকান্তি গুপ্তও এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
আরো পড়ুন:
দুর্ঘটনায় ৪ ছাত্রলীগ কর্মীর মৃত্যু: জৈন্তাপুর হাসপাতালে তুলকালাম